প্রেম কী?

 সুখী মানুষ প্রেমে কম পড়ে। যার দুঃখ যত বেশি, দুঃখ কমানোর আশায় সে তত বেশি কাউকে তার জীবনে খোঁজে। এমনও হয়, হয়তো কারও মধ্যে এমন একটা বিষণ্ণতা ছিল, যা সে কখনও ওরকম খেয়াল করে দেখেইনি! আমাদের সবার মধ্যে এরকম কিছু বিষণ্ণতা থাকে, যা কিনা আপনাআপনিই ঠিক হয়ে যায়, কিংবা ঠিক হয়ে যায় না যদিও, তবু তা অতটা প্রকট কিছু নয়, যা আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে দেয়!
  
 তো যা বলছিলাম। মানুষ যখন কারও প্রেমে পড়ে যায়, তখন সে হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে, তার ভেতরে এমন একটা ভালোলাগার সৃষ্টি হয়েছে, যে ভালোলাগাটা যে তার দরকার ছিল, তা সে নিজেই জানত না, কিংবা ওভাবে করে এর আগে খেয়াল করেনি। প্রেম আমাদের মধ্য থেকে কখনও কখনও এমন একটা শূন্যতা দূর করে দেয়, যে শূন্যতার কথা আমরা নিজেরাই জানতাম না, জানলে হয়তো আরও আগেই এটা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম, কেননা এটা সরে যাবার পর আমাদের ভালো লাগছে।
 তাই বলা যায়, প্রতিটি প্রেমই মূলত বিষণ্ণতা বা শূন্যতা দূরে সরানোর একটি গল্প। আমরা কাউকে পাশে চাই, কেননা আমরা জীবনের কী-একটা যেন খুঁজে পাই না। কী যে খুঁজে পাই না, তা আমরা নিজেরাও জানি না! এমনও হতে পারে, আমরা আসলে খুঁজিই না, কারণ কিছু তো আর হারাইনি যে খুঁজব!
 আর কিছু হোক না হোক, আমরা সবাই-ই আসলে এমন কাউকে খুঁজছি যে আমাদের বলবে, 'হ্যাঁ, আমরা দু-জন ভালো আছি। আমরা আরও ভালো থাকব। তুমি খুব চমৎকার কাজ করছ, আরও করে যাও। আমি আছি না পাশে!' এই কথাগুলি খুব গতানুগতিক কথাবার্তা হলেও মানুষ সত্যিই চায়, কেউ তাকে এসব বলুক। ওরকম কাউকে পেয়ে গেলে তখন তার সঙ্গেই থেকে যেতে চায়, যাকে আমরা প্রেম বলি।
  
 প্রেমের শুরুতে কিন্তু অনেকসময় বিষণ্ণতা উলটো বেড়ে যায়। সম্পূর্ণ অপরিচিত দু-জন মানুষ যখন সম্পর্কে জড়ায়, তখন তো ওদের পরস্পরকে বুঝতেও একটু সময় লাগে। সেই সময়টাতে ওদের মনে হতে থাকে, ভুল করছি না তো? তারপর যখন দু-জনের বোঝাপড়ার জায়গাগুলি ক্রমশ স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, তখন ওদের সমস্ত ভাবনা ও যাপন পরস্পরের উপর অনেকটাই নির্ভর করে, আর শুরুর বিষণ্ণতা পরিণত হয় তৃপ্তিতে।
  
 প্রেম ব্যাপারটা কেমন, আরও একটু ভেঙে বলি। ধরুন, আপনি কোথাও বেড়াতে যাবেন। তো বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলেন, রিকশার জন্য অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ একটা ব্যাটারিচালিত রিকশা চোখে পড়ল, যা কিনা সনাতনি রিকশার চাইতে জোরে ছোটে। এ ধরনের রিকশাও যে আছে, তা আপনি জানতেনই না। আপনি ওই রিকশায় উঠলেন। দেখলেন, এটাতে চড়তেও আরাম, ভাড়াও একই, সময়ও লাগে অপেক্ষাকৃত কম। এরপর কী হলো? আপনি যখনই রিকশায় চড়ে কোথাও যান, আপনি মনে মনে ওই ব্যাটারিচালিত রিকশাই খোঁজেন। এর কারণ, আপনি ওটাতে মজা পেয়ে গেছেন।
  
 ভেবে দেখুন, ওই রিকশার কথা কিন্তু আপনি আগে জানতেন না, কখনও কারও কাছ থেকে শোনেনওনি। সেই রিকশায় চড়ে আপনি এমন কিছু পেয়েছেন, যেগুলি রিকশা থেকে পাওয়া যে সম্ভব, এটা কখনও আপনার মাথায়ই আসেনি! এর মানে, আপনার মধ্যে অবচেতনভাবেই এরকম কিছু বিষয়ের চাহিদা ছিল, যা আপনি নিজেই জানতেন না। ওসব না হলেও আপনার দিব্যি চলে যেত, কেননা ওসব যে রিকশায় পাওয়া যায়, তা আপনি কোনোদিন ভাবেননি, কিংবা ওটা নিয়ে যে ভাবা যায়, এটাই কখনও আপনার মাথায় আসেনি। মানুষ যা সম্পর্কে জানে না, তা যতই কাজের হোক না কেন, তা না হলেও মানুষের দিব্যি চলে যায়। কিন্তু একবার তা নিয়ে জেনে গেলে তখন তা না হলে মানুষের চলেই না!
 প্রেমও অনেকটা এরকম। আমাদের মনের মধ্যে এমন কিছু বিষণ্ণতা আছে, এমন কিছু জিনিসের শূন্যতা তৈরি হয়ে আছে, যা সম্পর্কে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জানতেই পারি না, যতক্ষণ না কেউ বা কিছু-একটা এসে ওই জায়গাগুলি পূর্ণ করে দিচ্ছে।
  
 আমরা সবাই-ই, সত্যি সত্যি আমাদের মনের মতো কাউকে খুঁজে চলি। জীবনে কী যেন নেই, কী যেন নেই! কী যে নেই, তা আমরা বুঝতেই পারি না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা পেয়ে না যাই। আমরা জানিই না, আমরা কাকে চাই। তবে যদি এমন কেউ জীবনে আসে, যাকে পাবার পর আমাদের মনে হতে থাকে, 'হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তো এমন কাউকেই খুঁজছিলাম!', তবে এই ব্যাপারটাকেই প্রেম বলে।
  
 আমার স্বপ্নের মানুষের সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, এবং তার সঙ্গে সম্পর্কে থেকে যেতে খুব ইচ্ছে করে, তখন ওটাকে প্রেম বলে। তার মধ্যে যা যা আছে ও নেই, সে যেরকম ও যেরকম নয়, তাকে যেভাবে পেয়েছি ও পাইনি, এই বিষয়গুলির সবই হয়ে ওঠে একদমই মনের মতন। ওর দিকে তাকালে প্রায়ই আমার মনে হবে, আহা, মানুষটা ঠিক আমার মনের মতন! আমার আর কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই জীবনের কাছ থেকে। জীবনে আর কোনও ঐশ্বর্য না পেলেও আমার চলবে!
  
 মজার ব্যাপার, ঠিক যা যা পেয়ে আমি এতটা খুশি হয়ে উঠেছি, এসব যে আমার দরকার, কিংবা এসব পেলে যে আমার ভালো লাগবে, কিংবা এমন কেউ আছে যে পুরোপুরিই আমার মনের মতন, এইসবের কিছুই আমার কল্পনাতেও কোনোদিন আসেনি। যে অনুভূতিতে আজ আমি এতটা নিবিড়ভাবে আপ্লুত হয়ে আছি, সে অনুভূতিটাই আমার অচেনা। অনুভূতি যে এমন দারুণও হয়, এটাই তো এর আগে ভাবতেও পারিনি। জানতামই তো না, ভাববই-বা কীভাবে!
  
 তাকে দেখি আর ভাবি, সে আমার এমনই এক স্বপ্নের মানুষ, যে স্বপ্নটাই আমি কোনোদিন দেখিনি। তবু আমি নিশ্চিতভাবে জানি, মানে এখন অন্তত জানি, আমি মনে মনে এতদিন তাকেই খুঁজছিলাম, আমি বুঝি তারই অপেক্ষায় ছিলাম!
  
 চোখের সামনে লাঠিটা দেখতে না পেলে কার মাথায় আসত যে লাঠিতে ভর করে পাহাড়ে উঠলে কষ্টটা একটু হলেও কমে! অপরিচিত ভালো একটা বই পড়লে মনে হয়, হ্যাঁ, এই বইটাই তো আমার মন খুঁজছিল এতদিন ধরে! অপরিচিত ভালো একটা মুভি দেখলে মনে হয়, আহা, এই মানুষটা যেভাবে বেঁচে আছে, আমি তো ঠিক সেরকমই একটা জীবন চেয়েছিলাম! মুভিটা একদমই আমার মনের মতন! যখন একেবারেই অচেনা বিদেশি কোনও সুর ইউটিউব ঘাঁটতে গিয়ে চোখের সামনে হঠাৎ চলে আসে, এবং সেটা শুনে আমাদের খুব ভালো লেগে যায়, এতটাই ভালো যে, বার বার শুনতেই থাকি, তখন আমরা ভাবি, ইস্‌! প্রেমে পড়ে গেলাম সুরটার!...অথচ অমন সুরের অস্তিত্ব নিয়েই তো আমি আগে জানতাম না; ওরকম বাদ্যযন্ত্র যে পৃথিবীতে আছে, তা-ই তো জানলাম আজকেই! সেই আমিই কিনা ভাবছি, এই সুরের সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে গেছে!
  
 যে আমার জীবনে এখনও আসেইনি, আমি জানব কী করে যে সে এলে আমার কতটা ভালো লাগবে কি লাগবে না? যদি সে আসে এবং তাকে আমার ভালো লেগে যায়, তাহলে আমি কী সহজেই বলে ফেলি, আমি তার প্রেমে পড়েছি!
  
 প্রেম আমাদের মধ্য থেকে এমন এক বিষণ্ণতা দূর করে দেয়, যে বিষণ্ণতার খোঁজই আমরা কখনও জানতাম না! প্রেম আমাদের সেই শূন্যতাটা পূর্ণ করে, যে শূন্যতার অস্তিত্বই প্রেম আসার আগে কোনোদিন টেরই পাইনি!
 এ এক অপূর্ব জাদু! প্রেম হচ্ছে আপনার মনের এমনই এক অসুখের চিকিৎসা, যে অসুখটার কথাই আপনি জানতেন না! আপনার যে বিষণ্ণতার খোঁজ আপনি আজও পাননি, অথচ যা দূর হয়ে গেলে আপনি খুব ভালো থাকতেন, আপনার জীবনে প্রেম এসে সে বিষণ্ণতাটিই দূরে ছুড়ে ফেলে দেবে! আপনিই বলুন, পৃথিবীতে এর চাইতে বড়ো জাদু, অদ্ভুত রহস্য আর কী হয়!