চেনা জীবনের অচেনা সড়কে দু-জনের আজ আবার দেখা! চোখে চোখ পড়তেই তুমি চোখদুটোকে লুকিয়ে নিলে! আমি তবু ঠিকই নিয়েছি চিনে আমার পুরনো তুমি’কে! দেখলাম, রগচটা চোখদুটো এখন সমুদ্রের মতো শান্ত ভীষণ! হাতঘড়ি আর পরো না বোধ হয়। ব্যস্ত নগরীর কালো ধোঁয়ায় মিশে পুরনো আবেগটাও কেমন যেন শিথিল হয়েছে। চুল পেকেছে, চোখে-মুখে বয়সের ভারটা বেশ চোখে পড়ে। চাপদাড়িটা আছে আগের মতোই। ওটা আমার বড্ড কাছের ছিল; আজও আছে। এখন কেউ কি আর আমার মতন জ্বালায় তোকে? শরীর খারাপ করলে পাশে তোকে চায়? আমার মতন কেউ তোর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদে? ঝুমবৃষ্টিতে তোকে নিয়ে কদম-হাতে নাচে? এখনও কি গল্পের বইটা হাতে পড়ার টেবিলে ঘুমিয়ে পড়িস? না কি নতুন কারও কথা ভেবে আনন্দে-সুখে সবই ভুলিস? কেউ কি আর আমার মতন তোকে নিয়ে কবিতা লেখে রাত জেগে? না কি সে অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়ে? কেউ কি তোকে আঁকড়ে ধরে রেখে দিতে চায় অশ্বত্থের ছায়া ভেবে? না কি স্রেফ সময় কাটায় আর অমনিই পালায়? কেউ কি ভোগে আমার মতন ইনসমনিয়ায়? রাখে ঘুমের ওষুধ মাথার কাছে, আর তোকে ভেবে দাগ ফেলে দেয় চোখের নিচে? না কি ওদের চোখে কাজলই শুধু মানায় ভালো? এখনও কি তুই ভাতের সাথে লঙ্কা মাখিস? জানিস, কাঁচালঙ্কার ঘ্রাণও পেলে আজও তুই মাথায় থাকিস! এখনও কি বৃষ্টি ভালোবাসিস? কাঁদিস একা বৃষ্টিমুখর রাতে? বৃষ্টি নামলে…ভিজিস? চোখের জলের নৈঃশব্দ্যতে এখনও হাঁটিস একলা একা? জ্বর হলে, প্যারাসিটামলটা মনে করে খেতে বলতিস, মনে আছে তোর? খেতাম তখন। অথচ দ্যাখ, ডাক্তার ওটা খেতে বললেই আজ বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে! অভিমানে কেউ কেঁদে-কেটে বুক ভাসালে তাকেও খুব বোঝাস নাকি আমারই মতো? বোঝাতে ফেইল মারলে রেগেমেগে বলিস তাকেও… তোমার সব ব্যাপারেই পুরোপুরি ব্যর্থ আমি! ফোনের ওপাশ থেকে কেউ কি আর কাঁদে এখন তোর জন্য? কারও কান্না শুনে ফোনটা ধরে চুপ হয়ে যাস, ঠিক আগের মতো? কেউ তোর জন্য এত এতসব লিখে রাখে? তুই পড়বি না জেনেও তোকে খুব যত্ন করে ঠায় লিখে যায়? মনে আছে, কত হাজারো ঘণ্টা আমরা কথা বলেছি দিনে-রাতে? নম্বরটা বদলে ফেলেছিস? একদিন ফোন করেছিলাম, কীসব যেন বলে! ফোন-নম্বরটা ভুলে গেলি রে! তোর প্রতিটি ডিজিট আজও আমার ঠোঁটের ডগায়! কারও সাথে ভুল করেও যদি মিলে যায়, ঠায় তাকিয়ে থাকি! অমন করে কাকে এখন শাসন করিস? একটুখানি ভুল হলেই কাকে বকে দিস? মনে আছে, আমাকে বকতে গিয়েই আপনি থেকে ‘তুমি’তে এলি! বোধ হয় খেয়ালই করিসনি, কখন যে বেখেয়ালে তুই আমাকে অমন করে কাছে নিলি! বড্ড সহজ রে তুই! কাউকে কি আর আপনি থেকে তুমি’তে টানিস? হয় রে অমন? বলেছিলি, আমাকে অনেকগুলো বই দিবি! জানিস, এখন বই আমার অনেকই আছে! শুধু তোর ঠিকানা থেকে কিছুই আর আসে না রে! আমি বোকার মতন ক্যুরিয়ারে আজও খোঁজ নিতে যাই, কিছুসময় সেই অফিসের সামনে দাঁড়াই। বইগুলি আজ কাকে কিনে দিস? সে-ও কি আমার মতন এমন অধীর হয়ে অপেক্ষা করে? বই হাতে পেয়েই খুশিতে এমন আটখানা হয়…সে-ও? নিজের মনের কথা গড়গড়িয়ে কাকে বলিস? সে-ও কি আমার মতন অমন করেই শোনে? তুই কি আজও কারও কাছে পুরো পৃথিবী…আমারই মতো? কেউ কি তোকে খড়কুটোরই মতন আঁকড়ে ধরে বাঁচে? আজ আমার বর হয়েছে, তবু ওর চোখে তোকেই দেখি। বরটা আমার মানুষ ভালো, আমাকে ভালোবাসে, আদরে রাখে। তোর মতন দূরে ঠেলে না, অবহেলাও করে না অমন। তবু ওকে নিয়ে লিখতে গেলে মাথাটা পুরোই ফাঁকা লাগে! তোকে পাইনি বলেই ভাবি বেশি, তোকে নিয়েই এই যা লিখি! তুই একটা বাঁদর ছিলি, আমার সাতজন্মের আদর ছিলি! মজনু যদি পেত লাইলিকে, যদি শিরিন হতো ফরহাদেরই, ওদের নাম কি তবে এমন করে ছড়িয়ে যেত? পেয়ে গেলে সব-সবটাই, নতুন করে জন্মে কি কেউ? তোকে আমি পাইনি বলেই নতুন করে জন্মেছি রে! আমি তো অনেক দিনই আঁধারে ছিলাম নিজের মতো…সেই প্লেটোর গুহায়! তুই এলি, আর অমনিই সূর্য এল! তোর ছেলেটা বড়ো হয়েছে? কথা বলে খুব? স্কুলে যায়? কোন ক্লাসে রে? আমি তো ভেবে রেখেছি, আমার একটা ছেলে হলে ওর নামটা তোর নামেই দেবো। সে-ও হবে তোরই মতন মস্ত মানুষ! ডাক্তারের বারণ-টারণ শুনিস তো, না? মিষ্টি আজও খাস বাড়িয়েই? সুগার কি হাই? না কি এখন ঠিকই আছে? জানিস, মিষ্টি দেখলেই তোর কথা খুব মনে এসে যায়! স্কাই-ব্লু পাঞ্জাবিটা পরিস আজও? পরিস ওটা, ওতে তোকে মানায় রে খুব! যে বইদুটো পাঠিয়েছিলাম, দেখেছিস খুলেও? না কি অবহেলায় ফেলে রেখেছিস বুকশেলফের একটা কোনায়? দেখা তো হয় কত জনেরই সাথে! তবু আজও এমন কাউকেই পেলাম না রে, যে আমার বুকের মধ্য থেকে কথা টেনে নেয় ঠিক তোরই মতন! তুই-ই প্রথম, আবার শেষও তুই-ই! আর কেউই পারেনি বুঝতে আমায় আমার মতো। এ জীবনের প্রথম যে আঘাত, পেলাম তা-ও তোরই কাছে। বোঝা না-বোঝার মাঝগলিতে এভাবে আমাকে ফেলে গেলি তুই কার ভরসায়? তোর বুকের পাঁজরগুলি কখনও আমাকে ডাকে না রে…ভুল করেও? এই দশ বছরেও? আমি এখন সংসারী রে! তোর জন্য পাগলামিটা আর করি না। তুই চেয়েছিস, আমার একটা সংসার হোক, নিজের একটা ঠিকানা হোক। হয়েছে সবই! নতুন সংসার হলো, পাকাপোক্ত একটা ঠিকানাও হলো। অনেক বছর আগে আমার নামহীন একটা সংসার ছিল, ঠিকানাবিহীন প্রেম ছিল! সেই সংসারটা আজ কেমন আছে? ওখানে এখন কে থাকে রে? কত কত নরম আবেগের মাটিতে গড়া ঘরটা আমার! আমার এখন বর হয়েছে, আর তুই হয়েছিস পর! তোরও এখন ঘর হয়েছে, আর আমি হয়েছি ভুলে-যাওয়া এক ঝড়! পেয়েছি যা-কিছু, তা কেবলই টানতে থাকে পাইনি যা যা! পেয়েছিস যেটুক, আমায় পেলে সেটুকে বুঝি কম পড়ত? জানি, চোখটা সরিয়ে নিলেও আমাকে তুই ঠিকই চিনেছিস! তুই তো সেই কবে থেকেই বুকের মধ্যে ভালোবাসার আবাদ করেও চোখদুটোকে স্থিরই রাখিস! ওসব আমি বুঝতে পারি। বুকের মধ্যে যদি না মোচড় দিত, চোখের কোনায় যদি না পুরনো দাগটা লেপটে থাকত, তবে কি চোখদুটোকে অমন করে রোদচশমায় ঢেকে দিতিস? আজ তুই অমন পালালি কেন? নিজের ভয়ে? সময়ের জালে আজ দু-জনই কেমন ধরা পড়েছি! কার বুক পুড়ল কতটা, কতটা চোখ ক্ষয়েই গেল, সেসব শুধুই সময় জানে! আগের মতোই, আমি নানান কথায় বকছি এত, আর তুই চুপ থেকেও গড়ে নিচ্ছিস কথার পাহাড়! তোর এই শব্দহীনতা আমার সকল শব্দের চেয়েও জোরালো বেশি! আমি ভাবি, তুই আমায় ভুলতে চেয়েও উলটো আরও বেশিই ভাবিস। যদি তা না ভাবিস, তবে আমার চোখে চোখ পড়তেই কেন চোখটা সরাস অমন করে? অবহেলা তুই যতই করিস, বুকের মধ্যে পাহাড়সমান দুঃখ নিয়ে তুই আজও আমায় ভাবিস। এটুক অনুমিত বোধ বেঁচে থাকুক কয়েকটা যুগ…অনন্ত এক স্বাক্ষর হয়ে…তোর আমার নামহীন এই ঘরসংসারে। ওরা বলে…পরের জন্ম! আমি মানিই না এই পরের জন্ম! আমাদের অদেখা সংসারটা হোক এই জন্মেই! একদিনের প্রেমটা ছুঁয়ে দেখুক অমরত্বের সবকটা ফুল! প্রেমটা হতে বছরের পর বছর লাগেই…অমন করে কারা যে ভাবে! কত কত সত্যিকারের প্রেম হয়ে যায় একনিমিষেই! রাত জেগে লিখিস আজও? অভ্যেসটা আছে এখনও? লেখাশেষে পড়ে এখন কাকে শোনাস? নির্ভার এক আশ্রয় পেতে এখন লুকাস কার বুকে রে? সে-ও কি তোকে আমার মতন হাজার পৃষ্ঠা পড়েই ফেলে ক্লান্তি ছাড়াই? না কি কেবল পড়ে ফেলার ভানটাই করে? ‘ওয়েটিং ফর গডো’ নিয়ে আজও গল্প করিস? জানিস, ওই গডোই আমার তুই, আমার তুমি; একান্ত ব্যক্তিগত! দিন পেরিয়ে ঘুরল বছর তোরই আশায়, এলি না তবু! এক তোকে ভেবেই কাটছে জীবন অন্য ঘরে! বুঝিস কিছু? আজ কি তুই বদলে গেছিস? গেলে গেছিস! বাঁচতে চাইলে বদলাতেই হয়! কিন্তু ভালোবাসাটা? সে-ও অমন বদলেছে কি? সময়ের কি ক্ষমতা অতই! মন খারাপের দিনে, কেউ চায় তোকে অতটা কাছে? অমন করে জাপটে বুকে হৃৎকম্প শোনায় সে-ও? মনে দুঃখ এলে কাকে দেখাস? নতুন মানুষ দুঃখ বোঝে? না কি কেবল সুখই কুড়োয়? তোর জীবনের নতুন আলো…সে কি আমার চেয়েও অনেক ভালো? আমি নাহয় খারাপই ছিলাম! তা-ও তোকে না পেয়েও পেয়েছি যত, নতুন মানুষ, ভালো যে মানুষ…সে আজও পেয়েছে তত? তোর মনের ভেতর বিনা নোটিশে যেমনি ঘুরি, তেমনি করে ঘুরে বেড়াতে পারে কি সে-ও? পারে সত্যিই? যে ভালোবাসে না, সে অনেক পেয়েও পায় না কিছুই! ভালোবাসে যে, সে কিছু না পেয়েও পায় অনেকটুকুই! এ জীবনে পাইনি তোকে, তবু তোকে ছাড়া আর পাইনি কিছুই! পেয়েও তোকে পেয়েছে কি সে এর সিকিটুকও ভাগ? হিসেবটা আজ থাকুক তোলা! সময় হলে সময় এসেই হিসেব দেবে! আজ বছর দশেক পর… তুই আজও আমার ঘর! এ জীবনে যে মানুষটা হয়েছে আমার পর, আরেক ঘরে থেকেও ভাবি, সে-ই আমার বর!