ফাগুনের পঁচিশ

সময়টা ফাগুনের পঁচিশ।


হঠাৎ বৃষ্টি! শেষরাত থেকেই একদম ঝুম বৃষ্টি। টুপ-টাপ-টুপ-টুপ-টুপ...অবিশ্রান্ত শব্দের মিছিল। মনে হচ্ছে, মাথার ভেতরে কেউ একটানা পিয়ানো বাজিয়ে চলেছে, থামবার নামই নিচ্ছে না সে-সুর! বন্ধ জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে বৃষ্টির সর্বকনিষ্ঠ সদস্যরাও এসে জুটেছে, সে কী উচ্ছ্বাস ওদের! আমার শরীরজুড়ে যেন ওদের নবান্নের মেলা বসেছে!


---আধভাঙা ঘুমে এসব সুখময় ভাবনা যেন আয়ুসির দুষ্টুবুদ্ধির গোড়ায় জল ঢেলে গেল! চোখ দুটো এখনো বন্ধ তার, কান কিন্তু সজাগ। মস্তিষ্ক মোটামুটি সচল, তবে অলস। সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভুতুড়ে অনুভূতি! চোখ বন্ধ রেখেই দুম্ করে বিছানায় পদ্মাসনের ভঙ্গিতে উঠে বসল সে, এরপর হাত বাড়িয়ে পাশের ডেস্ক থেকে খাতা আর পেনসিল বের করল। এবার সে অনুভূতির চেহারা আঁকবে!! অনুভূতি দেখতে খুউব সুন্দর হবে নিশ্চয়ই, অনুভবেই যখন এত তৃপ্তি!!


আচ্ছা, অনুভূতি কি ওর মতো দেখতে হবে?! ভেবেই লজ্জামিশ্রিত এক সুখে ভেসে গেল আয়ুসি। তার, আজও, নিজেকে অতটা সুন্দর ভাবতে বড্ড লজ্জা লাগে!


অনুভূতির চোখ দুটো কেমন হয়!? গোলগোল, না কি টানাটানা, ও-চোখের ঘনকালো পাপড়িও হয় বুঝি!? নীলাক্ষি সে? না কি বাদামী চোখের? না কি ওর মতোই কুচকুচে কালো চোখ তার!? দেখতে ভীষণ মায়াজড়ানো হবে? না কি গম্ভীর আর রাশভারী, বেশ রাগী রাগী?! চোখের ভাষা ঠিকঠাক পড়তে পারে তো সে? না কি শুধু ব্যাখ্যাই চাইবে ওর মতো!?


আর ভাবতে পারছে না আয়ুসি! কী মুশকিল রে বাবা!! কী এমন দেখতে তিনি, ভাবতেই মনে-মগজে জ্যাম লেগে যাচ্ছে রীতিমতো!! এমন একখানা ভাব দেখাচ্ছেন যেন ওর থেকেও সুন্দরী সে-মহারানি!!


দরজায় কড়া নড়ে উঠল।...কী রে আয়ুসি, উঠেছিস তো, মা? তোকে তো আবার বেরুতে হবে। একটু পর আবার নীরবতা। মা বোধহয় চলে গিয়েছে। কথাগুলো কানে যেতেই সম্বিৎ ফিরে এল তার, দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল চারিদিকে, কেউ শুনতে পায়নি তো! সে যে এতক্ষণ বিড়বিড় করেছে পাগলের মতো একা একা!! কী কাণ্ড কী কাণ্ড!! সে এবেলা কিনা অনুভূতির প্রতিমা গড়তে বসেছিল!?


হঠাৎ করেই তার বর্ষণের কথা মনে পড়ল। ওকে তো আজ 'শুভ সকাল' লিখেও পাঠাল না সে!!


অ্যাই শয়তান! ঘুম ভেঙেছে তোমার?


...মেসেজটা সেন্ড করতে গিয়েও করল না আয়ুসি। হাত দুটো শক্ত হয়ে এল, বুকের মধ্যে কেউ যেন খুব বিশ্রীভাবে হাতুড়ি-শাবল চালাচ্ছে অবিরাম, দু-চোখ বেয়ে বারিধারা নীরবতার সাক্ষী হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল বাধাহীনভাবে! তার মনে হতে লাগল, মাথার উপরে আকাশটা তো নেই, পায়ের নিচে মাটিও শেষে হারিয়ে গেল, সে যেন শূন্যে ভাসছে পালকের মতো!! চারপাশে সকালের নরম আলোর ছটা, কিন্তু আয়ুসির কাছে কেমন যেন বিদঘুটে রাক্ষুসে অন্ধকার ঠেকছে সে-ছটাকে!!


হায়, বর্ষণের ফোনটা যে তার বালিশের পাশেই পড়ে থাকে আজ বছরখানেক!! কে দেখবে, কার কাছে যাবে এই বার্তা?! তার মানুষটা যে মুঠোভর্তি স্বপ্ন আর হৃদয়ভর্তি কান্না নিয়েই মৃত্যুপুরীর বাসিন্দা হয়েছে সেই কবে!! একটা অ্যাকসিডেন্ট, একটা অধ্যায়ের যবনিকাপাত!!


নতুন ডায়েরির পাতাগুলি হাওয়ায় ওলটাচ্ছে একটা একটা করে, দ্রুত! অথচ, আয়ুসি যেন এখনও রয়ে গেছে সেই পুরনো ডায়েরিতে!


আজ ফাগুনের পঁচিশ, বর্ষণের জন্মদিন। রুমের দরজা-জানালা বন্ধ করে খুব গোপনে একজন মৃত মানুষের জন্মদিন পালন করার এমন ধরনের 'বাধ্যতা'---এর চাইতেও বড়ো দুঃখ হয় পৃথিবীতে?


'কয়টা যেন মোমবাতি কিনতে হবে এবার?' বর্ষণের ফোনটার দিকে ঠায় তাকিয়ে ভাবতে থাকে আয়ুসি...