পড়ন্ত ইশারাতে, অনন্ত মৃত্যুতে

 
আচ্ছা, তোমার ওখানে কি এখন অনেক আলো? রাশি রাশি সাদারঙের আলো? দিনকে রাত করে দেয়, রাতকে দিন করে দেয়…এমন আলো?
তোমার সারাগায়ে সেই আলোর রেশমিরেখার রেশ ফুটেছে, চোখগুলো আরও দিচ্ছে ঝলক, গোলাপি ঠোঁটে আরও লালচে আভা…হচ্ছে ওরা আরও দিব্যি রাঙা!
পুরো ঘরটা জুড়ে ছড়ানো-আলোর শেষবিন্দুটাও মেখেছ গায়ে, কী এক অপূর্ব আভায় মিশে আছ তুমি চেয়ারটাতে…যেন মৌচাক এক---সোনালিরঙের!


ইস্‌! কী যে সব যাচ্ছি বলে! আমি এখনও তোমায় দেখিই তো নি!
তবু দেখো, তুমি আমার খুব যে চেনা, যেন চিরদিনেরই!
সেই পুরনো ছোঁয়া, সেই পুরনো হাসি, সাথে একচিলতে চেনা রোদ্দুর…
চোখ দুটোকে ঝলসে-ফেলা সেই নরম আলোর সর্ষেরাঙা সকালবেলা, ডাহুকডাকা ক্লান্তদুপুর,
সাদাবকের ডানায়-ওড়া বিকেলবেলা…আহা, ওরা আমাদের কেমন ছুঁত,
অবাধ্য সব গ্রাম্যছেলের বৃত্তাকারের চাকায়-ঘোরা, তার পেছন-ছোটা, বাড়িতে-ফেরা সন্ধেবেলা,
মায়ের তুলসীতলার দীপ-কাঁপানো সেই শিখাটি…
এগুলি তো সব পুরনো হিসেব, এই হিসেবমাঝেই
নীলরংকে সোনালিপ্রেমে সাজিয়েছি তার দহনবেলায়…মৌনী আগুনের বুকটা চিরে!


সে যা-ই হোক না, সত্যি কি তুমি জানতে চাও না…
আমি এখন কেমন আছি, কীভাবে আছি, কোথায় আছি?
আমি তো জানি, যা দেখেছি তোমার গভীর-চোখে,
যদি আস্থা রাখি সেই দেখার উপর, তবে বলব,
তোমার ওই ঠোঁটের আড়াল সরিয়ে দেখো, সেখানে জমেছে অনেক কথার বসত,
আমি বেঁচে আছি ঠিক কতটা জুড়ে, তার সবটাই তোমার জানার আশা…
যদি এইটুকু হয় মিথ্যে সবই, তবে তুমিই বলো, কতকটা চাও, কোন নিয়মে!
আজকে নাহয় আমার ব্যথা যা আছে, সাজাব সেটুকই তোমার ছোঁয়ায়!


আমি এখন বার্থডে-কেকের ক্রিমের মতোই ঘন, অস্পষ্ট, অভেদ্য, এবং নরম এক অন্ধকারে বসে আছি।
ভাবছ তুমি, এ আবার কেমন আঁধার…ক্রিমের মতো!
জানো, এই আঁধারই আমি বড় ভালোবাসি…তোমায় ভালোবাসি তাই,
যেদিন তুমি আসবে এখানে, সেদিন আমরা দুজন মিলে সেই শুভ্রসাদা বিজলিআলো মাখব গায়ে,
যেন হাজার বছরের পুরনো সেই আঁধারফেড়ে আমি এক মানুষী---সদ্যোজাত!
সেই মানুষী হয় উজ্জ্বল শুধুই তোমার আলোয়, হয় পবিত্র শুধুই তোমার ছোঁয়ায়,
তোমার অযত্নেও বাঁধানো-ফ্রেমে থাকে আটকে উপকথন, সে যে কেবল ভালোবাসারই!


তুমি ভাবছ নাকি আমি বুঝি অন্যগ্রহের? এত এত আজব কথা এই গ্রহটার কোন মানুষ বলে?
তবে বলছি শোনো, চুমুতেও নয়, নয় নিছকই শরীরে কেবল, শিহরণের গণ্ডি আমার আরও অনেক দূরে…
অনুভূতিটুক কেবল আলো-আঁধারেই আটকে থাকে, ওখান থেকে বেরোয় না তো!
বাতায়ন-পাশে তোমায় নিয়ে বসব যখন, তুমি তোমার নিবিড়শ্বাসে আমায় ছোঁবে,
তুমি যখন আসবে কাছে, তোমার পায়ের আওয়াজ করবে ব্যাকুল, ভরবে আমায় পূর্ণতাতে,
…তখন খুব দুষ্টুমিতে কেউ ভেতর থেকে চাহনি ছুড়ে বলবে হেসে,
এখনও ঠায় বসেই আছিস! শাড়ির ভাঁজে গা জড়াবি, চোখের সীমায় আঁকবি কাজল…বলি, কী এক পাগলি রে তুই! এসব তুই করবি কবে? আসছে যে সে!


সত্যি আমার তখন যে কী লজ্জা লাগে!
মনের ভেতর ঘুরতে থাকে বোধের মিছিল অশান্ত এক তপ্তশ্বাসে!
এক-পা এগোই, দিই আর একটা-পা, এমনি করে এগিয়ে গেলে মনে এসে যায়,
আজ পিছলে আঁধার ভীষণ ধবল জ্যোৎস্না হবে চাঁদের স্রোতে,
সেই স্রোতের ভিড়ে দেখবে, এসো…আমি কেমন পূর্ণ হব, জ্যোৎস্নাস্নানে শুদ্ধ হব…
যদি তুমি সত্যি তাকাও এই পোড়া দুচোখে, তখন আবার ফাটব ক্রোধে---অমন করে দেখছটা কী! এখনও কী কী নেওয়ার বাকি?
তবে আজকেই আমায় একাকিত্বের তীর ছুড়বে? ছুড়ো তো দেখি, সাহস কত!
আজ এই শরীরে ছোঁয়াতে দেবো না ব্যথার বৃষ্টি…পৃথিবী যদি ভুলও ঘোরে!
আজকে আমায় থাকুক ঘিরে আমার সকল ছোঁয়ার, অনুভবের জ্যান্ত যা শ্বাস!


এই যে আমি শাড়ির ভাঁজে নিজেকে কেমন খুব মুড়েছি,
এই যে পায়ে পরেছি নূপুর, মেখেছি খোঁপায় বকুলের ঘ্রাণ,
এই যে আমি ছুঁইয়েছি দুঠোঁটে গোলাপ-পরাগ---
করেছি এসব কার জন্য? বোঝোনি কি দেখেও?
তোমার বোকা বোকা ওই চোখের তারা বোঝে না কিছুই!


শুধুই আকাশের নীলে ভাসলে বলো চলবে কেন?
শুধু মায়ামুখেই দৃষ্টি ছুড়ে রাজ্যজয়ের উড়বে নিশান?
একটুখানি ভালোবাসতে জানতে যে হয়,
একটুখানি প্রতীক্ষারও প্রহরগোনা শিখতে হবে,
একটুখানি পথের দিকে তাকিয়ে থেকে কানটা পেতে পায়ের আওয়াজ শুনতে হবে!
…বুঝেছ কি তারা! বুঝেছ কি নীল! বুঝেছ কি চাঁদ!
হে নীরবতা, বুঝেছ কি তুমিও!


ঢের হয়েছে! আর বুঝতে হবে না! আজ আমার হাতে অনেক কাজ পড়েছে!
তার জন্যে সাজাতে হবে ফুলের বাসর, আদরের নরম চাদর মেলে আজ তাকে ঘুমুতে দেবো!
ঝরা-টগরের গাঁথব মালা, হলদে-গাঁদার বানাব পাটি…
সে আসবে যখন, তখন কোথায় তাকে বসতে দেবো! বোঝ না কি তাও?
নীলকণ্ঠ এনেছ তো? দেরি কেন গো? বেলা হচ্ছে, বরণডালা সাজিয়ে ফেলো!


আজ আমার জগতটাকে খুব সাজাব নিজের খেয়ালমতো,
এই হৃদয়ের চারখণ্ডে চারটি ভাগে সাজাব বাসর,
স্পন্দিত আধধরা স্বরে অব্যক্ত যত কথার মালা, পরাব তাকে,
এই দুচোখের মিশকালো সুতোয় বোনা যে বাগান, তার কথাও বলব তাকে,
তখন তার হাত দুটোকে শক্ত করে ধরব চেপে বুকের ভেতর!
এই বুকে এক ঝরনা আছে, সেখান থেকে শান্ত-করুণ শব্দতেজে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে চারিদিকে!


আমার যত অপূর্ণ কাজ, আজ সমাপ্ত হোক এইখানেতেই!
জীবন-সীমানায় দাঁড়িয়ে জীবন আজও কেন প্রান্ত খোঁজে?
আমার যত দায়িত্বতে পেয়েছ আমায়, বিদায় বলো ওসব এখন!
আমার আগলে-রাখার সব চেষ্টা, সব আর্তি আজ পূর্ণতা পাক,
সে আশাতেই আমি এক ক্লান্তপথিক টানছি রেখা---স্বস্তিসুখের!