বিষের পেয়ালার হার

বিষের পেয়ালা হাতে নিয়ে প্রথমেই যে ব্যাপারটা মাথায় কাজ করছিল, সেটা হল, এটা খেয়ে ফেললে সত্যি-সত্যিই যদি মরে যাই? আচ্ছা, মরে যাওয়ার সময় কি খুব ব্যথা লাগে? এই যে বেঁচে আছি, এর যে কষ্ট, মরে যাওয়ার কষ্ট কি এর চাইতেও বেশি? আচ্ছা, মরেটরে যেতে কেমন লাগে? এভাবে মরে যাওয়ার সময় কি চারপাশটা অন্ধকার যায়? বেঁচে আছি অন্ধকারে, ওতেই মরব?

আমার মৃত্যুর পরের দৃশ্যটা কী হতে পারে, সেটা কল্পনাতে আনার চেষ্টা করলাম। মা বিলাপ করে করে কাঁদতে-কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাবে। বাবা কোর্ট ফেলে ছুটে আসবে। বাবাও অনেক কাঁদবে। মা-বাবা কাঁদলে শরীর ভেঙে পড়ে, ভীষণ অসুস্থ হয়ে যায়। আমার ছোটভাই কিছুক্ষণ ভাববে কী করা উচিত, এরপর সেও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করবে। আশেপাশে যারা থাকবে, ওরা কষ্টে না হলেও ওদের তিন জনকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করবে। কান্না মাত্রই সংক্রামক। সামনে বসে কেউ কাঁদলে তার সাথে জয়েন করাটা একটা সাধারণ ভদ্রতা।

এসব ভেবেটেবে ভাবলাম, যে জীবনটা আমার মায়ের দেয়া, সেটাকে আমার নিজের হাতে হত্যা করার কী অধিকার আমার আছে? নিজের জীবনের উপরে কারওই একচ্ছত্র দাবি থাকে না। এসব ভেবে আমার কেমন জানি খুব গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল, মন হাল্কা করা কান্না। কিন্তু প্রচণ্ড কান্না পাওয়া সত্ত্বেও কাঁদতে পারছিলাম না। সমস্ত কান্নাই যেন বুকের ভেতরে গুমরে মরছিল। চাপাকান্না। কী কষ্ট! কী কষ্ট! . . . . . .

পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তের কষ্টটা কেমন, এটা নিয়ে কিছু লেখা পড়েছিলাম। সবগুলো যে কষ্টেরই, এমন নয়। আমার চোখে পৃথিবীর সর্বকালের সবচাইতে সেন্স অব হিউমারসমৃদ্ধ লেখক অস্কার ওয়াইল্ডেরটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। ওটা বিষাদের ছিল না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, My wallpaper and I are fighting a duel to the death. One or the other of us has to go. এই কথাটি ওয়াইল্ড মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে বলেননি, বলেছিলেন মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে; যদিও অনেকেই মনে করেন, মৃত্যুর ঠিক আগেই উনি ওটা বলেছিলেন। সুইসাইড করার নিয়ম হল, এত চিন্তাভাবনা করা যাবে না, জাস্ট করে ফেলতে হবে। মরে যাওয়া মানেই তো সবকিছু নেই হয়ে যাওয়া। মৃত মানুষের ভাল লাগা খারাপ লাগা বলে তো আর কিছু নেই। কে কাঁদল, কে হাসল, এ নিয়ে ভাববার কী আছে? তবুও ভাবনা হয়ই! বেঁচে থাকার অভ্যেস যার, মরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে সে একটু ভাবতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই।

শশ্যাঙ্ক রিডেম্পশন মুভির একটা কথা আমার খুব প্রিয়: Get busy living, or get busy dying. বিষের পেয়ালা হাতে হঠাৎ করেই এই ভাবনাটা মাথায় এল: আর দশজন উজ্জ্বল মানুষের মত না হোক, অন্তত একজন অনুজ্জ্বল মানুষ হয়ে হলেও একবার বেঁচে থেকে দেখিই না কী হয়! শীর্ষেন্দুর সাঁতারু ও জলকন্যা’র জলকন্যাটির কথা মনে পড়ছিল। এখন বুঝি, স্রেফ বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়। আচ্ছা, বেঁচে থাকলে কী হয়? বেঁচে থাকলে আর কিছু হোক না হোক, কষ্ট অন্তত পাওয়া যায়। মরে গেলে তো কিছুই পাওয়া যায় না। জীবনে কিছু না পাওয়ার চেয়ে কষ্ট পাওয়াও ভাল। কষ্ট পেতে হয়, ওটা সহ্য করতে হয়, কষ্টকে শক্তিতে পরিণত করতে জানতে হয়। লোকে নাকি দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ায়। আমার পিঠ তো দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল! ওই সময়ের কষ্ট যন্ত্রণা বিষাদ হতাশা বিষণ্নতা কখনওই ভোলার নয়। বেঁচে ছিলাম বলেই তো এত-এত বোনাস পেলাম! তাই, যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, জীবনে সবচাইতে আনন্দের কী? সফল হওয়া? অনেক টাকাপয়সার মালিক হওয়া? বড় হওয়া? তখন আমি বলি, বেঁচে থাকাটাই জীবনে সবচাইতে আনন্দের। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, কখনও-কখনও স্রেফ বেঁচে থাকাটাও কী ভীষণ কঠিন। সে কাজটি দিনের পর দিন করে-করে মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেয়াটা কত বড় সাফল্য!

সন্দীপনের একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম,

“আমাদের এই অন্ধকার দিনগুলিতে গান হবে কি?

হ্যাঁ, আমাদের এই অন্ধকার দিনগুলি নিয়ে একদিন গান হবে।”

আমি সেই দিনটার প্রতীক্ষাতে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জানতাম, সে গান লেখা বড় কঠিন, তবুও . . . . . . .