বন্দি হবার পরও, বেঁচে থাকতে চাই বলেই প্রতিদিনই কিছু বিষাদ ছুঁয়ে থাকি। কখনও যদি ভুল করেও ভুলে যাই আমি কে কিংবা কেন, কতটা সরে আছি সবকটা হাতের নাগাল থেকে, ঠিক তখনই চোখের সামনে বিশ্বস্ত খড়কুটোর মতো বিষাদ ভেসে আসে।
দিনের সশব্দ অন্ধকারে চোখদুটো যখন ঝলসে ওঠে, রাতের নিঃশব্দ আলোয় এই মনটা যখন নিভতে বসে, ঠিক তখনই একটুখানি ওম হয়ে বিষাদ ফোটে। ক্ষতগুলির বিস্বাদ ঘুমটি ভাঙে একে একে, অমন আছড়ে পড়তে পড়তেই তো প্রাণটা বাঁচে!
এই নিরুদ্বেগ বিষাদটুকু সঙ্গ না দিলে আমিও হয়তো তোমাদেরই মতন নির্জনতাকে স্থায়ী একাকিত্ব ভেবে ভুল করে বসতাম! জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যকার দূরত্বটি ঘুচিয়ে দিতে ঠিক এরকম দুইএকটি ভুলই তো যথেষ্ট!
একেকটি শব্দহীন প্রহর এসে বিষাদ ছুঁতে বাধ্য করে। ছুঁতে জানে না যারা, ওদের সমস্ত দুঃখের গর্ভ ভেদ করে জেগে ওঠে নাগরিক পারিপাট্য, নরকের কয়েক টুকরো মোহ, কিংবা সেইসব বোবাদের রাতভোর কোরাস, যারা শব্দ ভালোবাসে।
যত বারই ভেবেছি, এই জীবনে বোধ হয় আর কিছুই করবার নেই পুরনো প্রেমের স্মৃতিস্তম্ভে দুএকটি ফোঁটা অশ্রুপাত বাদে, ঠিক তত তত বার বিষাদ এসে শিখিয়ে গেছে, সত্যি সত্যি সুখী হবার চাইতে বড়ো স্থবিরতা আর হয় না! স্বস্তিটুকুও পেয়ে ফেলে যে, জীবনে তার কিছুই হয় না পাওয়া!
নৈরাশ্যের অনন্ত অনুপুঙ্খ রাস্তা ধরে আলগোছে হেঁটে গিয়েছি রক্তের প্রতিটি বুদ্বুদের নিরন্তর অট্টহাসিতে মূঢ় ও বধির হয়ে, সেই সৈকত ধরে হাঁটতে হাঁটতেই জেনেছি দহনে, কখনওবা প্রেমে, জীবনের মানে কেবলই নিরুদ্ধার বেদনার ভার বয়ে চলা।
এই কলম ছুঁতে বিষাদ লাগে, তোমায় ছুঁতে বিষাদ লাগে, প্রিয় বন্ধুকে ছুঁতেও…সেই বিষাদই লাগে। বিষাদের নির্ভার বৃষ্টিতেই ভিজে যায় দিনযাপনের সমস্ত গ্লানি কিংবা জীবনবেদের চিত্রনাট্য এবং তার প্রতিটি পাতা।
সমস্ত গ্লানি বিস্মৃত হয়ে বেঁচে থাকে যারা, ওদের ছায়াগুলি ক্রমশ বড়ো হয়। জারিত যৌনতা আর ঘোলাটে প্রেম, এই দুই মিলেমিশে একাকার হয়ে সমস্বরে আহ্বান জানায় আগুনফোটা বিষাদ কিংবা জন্মান্ধের সূর্যোদয়কে।
অন্ধরা যেমনি করে সিঁড়ি পেরোয়---অন্ধকারেই, গত জন্মের উন্মথিত তৃষ্ণা যেভাবে জেগে থাকে নিভৃত আরোহে আর অবরোহে, সেইসব হিসেবকেও কিছু প্রচ্ছন্ন আত্মপ্রসঙ্গের বাক্দেয়ালের ওদিকটায় ঠেলে দেয় মুঠোয় মুঠোয় বিষাদ।
যে শরীর কখনও ছোঁয়নি শরীর, যে আঙুলে কখনও হয়নি সমর্পণ, যে তর্জনী কখনও ভাঙেনি মানত, যে সত্যি কখনও দাঁড়ায়নি নুয়ে, ---ওদেরই ঘনকৃষ্ণ ছায়ায় বেহালার ছড়ের মতো কাঁপতে থাকে বিষাদ।
উল্লেখ করবার মতো ওদের আর কিছুই যে নেই, কেবল এটুকুই আছে।