প্রাণ যখন জীবন হয়ে ওঠে/ পঞ্চম অংশ


২০১। এমন কাউকে বিয়ে করা উচিত নয়, এক আপনার পেছনে পড়ে থাকা বাদে, যার নিজের আর কোনও পৃথিবী নেই। প্রত্যেকরই নিজের একটা পৃথিবী থাকতে হয়। সেই পৃথিবীতে ডুব মেরে থাকলে অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিসে চোখ আর পড়ে না, অহেতুকই বাড়তি ঝামেলা জীবনে ডেকে আনতে হয় না। মানুষ যা যা ঝামেলায় পড়ে, তার বেশিরভাগই সে নিজেই তৈরি করে। ব্যস্ত থাকলে ওসব ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ঝামেলা বাধানোর সময়ই হাতে থাকে না। যদি আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনীর পুরো পৃথিবীই হয় আপনাকে ঘিরে, তাহলে আপনি একসময় মহাবিপদে পড়ে যাবেন। তাই ব্যস্ত থাকার জন্য প্রত্যেকেরই নিজের একটা জগত থাকা ভালো। যে দাম্পত্যসম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জগত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কম, সে সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মানবোধ অনেক বেশি থাকে।
২০২। এমন নয় যে, শুয়োরের বাচ্চাদের শুয়োরের বাচ্চা না ডেকে বরাহশাবক ডাকলে ওদের মান বাড়ে কিংবা ওরা নিজেকে শোধরায়। বরং বরাহশাবক ডাকলে কিছু সহজসরল মানুষ ওদের চিনতে একটু বেশি সময় নেয়। যে যা ডিজার্ভ করে, তার সঙ্গে সেরকম আচরণই করা উচিত। ‘ঘৃণা করি’ আর ‘ঘেন্না করি’, এই দুইটি অভিব্যক্তি এক নয়। অর্থ এক হলেও প্রকাশের তীব্রতা পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেয়। এমন মানুষ অহরহই দেখতে পাবেন, যাকে নিয়ে বলতে গেলে ‘ঘৃণা’র বদলে ‘ঘেন্না’ কথাটা আপনাআপনিই মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে। ‘ঘেন্না’ শব্দটা উচ্চারণ করলেই মুখে কিছু থুতু এসে জমা হয় নিজের অজান্তেই, ‘ঘৃণা’ বললে যা হয় না।
২০৩। কারও পরিশ্রমের মূল্যায়ন করতে পারুন আর না-ই পারুন, কখনও অবমূল্যায়ন করতে যাবেন না। তার চাইতে বরং চুপ করে থাকুন। বাঁচবেনই-বা আর কয় দিন? গায়ে পড়ে কারও ঘৃণা, বিরক্তি আর দীর্ঘশ্বাস গায়ে মাখানোর কী দরকার? একটা সহজ বুদ্ধি শিখিয়ে দিই। আপনি যা বোঝেন না, তার মূল্যায়ন করার চেষ্টাও করবেন না। পৃথিবীর সব কিছু নিয়েই আপনাকে মতামত দিতে হবে না। জোর করে হলেও মেনে নিন, করার মতো আপনার অন্য কাজ আছে।
২০৪। আমাকে ভালোবাসার শর্ত যদি হয়, আমার কাছ থেকেও ফিরতি ভালোবাসা কিংবা সময় পাওয়া, তাহলে আপনার ভালোবাসার দরকার আমার নেই। এটাকে ভালোবাসা বলে না, এটার নাম হিসেব। ধরুন, আপনাকে কেউ ভালোবাসে। তো যে আপনাকে ভালোবাসে বা পছন্দ করে, সে নিজের ভালোলাগা থেকেই তো অমন করে, তাই না? এখানে আপনার কীসের দায়? আপনার প্রতি তার প্রত্যাশা কেন তৈরি হবে?
২০৫। অতীত ভুলে যাবার চেষ্টা করার কিছু নেই, বরং নিজের বর্তমান কাজে আরও কঠোরভাবে মনোযোগী হওয়া উচিত। অতীতের উপরেই তো বর্তমানটা দাঁড়িয়ে আছে। তা ভুলে যাবেন কী করে? অতীত যা শেখায়, তার উপর ভিত্তি করে বর্তমানের অনেক ভুল কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
২০৬। যদি কেউ আপনাকে কারও সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তবে নিশ্চিতভাবে না জানলে ওই ব্যক্তি নিয়ে একটিও মন্তব্য না করলেই ভালো। এতে করে যে আপনাকে জিজ্ঞেস করছে, সে-ও ভুল তথ্য পেয়ে বিভ্রান্ত হবে না, আবার যাকে নিয়ে আপনি না জেনে বলবেন, সে-ও অহেতুক বিব্রত হবে না। সবচাইতে বড়ো কথা, কোনও বিষয় নিয়ে পরিষ্কারভাবে না জেনে অনুমান বা শোনাকথার উপর ভিত্তি করে কথা বলে যারা, ওদের চাইতে জঘন্য নিকৃষ্ট মানুষ কমই আছে। আপনি চুপ থেকে কিংবা ‘জানি না’ বলে খুব সহজেই ওই বাজে লোকজনের দলে ঢুকে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন।
২০৭। আমাদের ভুলগুলো তখনই আমাদের কাছে ধরা পড়ে, যখন আমরা নিজের সব কাজের জন্য নিজের কাছেই জবাবদিহি করি। যে লোক নিজের কাছেই স্বচ্ছ নয়, তার পক্ষে বেশিদূর এগোনো অসম্ভব।
২০৮। আমার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যদি কিছুই না পাও, কিংবা নিজের মধ্যে কোনও ভালো দিকের জন্ম না হয়, তবে আমাকে তোমার কাছে অহেতুক ভালোমানুষটি করে রেখো না। জেনে রেখো, জীবনে কারও কাছে ঘৃণ্য বা অপ্রয়োজনীয় হওয়াটাও একটা অদৃশ্য যোগ্যতা। সেই যোগ্যতার বলে মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে কি এখন থেকে যাবে, না কি সরে যাবে?
২০৯। নিজের প্রয়োজন আদায় করতে সবসময় প্রতিবাদী মনোভাব না থাকলেও চলে। ভেবে দেখতে হবে, আপনার প্রয়োজনটা আপনার প্রাপ্য কি না। যদি প্রাপ্য না হয়, তবে তা নিয়ে তো কোনও প্রত্যাশা রাখাই চলে না, প্রতিবাদ করবেন কোন যুক্তিতে? আর যদি প্রাপ্য হয়, তবে শুরুতেই প্রতিবাদী না হয়ে বরং কৌশলী হওয়াটাই ভালো।
২১০। মানুষ ততদিনই বোকা থাকে, যতদিন না সে তার প্রয়োজনের প্রয়োজনীয়তা বোঝে। একবার বুঝে ফেললে তখন তা পাবার জন্য যা যা করা দরকার, সেগুলি করতে শুরু করে। আর যারা বোঝার পরও করে না, ধরে নিতে হবে, ওই সমস্ত প্রয়োজন না মেটালে যা যা ঝামেলা তৈরি হতে পারে, সেগুলি নিয়ে বাঁচতে তার কোনও আপত্তি নেই।
২১১। গায়ে পড়ে কখনও মাস্টারি করতে যাবেন না। যখন আপনি কোথাও গিয়ে গায়ে পড়ে উপদেশ বা পরামর্শ বিতরণ করেন, তখন মনে মনে আপনি যতই ভাবুন না কেন, আপনি অনেক কিছু এবং আপনি যেভাবে ভাবছেন, সবাই সেভাবেই ভাবছে, আসলে সবাই তখন আপনাকে ছাগল বাদে আর তেমন কিছু ভাবে না। বিশেষ করে, পরামর্শের দরকার হলে আপনার সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও যে লোকটা আপনার দ্বারস্থ হতেন না, তাঁর কাছে গিয়ে গায়ে পড়ে পরামর্শ দেওয়াটা খুবই হাস্যকর!
২১২। ভালোমানুষ হওয়া, ভালোমানুষ হয়ে বাঁচা, ভালোমানুষ থাকা খুবই জরুরি, কিন্তু সেটা একান্তই নিজের কাছে। অন্যের কাছে নিজের ভালোমানুষি প্রমাণ করতে যাওয়াটা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা। আপনি ভালো কি খারাপ, মহৎ কি নীচ, সৎ কি অসৎ, এসব নিয়ে কারুরই কিছু এসে যায় না যদি না আপনার সঙ্গে তার স্বার্থের কোনও সংশ্লেষ থাকে।
২১৩। হেলায় হারালে যা-কিছু আর কখনও ফিরে পাওয়া যায় না, শোধরাবার সময়টুকুও হয় না, তার প্রথমটি হচ্ছে আমাদের বাবা-মা। অন্য কিছুরই বিনিময়ে যেন এই দু-জন মানুষকে আমরা কখনও অবহেলা না করি, তাঁদের প্রতি অন্যায় আচরণ না করি। আমরা যেন স্বামী বা স্ত্রী হবার পরেও, প্রথমত বাবা-মা’য়ের সন্তানই থেকে যাই।
২১৪। কখনও কখনও, এই পৃথিবীতে আমাদের অবহেলার সবচেয়ে সস্তা জিনিস হয়ে ওঠে আমাদের বাবা-মা। মাকে খেতে দেয় না, একদিন টিন খুলে একমুঠো মুড়ি খেয়েছিল বলে মাকে আজও চোর ডাকে, এমন ছেলেও আমি দেখেছি। ওদের দিকে তাকাই আর ভাবি, ঈশ্বর বোধ হয় এখন ছুটিতে আছেন!
২১৫। প্রায়ই, আমরা আমাদের বাবা-মা’য়ের চেয়ে ভালো বাবা-মা হয়ে উঠতে পারি না। যখন আমরা নিজেদের দিকে তাকাই, তখন এটা খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারি। কেন পারি না? কেননা আমাদের জীবনে যত জটিলতা, ওঁদের জীবনে এর দশভাগের একভাগও ছিল না। জীবনকে যেহেতু সহজ করে রাখিনি আমরা নিজেরাই, তাই সেখানে কিছু জিনিসের চরম মূল্য দিতে হবে, এটাই তো স্বাভাবিক!
২১৬। আপনার জায়গা থেকে আপনি যা ভাবছেন, তা আপনার জন্য সত্য হলেও অন্য অনেকের জন্য সত্য না-ও হতে পারে। যা আপনার জীবনে ঝামেলার সৃষ্টি করবে না, তা আরেকজনের জীবনটাই বরবাদ করে দিতে পারে। তাই জীবনটা যার, তার নিজের মতো করে তা রাখতে দিন। ওই জায়গায় মাস্টারি করতে যাবেন না। গেলে সে লোকটা আপনার উপর বিরক্ত হবে এবং আপনাকে উটকো লোক ভেবে নেবে। সবসময়ই মনে রাখবেন, আপনার ভাবনার জগতের বাইরেও অসংখ্য জগত আছে, যেগুলির একটিতেও আপনি কখনও থেকে দেখেননি, সেখানে থাকতে হলে কী কী মেনে চলতে হয়। থাকেননি যেহেতু, তা নিয়ে মন্তব্য করতেও যাবেন না। আর তা ছাড়া, কেউ কী নিয়ে কী ভাববে বা ভাববে না, এটা ঠিক করে দেবার আপনি কে? যদি সে ভুল করে, ভুলের শাস্তি তো আর আপনি পাবেন না। আপনার সমস্যা কোথায় তাহলে?
২১৭। রেগে না গেলেও, ঝামেলা এড়াতে কখনও কখনও রাগ দেখানো ভালো। বেশিরভাগ মানুষেরই আক্কেল ও কাণ্ডজ্ঞান কম থাকে। তাই ওদের থামিয়ে দিতে বা সংযত রাখতে কপটরাগ দেখাতেই হয়। না দেখালে নানাবিধ উটকো লোকজন এসে জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে তুলবে। বেআক্কেল লোকজন ভালোমানুষ হলেও বিরক্তিকর। ওরা নিজের অজান্তেই মানুষকে বিপদে ফেলে দেয়।
২১৮। নদীতে ভাসতে চাইলে যেমনি সাঁতার শেখা আবশ্যক, তেমনি জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করার আগে বাস্তবতার ধারণা থাকতে হবে। প্রায় মানুষই, কিছু অবাস্তব ধ্যানধারণা মাথায় রেখে জীবনকে উপভোগ করতে গিয়ে নিজের সর্বস্বই হারিয়ে ফেলে।
২১৯। এলিট শ্রেণির মাঝে যেটি আছে, সেটি হচ্ছে, অন্যকে টেনে পাকাপোক্তভাবে আরও দু-লাইন নিচে নামিয়ে আনার অসীম সাহস ও বুদ্ধি। এলিট শ্রেণির প্রতিটি ব্যক্তিই এক-একটা শয়তানের বাসা! ওদের মুখের হাসি, বাহ্যিক চালচলন, কথার ফোয়ারা, সবই কূটকৌশলের কিছু অংশ মাত্র। সম্ভব হলে ওদের কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো, এতে আর কিছু হোক না হোক, মনের সুখ অন্তত নষ্ট হবে না।
২২০। শর্ট-টেম্পারড মানুষের সঙ্গে আর যা-ই হোক, সংসার অন্তত করা যায় না। খুব কষ্ট হয় এমন কারও সঙ্গে থাকতে, কথায় কথায় যার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ওরা কখন যে কী সিন ক্রিয়েট করে বসে, তা ওরা নিজেরাও বুঝতে পারে না। ওদের কাছে ভালোবাসার চাইতে গোঁয়ার্তুমি ও জেদই বড়ো। প্রায় সময়ই দেখা যায়, ওরা সাইকোপ্যাথ প্রকৃতির হয়, এবং সহজে কাউকে ক্ষমা করতে পারে না। একই পুরনো প্রসঙ্গ নিয়ে ওরা বছরের পর বছর ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে আর করতেই থাকে। যে মানুষ সঙ্গীর দোষ ভুলতে জানে না, সঙ্গীকে ক্ষমা করতে জানে না, তার সঙ্গেও সংসার করা যায় কীভাবে!
২২১। মানসিক দ্বন্দ্ব যে মানসিক অশান্তির সৃষ্টি করে, তা ভালোবাসাও সারাতে পারে না। ভালোবাসার চাইতে শান্তি অনেক অনেক বেশি জরুরি। ভালোবাসাহীন হয়েও বাঁচা যায়, কিন্তু মানসিক শান্তি নষ্ট হয়ে গেলে, সেখানে যতই ভালোবাসা থাক না কেন, বাঁচতেই আর ইচ্ছে করে না! মানুষ আত্মহত্যা করে বা করার কথা ভাবে ভালোবাসার অভাবে নয়, শান্তির অভাবে।
২২২। স্ত্রী রূপবতী হবার চেয়ে গুণবতী ও বুদ্ধিমতী হওয়া বেশি জরুরি। এই সত্যটি বুঝতে পুরুষদের সময় লাগে অন্তত বিয়ের পরের দু-বছর! রূপ দেখতে দেখতে আর কতই-বা দেখা যায়! সংসারের শান্তি ও সমৃদ্ধি, দুই-ই নষ্ট হয় স্বামী-স্ত্রী দু-জনেরই গুণ ও বুদ্ধির অভাবে।
২২৩। নারী-পুরুষের সমঅধিকার বলে কিছু নেই। নারী কিংবা পুরুষ কেউই কখনও কাউকে স্বাধীনতাই দেয়নি, সুতরাং অধিকার দেবার তো প্রশ্নই আসে না! পুরুষেরা যেটি করেছে, সেটি হচ্ছে, ওরা জোরপূর্বক নারীর উপর কিছু জিনিস চাপিয়ে দিয়েছে, আর নারীরা তা অন্ধের মতো মেনে নেওয়াকেই অবশ্যকর্তব্যকর্ম হিসেবে মেনে নিয়েছে। আবার ওদিকে নারীদের মনের মতো করে চলতে গিয়ে পুরুষেরা অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছে যুগের পর যুগ। পুরুষের সাবলীলতা ও অকপটতা মেনেই তার সঙ্গে ঘর করে, এরকম নারী লাখেও একটা পাবেন কি না সন্দেহ। নারীরাই পুরুষদের ভণ্ড সাজতে বাধ্য করে। ঘরে সত্যপ্রকাশ করলেই পুরুষের উপর মানসিক অশান্তি শুরু হয়ে যায়। অতএব, নারী ও পুরুষ উভয়েই নিজ নিজ জায়গায় দোষী।
২২৪। অন্যদের সাহায্য করুন, তবে খেয়াল রাখবেন, যেন ওরা আপনাকে টিস্যুপেপার ভাবতে শুরু করে না দেয়। যখনই দেখবেন, ওরা ধরে নিয়েছে, আপনি ওদের সাহায্য করতে বাধ্য, ওরা চাইলেই আপনাকে যখন খুশি ব্যবহার করতে পারবে, ঠিক তখনই ওদের কাছ থেকে সাহায্যের হাতটি সরিয়ে নিয়ে আসুন। যারা আপনার উপস্থিতির যথাযোগ্য দাম দিতে জানে না, তাদের অবশ্যই অবশ্যই আপনার অনুপস্থিতির বিড়ম্বনাগুলি বুঝতে দেওয়া উচিত।
২২৫। আমাদের সাথে কতটা খারাপ কিছু ঘটেছে, সেটা বড়ো বিষয় নয়। আমাদের আরও শক্তিশালী হতে হবে এবং ভালো আচরণ ধরে রাখতে হবে। ভালোমানুষ না হবার জন্য অনেক অজুহাত লাগলেও, ভালোমানুষ হবার জন্য একটাও অজুহাত লাগে না। যদি আপনার সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটে, তবে আপনি যা করতে পারেন, তা হলো, সেই খারাপ কিছু আপনাকে যা শিখিয়েছে, সেটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যাতে সবাই খারাপ কিছু ঘটার আগেই সতর্ক হয়ে যেতে পারে।
২২৬। মানুষ যেমন, তেমনই থাকে। কেউ কারও জন্য বিন্দুমাত্রও বদলায় না, বড়োজোর মনরক্ষার্থে অভিনয় করে যায় কিংবা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে। নিজেদের বিচক্ষণতা আর বিচারবোধ দিয়ে মানুষকে চিনে নিতে হয়। যদি আমরা কাউকে বুঝতে ব্যর্থ হই, তাহলে সে দায় আমাদেরই। যে যেমন, তাকে হুবহু তেমন করেই মেনে নিতে না পারলে অবশ্যই তার সাহচর্য ত্যাগ করা উচিত। যদি পরিস্থিতির শিকার হয়ে তা করা না যায়, তাহলে দুর্ভোগ পোহানো বাদে আর কিছুই করার থাকে না।
২২৭। বাড়িওয়ালাদেরও বোঝা উচিত, কী করে ভাড়াটিয়াদের থেকে সম্মান আদায় করতে হয়। প্রথম পক্ষের যা সম্পত্তি আছে, তার ছোট্ট একটা অংশ দ্বিতীয় পক্ষ ভোগ করে নির্দিষ্ট কিছু অর্থের বিনিময়ে। ফলে এক্ষেত্রে প্রথম পক্ষের কমিটমেন্ট ও সেলফ-রেসপ্সক্টের জায়গাটা খুব স্বচ্ছ না হলে দ্বিতীয় পক্ষের কাছ থেকে ঠিকমতো সম্মান পাওয়া যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। আবার দ্বিতীয় পক্ষ যদি নিজের আত্মসম্মানবোধটা সবসময়ই খুব সতর্কভাবে ধরে না রাখে, তাহলে তার অবস্থানটা স্বাভাবিকভাবে প্রথম পক্ষের কাছে বেশ নড়বড়ে হয়ে যাবে। পারস্পরিক সম্মানবোধ দুই পক্ষের আচরণের ফলেই সৃষ্টি হয়।
২২৮। মানুষ খুব একটা সুবিধার প্রাণী না। মাথায় রাখতে হবে, তেমন কোনও স্পষ্ট কারণ বা যুক্তি ছাড়াই মানুষ সবসময় আমাকে শেষ করে দিতে চাইবে; নিজেকে সম্মানের সাথে বাঁচিয়ে রাখা আমার নিজেরই কর্তব্য। আর এজন্য যদি কিছু মানুষকে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে হয়, তবে তা-ই দেবো। মানুষের সঙ্গের চাইতে বেঁচে থাকাটা বেশি জরুরি।
২২৯। যে অন্যের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে আসলে দাঁড়িয়েই নেই। যে অন্যের উপর ভর করে টিকে আছে, তার হাত ও পা দুই-ই অচল, সে আসলে পঙ্গু। অন্যের খায়, অন্যের পরে যে মানুষ, তার সঙ্গে একজন ক্রীতদাসের কোনও পার্থক্যই নেই। তার কোনও স্বাধীনতা নেই, তার কোনও মর্যাদা নেই।
২৩০। মনের কষ্টের চাইতে শরীরের কষ্ট বড়ো। মনের অসুখে যত লোক মারা যায়, তার চাইতে অনেক বেশি মারা যায় শরীরের অসুখে। তাই শারীরিক সুস্থতার চাইতে বড়ো সৌভাগ্য আর হয় না।
২৩১। কখনও কখনও, একমাত্র আবেগই মানুষকে সুখী হতে দেয় না। যে যত বেশি আবেগতাড়িত, তার দুঃখ তত বেশি। আবেগি মানুষ তখনই সুখ অনুভব করে, যখন কেউ তার আবেগের মতো করে চলে। এটা কি আদৌ সম্ভব? যার আবেগ, এক তার নিজের কাছে বাদে আর কার কাছে তা দামি? ভাগ্য খুব ভালো হলে সে হয়তো দুয়েক জন মানুষের দেখা পেয়ে যাবে, যারা তার আবেগের দাম দেয়। যাকে-তাকে নিজের আবেগের জায়গায় রাখলে দুঃখ অনিবার্য!
২৩২। যখন মানুষের ভেতর সুখ কিংবা দুঃখের অনুভূতিগুলো আর থাকে না, অর্থাৎ মানুষ যখন পুরোপুরি আবেগশূন্য হয়ে বাঁচতে শুরু করে, তখন তার কাছে এ পৃথিবীর সব কিছুই সুখের। দুঃখ পাবার চাইতে এরকম আবেগ ছাড়া বাঁচাও অনেক ভালো। বেশিরভাগ সুখী মানুষের আবেগ অল্প থাকে। যার আবেগ যত বেশি, তার দুঃখও তত বেশি।
২৩৩। চরম আঘাত মানুষকে জীবন চেনায়। আহত মানুষ তখন নিজের জীবনের উপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, যা অন্যদের ক্ষেত্রে তেমন একটা হয় না। নিজের জীবনটা নিজের নিয়মে কাটাতে চাইলে এরকম আঘাতের প্রয়োজন আছে। যে আঘাত মানুষকে শেষ করে দেয় না, সে আঘাত মানুষকে প্রায় অজেয় করে গড়ে তোলে। তাই জীবনে আহত হবার সুযোগ আসবে যখনই, তখন খুব ধীর-শান্ত হৃদয়ে সেখান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়।
২৩৪। যার কাছে আপনি মূল্যহীন, তার কাছে আপনার যাবতীয় সব কিছুই অনিরাপদ। যদি এমন কারও সঙ্গে বেঁচে থাকতেই হয় পরিস্থিতির চাপে বা সময়ের প্রয়োজনে, তবে সেক্ষেত্রে সবসময় খুব সতর্ক থাকা উচিত। আপনার মূল্যবান যা-কিছু আছে, তার সব কিছুই সে মানুষটার কাছ থেকে খুব সচেতনভাবে লুকিয়ে রাখবেন। ভালো হয়, যদি দ্রুতই তার কাছ থেকে দূরে সরে যাবার সব ব্যবস্থা করে ফেলতে পারেন।
২৩৫। নিচে পড়ে গেলে হাত বাড়িয়ে তুলে নেবার মানুষ খুঁজে কোনও লাভ নেই। মানুষ অন্যকে পড়ে যেতে দেখলে আনন্দ পায়। আর পড়ে থাকতে দেখলে তো পাথর ছুড়তে রীতিমতো একদৌড়ে চলে আসে। তাই পড়ে যাবার পর যেন নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ানো যায়, আগেভাগেই ততটা শক্তি নিজের মধ্যে সঞ্চিত রাখতে হয়। না রাখলে ওই রাস্তাতেই পড়ে থাকবেন, ভাগ্য খারাপ হলে ও সহ্যশক্তি কম হলে লোকের পাথরের আঘাতে আঘাতে মারাও যেতে পারেন!
২৩৬। ভালোবাসার মানুষের সব কিছুকেই সহ্য করতে পারাই ভালোবাসা। যে ভালোবাসেনি কখনও, সে এই অনুভূতিটা ঠিক বুঝতে পারবে না। তবে সহ্য করার পর যদি ভালোবাসার মানুষটাকে শান্তিতে রাখা না যায়, তবে প্রায় সময়ই সে মানুষটা জীবন থেকে হারিয়ে যায়। লোকে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলে যতটা ভালোবাসতে না পারার ব্যর্থতায়, তার চাইতে অনেক বেশি মানুষটাকে শান্তিতে থাকতে দিতে না পারার ব্যর্থতায়। মনে রাখতে হবে, আপনি কাউকে সহ্য করছেন, তার মানে এ না যে, তার শান্তি নষ্ট করার সকল অধিকার আপনি পেয়ে গেছেন!
২৩৭। বিবেকবোধশূন্য মানুষ সবসময়ই ভণ্ড। জীবনে যত খারাপ অবস্থাই আসুক না কেন, কখনওই এমন কারও সঙ্গে কোনও ধরনের সম্পর্ক রাখবেন না, যার বিবেকবোধ নেই। ওরকম মানুষ যতই মেধাবী হোক, যতই ধনী হোক, যত যা-কিছুই হোক না, আপনার ক্ষতি করতে সে একসেকেন্ড ভাববে না যদি কখনও প্রয়োজন হয়!
২৩৮। যখন কাছের দূরের কারও প্রশংসাতেই আমাদের কিছু এসে যায় না, কেবল তখনই আমরা প্রয়োজনীয় কাজটি করতে পারি। আর যখন আমরা নিন্দাতেও ওরকম নিঃস্পৃহ থাকতে শিখে যাই, তখন রীতিমতো পৃথিবী জয় করে ফেলার শক্তিও আমরা অর্জন করে ফেলি! সত্যি বলতে কী, কারও স্তুতি বা নিন্দা পাত্তা দেবার চাইতে হাজার গুণ বেশি জরুরি নিজের কাজটা ঠিকভাবে করা।
২৩৯। অন্ধকারে কোনও অবয়ব চোখে পড়ে না বলেই তখন কেবল মানসিক খুঁতগুলোই অনুভূত হয়। যার মনের খুঁত বেশি, সে অন্ধকারেও স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ নয়!
২৪০। যে যত বেশি দায়িত্বশীল, তার ঘাড়ে তত বেশি দায়িত্ব এসে চাপে। কাজের পুরস্কারই হচ্ছে, আরও বাড়তি কাজ! বাড়তি দায়িত্বের ভারটা বহন করতে গিয়ে যদি কোনও ভুল হয়, তবে কপালে তিরস্কার জুটলেও, ভুল না করলে পুরস্কারটা প্রায় সময়ই জোটে না।
২৪১। তুমি যে খাবারটা অপছন্দ করো, কেবল যদি সে খাবারটাই অন্যদের দেবার বেলায় তোমার দু-হাত খোলা থাকে, তবে তুমি মহৎও নও, উদারও নও, তুমি শুধুই এক ছোটোলোক! মানুষ কুকুর-বেড়ালকে খাবারের উচ্ছিষ্ট যে খেতে দেয়, তা পশুপ্রেমের নিদর্শন নয়, পশুখাদ্যের অর্থসাশ্রয়।
২৪২। যে লোক যে বিষয় নিয়ে কিছু জানে না, তার সঙ্গে সে বিষয় নিয়ে কখনওই তর্কে জড়াতে নেই। এতে আপনাদের দু-জনের মধ্যকার সম্পর্কটা সুস্থ থাকে। বেশিরভাগ মানুষই এতটাই মূর্খ যে, যা নিয়ে সে জানে না, তা নিয়ে কথাবলা থেকে বিরত থাকা দূরে থাক, রীতিমতো তর্কে জড়িয়ে পড়ে! ওরকম মূর্খদের সঙ্গে তর্ক করে নিজের অবস্থানটা নিচে না নামালেই ভালো।
২৪৩। একটা মানুষের ভেতরের চরম নোংরা কোনও মানসিকতা দেখে ফেললে, তার প্রতি লালিত সব শ্রদ্ধাই মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যায়, এমনকী বিশ্বাসটুকুও! নোংরা মানসিকতার মানুষ ভালো কাজগুলি কখনও লুকিয়ে করে না, সবসময় দেখিয়ে দেখিয়েই করে থাকে।
২৪৪। মানুষ একটা সম্পর্কের প্রতি যতটা শ্রদ্ধাশীল, তা-ই মূলত সেই সম্পর্কটিকে টিকিয়ে রাখে। সম্পর্ক বাঁচে ভালোবাসায় নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কারণে। যেখানে সম্মান ও শ্রদ্ধা থাকে না, সেখানে তীব্র ভালোবাসাও সম্পর্ককে টেকাতে আর পারে না।
২৪৫। অনেকের কাছে কাঁদতে পারাটাও ভীষণ মূল্যবান, কেননা খুব করে চাইলেও ওদের চোখে জল কিছুতেই আসে না, শুধু ভেতরটা পুড়ে যায়। কাঁদতে পারলে ওই ধরনের মানুষেরা প্রাণে বেঁচে যায় যেন! যদি আপনার ঠিক ওরকম কোনও বন্ধু বা কাছের কেউ থাকে, তবে তার মধ্যে এতটুকু আস্থা তৈরি করে দিন যাতে সে আপনার সামনে কাঁদতে পারে। এটা অনেক পুণ্যের কাজ।
২৪৬। ভালোবাসার উপযুক্ত মানুষ না পেলে বুকের সমস্ত ভালোবাসা নিরর্থকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। পৃথিবীর বড়ো ট্র্যাজেডি হলো এই: ভালোবাসতে জানে না যে, তার ভালোবাসার মানুষের কোনও অভাব নেই। আর যে ভালোবাসতে জানে, ভালোবাসার জন্য উপযুক্ত একটি মানুষও সে খুঁজে পায় না।
২৪৭। সেই মানুষটাই সার্থক, যার উপর কিছু মানুষ নির্দ্বিধায় আস্থা রাখতে পারে। যার উপর কেউ আস্থা রাখতে পারে না, তার মানবজন্মই বৃথা! নিজের মধ্যে অন্যের আস্থার জায়গাগুলি তৈরি করতে পারাটা অনেক বড়ো কৃতিত্বের কাজ।
২৪৮। সংকীর্ণ মনের মানুষদের কখনও সম্মান করতে নেই, কেননা তারা সেটা তাদের প্রাপ্য ভেবে অহংকার করতে থাকে। অহংকার দুই ক্ষেত্রে ধ্বংস ডেকে আনে: যখন মানুষ এমন কিছু নিয়ে অহংকার করে, যা তার অর্জনই নয়। যখন মানুষ নিজের যোগ্যতার বাইরে গিয়ে অহংকার করে।
২৪৯। সারাজীবনই অন্যের মাথায় কচিশসা রেখে লবণ-মরিচ দিয়ে মাখিয়ে খাবার মানসিকতা ত্যাগ করার সময় মেয়েদের এসে গেছে। মেয়েরা এটা বুঝতে যত গড়িমসি করবে, তত বেশি অপমান ও নির্যাতনের শিকার হবে। যে মেয়ে উপার্জন করে না, তার আত্মসম্মানবোধ ও সামাজিক-পারিবারিক অবস্থান, দুই-ই অনেক নিচে নেমে যায়।
২৫০। যেসকল মেয়ে ছেলেদের কাছ থেকে উপযুক্ত সম্মান আদায় করে নিতে জানে না, ছেলেরা তাদের সম্মান দেখাবার তেমন কোনও প্রয়োজনই বোধ করে না। ছেলে হোক, মেয়ে হোক, নিজের অবস্থান সম্পর্কে মিথ্যে অহংকারের বদলে যৌক্তিক মাত্রাজ্ঞান যার নেই, অসম্মান ও অপমানই তার প্রাপ্য।