বেকারপ্রায়, বেকার, কাঠবেকার

এক। ফেইসবুকের দু-চারটে অসাধারণ ভালো দিক আছে। আপনি মাঝে মাঝে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নারী সেলেব্রিটিদের পেইজে যাবেন, এই ধরুন, বিভিন্ন দেশের নায়িকা বা মডেল যারা আছে, তাদের পেইজে। তাদের ছবির কমেন্ট সেকশনে গেলেই দেখতে পাবেন আপনার ফ্রেন্ডলিস্টের কিছু পুরুষ কী পরিমাণ ভণ্ড পিরবাবা সেজে বসে আছে ওখানে, অবশ্য নারীরাও আছে, তবে সংখ্যায় কম। পুরুষেরা সেখানে এমন সব গালিগালাজ করে, অথবা ফালতু মন্তব্য করে, যেগুলো তাদের ব্যক্তিত্বের সাথে যায়-ই না। এই চিড়িয়াসম্প্রদায়ের পুরুষেরা এটাও জানে যে যেই নায়িকা বা সেলিব্রিটিকে সে ওরকম কমেন্ট করছে, সেই মানুষটা তার ওই কমেন্ট পড়েও দেখবে না, আর ওই কমেন্টটা তাদেরই চোখে পড়বে, যারা তার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। মনের কিংবা শরীরের ঝাল মেটানোর জন্য পুরুষমানুষ যে কত কিছুই যে করে! আবার এই একই মানুষটিকে একটু যাচাই করে দেখুন, সে ফেইসবুকে যে পিরমার্কা ভাবটা নেয়, আদতে সে মোটেও ওরকম নয়। ওদের চেহারা একটা নয়, কমপক্ষে দুটো। ওদের দেখলে মনে হয়, ওরা কী যে চায়, তা ওরা নিজেরাই জানে না। এমন ভণ্ডদের দেখলেই ঘেন্না লাগে।


দুই। পুরুষে পুরুষে বিবাদ হয়, নারীতে নারীতে মহাবিবাদ হয়, আর নারীতে পুরুষে হয় সমঝোতা।


তিন। আমাদের দেশে যারা রাজনীতি করে কিংবা ব্যবসা করে, তাদের দেখলেই বলা হয়, ওরা বেকার, কিছু করে না, সারাদিনই ঘোরাঘুরি করে। অথচ দেখুন, দেশ চালায়ই ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদরা। দেশের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে অত বড়ো প্ল্যাটফর্ম তো আর নেই। তবে আজকাল রাজনীতির নামে অনেকেই যা করে, তদের দেখে তারা কি বেকার, আকার, না কি উকার, কিছুই বোঝা যায় না। আর আমাদের সমাজে এখনও একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক, যার বিয়ে করার বয়স হয়েছে, অথচ সে কিছুই করে না, তাদেরকে ‘ব্যবসায়ী’ পরিচয়ে বাবা-মা বিয়ে করান। পরে দেখা যায়, ব্যবসাটা তার না, অন্য কারুর। এসব মিথ্যে যুগে যুগে চলে আসছে বলেই মানুষ ধরেই নেয় ‘ব্যবসা করে’ মানেই ছেলে বেকার। অন্য দিকে, রাজনৈতিক পরিচয়ে অনেকেই কী কী জঘন্য কাজ করে, সেটা তো সবাই চোখের সামনেই দেখতে পায়। তাই ওই শ্রেণিটাকেও আমাদের সমাজের মানুষ এখনও ততটা গ্রহণযোগ্য হিসেবে নেয়নি।


চার। একজন বেকার পুরুষ চিনবেন কীভাবে? তিন ধরনের পুরুষের উদাহরণ দেবো:


১। কাজ করে না যে, তাকে আসলে বেকার বলে না; বরং যে কোনও কাজের চেষ্টা করে না, সে-ই বেকার। আরও আছে। কাজ তো সে করেই না, তবে এ-বাড়ি ও-বাড়ি সব বাড়ির যে-কোনও কাজে তাকে আপনি যে-কোনও সময়ই পাবেন, ওই সময়টুকু সে ভালো কাজে লাগালে হয়তো কখনওই বেকার থাকত না। আর বেকারদের আরও একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে---উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট। তাদের বেশিরভাগের পোশাকআশাক আর পারফিউমের কালেকশন কিংবা ভাব দেখলে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে সে একটা বেকার। পৃথিবীর প্রায় সফল মানুষই বেশ সাদামাটা স্টাইলে চলাফেরা করেন। একজন বেকার পুরুষেরই এতসবের জন্য সময় থাকে। কোনও একটা কাজ করে আর ব্যস্ত, এমন ধরনের পুরুষের একে তো সময়ই থাকে না অত রংঢং করার, তার উপর ছেলেদের বেশিরভাগই পোশাকআশাকের বেলায় মোটামুটি কেয়ারলেসই থাকে। তাদের অনেকেই, আজকে কী পরবে, সে চিন্তা তো পরের কথা, মাত্র দুই দিন আগে কোন শার্টটা পরেছিল, তা জিজ্ঞেস করলে সেটাও মনে করতে পারে না।


এটা মেয়েদের বেলাতেও সত্যি, যে মেয়ে দেখবেন অনেক বেশি ফ্যাশন করে, ফ্যাশনের ঠ্যালায় শাড়িকে ‘শাড়িইই’ বলে, অন্তত দুই ঘণ্টা ব্যয় করে গয়না আর সাজগোজের পেছনে, আপনি মোটামুটি নিশ্চিত থাকতে পারেন, সেই মেয়ে একটা বেকার মেয়ে, মানে সে কোনও কাজেরই না। তার জন্মই হয়েছে সাজগোজ করার পেছনে সবটুকু সময় খরচ করার জন্য, কিছু ছেলের মাথাটা খারাপ করে দেবার জন্য। মেয়েরা একটু রূপ- আর পোশাকসচেতন থাকবে, এটাই নিয়ম, ঠিক আছে। কিন্তু যে শুধু ওই একটা বেলাতেই সচেতন, সেই মেয়ে নিঃসন্দেহে বেকার। সে বাবা-মাকে কোনও কাজে হেল্প তো করেই না, উলটা বয়ফ্রেন্ডের টিউশনির টাকা দিয়ে জামাকাপড়, মেকাপসামগ্রী কেনে, আর বান্ধবীদের কাছে শোঅফ করে। বিশ্বাস না হলে আশেপাশে তাকান, এমন বেহায়া মেয়ের অভাব নাই।


২। আরেক গোত্রের ছেলে/মেয়ে আছে, যারা বিয়ের সিভিতে মিথ্যা কথা লিখে। আপনি এটা জেনে থাকবেন, বিয়ের সিভি মানেই আমাদের দেশে মিথ্যা কথার সাজানো ডালা! যত সব আজগুবি তথ্য দেয় সিভিতে, যেন ওসব লিখলেই বিয়েটা হয়ে যাবে! এখনও, শতকরা সত্তর- থেকে আশিভাগ মানুষ সিভিতে ভুয়া জিনিস লিখে, বাড়তি ফালতু বিরক্তিকর তথ্য দেয়, মানে এমন কিছু ব্যাপার যোগ করে, যেগুলোর একটাও সত্য না, দরকারি না। বিয়ের ক্ষেত্রেও, চাকরির ক্ষেত্রেও। সিভিতে লিখে, মেয়ের/ছেলের চাচাত ভাইয়ের শ্বশুরের বাল্যকালের বন্ধুর এলাকার এক ছোটো ভাইয়ের স্ত্রীর মরহুম মামার পালকপুত্রের শ্যালিকার বিবাহপূর্ব তৃতীয় বয়ফ্রেন্ডের বন্ধুর এক দূরসম্পর্কের ভাতিজার খুবই কাছের বন্ধুর খালাত ভাইয়ের শ্যালকের শ্যালক গত বার ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় ভাইভা-বোর্ড পর্যন্ত যেতে পেরেছিল…


কী যে অদ্ভুত একটা দেশে বাস করি, যেখানে এক একজন নিজের উচ্চতা পর্যন্ত বাড়িয়ে লিখে দেয়! দেখা হবার প্রথমেই যে জিনিস চোখে পড়বে, সে জিনিসটা হচ্ছে হাইট। ভাই, ওইটা ভুল লিখলে কি একজন মানুষ নিশ্চিতভাবেই ধরা খাবে না? মেয়েপক্ষ কি ধরতে পারবে না যে সে ছেলে একটা মিথ্যুক? গাধারা, ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি হলে, সেটাকে ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি বানাক, সেটা না করে লিখবে ৫ ফুট পৌনে ১২! আমাদের হিপোক্রিসিতেও কোনও ক্রিয়েটিভিটি নেই, সারাজীবন আমরা একই ভুল করে যেতেই পছন্দ করি। আমাদের এক বন্ধু চাকরির সিভিতে আরেক বন্ধুর সিভি থেকে কপি-পেস্ট করে সাবমিট করেছিল, সেটা কোনও ব্যাপারই নয়। কাহিনি হলো, সিভিতে সে কেবল অ্যাপ্লিকেন্টের নামটা বাদে আর কিছুই চেইঞ্জ করেনি, পিতার নাম, মাতার নাম, ঠিকানা একটাও তার নিজের না! তার বাবার জীবিতাবস্থাতেই সিভিতে বাবার নামের আগে সিভিতে লেখা ছিল ‘লেইট’ (মরহুম)! আরেকটা কথা! মেয়েরা যে জিনিসটা সিভিতে আর বাস্তবজীবনে অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই প্রয়োগ করে, সেটা হচ্ছে…বয়স কমানো! বয়স কমানোর আর্টটা বোধহয় মেয়েরা মায়ের পেটে থাকতেই মায়ের মুখে শুনতে শুনতেই শিখে আসে!


তো যা বলছিলাম! দেখবেন, কিছু ছেলে আছে, যারা বিয়ের সিভিতে বাবা, বড়ো ভাই, চাচা, বোনের জামাইসহ নিজের ও পরের চৌদ্দগুষ্টির ডিটেইলস সুন্দর করে লিখে দেয়, অথচ নিজের স্কুল, কলেজ, ইউনিভারসিটির নাম ছাড়া তার নিজের সম্পর্কে কিছুই লেখে না। লিখবেই-বা কী! তার লেখার মতো আছেই-বা কী! সে ছেলে যে একটা কাঠবেকার, সেটা কি আবার বলে দিতে হয়? সেদিন একজনকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, সে অমুক এমপি’র পিএস-এর বন্ধু! শুনে হাসলাম অনেকক্ষণ! সে জিজ্ঞেস করল, ভাই, হাসেন কেন? আমি বললাম, ভাই রে, খুশিতে, আনন্দে, ঠ্যালায়…


৩। আরেক টাইপের ছেলে আছে, যারা বলে, ‘দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছি, যে-কোনও দিন চলে যাব!’ আসলে এরা দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টাটা মুখে মুখেই করছে, ছয় মাস আগেও ওরা বলত, ‘এই তো, সামনের মাসেই যাচ্ছি!’ এক বছর পরেও বলবে…যাচ্ছিই…ই…ই…! দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য পড়াশোনা কিংবা অন্য কোনও চেষ্টাই সে করে না, অথচ এটাই বলে বেড়ায়। এদিকে দেশে সে যে পড়াশোনাটা করত, সেটাও লাটে ওঠায়, পারলে ছেড়েই দেয়। হায় রে, কল্পনা আর ভণ্ডামি করেই যদি জীবনটা চলত! অবশ্য অনেকেই চালাচ্ছেনও! যে-দেশে ‘ছেলে বিদেশে থাকে!’ এটাও একটা যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়, সে-দেশে এরকমই তো হওয়ার কথা! আপনার আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিত লোকজনের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কারা বিদেশে যায়, কারা ওই প্রবাসী হবার ভাবটা নেয়! বেশিরভাগই প্রবাসী ছেলেই ১০০ টাকার সেই লুঙ্গিটার মতো, যেই লুঙ্গিতে ৫০০ টাকাকে গিঁট-মারা হয়েছে, অথচ লুঙ্গির দামটা ১০০ টাকাই রয়ে গেছে, যদিও সেই লুঙ্গির হাবভাব আর লাফঝাঁপ ৬০০ টাকার!