বড্ড দেরি হয়ে গেল

সুধার বাবা,




আমি ভালোবেসে ভিখিরি হয়েছি, ঠিক আছে।




কিন্তু আসলে তো আমি ভিখিরি নই। আরে, ভিখিরি কি আবার ভালোবাসতে জানে নাকি? আমাকে তুমি সত্যি সত্যিই ভিখিরি ভেবে লাথি মেরেছ, বের করে দেবার চেষ্টা করেছ।




আমি তোমার অপেক্ষায় থেকে থেকে তাদের উপেক্ষা করেছি, যারা আমাকে একটা বার কাছ থেকে দেখার জন্য মনে মনে প্রার্থনা করে। আর তুমি আমার সময়কে সস্তা ভেবে অপেক্ষা করিয়েছ, করিয়েই যাচ্ছ...




আমি তোমার সঙ্গে খুব কথা বলি। মন খুলে, প্রাণ খুলে, এমনকী আত্মাটাও খুলে। আরও আরও বলতেও চাই।




জেনে রাখো, আমি কিন্তু কেবল তোমার কাছেই বাচাল।




অন্য একটাও মানুষ নেই, যে আমার কাছ থেকে 'হ্যাঁ, না'-র বাইরে আর একটিও শব্দ শুনতে পায়।




অথচ তুমি করুণার সাথে ভাবো, 'আমি বলেই এই মেয়েকে সহ্য করে গেলাম, আর কারও কাছে তো সে পাত্তাই পায় না!'




তুমি কখনও জানতেই পারবে না যে, আমার মুখে শুধুই 'হ্যালো'টুকু শুনতেও কেউ কেউ এখনও অন্য নম্বর থেকে ফোন করে! আর করতেই থাকে...




তুমি জানো না। সত্যিটাও জানো না, মিথ্যেটাও না। তুমি কিছুই জানো না।




হ্যাঁ, দেশ-বিদেশের অনেক খবর, অনেক জ্ঞানের কথা তুমি জানো।




কিন্তু তুমি আমাকে জানো না, চেনো না। তুমি অনেক মেয়েকেই চেনো, কিন্তু কোনও নারীকে চেনো না।




আমি তোমার সঙ্গে থাকতে থাকতে মরে গেছি, আমার আত্মা এখন মৃত। তুমি এখনই সেটা বুঝবে না, বুঝবে আরও কয়েক বছর পর।




পরে কেন? বলছি।




এসব মনোজাগতিক ব্যাপার বুঝতে নারীদের চাইতে পুরুষদের অনেক বেশি সময় লাগে। আর ততদিনে তোমার একটা ক্ষতি হয়ে যাবে। কয়েক বছর পর যখন তুমি বুঝবে, তোমাকে পাগলের মতন ভালোবেসে-যাওয়া মানুষটার পাগলামো সেরে গেছে, সে এখন একটা লাশ মাত্র, সেদিন হুট করে তোমার মৃত্যু হবে...ওই যে আমারই মতন! শরীর বেঁচে থাকবে, আত্মার মৃত্যু ঘটবে।




তখন তুমিও আমার মতন মাঝরাতে উঠে বলবে, 'আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কাবেরি!' উত্তরে আমি খুব করে হেসে বলব, 'এই বয়সে এসব আবেগে তোমায় মানায় না, ঘুমোও তো!'




তখন আর আগের মতন তুমি অফিসের পর বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে চাইবে না। বাড়ি ফেরার, আমার কাছে ফেরার টান অনুভব করবে।




জলদি জলদি বাড়ি ফিরে হয়তো কোনও দিন দেখবে, আমি আমার বান্ধবীদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। আবার আরেক দিন হয়তো দেখবে, না বলে-কয়ে চলে গেছি মায়ের বাসায়।




এভাবেই চলবে, চলতেই থাকবে। তোমার মনের আগ্নেয়গিরি কেউ দেখতে পাবে না, কিন্তু মায়ের বাড়িতে বসে মহাশ্বেতা দেবীর বই ওলটাতে ওলটাতে আমি ঠিকই ওই আগুনের তাপ টের পাবো। "বেটার-হাফ" বলে কথা! হা হা হা...




আমিও উপযুক্ত কারণ দর্শানোর ভয়ে যেমন আত্মহত্যা করতে পারিনি, তেমনি তুমিও একটা সুইসাইড-নোটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দুটো উপযুক্ত লাইন লিখতে না পারার অসহায়ত্বে বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকবে।




স্বেচ্ছামৃত্যু ঘটাতে গেলেও মানুষকে কত কী যে কেচ্ছা সাজাতে হয়!




কী অদ্ভুত! নিজের কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে যে মানুষ মরতে বাধ্য হয়, "সুইসাইড নোট"-এর নামে, মৃত্যুর পরেও, 'কেন মরতে গেলে!'-র মতন প্রশ্নের উত্তরে তাকেও কৈফিয়ত সাজাতে হয়!




বলাই বাহুল্য, মরার অজুহাত হিসেবে কোনও কেচ্ছা-কাহিনি বানাতে তুমি পারবে না, আমিও পারিনি।




তোমার সেই সময়ের জন্য আমি একটি ডায়েরি লিখে রেখে যাচ্ছি। তুমি বসে বসে পড়বে। কেমন?




আমি মায়ের বাসায় বসেও তোমার মেসেজের জন্য অপেক্ষা করব। ডায়েরিটা পড়ে তুমি কাঁদতে কাঁদতে মেসেজ লিখবে, 'ভালোবাসি, কাবেরি! ফিরে এসো।'




আমি হেসে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলব, 'বড্ড দেরি হয়ে গেল যে...!'