ফোন করতে চায় না যারা

কিছু মানুষ আছে, যাদের কাউকে ফোন করতে ইচ্ছে করে না। নেহায়েত বাধ্য না হলে ওরা কাউকেই সাধারণত ফোন করে না। ওদের কেউ ফোন করুক, খোঁজখবর নিক, এটাও ওরা চায় না। কেউ ওদের নিয়মিত ফোন করবে, এমন কোনো প্রত্যাশা ওদের নেই; এবং ওরা এটাও চায় না যে, কেউ ওদের কাছ থেকে নিয়মিত ফোন পাবার প্রত্যাশা করুক। শর্তহীনতাই ওদের জীবনের একমাত্র শর্ত।

ধরে নিচ্ছি, আপনি ওদের দলে।

পড়াশোনা বা কাজের প্রয়োজনে আপনি বাড়ি থেকে দূরে কোথাও থাকেন, মানে সময়ের বা জীবিকার তাগিদে আপনাকে বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। বাড়িতে গেলে আপনি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পান, আপনার বাবা দিনদিন আরও বুড়ো হচ্ছেন, মায়ের শরীর আগের মতো আর চলে না। ওঁদের কাজ করার সামর্থ্য, মনে রাখার ক্ষমতা, হাঁটাচলার স্বাচ্ছন্দ্য কিছুই আর আগের মতো নেই। ওঁদের বয়স হয়েছে। বয়স কখনও চিকিৎসায় সারে না। আপনি জানেন, হুট করে আপনি একদিন ওঁদের হারিয়ে ফেলবেন। সেদিন হাত বাড়ালে শুধুই শূন্যতা।

তবুও, বাড়ি থেকে ফিরে যাবার পর ওদের ফোন করতে আপনার মনে থাকে না কিংবা ইচ্ছে করে না। ফোন করেন ঠিকই, তবে সেটা মাঝে মাঝে। আপনি কাউকে নিয়মিত ফোন করার মানুষ নন। ফোন দেওয়া না দেওয়া বা ফোন পাওয়া না পাওয়া আপনার কাছে ভালোবাসা বা ভালোবাসাহীনতার মানদণ্ড নয়। কাছের মানুষ আর ফোনের মানুষ দুইটি পৃথক সত্তা। হৃদয়ে রাখার প্রমাণ ফোনে রেখেই দিতে হয় কি? (ফেইসবুকে বাঁচে ও বাড়ে যে ভালোবাসা, তা নিয়ে লেখার রুচিও হচ্ছে না, তাই ওটা নিয়ে আর লিখলাম না।)

তবে হ্যাঁ, আপনার এই বৈশিষ্ট্যটি তাদের কাছে একটু বিরক্তিকর, যারা আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকে, যদিও আপনি ওদের ফোনের অপেক্ষায় থাকেন না। বাবা-মা একসময় মেনে নেয়, আপনি এরকমই। ফোন না করলেও ওঁরা ঝামেলা করেন না, বাড়িতে গেলে ঠিকই বুকে টেনে নেন। কিছু মুখে দেবার সময় আপনার মুখটি ওঁদের চোখে ভাসে। ওঁদের প্রার্থনায় আপনি সবসময়ই থাকেন। ভালোবাসা এখানে হৃদয়ে লালিত, মুঠোফোনে পালিত নয়। এ ভয় নয়, এ প্রেম। এমন পুরোপুরি প্রত্যাশাহীন ভালোবাসা আর কোথাও পাবেন না। রাগকে জিইয়ে রাখার বা জিতিয়ে দেবার নাম ভালোবাসা নয়। ভালোবাসায় কীসের অত ইগো?

কথা এটা নয়। কথা হচ্ছে, এই আপনিই আবার বাধ্য হয়ে একজনকে প্রতিদিনই নিয়ম করে ফোন করেন; তার ফোন ধরেন প্রতিদিনই (এবং অনেকটা ধর্মপালনের বাধ্যতায় একদৌড়ে সঙ্গে সঙ্গেই ধরেন), ধরতে না পারলে কলব্যাক করতে না পারা অবধি ভয়ে হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়; সে ফোন করলে যদি আপনি ওয়েটিং-এ থাকেন, তবে সে কী ভাবল, এই টেনশনে আপনার ঘাম ছুটে যায়---যদিও আপনার মোবাইলে জরুরি বা অজরুরি ফোন আসতেই পারে এবং তার মোবাইল কখন ও কতক্ষণ ওয়েটিং-এ আছে কি নেই, তা নিয়ে আপনার বিন্দুমাত্রও কোনো আগ্রহ বা মাথাব্যথা নেই। এখানে ভালোবাসা নেই, ভয় আছে। ভয়টা কীসের? ঝামেলা পোহাবার, কষ্ট সহ্য করার, অশান্তির মধ্য দিয়ে যাবার। সে ভালোবেসে অ্যাটেনশন চায়, আপনি ভয়ে অ্যাটেনশন দেন। এ বড়োই চমৎকার!

দিনশেষে, মানুষ ভালোবাসা নয়, শান্তি চায়। শান্তির স্বার্থে মৃত্যুকে মেনে নিতেও তার আপত্তি থাকে না।

প্রায়‌ই দেখা যায়, ভালোবাসার সম্পর্কগুলিতে ভালোবাসার চাইতে একজন পলায়নপর মানুষের অসহায়ত্ব বেশি থাকে। ভালোবাসা না পেলে জ্বালা, আর পেয়ে গেলে জ্বালা প্রোম্যাক্স!

যাঁদের সাথে জন্মের পর থেকে আপনার সম্পর্ক, তাঁদের চাইতে হাজার গুণ বেশি যোগাযোগ রাখতে হয় তার সাথে, যার সাথে আপনার পরিচয় বা সম্পর্ক মাত্র কয়েক মাসের বা বছরের! স্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাকরণ মানলে, আপনার (সত্যিকারের বা বাধ্যতার) প্রিয়তম বা প্রিয়তমার অনেক অনেক আগেই আপনি বাবা-মা’কে হারিয়ে ফেলবেন। অথচ, আপনাকে আপনার মতো করে যোগাযোগহীনতায় ডুবে থাকতে দেন তাঁরাই বেশি, যাঁদের সাথে আপনার যোগাযোগ প্রকৃতির নিয়মেই ছিন্ন হবে অপেক্ষাকৃত আগেই। এর নামই বোধ হয় ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষটিকে নির্ভার রাখতে শেখায় না যা, তার নাম ভালোবাসা নয়। কাউকে ভালোবাসা দেখাতে ইচ্ছে করে, আর কাউকে ভালোবাসা দেখাতে হয়।

মানুষ ভালোবাসার নামে মানুষ রাখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই মানুষ পুষতে শুরু করে দেয়।