বন্ধুর বাড়িটা কোথায়? (১৯৮৭)

(রিভিউতে স্পয়লার আছে। স্পয়লারে অ্যালার্জি থাকলে অনুগ্রহ করে আর পড়বেন না।)

ফার্সি কবি সোহরাব সেপেহরীর একটা চমৎকার কবিতা আছে, ‘ঠিকানা’:

“বন্ধুর বাড়িটা কোথায়?” গোধূলিআলোয় সওয়ারি সুধায়।

একটু থেমে হাসলো বেহেশত।

ছড়িয়ে আলো ঠোঁটের কোণায়, সরিয়ে আঁধার সেই মরুতে,

পপলার এক গাছের দিকে উঁচিয়ে আঙুল বললো পথিক,

“ওই তো ওই গাছের কাছেই

বাগান আছে—সে সবুজসারির সবুজ দেখে পুড়বে দুচোখ,

সেখানে দেখো, সততার পালক থেকেও ভালোবাসাটা নীলচে বেশি,

সারিটা ধরে এগিয়ে যেয়ো, এগোনো শেষে জাগবে জীবন,

খানিক ফিরে একাকীত্বের ফুলটা দেখো,

ফুলের দিকে দুই পা দিয়ো,

যে ঝর্ণাধারা চলেছে বয়ে পুরাণ থেকে পৃথিবীবুকে, তার পাশেতে একটু বোসো,

যদি ভয় পেয়ে যাও সেখানটাতে, শুকনো পাতা ভয় তাড়াবে, নিবিড়ভাবে শুনলে পরে শুনতে পাবে।

এক দেবশিশু আসবে, দেখো—

সে এসেছে উঁচু গাছের উপর হতে দিব্যজ্যোতির খবর নিয়ে।

শুধাও ওকেই:

“বন্ধুর বাড়িটা কোথায়?”

১৯৮৭ সালে উপরের কবিতার থিমে আব্বাস কিয়ারোস্তামি বানালেন ‘বন্ধুর বাড়িটা কোথায়?’, নামটাও কবিতার লাইন থেকে নেয়া। খুব সরল গল্পের মধ্য দিয়ে জীবনের নানান দর্শনের পাঠ দেন, এমন নির্মাতা কারা, এ প্রসঙ্গে যে কয়জন চলচ্চিত্রকারের নাম সবার আগে আসে, আব্বাস কিয়ারোস্তামি তাঁদের অন্যতম। “সত্যজিতের মৃত্যুর পর আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে মনে হল, সত্যজিতের জায়গায় আব্বাস এসেছে।” কথাটা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ আকিরা কুরোসাওয়ার। যে ছবির মাধ্যমে আব্বাস কিয়ারোস্তামি আন্তর্জাতিকভাবে প্রথমবার সমালোচকদের নজরে আসেন, সেটির নাম ‘বন্ধুর বাড়িটা কোথায়? (১৯৮৭)’

সিনেমার শুরু একটা বন্ধ দরোজা দিয়ে। দরোজাটা বন্ধ, ভেতর থেকে শিশুদের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। আমরা ক্লাসরুমের ভেতরে ঢুকে পড়লাম, আমাদের সাথে ঢুকলেন শিক্ষক। উনি বাচ্চাদের বকছেন হৈচৈ করার অপরাধে। উনি ক্লাসে পড়াচ্ছেন, দরোজাটা বারবার খুলছে, উনি সেটা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এ দৃশ্য দিয়েই পুরো গল্পের কথা বলে দেয়া যায়। এ মুভিতে দরোজার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দরোজা হচ্ছে শৃঙ্খলের প্রতীক, স্বাধীনতার অনুপস্থিতি। সে সময় ইরানের শিশুদের বড়ো হতে হতো পারিবারিক ও সামাজিক নানান বেড়াজালের মধ্যে। মানুষ তার শৈশবে একবারই বাঁচে। আর সেসময় শৃঙ্খলায় ও শাসনে বড়ো করার নামে শিশুদের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো এমন সব অহেতুক নিয়মকানুন, যেগুলি তাদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করতো। ছোটদের ব্যাপারে বড়দের মানসিকতা কেমন ছিল, সিনেমার একটা দৃশ্য থেকে তা দেখে নেয়া যাক:

(এ গল্পের নায়ক ৮ বছর বয়সি আহমেদ দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আহমেদের দাদাজান তাকে পেছন থেকে ডাকছেন।)

আহমেদ! কোথায় যাচ্ছিস? এদিকে আয়!

সালাম।

কোথায় যাচ্ছিলি?

রুটি কিনতে।

আমি তোকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। ঠিকভাবে উত্তর দে। কোথায় গিয়েছিলি? তুই পোশ্তেহ কেন গিয়েছিলি?

মোহাম্মদ রেজাকে নোটবুকটা ফেরত দিতে। ও আমার সহপাঠী।

দিয়েছিস?

না, আমি ওকে খুঁজে পাইনি।

যা, আমার জন্য বিড়ি নিয়ে আয়।

আমাকে বেকারিতে যেতে হবে।

আগে আমার বিড়ি নিয়ে আয়।

কিন্তু আমি দেরি করে ফেললে ওরা কেউ রুটি খেতে পারবে না।

আমি যা বলেছি, তা আবারো বলতে চাই না।

(আহমেদ বিড়ি কিনতে গেল। দাদাজানের পাশের বৃদ্ধ দাদাজানের সাথে কথা বলছেন।)

নাও, আমার কাছে কিছু বিড়ি আছে।

না, বিড়ি আমার কাছেও আছে। আসল বিষয় বিড়ি না, আমি আসলে চাই, বাচ্চাটা আদবকায়দা শিখুক, যাতে ভবিষ্যতে সে একজন ভাল মানুষ হতে পারে। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার বাবা আমাকে সপ্তাহে একআনা করে দিতেন, এবং প্রতি পনেরো দিন পরপর তিনি আমাকে পেটাতেন। কখনোকখনো তিনি ইচ্ছে করেই আমাকে টাকা দিতে ভুলে যেতেন, কিন্তু তিনি কখনোই আমাকে পেটাতে ভুলে যেতেন না, যাতে করে তিনি আমাকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারেন। তুমি তো নিজেই দেখলে, আমার নাতিকে বিড়ি আনতে বললাম, সেটা আবার আমাকে তিনবার বলতে হল। তারপরও সে আমার কথা শুনল না। আমি চাই, আমাদের বাচ্চারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠুক। সে অলস, সে তো সমাজের কোনো কাজেই আসবে না।

ধরো, সে তোমার কথা শুনল। তুমি কি তখনও তাকে পেটাবে? কারণ তখন তো………….

নিশ্চয়ই পেটাবো। আমি তো তোমাকে বললামই, আমার বাবা আমাকে হাতখরচ দিতে ভুলে গেলেও পেটাতে কখনো ভুলে যেতেন না। বুঝতেই পারছ, এর নাম শৃঙ্খলাবোধ। সমাজের বাচ্চাদের এটা শেখাতে হবে। তাদের বাবা-মা’কে মেনে চলতে হবে, সব ঐতিহ্যকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে হবে।

ঠিক আছে, বুঝলাম। কিন্তু বাচ্চাটা যদি কোনো ভুল না করে, তখন? তখন তুমি কী করবে?

কোনো না কোনো অজুহাত বের করে ওকে পেটাবো। প্রতি পনেরো দিন পরপর পেটাবো, যাতে সে কখনো এ মারের কথা ভুলতে না পারে।

বুঝুন অবস্থাটা! আচ্ছা, আমাদের সমাজের চিত্রও কি একই রকমের নয়? আহমেদের দাদাজান তো অশিক্ষিত মানুষ, নিজে যা দেখেছেন, তা-ই অন্ধের মতো নাতির উপর প্রয়োগ করতে চান, কিন্তু আমাদের আশেপাশের যে শিক্ষিত লোকজন বিশ্বাস করেন, “যেহেতু আমার সাথে আমার সিনিয়র অন্যায় করেছেন, সেহেতু এর ‘শোধ’ আমি আমার জুনিয়রের উপর নেবো”, তাদের শিক্ষার আর কী দাম রইল? তাদের সাথে আহমেদের গ্রাম্য অশিক্ষিত দাদাজানের মানসিকতার কী পার্থক্য? এ সিনেমায় আমরা দেখি, বড়রা ছোটদের কোনো কথাই গুরুত্ব দিয়ে শোনে না, কখনো শোনেই না। আহমেদ কোনো কথাকে তার বড়রা পাত্তা দিচ্ছে না, তার কথা শোনার প্রয়োজনই মনে করছে না। এ ফিল্মে আহমেদ শিশুদের নৈতিকতা ও ন্যায়বোধের প্রতীক। সে তার বন্ধু নেমাতযেদেহর নোটবুকটা ভুলে নিজের ব্যাগে নিয়ে আসে। ওটা দেখতে অবিকল তার নিজের নোটবুকটার মতো, তাই সে খেয়াল করেনি। ওদিকে তার বন্ধু যদি পরেরদিন হোমওয়ার্ক না করে স্কুলে যায়, তবে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হবে। এখন কী করা? তার মা বারবারই বলে যায়, পরেরদিন খাতা ফেরত দিলেই চলবে। আহমেদ তার মায়ের শত বারণ সত্ত্বেও রুটি কেনার উছিলায় বন্ধুর খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। তার কাছে মনে হতে থাকে, বন্ধুর নোটবুক ব্যাগে করে নিয়ে এসে সে ভুল করেছে, এ ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে বন্ধুকে বহিষ্কৃত হতে হয়, তখন তার দায় আহমেদের উপরও এসে পড়ে। বন্ধুর বাড়ি সে চেনে না, তার উপর গ্রামটা আহমেদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে। একেওকে জিজ্ঞেস করেকরে অনেক খুঁজেও যখন সে বন্ধুর বাড়ি পেল না, তখন সে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে, পরেরদিন স্কুলে যে হোমওয়ার্কটা দেখাতে হবে, সেটা রাতজেগে নিজের ও বন্ধুর নোটবুকে তুলে ফেলল। আহমেদের হাত থেকে নোটবুকটা অনেকটা কেড়ে নিয়ে যখন এক লোহার দরোজার ব্যবসায়ী নোটবুকের একটা পাতা ছিঁড়ে সেখানে কী একটা হিসাব করছিলেন, সে মুহূর্তে আহমেদের অসহায় এক্সপ্রেশনটি, তা মনে রাখার মতো।

সিনেমায় দেখি, গ্রামের লোকজন পুরনো কাঠের দরোজা বদলে নতুন লোহার দরোজা লাগাচ্ছে। যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটছে, তারাও বাড়িতে লোহার দরোজা ব্যবহার করছে। এখানে কাঠের দরোজা বদলে ফেলে লোহার দরোজা লাগানোর ব্যাপারটার মাধ্যমে সহজসরল জীবনযাপনের জায়গায় জীবনের জটিল রূপের স্থান করে নেয়ার দিকটার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আহমেদের নীতিবোধ ও বন্ধু বাৎসল্য লোহার দরোজার ব্যবসায়ীকে নাড়া দেয়নি, সে আহমেদের কথাকে পাত্তাই দেয়নি, কিন্তু পুরনো ধাঁচের কাঠের দরোজার ব্যবসায়ী বৃদ্ধ লোকটি ঠিকই আহমেদের আবেগ ও অনুভূতির মূল্য দিয়েছে, আহমেদকে তার বন্ধুর বাড়ি খুঁজতে সাহায্য করেছে। হঠাৎ ঝড় উঠলে ভয়ে ৮ বছরের আহমেদ বন্ধুর বাড়িতে না গিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। তার বাড়িতে ফিরে আসার দৃশ্যটি না দেখিয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামি আমাদের দেখালেন বৃদ্ধ ছুতারের বাড়িতে ফিরে জানালা নামিয়ে বিশ্রাম নিতে যাওয়ার দৃশ্য। একটা বাচ্চা ছেলেকে সাহায্য করতে পেরে তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া—এতে জাগতিক লাভ না থাকলেও আত্মিক শান্তি আছে। এ সিনেমায় আহমেদ এবং বৃদ্ধ ছুতার আমাদের এ অনুভূতি দেয়: এ সমাজে এখনো অনেক ভাল মানুষ আছে, যারা বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না করেই, সবকিছু এখনো নষ্টদের অধিকারে যায়নি।

যারা মুভিটা দেখেছেন, তাঁদের প্রতি একটা প্রশ্ন। সত্যি করে বলুনতো, নেমাতযাদেহর বাড়ি যখন আহমেদ খুঁজে পেল না, সে মুহূর্তে আপনার একবারও কি মনে আসেনি যে পরদিন নেমাতযাদেহ শাস্তি পেতে যাচ্ছে?