কোথাও কেউ নেই

 ‘বাকের ভাই, আপনার হাতটা একটু দেন? কিছুক্ষণ ধরে রাখি?’
  
 বাকের ভাই হাত এগিয়ে দিলেন। মুনা সেই এগিয়ে দেওয়া হাত দু-হাতের মুঠোয় পুরে চুমু খেতে লাগলেন। মুনার চোখের জলে বাকের ভাইয়ের হাত ভিজে গেল। ওঁদের দু-জনের মাঝে দেয়াল হয়ে রইল জেলের গরাদ। সেই দেয়াল এই পৃথিবীর সমস্ত দেয়ালহীনতার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বিজয়ীর হাসি ছুড়তে লাগল।
  
 বাকের ভাই কখনও কাঁদেন না। আজ তিনিও কাঁদছেন। এই অশ্রু মৃত্যুপথযাত্রী ফাঁসির আসামির অশ্রু নয়। এই অশ্রু প্রাপ্তির। যে মানুষটি বিশ্বাস করতেন, তিনি অগণিত মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে আছেন, আজ তিনি জেনে গেছেন, এক মুনার ভালোবাসা সঙ্গে নিয়েই তিনি মারা যাচ্ছেন। যে মানুষটিকে সমাজের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় না, বস্তুত সে মানুষটি বাদে আর কারও সাথে তাঁর কখনও পরিচয় ঘটেনি। এই একটি পরিচয় বাদে বাকি সবকটি পরিচয়ই ধ্রুব অপরিচয় ঢেকে-ফেলা এক একটি মুখোশ মাত্র! বাকের ভাইয়ের এ অশ্রুর উৎস জীবনের প্রতি মায়া নয়, ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ। মানুষ চোখের সামনে তীব্র ভালোবাসা সহ্য করতে পারে না, কেঁদে ফেলে। ভালোবাসার উদ্‌যাপন বরাবরই অশ্রুতে।
  
 : কেমন আছেন, বাকের সাহেব?
 : ভালো।
 : কিছু খাবেন?
 : খুব ঠান্ডা এক গ্লাস পানি দেন। আর কিছু না।
 : ঠিক আছে।
 : জেলার সাহেব…
 : জি।
 : আমার একটা খুব পছন্দের গান ছিল। গানটা শুনাইতে পারবেন?
 : অবশ্যই পারব। কী গান, বলুন?
  
 বাকের ভাই উদাসদৃষ্টিতে ডানপাশে তাকালেন। তাঁর এ দৃষ্টি হয়তো আসন্ন মৃত্যুর দিকে। এই এক মৃত্যু বাদে মানুষ যেদিকেই তাকায়, তা একসময় দৃষ্টির আড়ালে সরে যায়। মৃত্যুর চেয়ে অকপট বন্ধু আর কে আছে!
  
 আজান হচ্ছে। আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। মুনা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-এর সামনে পায়চারি করছেন। এই পায়চারির নাম অপেক্ষা। এই পৃথিবীর প্রায় সব অপেক্ষাই মানুষের জন্য, মুনার এই অপেক্ষা লাশের জন্য। ভালোবাসা থাকে যেখানে, সেখানে সব অপেক্ষাই ভালোবাসার মানুষটির জন্য। ভালোবাসার মানুষের কখনও মৃত্যু হয় না। চোখের সামনে থেকে সেই মানুষটি কখনও সরে যায় না। মুনা বাকের ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। বাকিরা সবাই দেখবে, বাকের ভাই আসেননি, তাঁর লাশ এসেছে। মুনা দেখবে, তাঁর এই পুরো জীবনের একমাত্র কাছের মানুষটি তাঁর চোখের সামনে এসেছে।
  
 বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে গেল। মুনা কারাগারের ভেতরে ঢুকলেন। তাঁর চোখ-মুখ শান্ত, নিথর, নিঃস্পৃহ। আজ মুনার আর কোনও বাধা নেই। তিনি বাকের ভাইকে এই জন্মের জন্য নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবেন।
  
  
 : আপনি কি ডেডবডি রিসিভ করবেন?
 (মুনা নীরবে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন।)
 : কাগজপত্র এনেছেন?
 (মুনা কাগজপত্র এগিয়ে দিলেন। তাঁর ডানচোখের কোনায় অশ্রু। ডানহাতের তর্জনী ভাঁজ করে তিনি অশ্রু মুছলেন।)
 : আপনি বাকেরের কে হন?
 : আমি…! আমি কেউ না।
  
 কারাগারের ভেতর থেকে বাকের ভাইয়ের লাশ বহন করে নিয়ে আসা হলো। ব্যাকগ্রাউন্ডে করুণসুরে বাজছে বাকের ভাইয়ের প্রিয় গানটি: হাওয়া মে উড়তা যায়ে…
  
 যে মানুষটির আশেপাশে সারাজীবনই শুভাকাঙ্ক্ষীরা ঘুরঘুর করত, তাঁর মৃত্যুর পর সঙ্গী হয়েছিলেন এমন একজন মানুষ যে মানুষটি তাঁর কেউ হন না। সেই একটি মানুষ বাদে মৃত্যুর পর আর কাউকেই তিনি পাশে পাননি। বেঁচে থাকবার সময়ে মানুষ কিছুতেই বুঝতে চায় না, তাঁর মৃত্যুতেও এই পৃথিবীর তেমন কারও কিছুই এসে যায় না। এটা বুঝে ফেলতে পারলে বেঁচে থাকাটা তাঁর জন্য আরও সহজ হতো।
  
 মুনা এক বার বাকের ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর তাকিয়ে রইলেন ভোররাতের আকাশের দিকে। সে আকাশের আবছা অন্ধকার ভেদ করে বাকের ভাই হয়তো মুনাকে বলছেন, ‘মুনা, তোমার অপেক্ষা আজ শেষ হলো। আজ থেকে আমি তোমার হলাম।’ আমরা মুনাকে আবার কাঁদতে দেখি। যে মানুষটি তাঁর কেউ হন না, সে মানুষটি আজ থেকে তাঁর সব কিছু হয়ে গেলেন পুরো জীবনের জন্য। কিছু অর্জন মানুষকে কাঁদায়।
  
 শেষদৃশ্যে মুনা হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি ধীরপায়ে হাঁটছেন সামনের দিকে। এ জীবনে তিনি তেমন কিছুই পাননি, শুধু বাকের ভাইকে পেয়েছেন। মানুষটিকে আর কেউ কখনও পাবে না। মুনার জীবনে প্রেম আসেনি, বাকের ভাই এসেছিলেন। বাকের ভাইয়ের জীবনে অনেকেই এসেছেন, মৃত্যুর পর শুধু মুনাই এসেছিলেন। এর নাম নিয়তি। বাকের ভাইয়ের মৃত্যু প্রমাণ করে দিল, মানুষ নিয়তির বাইরে যেতে পারে না। যাদের খুশি রেখে রেখে আমরা বাঁচি, তাদের তেমন কেউই আমাদের আয়ুর তোয়াক্কা করে না।
  
 যে মানুষটি সারাজীবন ধরে অসংখ্য মানুষের উপকার করে বেড়িয়েছেন, মৃত্যুর পর সে মানুষটির পাশে ছিলেন এমন একজন, যিনি সে মানুষটির কেউ হন না। পাশে আর কেউই কোথাও ছিলেন না। এই কেউ না হওয়া মানুষটিই ছিলেন মুনার এই পুরো জীবনটা, মুনার শরীরে প্রবহমান প্রতিটি রক্তবিন্দুতে ছিল সেই মানুষটির সতত বসবাস। মুনা ও বাকের ভাইয়ের সংসারটা হয়নি। মৃত্যুর পর বাকের ভাই মুনার পুরো জীবনের সংসার হয়ে বেঁচে রইলেন।
  
 এই পৃথিবীতে এমন সম্পর্কও থাকে, যে সম্পর্কের কোনও নাম হয় না। তবু সে সম্পর্কটিই হয়ে ওঠে জন্মজন্মান্তরের। সে সম্পর্কের চাইতে বিশুদ্ধ বন্ধন পৃথিবীর ইতিহাস ঘেঁটে আর পাওয়া যায় না। এইসব নামহীনতার কাছে পৃথিবীর সমস্ত নামই বড্ড বিবর্ণ!
  
 মুনাদের সব কিছুই হয় যে মানুষটি, সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে সে মানুষটিকে নিয়ে মুনাদের বলতে হয়, মানুষটি আমার কেউ হয় না! সমাজ সেটিই শুনতে চায়। সমাজ তার চাইতে বেশি কিছু মেনে নিতে আজও শেখেনি। পুরো জীবনের দামে কিনে নিতে হয় যে সম্পর্কটি, সে সম্পর্কেরই কিনা কোনও নাম নেই! কিছু সম্পর্ক ভালোবাসারও ঊর্ধ্বে, কিছু ভালোবাসা সম্পর্কেরও ঊর্ধ্বে! যে প্রেমকে কেউ দেখতে পায় না, সে প্রেমই পুরো জীবনটাকে দেখায়!
  
 যে হাতটি ধরতে বুকের ভেতরে একসমুদ্র দীর্ঘশ্বাস চেপে জমিয়ে রেখে অনুমতি নিতে হয়, সে হাতটিই বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন হয়ে যায়। বাকের ভাইদের মুনারা কখনও চাইতে পারে না। তবু বাকের ভাইদের মৃত্যুর পর মুনারা বাকি জীবনে এক তাদের বাদে আর কিছুই চাইতে পারে না। কিছু সম্পর্ক স্রেফ জীবনের দায়ে বেঁচে থাকে, কিছু সম্পর্ক মৃত্যুর নিরাবেগ শীতল বোঝাপড়াতেও মরে না। কিছু সম্পর্ক থাকে যা মানুষ মেনে নেয়; কিছু সম্পর্ক থাকে যা মানুষ মানিয়ে নেয়; কিছু সম্পর্ক থাকে যা মেনে নেওয়া কিংবা মানিয়ে নেওয়ার সমস্ত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দেয়ালের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে বেঁচে থাকবার একমাত্র অজুহাতটি হয়ে বেঁচে থাকে।