বাকের ভাইকে মুনা


প্রিয় বাকের ভাই,


কেমন আছেন ওপারে? আপনি কি ওখানেও আমাকে ভাবেন?
মিথ্যা-মামলায় হওয়া ফাঁসিটা আপনাকে পোড়ায় বেশি, না কি মুনা যে সময় থাকতে আপনাকে ভালোবাসেনি, সেটাই বেশি পোড়ায়? আমাদের শুধুই দেরি হয়ে যায়, তাই না?


আচ্ছা, বাকের ভাই, মুখ ফুটে কখনও ভালোবাসার কথা বলতে পারতেন না কেন? ওপারে গিয়ে বুদ্ধিসুদ্ধি একটু বেড়েছে আপনার, না কি এখনও সেই বোকাটাই থেকে গেছেন, বাকের ভাই? এখনও, ‘হাওয়ামে উড়তা যায়ে…’ গানটাই প্রিয় আপনার? বিড়ি-সিগারেট ফোঁকার অভ্যেসটা ছাড়তে পেরেছেন তো?


বাকের ভাই, বলতে পারেন, আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারিনি কেন? কেন আপনার মতন চমৎকার একটা মানুষের সঙ্গে আমার একটা ঘর হলো না? এক বার ভাঙার পরও তো মানুষ নতুন করে উঠে দাঁড়ায়। নদীতে এক চর বিলীন হয়ে গেলেও তো কতশত চর আবার নতুন করে জেগে ওঠে। আমরাও তো পারতাম বাকের ভাই উঠে দাঁড়াতে। পারতাম না?
এ দেয়ালের সমস্ত ধূসর রঙের উপর সাতটা রঙের গাঢ় প্রলেপ দিতে তো আমরাও পারতাম!
আমাদের একটা সংসার হলো না কেন, বাকের ভাই? কেন হাওয়ামে উড়তা যায়ে…গানের সুরে আমাদের সুখগুলি বাঁধা পড়ল না?


আপনি উসকোখুসকো বোকাসোকা আমার মানুষটা হয়ে সন্ধেশেষে ঘরে ফিরতেন। মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ বেরোলে খুব করে বকে দিতাম। অবশ্য ফেরার পথে একটা চুইংগাম মুখে নিশ্চয়ই রাখতেন যাতে গন্ধটা ধরে ফেলতে না পারি। ধরে আমি তা-ও ফেলতাম!
রোজ রোজই আমাদের এটা-ওটা নিয়ে ঝগড়া হতো। আপনার বেখেয়ালি আচরণে বিরক্ত হয়ে কখনও-সখনও বাপের বাড়ি চলে যেতাম অভিমান করে। ঝগড়া হতো, মারামারিও হতো, তবুও কেউ কাউকে ছেড়ে যেতাম না। রোজই বলতাম, তোমার জন্যই জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল! অথচ মনে মনে বলতাম, তোমাকে ছাড়া আমার আর কোনও জীবনই নেই!


আচ্ছা, বাকের ভাই, আপনাকে কখনও তুমি করে ডাকিনি কেন? তুমি ডাকতে বুঝি খুব অধিকার লাগে? আমার সেই অধিকারটা ছিল না, তাই না? আজ আপনি নেই, আজ আপনাকে তুমি করে ডাকতে খুব ইচ্ছে করে, বাকের ভাই! সময় চলে গেছে, না! এ জীবনে আমার ঠিক আপনার মতন একটা তুমি’র খুব অভাব! এমন তুমিবিহীন হয়েই বুঝি জীবনটা কেটে যাবে!


বাকের ভাই, আপনি বেঁচে থাকলে বোধ হয় আপনার সঙ্গেই আমার একটা ঘরসংসার হতো। আপনার সঙ্গেই বোধ হয় দু-লাইনের ছোট্ট জীবনটা জুড়ে যেত। এমনটা কেন হলো না, বাকের ভাই? হারিয়েই কেন বুঝতে হলো এইসব?


বাকের ভাই, জানেন, আমি রোজ ভাবি, আমি বোধ হয় দুঃস্বপ্ন দেখছি। একটু পরেই স্বপ্ন ভেঙে যাবে, আর আপনি হুট করে এসে বলবেন, অ্যাই মুনা, অ্যাই! ওঠো, চলো, বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, দু-জন মিলে তারা দেখি। তারা-দেখা ভালো কাজ।
আমরা তারা দেখতে দেখতে গান শুনতাম, হাওয়ামে উড়তা যায়ে…চারপাশে ঝিরিঝিরি বাতাস বইত। অথচ দেখুন, আজ আপনিই আকাশের তারা হয়ে গেছেন!
জানেন, আমি রোজ সন্ধেয় আকাশ দেখি, তন্নতন্ন করে খুঁজি, ওই যে ওই তারা-ভরা আকাশটার ঠিক কোন তারাটি আপনি! সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল-করা তারাটি, না কি সবচেয়ে অনুজ্জ্বল হয়ে মন খারাপ করে এককোণে একাকী জ্বলতে-থাকা তারাটিই আপনি!
আপনি আমাকে দেখতে পান, বাকের ভাই? কথা বলতে ইচ্ছে করে? চোখের জল মুছতে মুছতে কি বলতে চান, ‘মুনা, তোমাকে খুউব ভালোবাসি।’ ভালোবাসি বলতে পারাটা কিছু মানুষের জন্য এত কঠিন কেন, বাকের ভাই?


বাকের ভাই, জানেন, আপনি চলে যাবার পর আমার কী যে ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগে! জীবনে এতটা নিঃসঙ্গ, এতটা একা আগে কখনও লাগেনি। আপনি মারা যাবার পর গোটা পৃথিবীটাকে একটা নিঃসঙ্গ তারা মনে হয়, যেখানে এক আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এমন লাগে কেন, বাকের ভাই? তবে কি আমি আপনাকেই ভালোবাসতাম, বাকের ভাই? আমি কি তবে তখন বুঝতেই পারতাম না এটা? কেন কিছু মানুষ বুকের ভেতরে-থাকা ভালোবাসাটা টেরই পায় না কখনও?


আপনাকে ছেড়ে এত নিঃস্ব লাগে কেন, বাকের ভাই! মনে হয়, যেন পুরো মহাপৃথিবীর কোথাও কেউ নেই, কিচ্ছুটি নেই!


আজ তবে আসি, বাকের ভাই। চোখে কী জানি পড়েছে আমার!
বিশ্বাস করুন বাকের ভাই, আমি একদমই কাঁদছি না! একদম না!
এ শহরে ধুলো বেড়েছে খুউব, তাই…


ইতি-
বড্ড অসময়ে আপনার হয়ে-ওঠা মুনা