বিষাদের শরীর

 মাঝে মাঝে আমার মন খারাপ হয়। কেন হয়? জানি না। শুধু জানি, কোত্থেকে জানি একটুকরো মেঘ এসে আমাকে ছেয়ে ফেলে। কখনও বৃষ্টি হয়, কখনও তা-ও হয় না। কাঁদলে মন একটু ভালো হয়। কাঁদতে না পারলে মন আরও খারাপ হয়। এই মন খারাপটা চলে যায় না, থেকে যায়।
  
 যাদের আমরা ভালোবাসি, ওরা ক্রমেই আমাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অস্তিত্বের একটি প্রিয় অংশ হয়ে ওঠে। ওদের কখনও হারিয়ে ফেললে মানতে পারি না, কান্না পায়। কান্না বাড়তেই থাকে। এটাই কান্নার ধর্ম। আমরা কখনও কাঁদতে চাইনি, অথচ বাঁচতে চাইলে কান্না থেকে পালিয়ে যাবার কোনও রাস্তাই নেই! যেখানে স্মৃতিদের জন্ম, সেখানেই দুঃখদের বেড়ে-ওঠা।
  
 কষ্টকে চাই না চাই, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হয়। রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে যেমনি করে আমরা হাঁটি, তেমনি করে কষ্টরা বিষণ্ণতার চাদরের ভাঁজ খুলতে খুলতে কোনও এক সুখের মুহূর্তকে ম্লান করে দিয়ে আমাদের চোখের সামনে হঠাৎ এসে দাঁড়ায়! আমাদের গায়ে একধরনের স্থির পোশাকের মতো লেপটে থাকে মুঠো মুঠো বিষাদ। সে ভারী পোশাকটা স্নানের সময়ও গায়ে রাখতে হয়, ঘুমোতে গেলেও রাখতে হয়। বিষাদের অনেক স্তর আছে, যদিও সে স্তরগুলি মিলে একটাই দ্যোতনার সৃষ্টি করে। আশ্চর্যের বিষয়, মানুষ কিংবা অঞ্চল ভেদেও সে দ্যোতনা বদলায় না।
  
 মানুষ তার হৃদয়ে যতটা ভালোবাসা ধারণ করতে পারে, ঠিক ততটাই কষ্ট ধারণ করতে পারে। তাই যে যত ভালোবাসতে পারে, সে তত কষ্ট সহ্য করতে পারে। যা শেষপর্যন্ত সঙ্গে থাকবে না, মানুষ তা-ও ভালোবেসে ফেলে। যা থেকে কষ্ট অনিবার্য, মানুষ তা-ও কাছে টেনে ফেলে। হারানোর ভয়ের চাইতে ভালোবাসার অনুভূতি যার তীব্র নয়, সে কখনও সত্যিকারের প্রেমে পড়ে না। যুক্তি মেনে প্রেম হয় না, যুক্তি মেনে কষ্টও আসে না।
  
 ধরুন, আমার মন ভালো নেই। আমাকে দেখে আপনার মনে হচ্ছে, আমার মন বেশ ফুরফুরে। এর কারণ, আমি একজন ভালো অভিনেতা। আমি মেকি সুখী চেহারা ধারণ করে ফেলতে পারি যে-কোনও মুহূর্তেই। আমাকে দেখে আপনি আমার দুঃখ বুঝতে পারবেন না। আমি কেন এমন করি? কেননা আমি জানি, দুঃখী মানুষের কাছে কেউ ঘেঁষে না। কখনও কখনও, আমি একাকিত্বকে ভয় পাই।
  
 মাঝে মাঝে আবিষ্কার করি, বিষাদের শরীরটা অনেক বড়ো। যেদিকেই তাকাই, বিষাদ দেখতে পাই। আমাকে ঘিরে হাওয়া নয়, শুধুই বিষাদ থাকে। ওরকম অনুভূতি খুব ভয়ংকর। তখন আমাকে বিষণ্ণ দেখায়। চেষ্টা করি স্বাভাবিক থাকতে। খুব চেষ্টা করেও কিছু হয় না। একদৌড়ে একাকিত্ব এসে পড়ে।
  
 আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুটি মারা গেছে। আমি ওকে অনেক ভালোবাসতাম। আমার ধারণা ছিল, ভালোবাসা মৃত্যু আটকে দিতে পারে। বন্ধুর মৃত্যুর পর আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। যাদের আমরা ভালোবাসি, তারাও একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, কিংবা আমরাই তাদের ছেড়ে চলে যাব। ভালোবাসা বা ঘৃণার সাথে বেঁচে থাকার কিছুটা সম্পর্ক থাকলেও মরে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। মৃতদের প্রতি ভালোবাসা আমাদের মৃত করে রাখে।
  
 কারও খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে গেলে সে এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে যেন তার সবই হারিয়ে গেছে। ব্যাপারটা তাকে খুব তাড়া করে ফেরে। নিজের এমন আচরণে সে কখনও বিরক্ত হয়, আবার পরক্ষণেই ভাবে, সে যা করছে ঠিকই করছে। নিজেকে সামলে নেবার ঠিক পরের মুহূর্তে তার মনে হয়, যা নেই, তার চাইতে জরুরি কিছু তার এ জীবনে কখনও ছিল না, আজও নেই। একটি দুঃখ হাজারো দুঃখের সূচনা করে। দুঃখ এমনই এক সত্তা, যার দিকে তাকালে মনে হয়, এর বুঝি কোনও শেষ নেই। চলে গেছে যা, তাকে ধরে রাখতে চাওয়ার এই যে আকাঙ্ক্ষা, একে বলে অস্তিত্বের স্থবিরতা।
  
 এসব দেখে মাঝে মাঝে মাথা ঠিক থাকে না। সত্যিই রেগে উঠি। তখন নিজের দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিই, সে আমায় ছেড়ে চলে গেল কীভাবে! আমার মনটা এমন খারাপ করে দেওয়ার এতটা সাহস সে কোথায় পেল! আচ্ছা, ও কি বেঁচে থাকবার সময়েও এমন সাহসী ছিল কখনও?
  
 এসবের উত্তরে আমার বন্ধুটি কিছুই বলে না। সে এখন আর আমার সামনে নেই। মৃত মানুষের প্রতি আমাদের সমস্ত ক্রোধই নিরর্থক। মৃতদের উত্তর একটাই---হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক!
  
 মাঝে মাঝে আমার মনে যা যা আসে, তার সব কিছু নিয়েই আমার কাছের কারও সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করে। এই যেমন আমার মায়ের মতন কারও সাথে। কিন্তু মায়ের মতন কেউ হয় কি? হয় না। তাই মনে হয়, আমার কথাগুলি মাকেই বলতে পারলে বেঁচে যেতাম! অথচ আমি আমার মাকেও হারিয়ে ফেলেছি। তাই কথাগুলি অব্যক্তই থেকে যায়। মায়ের জায়গায় কাউকে-না-কাউকে আমি পেয়ে যাই। আমি তাকে আমার মনের সব কথা খুলে বলি। সে কিছুই বোঝে না, যদিও এই না-বোঝার ব্যাপারটা সে কৌশলে আড়াল করে। যে আমাকে বোঝে না, তার কাছে নিজেকে মেলে ধরবার কোনও মানে নেই।
  
 আমি মানুষের অভিনয় ধরে ফেলতে পারি। এটা যন্ত্রণার! তার চাইতে বরং চুপচাপ থাকতে পারলে ভালো হতো। কাউকে কিছু বলতে হয় না। একেবারে কাউকেই না! নিজের সমস্ত কথা নিজের মনের মধ্যে রেখে দেওয়াই ভালো। সময় করে ওদের সাথে আলাপচারিতায় মেতে ওঠা যায়---যখন-তখন, ইচ্ছে হলেই। নিজের দুঃখ ও স্মৃতি কাউকে দিতে হয় না। ওরা বড্ড ব্যক্তিগত।
  
 একটি রুপোলি আলোর রেখা এসে আমাদের দুঃখ একটু একটু করে কমাতে থাকে। বিষাদের সবকটা গতানুগতিকতাকে অস্বীকার করে আমাদের মনের উপরে রেখাটি আলতো করে স্বস্তির প্রলেপ এঁকে দেয়। এরও প্রয়োজন আছে। এটি আমাদের অভিজ্ঞতাকে খুব তীব্রভাবে স্পর্শ করে, তার ফলে যে মুক্তিটা ধীরে ধীরে আসতে থাকে, তা বর্তমানকে কোনও এক ঝলমলে ভবিষ্যতের দিকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়।
  
 মন খারাপ হলে কিছু উদ্ভট কাণ্ড ঘটিয়ে বসি। এই যেমন বাথরুমে ঢুকে জোরে শাওয়ার ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। তখন পাগল পাগল লাগে। কেন লাগে, জানি না। বিষাদের শালটা খুলে অন্য দিকে ছুড়ে মারতে পারি না। কী যে ভারী একটা শাল! শুধুই কান্না পায়। কেন পায়? বন্ধু নেই বলে? মা নেই বলে? কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ নেই বলে? সম্ভবত ওসবের একটিও নয়। কখনও কখনও, বিষণ্ণ হয়ে থাকতে তেমন কোনও কারণই লাগে না।
  
 দুঃখ কী আসলে? সে থাকে কোথায়? দুঃখ হচ্ছে সুখ গোপন করে রাখবার একটা ঘর। সে থাকে সব জায়গাতেই! তাকে খুঁজে খুঁজে ডেকে আনতে হয় না। সে নিজেই আমাদের খুঁজে নেয়। দুঃখ এসে যায় বিনা প্ররোচনাতেই। কখন সে আসে? প্রশ্নটা ঠিক হয়নি। বরং বলা উচিত, কখন সে আসে না? দুঃখের কোনও ক্যালেন্ডার হয় না, দুঃখের শুধুই ডায়েরি হয়। আমি আজ ক্যালেন্ডারে নেই, একসময় ছিলাম। ডায়েরির মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে সবাইকে দেখছি। যারা আছে, ওদের ধারণা, আমি নেই। যারা নেই, ওদের ধারণা, আমি আছি। দুই-ই সত্য।