পরামর্শ নিবি কি না বল!



যে কখনও সমুদ্র দেখেনি, দিঘি দেখেছে বড়োজোর, তাকে নদীর সামনে নিয়ে গেলে সে বলবে, এর চাইতে বড়ো জলাশয় পৃথিবীতে আর কোথাও নেই, থাকা সম্ভবও নয়। তাকে আপনি যা-ই বলুন না কেন, সে বার বারই বলবে, নদীর চাইতে বেশি জল আর কোথাও ধরে না। মজার বিষয়, যে সমুদ্র দেখতে শেখেইনি, তাকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে যাওয়াটা খুবই কঠিন! মানুষের সকল বড়োত্ব ও ছোটোত্বই আরোপিত, অনুমিত। সবাই যদি বিশ্বাস করে নেয়, লোহাই সবচাইতে মূল্যবান ধাতু, তবে কিন্তু সোনার দাম কমে যাবে, সবাই লোহার গহনা পরতে শুরু করে দেবে। আবার এমনও হতে পারে, নির্দিষ্ট কোনও অঞ্চলে সোনার চাইতে লোহার কদর বেশি। সে অঞ্চলের মানুষ লোহাকে সোনার চাইতে দামি বলতে চাইলে যেন অঞ্চলের সীমানাটা না পেরোয়!


এতে কোনও অসুবিধে নেই। সমুদ্র দেখেনি যে, যদি সে সারাজীবনই সমুদ্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বেঁচে থাকতে পারে, তবে নদীর এই মিথ্যে বড়োত্ব তার জীবনযাপনে ন্যূনতমও বাধার সৃষ্টি করবে না। গণ্ডগোলটা বাধে তখনই, যখন সমুদ্র দেখেছে যে লোকটি, তার সামনে গিয়ে সে নদীর গল্প করে করে পরামর্শ দেবে, ‘মেনে নাও, নদীর চাইতে বড়ো জলাশয় আর হয় না। তুমি যা জানো, তা ভুল জানো।’ তার বিশ্বাস এতটাই গভীর যে, সে কিছুতেই মেনে নেবে না, নদীর চাইতে বড়ো জলাশয় পৃথিবীতে আছে। সমুদ্র দেখেছে যে, তাকে নদীর দিকে টানা যেতেই পারে, তবে নদীই সবচাইতে বড়ো জলাশয়, এরকম কিছু বলে টানাটানিটা করা যায় না। আমরা যেন মেনে নিতে শিখি, আমরা যা জানি, তা-ই শেষ নয়।


অন্য কথায় আসি। আসল কথা হচ্ছে, পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। যে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়লে পরীক্ষায় পাশ করা যায়, তিনিই শ্রেষ্ঠ। তাঁর চাইতে বড়ো স্যার আর হয় না। তাঁর হ্যান্ডনোটের চাইতে ভালো নোট হওয়া অসম্ভব। তাঁর ব্যাচে পড়ে না যারা, তাদের সবার জীবনই বৃথা। পড়াশোনা করে কী লাভ যদি এমন একজন স্যারের ব্যাচে প্রাইভেট পড়া না যায়? স্যারের প্রাইভেটে সবাইকেই ঘাড়ে ধরে নিয়ে আসতে হবে। এটাই কর্তব্য! আসতে চাইবে না যারা, তারা অপদার্থ - নির্বোধ - অবোধ।


এবার আসা যাক সেই দু-একজনের কাছে, যারা পরীক্ষা দিতে বসলেই পাশ করে। মানে পাশ করাটা ওদের কাছে মূল বিষয় নয়। কী করে পরীক্ষায় পাশ করতে হয়, তা ওরা জানে। ওদের দরকার পরীক্ষায় প্রথম হওয়া। যে স্যারের ব্যাচে পড়লে পরীক্ষায় কেবলই পাশ করা যায়, যে স্যারের হ্যান্ডনোট পড়লে পরীক্ষার খাতায় কেবলই পাশনম্বর আসে, সে স্যারের কাছে পড়ে ওদের কী লাভ হবে? ওইটুকু তো ওরা এমনিতেই পারে, স্যারের কাছে যেতে হয় না। যার পাশ করতেই ঘাম বেরিয়ে যায়, সে মরে গেলেও ওদের মাইন্ডসেটটা ধরতে পারবে না।


ওরা এ-ও জানে, অমন স্যারের কাছে গেলে ওরা সে ব্যাচে সেরা শিক্ষার্থী হতে পারবে, সবাই ওদের খুব মান্য করবে। তবে সেখান থেকে এমন কিছু শেখার নেই, যা ওরা জানে না কিংবা যা ওদের দরকার। ওরা সেখানে পড়তে যাবে বলে আপনার মনে হয়? কেন যাবে, বলুন তো? পাশ করতে? পাশ তো ওরা ওখানে না গেলেও করতে পারবে। পরীক্ষায় যে পাশই করতে পারেনি কখনও, তার কাছে পাশ করতে পারাটা বিশেষ কিছু হতে পারে, কিন্তু ওদের কাছে কেবলই পাশ করার কোনও মূল্যই নেই। এমনও তো হতে পারে, ওরা কেবলই পাশ করতে চায় না, নিজের জানবার ও বুঝবার ভিত্তিটাও শক্ত করতে চায়। পরের ক্লাশে উঠতেই যার কষ্ট হয়, তার সাথে ওদের চিন্তাভাবনা মিলবে না।


যা-কিছু আমাদের জানার পরিধিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না, তা-কিছু জানতে চাওয়ার পেছনে সময় নষ্ট করাটা নিছকই নির্বুদ্ধিতা। যা শেখা সহজ, তা শেখাটা জরুরি না-ও হতে পারে। না বোঝা সহজ, তা বোঝাটা দরকারি না-ও হতে পারে। পরীক্ষায় প্রথম হতে চায় যে শিক্ষার্থী, সে কী চায়, তা সম্পর্কে অনুমানটুকুও সে শিক্ষার্থী করতে পারবে না, পরীক্ষায় পাশ করতেই যার কষ্ট হয়। যে নোট পড়ে একজন ভালো ছাত্র বা ছাত্রী তৃপ্ত হয়, সে নোটে হয়তো মাঝারি কিংবা খারাপ মানের ছাত্র বা ছাত্রী দাঁত বসাতেই পারবে না। এটাই স্বাভাবিক। যে বইটা না পড়লে জীবন বৃথা বলে আমি বিশ্বাস করি, সে বই না পড়েই কিন্তু জো বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তা-ও আমি বলতেই পারি, বাইডেনের জীবন বৃথাই! আমার এমন সফল একটা জীবন নিয়ে মাঠে-ঘাটে হাসবার চাইতে বরং ওরকম ব্যর্থ একটা জীবন নিয়ে হোয়াইট হাউসে বসে কান্নাকাটি করাও ভালো। সবচাইতে বড়ো কথা, অমুকের জীবন ব্যর্থ, তমুকের জীবন অন্ধকার এসব মনগড়া রায় গলায় ঝুলিয়ে হাঁটে যারা, ওদের দিকে ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখবেন, ওদের জীবনে স্বীকৃতি পাবার মতো তেমন কোনও অর্জনই নেই।


আবেগের বশে হুট করে রায় দিয়ে দেবার বদভ্যাস থেকে সময় থাকতে সরে আসাটা খুব প্রয়োজন। যা আমাদের ভালো লাগে, তা নিয়ে আমরা অন্যদের বড়োজোর জানাতে পারি, তবে জানানোর সেই ধরনে যেন এমন কোনও ইঙ্গিত না থাকে যা দেখলে মনে হয়, আমরা কাউকে হেয় করছি কিংবা গায়ের জোরে আমাদের ভালোলাগার শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করছি। এ পৃথিবীতে কোনও কিছুই অপরিহার্য নয়। পৃথিবীতে অবশ্যপাঠ্য কোনও বই নেই, অবশ্যকর্তব্য কোনও কাজ নেই, অবশ্যপালনীয় কোনও আচার-রীতি নেই। একেক মানুষের একেক মত, একেক পথ। যা-কিছু আমার ভালো লাগে, তা-কিছুকে কেউ যখন গায়ে পড়ে বাতিল করতে আসে, এবং তার ভালোলাগার কিছু নিয়ে নির্লজ্জভাবে বিজ্ঞাপন করে বিভিন্ন উগ্র ও কটু মতামত চাপিয়ে দিয়ে, তখন তাকে আমার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মনে হয়।


আমি যা বুঝি না, আমি যা চাই না বুঝতে, তা বাজে ও অকেজো বলে বাতিল করে দেওয়া যায় কি? আমি যা বুঝি, তা বুঝতে চায় না, এমন অনেকেই তো আছে। আমি যা হৃদয়ে ধারণ করে আনন্দ পেয়েছি, তা হৃদয়ে ধারণ করতে চায় না, এমন অনেকেই তো আছে। যা আমার বোধেরও অতীত, তা আয়ত্ত করে বসে আছে বহুআগেই, যখন আমি বুঝতেও শিখিনি, এমন অনেকেই তো আছে। জীবনের ও বিশ্বাসের যাপনে বৈচিত্র্য থাকবেই। কাউকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখছে যা, তা কিছুতেই মিথ্যা হতে পারে না। এসব সহজ সত্য বুঝতে হয়। না বুঝলে নির্বোধ হয়ে থাকতে হয়। তখন লোকে আমার বিশ্বাসের ভ্রান্তি নিয়ে বিনোদিত হবে, আর আমি ক্রমেই হয়ে উঠব হাস্যাস্পদ। যাদের মনের অবস্থান অনেক উঁচুতে, তারা আমার এমন আস্ফালন দেখে আমার বোধের দৌড় নিয়ে করুণাবোধ করবে। নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলি। আমার এক কলিগ জ্বর কমাতে নাপা ট্যাবলেট খান না শুনে তাঁকে আমার নির্বোধ মনে হয়েছিল। পরে জানতে পারি, জ্বর কমাতে তিনি আমেরিকায় তৈরি একটা ট্যাবলেট খান যা নাপার চাইতে হাজার গুণে উন্নত।


উৎকৃষ্ট কিছু গ্রহণ করতে চাইলে নিজেকে আগে সেই উৎকৃষ্ট কিছু গ্রহণের জন্য তৈরি করতে হয়। তৈরি নয় যে, সে কখনও বুঝতেই পারবে না কোনটা উৎকৃষ্ট আর কোনটা মাঝারি বা নিকৃষ্ট। ছাগলের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই কাঁঠালপাতা। আমাদের বোধশক্তির অনেক উপরে যা-কিছু, সেগুলিকে বাতিল করে দেওয়ার নামই মূর্খতা। কেউ যদি তার মূর্খতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে কিংবা নীরব থাকে, তবে সেটি মেনে নেওয়া যায়। মূর্খতা বরাবরই ব্যক্তিগত। তবে নিজের মূর্খতার পক্ষে সাফাই গাইতে সে যদি লোকজনের উপর চড়াও হয়, তবে সেটি বেশ দৃষ্টিকটু। ধরে নিলাম, সে যা অর্জন করেছে, তা মূর্খতা নয়, জ্ঞান। তাই বলে কি সেই জ্ঞান সবাইকে বিরক্ত করে হলেও বিলোতে হবে? আমার কাছে যা জ্ঞান, অন্য কারও কাছে সেটি তো গণ্যেরও অযোগ্য হতে পারে, তাই না? নিজের মায়ের রান্নার স্বাদটা সবার কাছেই সেরা। তবে তা নিয়ে বলবার কিছু কায়দা আছে। বাকি সব মায়ের রান্না অখাদ্য, কুখাদ্য বলে বেড়ানোটা সঠিক কায়দা নয় বলেই আমার অনুমান। আপনারাই বলুন, নিজের খোঁড়া ছেলেটিকেও দৌড় প্রতিযোগিতায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার যোগ্য ভাবেন না কোন মা-টি?


আমার সমস্ত ভাবনা ও বোধের শেষ যেখানে, সেখান থেকেই হয়তো কারও যাত্রাটা শুরুটা হয়েছিল বহুদিন আগে, যখন আমি ভাবতেও শিখিনি। অহংকার মানায় না যাকে, তাকেও বড়ো বড়ো কথা বলতে দেখলে হাসি পায়। হাসিটা অবশ্য সবার পায় না, অনেকেই তাকে গুরু মেনে পায়ের কাছে টুক করে বসেও পড়তে পারে। কার পায়ের কাছে কে বসে পড়ে, তা দেখে গুরু ও শিষ্য উভয়ের দৌড়টা ধরে ফেলা যায়। মাত্রই স্বরে অ, স্বরে আ শিখল যে, তার কাছে গাইডবইয়ের গরু রচনাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য! হোক ওরকম, অসুবিধে নেই। কিন্তু সেই ‘মহান সাহিত্য’কে মাথায় তুলে ভাবাবেগে অন্ধ হয়ে প্রলয়নাচন আরম্ভ করলে তখন তা দেখতে খুবই বিরক্ত লাগে। আমরা যেন মাথায় রাখি, আমাদের মতামত নিয়ে আমরা যত বেপরোয়া হব, সবার চোখে ততোধিক নিন্দার্হ হয়ে উঠব।


ফিরে আসি আগের উপমায়। আমি কোন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ব, সেটি ঠিক করব আমি নিজেই। ওতে যদি আমি ফেইলও করি, সেই ফেইলটা তো আমি করব, তাতে কার কী এসে যায়? আমার নরকযাত্রার আয়োজন আপনার স্বর্গপ্রাপ্তির সম্ভাবনাকে কণামাত্রও কমিয়ে দিচ্ছে কি? আমাকে ধরে বেঁধে স্বর্গে নিলে কি আপনি কমিশন পাবেন? দু-লাইন লিখতে জানে না যে, সে-ও দেখি লিখতে শেখায়! দু-কদম হাঁটতে জানে না, সে-ও দেখি হাঁটতে শেখায়! দু-ধাপ ভাবতে জানে না, সে-ও দেখি ভাবতে শেখায়! অন্ধকে দেখি হাত বাড়িয়ে দেয় আমাকে ধরে রাস্তা পার করানোর জন্য! ওরকম করলে হয়?


হ্যাঁ, যদি আমি স্যারের খোঁজে কারুর দ্বারস্থ হই, তবে সেটি ভিন্ন কথা। গায়ে-পড়া লোকজন বরাবরই দৃষ্টিকটু। ওদের সবাই-ই সন্দেহের চোখে দেখে। ‘আসুন আমাদের গাড়ির নিকট, দেখুন আমাদের মলমখানা!’ বলে বলে কানের কাছে এসে চেঁচায় যারা, ওদের গায়ের চুলকানিটা চোখে পড়বে যাদের, তারা কি কেউ কিনবে সেই মলম? অবশ্য চুলকাতে ভালো লাগে যাদের, তাদের কাছে সে মলমটি আদর পাবে!


আমরা ছোটোবেলায়, ভালো স্টুডেন্টরা যেখানে প্রাইভেট পড়ে, সেখানেই পড়তে যেতাম। মাঝারি ও খারাপ স্টুডেন্টদের দেখে কোথাও পড়তে যেতাম না। ক্লাশের ফার্স্টবয় কোথায় পড়ে, সে খোঁজ নিতাম। ফার্স্ট হতে না পারি, ফার্স্টের কাছাকাছি যেতে তো পারব! গাধার বন্ধু গাধাই হয়! যে লোকটা জীবনে কিছু করতে পারেনি, তার কাছ থেকে একটাই জিনিস শেখার আছে---জীবনে যা যা করা যাবে না! বড়োবেলাতে এসেও সেইসব অভ্যেস রয়ে গেছে। ভালো স্টুডেন্ট হওয়া কাকে বলে, ভালো স্টুডেন্টরা কী করে আর কী করে না, ভালো স্টুডেন্টদের প্রায়োরিটি কী কী নিয়ে . . . ওসব জানা তো দূরস্থ, অনুমান পর্যন্তও মাঝারি ও খারাপ মানের স্টুডেন্টরা করতে পারে না। একজন বাজে ছাত্র যে অর্জন নিয়ে গর্ব করে, একজন ভালো ছাত্র হয়তোবা সেটিকে অর্জন বলেই গণ্য করে না। একটি সহজ বুদ্ধি মাথায় রাখলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচানো যায়। বুদ্ধিটি হলো, পরামর্শের প্রয়োজন হলে যে লোকটি আমার কাছে কখনও আসতেন না, কেননা তাঁকে পরামর্শ দেবার যোগ্যতাই আমার নেই কিংবা তিনি আমাকে পরামর্শ নেবার যোগ্যই মনে করেন না, তাঁর কাছে গিয়ে গায়ে পড়ে পরামর্শ আমি কিছুতেই দেবো না।