প্রেম নয়, ইগো

: হ্যালো শুনছেন?

: হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি৷ আপনি কে বলছেন, প্লিজ?

: রাত দেড়টা বাজে৷ আপনি জেগে আছেন কেনো? ঘুমাবেন না?

: আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না৷

: চেনার দরকার নেই৷ গল্প করবেন?

: না৷ আমি রাখছি৷

বলেই ফোন কেটে দিলাম৷ সেসময় মেয়েদের ফোন কাটলে মনে হতো, দুনিয়ার সব মেয়েই আমার জন্যে দিওয়ানা৷ অল্প বয়সের অদ্ভুত অহংকারী ইগো৷

দুইদিন পর৷

: যদি ফোন কেটে দেন, আমি আপনার বাবার সাথে সরাসরি কথা বলবো৷ উনাকে সব বলে দেবো৷

: মানে??

: আপনি আমাকে চেনেন৷ আমার সাথে কথা বললে কী সমস্যা?

: আচ্ছা বলেন৷

: ভয় পেলেন? হিহি…..

কথা চলল৷ অল্পবয়েসি মেয়েদের মাথায় ছিটটিট থাকে৷ আগপাছ না ভেবেই ঝামেলা বাধাতে পারে৷ ও যদি বাবার নাম্বার যোগাড় করে বাবাকে সত্যি-সত্যি ফোনটোন করে বসে, বাবা ভাববে, কাউকে পছন্দ করি এটা সরাসরি বলার সাহস আমার নাই৷ আমি ইচ্ছা করে মেয়েটাকে দিয়ে বলাচ্ছি৷ প্রেস্টিজ থাকবে না৷ খুবই বিশ্রী ব্যাপার!

আরেকদিন৷

: আমার পরিচয় জেনে কী হবে?

: আমি অচেনা মানুষের প্রতি ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা, কোনওটাই বোধ করি না৷

: আপনি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ দেখেননি? আমাদের প্রেমটা ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ টাইপ প্রেম৷ হিহি….

: মুভিটুভিতে নায়কনায়িকা দু’জনেই সুন্দর থাকে৷

: আপনি সুন্দর না হলেও আমার কোনও সমস্যা নাই৷ হিহি ……

(চুপ করে থাকলাম৷ মেয়েটার সেন্স অব হিউমার আছে৷ তার মানে, ওর সুন্দরী হওয়ার চান্স কম৷)

: চুপ কেনো? হিহি …… আচ্ছা, আপনি কী করছিলেন?

: গান শুনছিলাম৷

: কার গান?

: জগন্ময় মিত্রের৷

: ও …..

: উনার গান কেমন লাগে আপনার?

: হুঁ, ভালো৷

(কণ্ঠস্বরে মনে হলো, বানিয়ে বলছে৷)

: কোনটা সবচে’ ভালো লাগে?

: আসলে আমি উনার নাম শুনিনি৷

(আমি চুপ……..)

: চুপ কেনো?? আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি শুনে নেবো৷ উনার নতুন অ্যালবাম বের হলে আমিই আপনাকে কিনে পাঠাবো৷

: উনার অ্যালবাম আর বের হবে না৷

: কেনো? উনি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন??

(মেজাজ খারাপ হলো৷ জগন্ময়ের ভূতও ততোদিনে মরে ভূত হয়ে গেছে৷ তবে মেয়েটার গুণ ছিল৷ রেজাল্ট খুব ভালো৷ প্রচুর বই পড়তো—সবই মেডিকেলের বই৷ এবং সে রবীন্দ্রনাথের নাম জানে৷ এও বিশ্বাস করে, রবীন্দ্রনাথের লেখা নিশ্চয়ই ভালো৷ নইলে অ্যাতো লোক ওগুলোকে ভালো বলবে ক্যানো? ওকে ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ সহ আরও কয়েকটা মুভি দেখতে বলতে-বলতে ক্লান্ত হয়ে একসময় বলা ছেড়ে দিই৷ ও থাকুক ওর মতো৷ তবে ওর খুব ভালো একটা দিক হলো, ও ভালোবাসতে জানতো, আর ভালোবাসতো৷ খুব ভালো রেজাল্ট-করা ছেলেমেয়েদের সাথে প্রেম করা অনেকসময়ই একটা বিরাট শাস্তি৷ ও ওরকম নয়৷ আমিই গাধার মতন করে ভাবতাম৷)

সুখের ব্যাপার, আজকে ওর চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী৷ ওর বিয়ের ঘটকালি করি আমি নিজেই৷ আমি চিটাগাং কলেজে পড়ার সময় এক বন্ধুকে বলেছিলাম, কিশোর কুমার খাতুনগঞ্জের বড়ো চাল-ব্যবসায়ী৷ শখের বশে গানটানও করেন৷ ওয়াকম্যানে উনার আজ এই দিনটাকে শুনে ও রীতিমতো মুগ্ধ৷ আমার বন্ধুটি কিশোর কুমারকে চিনতো না৷ (সত্যিই চিনতো না৷) অমন চালের ব্যাপারি অ্যামেচার গায়কের প্রতি শ্রদ্ধায় ওর মাথা নত হয়ে গিয়েছিল সেইদিন৷ চিটাগাং কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সামনে যে কলাপসিবল্ গেটটা সবসময় বন্ধ থাকতো, সেটার সামনের সিঁড়িতে বসে আমি আমার ভালোমানুষ টাইপ বন্ধুটিকে বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে ওসব বলেছিলাম৷ সেইদিন আশেপাশের বান্দরগুলোও অতিকষ্টে হাসি চেপে রেখেছিল৷ আমি বরাবরই খুব গুছিয়ে সত্যের মতো করে সিরিয়াসলি এবং সিনসিয়ারলি হার্মলেস মিথ্যা কথা বলতে পারি৷

বন্ধু, আজকের দিনে এটাই চাওয়া, তোদের ছেলেমেয়েকে অন্তত লতা-কিশোর শুনিয়ে বড়ো করিস৷

শ্রীজাত তাঁর কবিতায় (কোনও মেয়েকে) জিজ্ঞেস করছেন,

শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি, এমন কেউ

তোমায় যদি প্রোপোজ করে, কী করবে……

আজকের দিনে যখন প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’জন করে বন্ধু কিংবা ছোটোভাই তাদের বিয়েতে দাওয়াত দেয়, যখন দেবদূতের মতো দেখতে বন্ধুদের কিডসের ছবিতে লাইক দেই, যখন দেখি আমার পাড়ায় আমাকে দাদা ডাকার লোক কমে গেছে, স্কুলগোয়িং অল্পবয়েসীরা আঙ্কেল বলেটলে, যখন বিয়ে ঠিক হয়ে-যাওয়া বন্ধুরা বলে, আগে ‘না’ করে দেয়া অনেক ছেলেই কিংবা মেয়েই এর চেয়ে বেটার ছিল, তখন শ্রীজাতকে বলি, ও ‘হ্যাঁ’ বলার মতো কেউ হলে ওকে শঙ্খ ঘোষ পড়তে দেবো৷ (অনেক হয়েছে……..) বেশিরভাগ মেয়েই কিন্তু আস্তে-আস্তে তার ভালোবাসার ছেলেটার মতো হয়ে ওঠে৷