প্রসঙ্গ: র‍্যাগিং (প্রথম অংশ)

 আমাদের ভার্সিটিতে এক বড়ো ভাই ছিলেন। ফোর্থ ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টারে পড়তেন। আমার ডিপার্টমেন্টেই। দেখতে বেশ সুদর্শন, সবসময়ই পরিপাটি হয়ে থাকতেন। উনার বাবা ছিলেন অনেক ধনী, সেই সূত্রে উনিও ছিলেন বেশ ধনী। ভার্সিটিতে আসার সময় গাড়ি নিয়ে আসতেন। উনার পকেটে সেই ২০০৩ সালেই হাজার পাঁচেক টাকা সবসময়ই থাকতো। কেউ টাকা ধার চাইলে কিংবা কোনো কিছু খেতে চাইলে উনি হাসিমুখে ধার দিয়ে দিতেন, খাওয়াতেন। নিজের (বাপের) গাড়িতে করে ঘোরাতে নিয়ে যেতেন। এছাড়া প্রতিদিনই উনার পকেটে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট থাকতো। (সিগারেট শেষ হলেই উনি সাথসাথে ‘রিফিল’ করে ফেলতেন!) উনার কাছ থেকে আনলিমিটেড সিগারেট খাওয়া সে সময় অনেকটা অধিকারের পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো, মানে উনি নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন মোবাইল ফোনে কথাবলার রেট ছিল লোকাল কলে প্রতি মিনিট ৭ টাকা। উনার মোবাইল ছিলো অনেকটা সরকারি মোবাইলের মতো। যার যখন যতক্ষণ ইচ্ছে কথা বলতে পারত। এমনকি অনেকে বিদেশে ফোন করেও কথা বলত। উনি কিছুই মনে করতেন না। লাগে টাকা দেবে বাবা! চিন্তা কী? এর বিনিময়ে সবাই উনাকে সমীহ করে চলত, খুব তোয়াজ করে কথা বলত। উনার ধারণা ছিলো উনি অনেক ক্ষমতাবান, উনি চাইলেই যা মন চায়, তা-ই করতে পারেন। উনার এক চাচা ছিলেন তৎকালীন সময়ের এমপি, আরেক চাচা ছিলেন আমাদের ভার্সিটির শিক্ষক। উনি লোকজনকে অনেকটা ধরেধরেই পারিবারিক অর্থসম্পদ আর প্রতিপত্তির কথা বলতেন। অনেকেই উনার কথায় প্রভাবিত হতো, তবে বেশিরভাগই উনাকে স্রেফ অয়েলিং করে চলতো। আমার উনাকে সেই শুরু থেকেই একটু গাধা টাইপের মনে হতো। উনি কাউকে র‍্যাগিং দেয়ার মানেই ছিলো তার ভাগ্য খুলে যাওয়া। র‍্যাগিং খাওয়ার পর থেকে তার যাবতীয় খাওয়ার খরচ আর সিগারেট কিংবা মোবাইল বিল সে ভাইয়ার। সাথে যখনতখন টাকা ধার দেয়া তো আছেই!
আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে। ভার্সিটিতে বরাবরই ড্যামকেয়ার স্টাইলে চলতাম, তবে খুবই বিনয়ের সাথে। তো একদিন ভাইয়া আমাকে গোলচত্বরে বসে কাছে ডাকলেন। গেলাম। বললেন, “এই কীরে? তোর নাম কী?” “তুইতোকারি করছেন কেন? ভদ্রভাবে কথা বলুন।” “তা-ই নাকি? তোমার সাথে ভদ্রভাবে কথা বলতে হবে! তা তোমার নাম কী?” নাম বললাম। “তোমার নাকি ভাব অনেক বেশি?” “মানে?” “মানে কিছু না।” “শোনো, ওই দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসো তো!” (উনি মানিব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার নোট বের করে আমার হাতে দিলেন।) আমি টাকাটা উনার কোলে রেখে বললাম, “পারবো না, ভাইয়া। সিগারেট খেতে মন চাইলে নিজে উঠে নিয়ে আসুন।” উনি পুরাই বেকুব হয়ে গেলেন! উনার পাশে আরো দুইজন ভাইয়া ছিলো (একজন সেকেন্ড ইয়ারের, আরেকজন উনার ব্যাচমেট) যারা উনাকে দুধেল গাই হিসেবেই ট্রিট করতো এবং উনার পকেট থেকে নিয়মিত পয়সা খসাতো বলে উনার খুব ‘অনুগত’ ছিলো। “সুশান্ত! এর পরিণতি ভাল হবে না কিন্তু! তোমাকে তো হলেই থাকতে হবে, সবসময়ই তো আর বাসা থেকে ক্লাস করতে পারবে না।” “ভাইয়া, আপনি কি হলের রুম বরাদ্দ দেন? নাকি সুপারভাইজার?” “উনি আমাকে মারতে হাত উঠালেন।” আমি সাথেসাথেই খুব শক্ত করে উনার হাত ধরে ফেললাম এবং বললাম, “কীরে ভাই, আপনার লজ্জাও করে না এরকম চামচামি করেন যে?” ওদিকে দেখি সেই ক্ষমতাবান ভাইয়াটি ঘাম মুছছেন! সেদিনের পর থেকে আর কখনোই কোনো সিনিয়র আমার সাথে ন্যূনতমও ভাব নেয়ার চেষ্টা করেননি। তবে হ্যাঁ, আমার একটা সুবিধা ছিলো যে আমি হলে থাকতাম না, তাই হলের কাউকে তেমন একটা কেয়ার না করলেও চলতো।
আনন্দের বিষয়, সে ঘটনার পর ওই ভাইয়াটি ক্লাসরুমের বাইরের বারান্দায় ক্লাসের ইন্টারভ্যালে আমার সাথে নিজ থেকেই ডেকে অনেক গল্প করতেন এবং সেদিনের ঘটনার জন্য কয়েকবারই ‘সরি’ বলেছেন। তবে উনার সাথে গল্প করতে বিরক্ত লাগতো, কেননা গল্প করলেই উনি উনার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নেয়ার জন্য উস্কানোর চেষ্টা করতেন এবং ইনিয়েবিনিয়ে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিশদ বর্ণনা দিতেন। বেচারা খুবই ভালমানুষ টাইপের ছিলেন কিন্তু ছেলেরা যে উনাকে গাধা বানিয়ে পয়সা খসায়, সেটা কখনো বুঝতে চাইতেন না। ধনী বাবার ছেলেরা এ ব্যাপারে গাধাই হয় কিংবা অনেক টাকা থাকার কারণে গাধা হয়ে থাকলেও ওদের তেমন কিছু এসে যায় না বলে গাধা হয়ে থাকে।
আমি বরাবরই ভার্সিটির র‍্যাগিং কালচারের বিপক্ষে। একসময় আমার একটা পোস্টে পাঠকদের কাছ থেকে র‍্যাগিং নিয়ে অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েছিলাম। তার রেসপন্স হিসেবে ইনবক্সে অনেক মেসেজ পাই। সেগুলির মধ্য থেকে কিছু শেয়ার করছি। আমি নিজের মতো করে মেসেজগুলি শেয়ার করছি। মূল বক্তব্যকে অবিকৃত রেখে আমার নিজস্ব লেখনীতে কেস স্টাডি আকারে এই লেখাটা লিখেছি। র‍্যাগিং যে কত বাজে ও বিকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত একটা ব্যাপার, এই লেখাটি পড়লে তা সহজেই অনুমান করতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, র‍্যাগিং-এর কিছু ইতিবাচক দিক নিয়েও অনেকে লিখেছেন। পড়ুন, নিজেই বিচার করুন।
(সঙ্গত কারণেই, শেয়ার করার সময় ভার্সিটির নাম এবং র‍্যাগিং-এর অভিজ্ঞতা যিনি লিখেছেন, তার নাম গোপন রাখছি কিংবা দুই ক্ষেত্রেই ছদ্মনাম দিচ্ছি।)
কেস স্টাডি-১।
ভাইয়া, আমি জৌনপুরী ভার্সিটির একজন স্টুডেন্ট। ‘১৫ ব্যাচ এর। আমি এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিলাম। জানতাম না এখানে এতটা বিভীষিকা আছে। বাবা-মা’কে ছেড়ে সেই রাজশাহী থেকে এখানে এসেছি। কিন্তু ভাইয়া, এখানে এসে র‍্যাগিং খেতেখেতে আমি এখন মনেমনে লাশ হয়ে গেছি। ডাইনিং-এ খাওয়ার সময়ও ভাইয়াদের দিকে চোখ পড়লে রুমে ডেকে টেবিলকে মেয়ে কল্পনা করে **তে বলে। (এই ভাষাই ইউজ করে একদম!) সিগারেট আনতে দেয়, থাপ্পড় মারে, মা ফোন দিলে বলতে হয়, আম্মু ভাল আছি আমি! আমার মা বলে, বাবা, একটু কথা বলি, আমি সন্ধ্যার আগে আর কথা বলতে পারবো না, তবুও ফোন কেটে দিতে হয়।
এইজন্য কি এইখানে এসেছিলাম, ভাইয়া? স্যারদের বলা যাবে না, কেননা আমাদের এই বড় ভাইদের সাথেই থাকতে হবে। আচ্ছা ভাইয়া, রাত ২টা-৩টার সময় হল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বলে, ৫০বার কানে ধরে উঠবস কর, আমি এবং আমার ফ্রেন্ডকে বলে সেক্স পজিশন দেখা এবং ওইরকম এক্সপ্রেশন দে, ওইরকম সাউন্ড কর।
ভাইয়া, আমরাও জানি বড় ভাইরা আমাদের আপনজনের মতন। তারা আমাদের ভুলভ্রান্তি শুধরে দিবেন, বিপদে পড়লে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু আমাদের দিয়ে সেক্স পজিশন দেখিয়ে উনারা আমাদের কী শেখাচ্ছেন, ভাইয়া? প্রশ্ন থাকলো। আমি এখানে পড়তে আসার পেছনে আপনার অনেক অবদান আছে। আপনি এখন বলেন, আমি কি এইসব শেখার জন্য রাজশাহী থেকে এখানে এসেছি?
খুবই অসহনীয় লেভেলে চলে যাচ্ছে এই ব্যাপারটা। গুটিকয়েক বড়ভাই এই কাজগুলি করেন। ভাল অনেক বড় ভাই আছেন। তাঁরা একটু শাসন করেন, আবার তাঁরাই স্বাভাবিক করে নেন, অনেক আদরও করেন; কিন্ত ভাইয়া, এই গুটিকয়েক জনের জন্য মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আমি। হয়ত এই মেসেজ আপনি পড়বেন না, কিন্তু আপনাকে বলতে পেরে আমার নিজেকে অনেক হাল্কা লাগছে, ভাইয়া। বলার মত কেউই নাই। ফ্রেন্ডরাও ভুক্তভোগী। পড়াশোনার প্রেশার, অথচ এইসব করতেই দিন যায়। আপনাকে কিছু করতে হবে না, ভাই, আপনি আমার মেসেজ না পড়লেও চলবে। আমি আমার মনের কথা শেয়ার করলাম।
আর ভাইয়া, আমার পরিচয়টা, ফেসবুক নামটা গোপন রাখতে অনুরোধ জানাচ্ছি। প্লিজ।
কেস স্টাডি-২।
ভার্সিটির এক বড় আপু সবার সামনে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোর ক্লাসের সেক্সি মেয়ের নাম বল।
আমি স্পিচলেস!
কয়েকবার প্রশ্ন করার পরও আমার মুখে কোনো কথা নেই। তখন আপুরা ক্লাসের সুন্দরী মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, তুই ওকে প্রেজেন্ট কর.......ওর ***-এর সাইজ কত বলেটলে.......তারপর বললেন, ওকে দেখে তোর কেমন ফিলিংস হয়? সবার সামনে বল দেখি। বলতে না পারলে চড় খাবি!
কেস স্টাডি-৩।
ভাইয়া, র‍্যাগ খেতে কেমন যে লাগে গুছিয়ে বলতে পারব না, কিন্তু যখন খাই, তখন মনে হয়, এই পৃথিবীটা ছেড়ে যেতে পারলে বেঁচে যেতাম! এত ভয়াবহ অনুভূতি হয় যে পাশে কে থাকে, তাকেই চিনতে পারি না। চোখ আর কান লাল হয়ে যায়, মুখ বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে, মাথায় ঝিম ধরে আসে। বড়ো ভাইয়ারা বলেন, এসব নাকি জুনিয়রদের ম্যানার শেখানোর জন্য করা হয়, কিন্তু যখন আমাকে র‍্যাগিং দেয়া হতো, আমি ভাবতাম, এই পৃথিবীর বাজে ছেলেদের মধ্যে আমি এমন একজন যাকে এমন ভিন্ন অভিনব উপায়ে ম্যানার শেখাতে হচ্ছে! আমি এতটা বাজে কখন থেকে হয়ে গেলাম?
কেস স্টাডি-৪।
আমাকে পরীক্ষার আগের রাতে র‍্যাগিং দেয়া হয়েছিলো বাজেরং ভার্সিটির হলে।
ধর, শোয়েব আক্তার বোলিং করছে। বলটা তোর মাথা বরাবর লাগবে। এমন অবস্থায় তখন তুই ক্যাম্নে বইসা পড়বি, সেইটা এখন লুঙ্গিপরা অবস্থায় দেখা।
হাতের মধ্যে পাউডার এর বোতল দিয়ে ব্যাট বানিয়ে ৬ মারতে বলেছিলো। বল কোনদিকে মারছি, কার শরীরে লাগবে, সেটা বলতে হয়েছিলো।
গান গাইতে বলা হয়েছিলো। মুন্নি, বাদনাম হুয়ি........এটার নাচ দেখাতে হয়েছিলো! কী একটা বাজে অবস্থা!
কেস স্টাডি-৫।
ভাইয়া, আমি ২০১৩’তে দেবনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গিয়েছিলাম ভর্তি পরীক্ষা দিতে। আর পরীক্ষা শেষ করে বের হয়ার সময় এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। আমাকে বাধ্য করা হয়েছিলো আমার চেয়ে ৩ বছরের সিনিয়র এক আপুকে প্রপোজ করার পাশাপাশি উনাকে ফুল দিয়ে I LOVE YOUবলতে।........অনেকের সামনে ওটা আমার জন্য খুব কঠিন আর লজ্জার একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলো। সে আপু প্রপোজ করার পর আমাকে সবার সামনে জোরে একটা চড় মেরেছিলেন, যা ছিলো ওদের প্ল্যানেরই একটা অংশ।
কেস স্টাডি-৬।
আগে শুনেছি কলা আর চা ভিজিয়ে খাওয়ায় নাকি র‍্যাগিং-এ। পরে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম র‍্যাগিং অতো ভদ্র টাইপের কিছু নয়। এখানে অনেক কিছু হয়। আমাদের কলেজে র‍্যাগিং ছিলো এবং তা ছিলো অতিমাত্রায়। এই যেমন ঠাঁঠাঁ রোদের মধ্যে কংক্রিট স্ল্যাবে শিরদাঁড়া টানটান করে বসিয়ে রেখে যাবতীয় ‘মানতে না পারা’ কষ্টকর নিয়ম শোনাতেন সিনিয়র ভাইয়ারা। নিয়মকানুন মানতে জুনিয়ররা বাধ্য ছিলো। অনিয়মে চললে যার যেমন ইচ্ছে, তেমন করে জুনিয়রকে নাস্তানুবাদ বানাতেন।
তবে হ্যাঁ, আমার ডিপার্টমেন্টের যে বড়ভাইয়েরা আমাদের কয়জনকে র‍্যাগ দিয়েছিলেন, তাঁদের সাথেই পরবর্তীতে আমাদের সব থেকে ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। তাঁরা সবসময়ই খোঁজখবর নিয়েছেন আমাদের। র‍্যাগিং নিয়ে যেসব সিরিয়াস গল্প শুনি, সেরকম কিছুর শিকার কখনো হইনি, যতটুকু হয়েছি, ততটুকুকে স্রেফ দুষ্টমি বলা যায়, যেটা আমরাও পরে জুনিয়রদের সাথে কন্টিনিউ করি এবং যাদের সাথে করেছি, সেই ভাইগুলিকে আজো ভুলিনি। তবে কারোকারো ক্ষেত্রে খারাপ ঘটনাও ঘটে বৈকি!
কেস স্টাডি-৭।
হলে সিট পাওয়া নিয়ে আমার খুব বাজে অভিজ্ঞতা আছে, সেটা এখনো মনে পড়লে কষ্ট পাই।.......আর ওই দুই নেত্রীর মুখে থুতু দিতে মন চায়.........কী কষ্টের ছিলো দিনগুলি!
র‍্যাগিং-এর চাইতে অনেক বেশি কষ্টের ছিলো নেত্রীদের অপমান, বাজে কথা, গালাগালি, জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া। পরে শুনেছি সেগুলিও নাকি এক ধরনের র‍্যাগিং!
Sometimes ragging can be beautiful even, when it comes from an elegant senior. It helps juniors correct their mistakes in the campus or in the hostel room…...for example, if a junior becomes addicted to smoking or breaks the library codes, ragging in a proper way can be helpful.
কেস স্টাডি-৮।
আমার জন্ম হয়েছে র‍্যাগ দেয়ার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়।
ক্যাম্পাসে একবার একটা ছেলে আমাকে দেখিয়ে ‘নতুন আমদানি’ বলছিল........স্রেফ এইটুকু বলার পরপরই আমি সোজাসুজি ওর নাকের উপর ঘুষি বসিয়ে দিই। সাথসাথেই রক্তে ওর শার্ট ভিজে যায়।
এরপর মেয়ে হয়েও সারাজীবনের জন্য র‍্যাগিং পাওয়ার ‘অধিকার’ হতে বঞ্চিত হয়ে গেলাম!
কেস স্টাডি-৯।
দাদা, র‍্যাগিং সম্পর্কে লিখতে গেলে তো অনেক কিছুই লিখতে হবে। আমি নিজে অবশ্য খাইনি, তবে দেখেছি। প্রথমে রুমে নিয়ে যায়। এরপর প্যান্ট খুলতে বলে। না খুলতে চাইলে রড দিয়ে মারার ভয় দেখায়। একসময় যখন বাধ্য হয়ে প্যান্ট খুলে তখন একজনের পাছায় আরেকজনকে লাথি মারতে বলে। এটা নিয়ে কেউ যদি হাসে, তাহলে তার উপরও বিপদ নেমে আসে। এছাড়াও কাউকে কাউকে ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুমের মেঝে মাপতে বলে। যদি সে ঠিকঠাকও মাপে, তাও ইচ্ছে করে ভুল ধরে বলে, কিছুই হয়নি, আবার মাপ। এমন এমন কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে, যেটা কোনো ভাইয়ার মুখ থেকে শুনতে হবে, এটা হয়তো একটা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে কখনোই ভাবতেও পারেনি ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে।
কেস স্টাডি-১০।
মেসেও র‍্যাগিং হয়। কেমন, বলি........নতুন কেউ মেসে উঠলে তাকে স্মার্ট বানাতে প্যান্ট খোলানো হয়.........কিংবা রাস্তায় দৌড়াতে বাধ্য করা হয়। মেয়েদের মেসে নাচতে বলা হয়, মাথায় পানি ঢেলে ভিজিয়ে দেয়া হয়, নানান এক্সপ্রেশন দিতে বলা হয়।
ভাল কথা, যে মেয়েটা আমাকে র‍্যাগ দিয়েছিল, সে এখন আমার বউদি, আমার দাদা চাইলে এখন তাকে প্রতিদিনই র‍্যাগ দিতে পারবে! হাহাহাহা
কেস স্টাডি-১১।
আমাকে র‍্যাগ দেয়ার চেষ্টা করেছিলো।
ওই ছেলের কলার ধরে এমন ঝাঁকি দিয়েছি যে এখন আপু বলে ডাকে।
ভার্সিটিতে যারা র‍্যাগ দেয়, ওরা বলে, ওইটা র‍্যাগিং না, ৩/৪ ঘণ্টা জামায়াতে দাঁড় করিয়ে রেখে আপু/ভাইয়া-রা তাদের ছোট ভাই/বোন-দের ম্যানার শেখায়! ছোট আপু/ভাই-দের মা-বাবা’দের ১৮ বছরের অপারগতার দায় বড় আপু/ভাই-রা নিজ দায়িত্বে নিজের/নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়! বাব্বাহ্‌!
আসলে র‍্যাগিং হলো একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা, যেখানে মানবতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চরমভাবে উপেক্ষিত, যেটা একটা সহজসরল তরুণের মানসিকতার উপর চরম আঘাত।
অ্যাডমিশনের সময় পরীক্ষার আগের দিন রাতে যারা কোন আশ্রয় না পেয়ে হলে একটু জায়গা করে নেয়, তাদের ১টা ‘আবালমার্কা’ প্রশ্ন হাতে ধরিয়ে দিয়ে জোর করে ২০০-৩০০ টাকা নেওয়া হয়। এইটাকে কি চাঁদাবাজি নাকি র‍্যাগিং বলবেন, দাদা?
কেস স্টাডি-১২।
নিজে কখনও র‍্যাগ খাইনি, তবে দেখেছি। ভার্সিটিতে একজাম দিতে গেলে আমার এক ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ডকে হাতে ব্লেড ধরিয়ে দিয়ে জোর করে হাত কাটিয়েছে।
সিনিয়র যে আপুকে দেখলে বুক ধড়ফড় করে ওঠে সেইই আপুকে প্রপোজ করতে পেরেছি, জড়িয়ে ধরতে পেরেছি, র‍্যাগিং-এর মাধ্যম ছাড়া যা হয়ত কোনোদিনই সম্ভব হত না!
হ্যাঁ, র‍্যাগিং থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। তবে সেই র‍্যাগিং হচ্ছে সফট র‍্যাগিং।
আমি প্রথম যেদিন হস্টেলে যাই, এর আগের রাতে সারারাত জার্নি করে গেছি সেই সিলেট থেকে। গিয়েই ঘুম! বড়ো ভাইয়ারা ঝাড়ি মেরে দুপুরে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে বলেছিলো, যা, এখনই গোসল করে খেয়ে নে, বিকালে তুই আমাদের জন্য বেগুনি ভাজবি! আমি হস্টেলে থাকতে র‍্যাগিং খেয়ে রান্না শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম, পরবর্তীতে আমিই হস্টেলে সবচাইতে ভাল রান্না করতে জানতাম, পিকনিক হলে আমিই রান্না করতাম। আমি যে রাঁধতে ভালোবাসি, সেটা ভাইয়ারা র‍্যাগিং না দিলে কখনোই জানতে পারতাম না!
কেস স্টাডি-১৩।
আমি নিজে কখনো এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়িনি। আমার বন্ধুদের থেকে শোনা কিছু কথা শেয়ার করছি। ওরা তখন একটি স্বনামধন্য টেকনিক্যাল কলেজে ডিপ্লোমায় পড়তো। ভর্তির কয়েকদিন পর ওদের সবাইকে একটি মাঠের মধ্যে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো। সবাইকে বলা হয়েছিলো একটু নড়াচড়া করলে শাস্তি দেয়া হবে। ক্লান্তির কারণে কেউ যদি একটু নড়তো, তখন নাকি কিলঘুষি দিতো। সারাদিন দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন নিয়মকানুন বোঝাতো। শার্টের বোতাম খুলে হাঁটা যাবে না। সানগ্লাস চোখে কলেজ ক্যাম্পাসে যাওয়া যাবে না। বড় ভাইদের সামনে মাথা নিচু করে সালাম দিয়ে এক সাইড দিয়ে যেতে হবে। এসবের অন্যথা হলে বিভিন্ন শাস্তি। যেমন, পুরো মাঠ চক্কর দেয়া, পুকুরের মাঝখানে পানিতে দাঁড় করিয়ে রাখা, একবেলা খাবার বন্ধ করা, এমনকি গায়ে হাত তোলা............সবই করতো।
কেস স্টাডি-১৪।
র‍্যাগিং-এর কারণে টাবি থেকে ফরম উঠাইনি,সাবি’তে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে গিয়ে রাতে লুঙ্গি পরে বাইরে বের হওয়ার ‘অপরাধে’ একদল গাঁজাখোর আমার এক বন্ধুর লুঙ্গি খুলে নিয়ে তাকে গাছে তুলে দেয় এবং বন্ধুটি সেখান উঠে লুঙ্গি পরার কারণে গাছের ডালে দাঁড়িয়েই প্রস্রাব করতে বলে, নাহলে নিচে নামলে পিটানোর ভয় দেখায়। তখন সে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলো। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। তবে মাবি’তে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আজ অবধি কেউ এমন কিছু করতে সাহস পায়নি........কারণ আমি এমন পরিস্থিতি শক্তভাবে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।
কেস স্টাডি-১৫।
প্রথম ক্লাস, মানে ওরিয়েন্টেশনের দিন ভার্সিটির বা কলেজের অনার্সের বড় ভাই বা আপু-রা ছোট ভাই বা বোন-দের অনেক কিছু করতে বলে, যেমন, ভাইরা বিভিন্ন খারাপ কথা শিখিয়ে দিয়ে বলে, যা, ওই সুন্দরী আপুকে এই কথাগুলি বলে আয়। কাগজে I love you লিখে বলে, ওই আপুকে দে, আর আপুকে দিলে তো আবার উল্টা ঝাড়ি---বেয়াদব কোথাকার! এখানে প্রেম করার জন্য আসছো,সাথে দুই-চারটা পিটুনি ফ্রি। আরো বলে যে, এই বিড়িটা লাগা, দেখতো খাইতে কেমন! না লাগাইলে বলবে ছোট ছেলে ফিডার খাস, আর অনার্সে পড়তে আসছোস, খা কইতাছি! ভয়েভয়ে যখন ছেলেটা বিড়ি ধরাবে, তখন বলবে, বড় ভাইদের সামনে বিড়ি খাস! বেয়াদব! বাড়ি কই তোর? আদব কারে কয়, শিখস নাই? বড়দের সম্মান করতে হয় কেমন করে জানিস না, হারামজাদা! খুব বেশি ভদ্রতা দেখালে বলবে, এই যে সুন্দরী আপুটা আসছে, তাকে আমাদের সামনে বলবি I love you, অথচ আপু মাস্টার্সে পড়ে, অনেক সিনিয়র। কথাটা চাপে পড়ে বলতেই হয়, আর বলামাত্রই আপুর মার তো ফ্রি.........কী যে বিচ্ছিরি অবস্থা! অনেক সময় বলে, তুই যদি এই ক্যাম্পাসে থাকতে চাস তো ২-৩ দিনের মধ্যে তো ডিপার্টমেন্টের সব মেয়েদের ফোন নাম্বার যোগাড় করে লিস্ট করে দিবি, না দিলে তোর খবর আছে। একটু বেশি পাকামো দেখিয়ে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা করলে সবার সামনে দুই কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে.........এরকম আরো অনেক আছে!
তবে আমার মতে র‍্যাগিং-এর দরকার আছে। কারণ এটা ইউনিটি বাড়ায়। তবে কোনো কিছুই অতিরিক্ত ভাল না, তেমনি র‍্যাগিং-এর নামে বাড়াবাড়িও ভাল কিছু নয়। যদি একটা লিমিটের মধ্যে থাকে, তবে র‍্যাগিং খুব খারাপ না।
কেস স্টাডি-১৬।
দাদা, হংসধ্বনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে গিয়ে র‍্যাগিং-এর শিকার হয়েছিলাম। গাছের নিচে বসে আছি। কিছু বড় ভাই টাইপ ছেলে আসলো। এসেই ঝাড়ি। মুখের কী ভাষা, দাদা! শুনলে কেউই বলবে না ওরা ভার্সিটির স্টুডেন্ট! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ওরা বললো, দেখি, তোর পেনিসের ছবি এঁকে দেখা। ভয়েভয়ে কী যেন আঁকলাম। তারপর বললো, ওই যে গাছের নিচে একটা আপু বসে আছে, ওর কাছ থেকে এই কাগজে সাইন করে নিয়ে আয়। গেলাম। যদিও একটু শক্ত মনের ছিলাম। আপুকে গিয়ে সব খুলে বললাম। এরপর আপু যা বললো, তা শুনে যে কী পরিমাণ শক খেয়েছিলাম, বলে বোঝানো যাবে না। আপু বললো, আসলটা না দেখালে তো নকলটায় সাইন করা যাবে না! একটা মেয়ে কীকরে এতটা নিচে নামতে পারে র‍্যাগিং-এর নামে? ভয়ে, রাগে, ক্ষোভে, হতাশায় চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিল। ওদের আমি কখনো ক্ষমা করবো না।
কেস স্টাডি-১৭।
ভাইয়া, আমার একটা বাজে অভিজ্ঞতা আছে, সেটা ২০০৭ সালের ঘটনা। শ্রীরঞ্জনী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে হয়েছিলো। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে হলে উঠেছিলাম। সেই হলের কয়েকজন বড়ো ভাই মিলে আমাদের সবাইকে ধরে নিয়ে হলের সবার সামনে সব কাপড় খুলে কেবল আন্ডারওয়্যার পরে ‘ঝুম বালিকা, ঝুম বালিকা’ গানের সাথে নাচতে বাধ্য করেছিলো। এমনকি হাই বেঞ্চের উপর একপায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। সব শেষে হলের ছাদে নিয়ে এক জনকে আরেক জনের কান ধরে ২০বার উঠবস করিয়ে ছিলো। আমাদের এক বন্ধুকে চোখে গামছা বেঁধে একটা টুলের উপর দাঁড় করিয়ে বলা হয়, আমরা যা বলতে বলবো, তা-ই বলবি, নইলে তোকে এখুনিই রেলিং থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো। চোখ বাঁধা থাকার কারণে ও ভেবেছিলো ও রেলিং-এর উপরই দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দিয়ে খুবই অশ্লীল (যা লেখা সম্ভব নয়) কথা বলিয়েছিলো। ও প্রাণের ভয়ে ভাইয়াদের কথামতো সব কিছুই বলে। পরে এক ভাইয়া, “ছিঃ! তোর মুখ এত খারাপ, তোকে আজ মেরেই ফেলবো” বলে ওকে টুল থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। আমার বন্ধুটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।
সেইসব কথা মাঝেমাঝে মনে পড়ে। মনে পড়লে ভয়ে আঁতকে উঠি। কী যে একটা দুর্বিষহ রাত ছিলো সেই রাতটি! একটা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা স্টুডেন্টদের সাথে এমন করলে তাদের মনে সেই ভার্সিটি সম্পর্কে কী ধারণার জন্ম হয়?
কেস স্টাডি-১৮।
র‍্যাগিং আসলেই খুব বাজে একটা অভিজ্ঞতা। আমার এক বন্ধু ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ভার্সিটির কাহারবা হলে উঠে। প্রথম রাতেই বন্ধুকে হলের অপরিচিত এক বড় ভাই তার রুমে ডাকল। তারপর তাকে প্যান্ট খুলতে বাধ্য করে, একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে গোটা রুমের দৈঘ্য আর প্রস্থ উলঙ্গ অবস্থায়ই মাপায়, আর বারবার হিসাব ঠিক হওয়া সত্ত্বেও ভুল ধরে, মানে ইচ্ছে করেই আাবার মাপায়। এমন আরো অনেক কিছুই হলে হয়, যার সবটা লেখাও সম্ভব নয়।
তবে এটাও ঠিক, র‍্যাগ খেলে নিজের ভেতরের মনমরা টাইপ অবস্থাটা দূর হয়ে যায় এবং সবকিছু উপভোগ করতে শেখা যায়। বলতে পারেন, কখনো-কখনো র‍্যাগিং-এর মাধ্যমে একটা উপকারী ভোল্টেজ দেওয়া হয়।
কেস স্টাডি-১৯।
আমাদের গ্রামের এক বড় ভাই দ্বিতীয়বারে ভার্সিটিতে চান্স পেলেন।
তো ঢাকায় ভাই যখন প্রথম যায়, হলের রুমে ঢুকে পড়ল বন্ধুত্বের কারণে অনুমতি ছাড়া। এরপর ভাইয়ের বন্ধুর বড় ভাইরা র‍্যাগিং শুরু করল অনুমতি ভালভাবে নেওয়া হয়নি বলে। ভাইকে পাঁচ টাকার কয়েন দিয়ে রুমের ক্ষেত্রফল বের করে দেখাতে বলা হয়।
তবে সে ভাই ছিল তেজি। সে বললো ৪০০০ বর্গমিটার। ওরা যখন বললো, না হয় নাই, তখন সে তাদের মাপতে বলে ড্যাম কেয়ারভাবে রুম বের হয়ে আসে।
কেস স্টাডি-২০।
সারাজীবন ধরে জেনে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানের আঁতুড় ঘর। কথাটা সত্য অবশ্যই, আর এই সত্যের সন্ধানে যেদিন পাখোয়াজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে পা রাখলাম, সেদিন এক বড় ভাই র‍্যাগ দিয়েছিলো। সেটা ছিলো খুবই সফট র‍্যাগিং।
র‍্যাগিং। এটার খারাপ দিক অনেক আছে, তবে আমি যে সমস্ত ভাল দিক এটা থেকে পেয়েছি, সেগুলো হলো: বড় ভাইদের সাথে এখনো পর্যন্ত খুবই ভাল সম্পর্ক আছে; ভাল খারাপ যেকোনো ধরনের কাজ ভাইদের সাথে শেয়ার করতে পারি, আর খুবই দ্রুতই সমস্যার সমাধান পেয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয় লাইফটা হলো রঙিন চশমার ফ্রেমে আবদ্ধ একটা লাইফ, যার জন্যে অনেক সময় আমরা ভুলে যাই যে এই ক্যাম্পাসে আমাদের সিনিয়র বলে একটা বস্তু আছে, যাদেরকে সম্মান দেখানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব, র‍্যাগিং-এর মাধ্যমে ওরা আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়।
র‍্যাগিং সত্যি খুবই অপছন্দ করি, দাদা, কিন্তু মাঝেমধ্যে কিছু জুনিয়রের আচরণে এত বিরক্ত লাগে যে বলে বোঝানো যাবে না। তখন মনে হয়, হ্যাঁ, র‍্যাগিং-এরও দরকার আছে।
কেস স্টাডি-২১।
র‍্যাগিং-এর একটা কমন প্রশ্ন হলো---চড় আর থাপ্পড়ের মধ্যে পার্থক্য কী? এর উত্তর আমার জানা নেই। আপনার জানা আছে, দাদা?
আমাদের ভার্সিটিতে র‍্যাগিং নেই, এটা ঠিক। কিন্তু র‍্যাগের বড়োটা, মানে রেস্টরুম আছে! আজকের বার্তা পত্রিকায় নিশ্চয়ই দেখেছেন। না দেখে থাকলে বলি কিছু। রেস্টরুম হলো হলে থাকার আদবকায়দা শেখানোর জায়গা। সেখানে, মাশাআল্লাহ, বড়ো ভাইদের মুখ থেকে ফুলের বৃষ্টি বর্ষিত হয় রীতিমতো। যদিও আমি নিজে তেমন ভুক্তভোগী না। তবে আমার সাথে থাকে, এমন অনেক বন্ধুই র‍্যাগিং-এর কারণে হলে থাকা বন্ধ করে দিয়েছে। রেস্টরুমে ‘আতিথেয়তা’ ভালই হয় আনন্দ ভৈরব ভার্সিটির হলগুলোতে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে র‍্যাগিং ভাল। যে স্টুডেন্ট কখনো র‍্যাগ খায়নি, সে জীবনে অনেক কিছুই মিস করেছে। প্রথম উপকারিতা হল, বড়ো ভাইদের সাথে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা খুব ভাল হয়। ভেতরের জড়তা কেটে যায়। সাহস অনেক বেড়ে যায়। এমন কিছু ভাল দিক আছে র‍্যাগিং-এর।
কেস স্টাডি-২২।
আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু আছে, ইমন কল্যাণ ভার্সিটিতে পড়ে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। ও যখন নতুন ক্যাম্পাসে যায়, তখন ওর কাছ থেকে র‍্যাগিং নিয়ে অনেক কথা শুনি। আমি প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ি। এখানে র‍্যাগিং অতোটা নিয়মিত কোনো ঘটনা না, তবে অল্পবিস্তর আছে কিছু। তো ওই বন্ধু এমনভাবে র‍্যাগিং-এর কথা বলতো, আমার শুনেই খুব লজ্জা লাগতো। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের বাংলা সিনেমার গানে অর্ধউলঙ্গ করে নাচানো। মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে অশ্লীলভাবে বিস্তারিত আলোচনা, স্থান বিশেষের নতুন নামকরণ, মেয়েদের ডেকে নানান উপায়ে বিব্রত করার চেষ্টা, এসব শেষে চা আর কেক খাইয়ে বিদায় দেওয়া।
বিস্ময়কর ব্যাপার হল, আমার বন্ধুটি এই ব্যাপারগুলো উপভোগ করতো। আমি দেখে খুবই অবাক হতাম। রীতিমতো স্টকহোম সিন্ড্রোম! একদিন, দুইদিন পর ওকে আমি বলি, র‍্যাগিং খুব বাজে জিনিস এবং এটা নিয়ে আমাদের কথা কাটাকাটি হয়। ওর কথামতে, আমি এগুলি বুঝি না, এগুলি মজা; আর যারা এগুলি বুঝে না, তারা সিনিয়রদের সাথে মিশতে জানে না, ওদের শ্রদ্ধা করতে জানে না। কথায় কথা বেড়ে যায়, নিজেদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হয়।
তবে একটা ব্যাপার আমি আজও বুঝি না যে এসব নোংরামি কীভাবে কোনো শিক্ষাপীঠে চলতে পারে! আমার ঘটনাটা খুবই সামান্য, তবে এই যে মতভেদ, এতে করে আমি একটা বন্ধু হারালাম, আর এই ফালতু ট্রেন্ডে পড়ে আমার বন্ধু হারিয়েছে তার বিবেক।
কেস স্টাডি-২৩।
ভাইয়া, আমি মারওয়া ভার্সিটিতে পড়ি। ‘১৫ ব্যাচ। মাত্র ২ সপ্তাহ হল ক্লাস শুরু হয়েছে। মারওয়ায় পড়ার অন্যতম কারণ, আপনিও এখানে পড়েছেন। সে যা-ই হোক......।
কখনো ভাবিনি বড় ভাইরা এই ধরনের প্রশ্ন করবে। ত্রিতাল হলের একটা রুমে ডেকে নিয়ে গেল। ১০-১২ জন বড় ভাই, আর আমি একা মুরগি। ভাইদের প্রথম প্রশ্ন, কীরে ভাব লস নাকি?আমি বললাম, নাহ্‌ ভাই, ভাব নেই না। “তুই তোর পরিচয় বল।” বললাম। “তুই কি আমাকে **স নাকি **স না?” আমি পুরাই অবাক, কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে বসে আছি। “কীরে তোর ইয়েটা কি ছোট নাকি?” কিছুই বললাম না। “তাড়াতাড়ি বল।” (হাতে রড নিয়ে) “নাহ্‌ ভাই, *দি না।” “কী বলস, **স না! তাইলে এইবার কোলবালিশরে কইরা দেখা।” তখন আমি মাথা নিচু করে কাঁদছি। বলছিলাম, “ভাই, এটা সম্ভব না, আমি পারব না।” “কস কী? **তে পারবি না? তাইলে কী পারবি? বিয়ের সময় বউরে কী করবি!” আমি তখনও মাথা নিচু করে কাঁদছি। একটু পর ‘১৫ ব্যাচ এর আরেক জনকে রুমে ডেকে আনল। ওকে অনেক চাপ দেয়াতে ও বালিশ এর সাথে সেক্স করে দেখাল, তাও ১০টা স্টাইলে। এদিকে আমি চুপ করে কাঁদছি। ভাইরা আমাকে টিটকারি মারলো। তারপর ভাইরা বললো, ‘১৫ ব্যাচ এর ওই ছেলেকে আমি যেন আমার বউ ভাবি। আর ওর সাথে কাপড়ের উপর দিয়ে ওই সব করে যেন দেখাই। ভাই, আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর সবাই অনেক হুমকি দিল। তারপরও কিছু করিনি। প্রায় ২ ঘণ্টা অনেক কিছু বলে পরে ছেড়ে দিল।
আরো অনেক ঘটনা আছে। ভাই, মেসেজটা যদি পড়েন, তাহলে আমাকে ইনবক্সে জানাবেন। র‍্যাগিং-এর বিষয়ে জানতে চাইলেন, তাই সরাসরিই বললাম। ভাই, আমাকে বেয়াদব ভাইবেন না, প্লিজ। আমি আসলেই আপনার অনেক বড় ভক্ত।
কেস স্টাডি-২৪।
পুরিয়াধানেশ্রী ভার্সিটিতে র‍্যাগিং-এর কথা শুনে আগে থেকেই ভীত ছিলাম। নেটে যে তথ্য পেয়েছিলাম, তা ছিলো রীতিমত ভয়ংকর। মনে ভয় নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলাম। চান্স পাওয়ার অপরাধে(!) ফার্স্ট ইয়ারের বড় ভাইয়েরা চা খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। নিয়ে শুধু অশ্লীল কথাবার্তা বলে আর আমার মুখ থেকে শুনতে চায়। না বললে বকাঝকা। আর এমন সব কাজ করতে বলে যেন আমরা তাদের কেনা গোলাম, অথবা পরীক্ষা দিতে এসে ভুল করেছি। বললো, কী খাবি? জানতাম, কী ঘটতে চলেছে। ভাগ্যক্রমে কয়েক গ্লাস পানির উপর দিয়েই পার পেয়ে গেলাম। শেষে অবশ্য চা আর সাথে কিছুটা ভাল ব্যবহারও ছিলো। তবে তারা ছিলো ফার্স্ট ইয়ারের। ততদিনে শুধু র‍্যাগ খেয়ে এসেছে, দেয়নি। প্রথম র‍্যাগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের মনে হয় ততটা সুখকর ছিলো না।
কেস স্টাডি-২৫।
ক্লাস সেভেনে দারুণ রকমের র‍্যাগ খেয়েছিলাম হাউজের ক্লাস টেনের এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে, তখনকার ক্রেজ আতিফ আসলামের গান বন্ধ করে ওয়ারফেজ ছাড়ার জন্য। মজার ব্যাপার কী জানেন, এটা ঘটেছিলো বিকালের দিকে। সন্ধ্যাবেলা প্রেপ স্টাডিতে যাবার সময় সেই সিনিয়র ভাই ক্যান্টিনে ডেকে আমাকে বোঝায় যে সেখানে উনি ওভাবে অ্যাকশন না নিলে ওনার সিনিয়ররা আরো সিভিয়ার কিছু করতে পারত। ইন মাই লেটার ইয়ারস, উনিই আমাকে সমরেশ বসু/মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয় করান।
কেস স্টাডি-২৬।
আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই র‍্যাগ খেয়েছিলাম।
একদিন ক্যাম্পাসে ঢুকছি, আরো কয়েকজন ফ্রেন্ড ছিলো সাথে। ১৫-২০ জন ভাইয়া আর আপু এক সাইডে বসে ছিলেন। তো উনারা আমাদেরকে ডাকলেন। উনাদের একজন জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোন ব্যাচের, কোন ডিপার্টমেন্টের। এরপর বললেন, ভার্সিটিতে এখন তোমরা সবচেয়ে জুনিয়র ব্যাচ, আর বাকি যারা আছে, সবাইই তোমাদের সিনিয়র। তোমরা কি ম্যানার শিখ নাই? সিনিয়রদের সালাম দিতে হয়, জানো না?
আমরা বললাম, ভাইয়া, ভুল হয়ে গেছে, আর কখনো ভুল হবে না।
এরপর উনারা বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু আমরা তো তোমাদের এমন ব্যবহারে খুব রেগে আছি, তো এখন তোমরা সবাই আমাদের গান শোনাও, যাতে আমরা তোমাদের উপর খুশি হয়ে তোমাদের ছেড়ে দিতে পারি।
সেখানে আমরা যারা ছিলাম, তারা কখনো কারো সামনে গান গাইনি। এটা উনাদের বলাতে উনারা বললেন, একাএকা গান গাইতে লজ্জা করলে সবাই মিলে জাতীয় সংগীত গাও।
ভয়ে আর লজ্জায় আমাদের সবার অবস্থা খারাপ, আবার ওদিকে ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছিলো।
আমরা বুঝতে পারছিলাম যে গান না গাইলে আমাদের ওরা ছাড়বেন না। উপায় না দেখে আমি হাত তুলে বললাম, ভাইয়া, আমি গান গাইবো। তারপর অতো লোকের সামনে বেসুরো গলায় গান গাইলাম। সবাই হাততালি দিয়ে বলেছেন, বাহ্‌, খুব সুন্দর হয়েছে!
তখন এক ভাইয়া বললেন, একটা মেয়ে গাইলো, এইবার একটা ছেলে গাও। তারপর একটা ছেলেও সাহস করে গান গাইল। এরপর ভাইয়াটা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার বাড়ি কোথায়। আমি নোয়াখালী বলায় একটা বাক্য বলে আমাকে সে বাক্যকে নোয়াখালীর ভাষায় বলতে বললেন। সেটাও করলাম। এরপর ক্লাসের দোহাই দিয়ে কোনক্রমে ওখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। ভাইয়ারা বলেছিলেন ক্যাফেটেরিয়াতে যেতে, আমাদের ট্রিট দিবেন, কিন্তু ক্লাস থাকার কারণে যেতে পারিনি।
এটাই আমার র‍্যাগিং-এর অভিজ্ঞতা। প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গেলেও পরে দেখলাম, খুব বাজে কিছু হয়নি আমার সাথে। বন্ধুরা বলত, ভার্সিটি লাইফে র‍্যাগ না খেলে নাকি ভার্সিটি লাইফ অপূর্ণ থেকে যায়!
কেস স্টাডি-২৭।
নমস্কার দাদা, র‍্যাগিং নিয়ে জানতে চেয়েছেন দেখে লিখতে ইচ্ছে হলো। আমার লাইফের একটা ঘটনা, এটাকে র‍্যাগিং বলে কি না জানি না, ওটার মধ্যে পড়লে শেয়ার করবেন। ঘটনাটা ২০০৮ সালের। কৌশধ্বনি ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। থাকার জায়গা হিসেবে হলে উঠেছিলাম। দুই দিন ধরে পরীক্ষা হয়েছিলো। তো প্রথম দিন হলের যে রুমে ছিলাম ওই ভাইয়াকে ভালই মনে হয়েছিলো। বিপত্তি ঘটল রাত আটটার একটু পরে। হলের ডাইনিং-এ খাবার খেতে যাবো, এমন সময়, পাশের রুম থেকে এক বড় ভাই ডাক দিল, আমি গেলাম। যাওয়ার সাথেসাথে আমার হাতে এক বান্ডেল ৫০০ টাকার নোট গুনতে দিয়ে সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি স্তম্ভিত হয়ে টাকাগুলো গুনে দেখলাম সম্ভবত ১০৫০০ টাকা (ঠিক ফিগারটা মনে নেই) আছে। অনেকক্ষণ পর তিন-চার জন ওই রুমে প্রবেশ করে টাকাগুলো চাইলো এবং কত আছে জিজ্ঞাসা করলো। আমি বললাম, টাকাটা দিতে চাইলাম। তখন ওরা তা অস্বীকার করলো, বললো, টাকা ছিলো ১৫০০০। আমি তো অবাক হলাম, তাদের কেউ একজন কটুকথা শোনাচ্ছিল, সরাসরি আমাকে চোর সাব্যস্ত করা হলো, কেউ একজন বলছিলো আমার বাড়িতে ফোন করতে। এ অবস্থায় পুরো কেঁদে ফেলেছিলাম। ক্ষণিক পরে আমি যে বড় ভাইয়ের রুমে উঠেছিলাম, উনি ওদের কী যেন বলে আমাকে ডাইনিং-এ পাঠালেন। সেই রাতে ঘুম তো হয়ইনি, পরদিন পরীক্ষাটাও ভাল হলো না।
কেস স্টাডি-২৮।
ফিজিক্যালি বেশ লম্বাচওড়া বলে এমনিতেই একটু ড্যাম কেয়ার টাইপের ছিলাম। তাই বড় ভাইদের চোখে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাদের মেসে আমাকে অনেক আগে থেকেই টার্গেট করে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু আমাকে র‍্যাগ দেওয়া হয় সবার শেষে। দরবারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশালদেহী নেতাগোছের এক বড় ভাইকেও আনা হয়। রাত এগারটা থেকে দুইটা পর্যন্ত র‍্যাগিং চলে। কিছু বড় ভাই ততদিনে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে যান, তারা চলে যান রুম থেকে। প্রায় ৭-৮ জন মিলে একবারে র‍্যাগ দেন। অশ্লীল প্রশ্ন, ধমকাধমকি ইত্যাদি চলে। এক পর্যায়ে আমাকে ব্যাট তুলে মারতে যান একজন। আবার আমাকে উলঙ্গ করা হবে বলে হুমকি দেন। সেই মুহূর্তে আমি চোখ তুলে উনার চোখের দিকে সরাসরি তাকাই। উনি কথা ঘুরিয়ে নেন।
আসলে উনাদের রাগ ছিলো আমার অ্যাটিটিউডের উপর। সাইজে আমার অর্ধেক, জাস্ট এক ইয়ার আগে এইচএসসি দিয়েছেন বলে উনাদের কথায় তুর্কিনাচ নাচবো---এটা মানতে পারতাম না। তাই উনাদের রাগটাও ছিলো বেশি। মেন্টালি টর্চার করে আমাকে ভেঙে দিতে চাইছিলো। আমি কাঁদিনি সেই রাতে। জাস্ট ভেবেছি---এই সময়টা একসময় কেটে যাবে। নিজে এরকম বাস্টার্ড না হলে আসলে এই র‍্যাগ-দেওয়া ভাইদের কখনও ক্ষমা করা যায় না, র‍্যাগকে সাপোর্ট করা যায় না। আমি এখনও ক্যাম্পাসে ওই ভাইদের দেখলে মুখে সালাম দিলেও মন থেকে ভালোবাসতে পারিনি।
কেস স্টাডি-২৯।
বৃন্দবনী সারং ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে গিয়ে আমার র‍্যাগিং-এর অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। যারা র‍্যাগ দেয়, তারা কতোটা যে বাজে ব্যবহার করতে পারে, তা অকল্পনীয়। এরপর থেকে এই র‍্যাগিং-এর প্রতি আমার তীব্র ঘেন্না জন্মে গেছে।.......পরবর্তীতে ভার্সিটিতে ভর্তি হই। আমি এখনো র‍্যাগ খাইনি, তবে আমার রুমমেট, ওর নাম সুমন, ওকে এইতো কিছুদিন আগে ভাইয়ারা রাতে রুমে ডাকলো! ও তখনও খাওয়াদাওয়া করে নাই, ক্লাস করে এসে ভাইয়াদের সাথে বসে খেলা দেখছিলো। ভাইরা কারণে অকারণে আমাদের ডাকে......পড়াশোনা কী করবো, সবসময় উনাদের ভয়েই থাকতে হয়.......যা-ই হোক, যেটা বলছিলাম। ওই ছেলেটা যেভাবে বলছিলো, সেভাবেই বলি। ভাইয়ার রুমে যাওয়ার পর ওর কাপড়চোপড় খুলিয়েছে। ফ্লোরে শুইয়েছে, এরপর বলেছে, মনে কর, সানি লিওন তোর নিচে আছে এবার..........আবার বলছে বডি ফিগার তো ভালই বানিয়েছিস, কয়টা মেয়েকে..........? ওর শরীরে হাত পর্যন্ত উঠিয়েছে......তারপর একটা বোতল হাতে দিয়ে বলেছে, এই বোতলের বোতলের মুখের ভিতর দিলে লি* ঢুকা......মা-বাবা নিয়েও অনেক খারাপ কথা বলেছে, আরো যা করেছে, সেগুলি ভাষায় বলার মতো না। ওকে পরে আমি অনেক কষ্টে ধরে রুমে নিয়ে আসি......বমি করতেকরতে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো......পরে শুনলাম, শুধু তাকেই না, ডিপার্টমেন্টের সব ছেলেকে একএক করে ডেকেডেকে র‍্যাগ দিচ্ছে.....
পরে আর থাকতে পারলাম না। আমি আমার ক্লাসমেট সিরাজকে ফোন দিলাম। ও এলে ওকে সব বললাম, আর বললাম, এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না.......সবাইকে ওই দিন রাতে ফোন দিলাম এবং যোগীয়া চত্বরে এ সবাই একত্রিত হলাম.......আমাদের ভার্সিটিতে নির্বাচনের সময় আলাওল ভাই নামে এক ভাই বলেছিলো কেউ র‍্যাগ দিলে তাকে যেন জানাই। উনি ফোর্থ ইয়ারের ভাই......উনাকে সব খুলে বললাম। উনি সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেদের ডাকলেন। তারপর কী হলো, বুঝে উঠার আগেই থার্ড ইয়ারের ভাইরা আমাদের ডেকে ঝাড়ি দিলো। তাদের ঝাড়ি খেয়ে ছেলেরা ভয় পেয়ে গেলো, আমাদের একতা ভেঙে গেলো........তারা বললো কালকের মধ্যে সেকেন্ড ইয়ারের কাছে মাফ চাইবি........কী আর করা! ২-৪ দিন পেছনপেছন ঘুরে পায়ে ধরেও আমরা মাফ পাইনি......পরে আমাদের ছেলেদের ধরে জিজ্ঞেস করল, আমাদেরকে এইসব বুদ্ধি কে দিলো, ইত্যাদি ইত্যাদি.....আমাদেরই ছেলেরা সব দোষ আমার আর সিরাজের উপর দিলো.....কী আর করা! আমরাই নির্যাতিত হলাম, আবার আমরাই মাফ চাইলাম.......
দুনিয়া থেকে ন্যায়বিচার উঠে গেছে, ভাই.......এখন যা ঘটে, তার সবই নাটক। যার টাকা আর ক্ষমতা বেশি, সে-ই নাটকের নায়ক! আর জাতিগতভাবে আমরা তো খুবই বিস্মৃতিপরায়ণ, তাই এইসব অবিচারের প্রতি মানুষের ক্ষোভও বেশিদিন থাকে না। ক্ষোভের আয়ু খুব কমে গেছে।
কেস স্টাডি-৩০।
র‍্যাগিং নিয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে। তবে আমাকে কখনো র‍্যাগিং-এর শিকার হতে হয়নি। আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমাদের সামনে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা, তাই প্র্যাকটিক্যালের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সেমিনারে। আমার সাথে আমাদের ক্লাশের অনেকেই ছিলো সেমিনারে। সবাই প্র্যাকটিক্যালের খাতা রেডি করতে ব্যস্ত। নতুন ব্যাচ তাদের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শেষ করে সেমিনারে এসে বসেছে। আমাদের ব্যাচের আর পরের ব্যাচের কয়েকজন মিলে ঠিক করলো, র‍্যাগ দিবে। বড় ভাইরা আগেই বলে দিয়েছিলো, “এমন কিছু করো না যাতে স্যারদের কানে যায়। একটু মজা করেই ছেড়ে দিবে।” যা-ই হোক, ওরা সবাই মিলে নতুন ব্যাচের একটা ছেলেকে ধরলো। তাকে বললো, ওদের ব্যাচেরই, পছন্দ হয়েছে, এমন একটা মেয়েকে সেমিনারের সবার সামনে প্রপোজ করতে। সে সবার দিকে তাকিয়ে বললো তার কোনো মেয়েকেই পছন্দ হয়নি। তারপর তাকে বলা হলো সেমিনারে বাকি যত সিনিয়র আপু আছে তাদের মধ্যে একজনকে প্রপোজ করতে। সে ঘুরে এসে আমাকে দেখাল। সাথেসাথে আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে কানেকানে বলে দিলো যেন প্রপোজ করার সাথেসাথে এমন রিঅ্যাক্ট করি যাতে ছেলে ভয় পেয়ে যায়। যা-ই হোক, সে সবার সামনে আমাকে প্রপোজ করল। আমি রাগ দেখাব কী, উল্টা এমন হাসি পাচ্ছিলো! হাসি আটকে রেখে তাকে ধমক দিলাম। পরে সে ‘সরি’ বলে মাফ চাইলো। আমি হেসে দিলাম। আর আমার ফ্রেন্ডগুলি ওকে কিছু না বলে উল্টা আমাকেই ধমক দিলো হেসে দেয়ার অপরাধে। যা-ই হোক, এরপর থেকে ওই ছেলে আমাকে যেখানেই দেখতো, সেখানেই সালাম দিতো।
কেস স্টাডি-৩১।
এটা আমার কাজিনের সাথে ঘটেছে। হিন্দোল ভার্সিটিতে চরম র‍্যাগিং-এর শিকার মেয়েরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস হলো বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। এইটুকু শুনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন অনেকেই। কিন্তু কী হচ্ছে হিবি’তে, সেটা শুনলে শিওরে উঠবেন আপনি! ২০১৫-‘১৬ শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে কিছুদিন হলো। ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে মেয়েরা। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন র‍্যাগিং-র শিকার হচ্ছে মেয়েরা। নাম না জানানোর শর্তে ২০১৫-‘১৬ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রী জানায়, তাদেরকে সিনিয়র আপুরা ডেকে মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে কুরুচিপূর্ণ সব কথাবার্তা বলে। ক্লাসের সময় পেরিয়ে গেলেও তাদের ছাড়া হয় না। এমন সব প্রশ্ন করা হয় যেগুলোর উত্তর দিতে প্রতিটি মেয়েই অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কান্না করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় এবং যাবার সময় শপথবাক্য পাঠ করানো হয় যাতে করে এই খবর কোথাও না বলে। জানতে পারলে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়া হয়। ফলে অনেকেই সাহস করে প্রশাসনকেও জানাতে পারছে না এইসব কথা, আবার সহ্য করতেও পারছে না এই মানসিক নির্যাতন। একাধিক মেয়ে শিক্ষার্থী নাম না বলার শর্তে এমনটি জানিয়েছেন। বড়দের থেকে এমন আচরণ কী শিক্ষা দিবে জুনিয়রদের, এটা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। তারা র‍্যাগিং বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ ইউজিসির সহযোগিতা চেয়েছেন।
কেস স্টাডি-৩২।
২০১২ সালের ঘটনা, সবেমাত্র সাবজেক্ট পছন্দের জন্য ভাইভা দিয়ে বের হলাম৷ ক্যাম্পাসে বৃত্তাকারে বসে থাকা ৮-১০ অপরিচিত (বড় ভাই) হাতের ইশারায় আমাকে ডাকলো৷ আমি তাদের কাছে গিয়ে সালাম দিলে তারা বললো সালাম শুদ্ধ হয়নি, আবার শুদ্ধ করে সালাম দিতে৷ আমি স্পষ্ট উচ্চারণে শুদ্ধ করে সালাম দিলাম৷ তারা আবার বললো, দাঁড়িয়ে নয়, দূর থেকে হেঁটে এসে সালাম দিতে হবে৷ আমি হেঁটে এসে সালাম দিলাম৷ পরবর্তীতে তারা বললো গান গাইতে অথবা নাচতে৷ আমি একটি দেশাত্মবোধক গানের ৩-৪ লাইন গাইলাম৷ আমার গান গাওয়ার ধরন এবং গানটি দেশাত্মবোধক হওয়ায় তাদের মনঃপুত হল না৷ ওই মুহূর্তেই আব্বা কল করেছিলো৷ ফোনের রিংটোন বাজতেই তারা বলতে শুরু করলো, কীরে, গার্লফ্রেন্ড কল করেছে? আমি আমার মোবাইলে সেভকরা ‘বাবা’ নামটি দেখানোর পর তারা কল রিসিভ করার ‘অনুমতি’ দিল৷ আব্বার কল রিসিভ করে র‍্যাগদাতা ৮-১০ জনের সামনে যখন বলছিলাম, আমি ভাল আছি, তখন খুবই কষ্ট হচ্ছিলো৷ আব্বার সাথে কথা বলা শেষ হলে আবার র‍্যাগ শুরু হল৷ তারা জিজ্ঞেস করলো আমার গার্লফ্রেন্ড আছে কি না? তখন আমার গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্বেও আমি বললাম, নাই, কেননা আমি জানতাম গার্লফ্রেন্ডের কথা বললে তাকে কল করতে বলবে৷ আমি চাইনি আমার মত সেও কোন বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়ুক৷ তবে গার্লফ্রেন্ড নাই বলাতে নতুন একটা সমস্যা তৈরী হল৷ তারা বলছিলো আমাদের ক্যাম্পাসে প্রেম না করে ক্লাস করা যাবে না৷ তাই একটি মেয়েকে (বড় আপু) ডেকে আনা হল এবং বলা হল তাকে আমার প্রেমের অফার করতে হবে৷ আমি চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লাম৷ আমার ভাগ্য ভাল ছিলো, আমাকে র‍্যাগ দেওয়ার ঘটনা দূর থেকে দেখতে পেয়ে আমার পরিচিত এক বড় ভাই এসে আমাকে র‍্যাগ থেকে উদ্ধার করলো৷ এটাই ছিলো আমার জীবনে প্রথম এবং শেষ র‍্যাগ৷ এখনও সেই বড় ভাইদের অনেকের সাথে আমার সম্পর্ক ভাল, তবে দুইজন বড় ভাই, যারা র‍্যাগ দেওয়ার সময় খারাপ মন্তব্য করেছিলো, তাদের মুখগুলো আমার চোখে এখনও ভাসে৷ তাদেরকে তো কখনও ক্ষমা করবোই না, বরং সুযোগ পেলে সেটার যথাযথ জবাব দেবো৷
কেস স্টাডি-৩৩।
র‍্যাগ দেয়ার সময় আমার অনুমতি না নিয়েই ইন্টারমেডিয়েট পড়ুয়া এক ছোট ভাইকে দিয়ে আমার মানিব্যাগ চেক করিয়ে নেয়া হয়। ওরা ওখানে হন্যে হয়ে আমার গার্লফ্রেন্ডের ছবি খুঁজছিলো। আমি অবাক হয়ে রাগে বলেই ফেললাম, “আপনারা সৌজন্যবোধ বলতে কিছু শিখেন নাই?” তখন ওদের মধ্যে একজন বললো, “সৌজন্যবোধ আবার কী? শেখাও দেখি আমাদের!” আমি তখন বললাম, “এতদিনেও যখন শিখেন নাই, তাহলে আর শিখবেনও না।”
কেস স্টাডি-৩৪।
আমাকে একবার রোজার ইফতার করানোর পর পুরো প্যান্ট খুলে ভিক্ষা করার স্টাইলে নাচানো হয়েছে। পরের দিন সিএসই ল্যাব ফাইনাল ছিলো, কিন্তু এটা বলার পরও রেহাই পাইনি সেই অসুস্থ মানুষগুলির কাছ থেকে। আমার আরো ৫ জন বন্ধু ছিলো, এবং ওদের সাথেও একইভাবে ট্রিট করা হয়েছে। সাথে ফ্লোরে গড়াগড়িও দিতে হয়েছে। আমার বাড়ি ঢাকার বাইরে ছিলো বলে ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।
কেস স্টাডি-৩৫।
আমি তখন দেশকার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি কেবল। ভার্সিটিতে একটাই হল ছিল, আমি ওখানে উঠলাম। হলে উঠার পর থেকেই শুরু হল র‍্যাগিং। দিন নাই, রাত নাই, র‍্যাগিং চলতেই থাকল। আমার নামে যে সিটটা ছিলো, সেটা এক সিনিয়র ভাই দখল করে রেখেছিলো। উনাকে খুব সম্মান দেখিয়ে বলেছিলাম যে সিটটা আমার। সেটাই ছিলো আমার ভুল। আমার গায়ে হাত তোলেনি, কিন্তু এমন কিছু কথা বলেছিলো, যা মনে আনতেও ঘৃণা অনুভব করি। আমাকে র‍্যাগিং দিতো এই বলে যে পাস করার পর ওরা নাকি আমাকে চাকরি দিবে। (আজো ওরা কেউ ভাল চাকরি পায়নি, ছ্যাঁচড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।) যা-ই হোক, এক ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাই তার বেডে আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন। ওই ভাই আমি ছাড়াও অন্যান্য জুনিয়রদের কাছেও প্রিয় ছিলেন। এর কারণ, উনি কখনো র‍্যাগ দিতেন না। এমনও হয়েছে যে র‍্যাগিং-এর কষ্টে উনার কাছে অনেকেই গিয়ে কান্না করতো।
পরে একদিন উনার সিনিয়ররা উনাকে ধরে নিয়ে গেলো। সারারাত রুমে আটকে অনেক মারধর করা হলো এই অপরাধে যে কেন উনি জুনিয়রদের হেল্প করেন, কাউন্সেলিং করেন। এটা দেখে আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। এরপর আমরা শপথ নিলাম যে এর বদলা নিতেই হবে। এরপর আমরা অনেক কষ্টে ভার্সিটির অ্যাডমিনকে র‍্যাগিং-এর প্রমাণ দিলাম। ২৩ জন সিনিয়র স্টুডেন্টকে হল থেকে বের করে দেয়া হল। এর মধ্যে ১৫ জনকে রাস্টিকেট করে দেয়া হল। এরপর বলতে গেলে র‍্যাগিং-ই বন্ধ হয়ে গেলো ভার্সিটিতে, হলে। বলা যায়, আমরা সবাই মিলে ভার্সিটি থেকে র‍্যাগিং দূর করতে পেরেছিলাম।
র‍্যাগিং মানে নাকি সিনিয়রদের সাথে দেখা করার একটা প্রক্রিয়া! কিন্তু এর নামে যা হয়, সেটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এখন আমার ভার্সিটিতে র‍্যাগিং নেই বলতে গেলে (খুবই সফট র‍্যাগিং কিছু থাকতে পারে), কিন্তু জুনিয়র আর সিনিয়রদের মধ্যে সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। র‍্যাগিং সবসময়ই একটা ফালতু জিনিস। যে বা যারা র‍্যাগ দেয়, তারা মূলত তাদের অসুস্থ, কর্তৃত্বপরায়ন, বিকৃত রুচির কিছু বাস্তবায়ন করে র‍্যাগিং-এর মধ্য দিয়ে।
কেস স্টাডি-৩৬।
আমি গৌরাঞ্জনী ভার্সিটিতে পড়েছি। প্রাইভেট ভার্সিটি হলেও এখানে র‍্যাগিং-এর কালচার আছে। মজার ব্যাপার হল, এই র‍্যাগিং-এর নাম তারা দিয়েছিল ব্রাদারহুড। র‍্যাগ দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করা হতো, বল, এটা কী ভার্সিটি। যদি উত্তর আসত, প্রাইভেট ভার্সিটি, তাহলে একগাদা বকাঝকা দিয়ে অপমান করে শেখানো হতো, এটা প্রাইভেট না, এটা সেমি-প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি।