পেন্ডুলামের বিধিলিপি/ দুই

 
(আগের পর্বের পর…)


আত্মহত্যা। বিষয়টা নিয়ে একটাসময় অজস্রবার ভেবেছি, কেঁদেছি। এবং, কেন এমন চিন্তা মাথায় আসে, আর কেনই-বা আমাদের নিজেকে নিজের প্রতি চরম ঘৃণা করতে বাধ্য করে দেয়, হঠাৎ করেই আমরা এ ধরনের অপ্রস্তুত হয়ে অপ্রত্যাশিত রকমের চরম ঘৃণার যোগ্য কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি, এসব নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমরা অনেকসময় অন্যদের জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো সামলে নেবার জন্য নানারকম উপদেশ ওদের দিয়ে থাকি। দূর থেকে আমরা মনে করি, আত্মহত্যা ব্যাপারটি কাটিয়ে-ওঠা আসলেই খুব সহজ। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের প্রতি মায়া তৈরি-করা কিংবা বেঁচে-থাকার জন্য কিছু কারণ চোখের সামনে দেখতে-পাওয়া সব সময় আসলে সহজ নয়। তার থেকে বরং এসব ক্ষেত্রে ওসব না-বলাই ভালো, কেননা এসময় আসলে নিজের উপর কোনও প্রকারের নিয়ন্ত্রণটা ঠিক থাকে না। অনেকসময় এই মুহূর্তগুলো আমরা নিজেরাই কাটিয়ে উঠতে পারি, আবার অনেকসময় আমাদের খুব কাছের কেউ, অর্থাৎ বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়, যে কেউ আমাদের অনুভূতিগুলো বুঝতে পেরে আমাদের যে করেই হোক, এই আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কখনও কখনও এমনও হয়, আত্মহত্যা করার সময় কিংবা আত্মহত্যা করার আগে যে দুঃখগুলো মনে কাজ করে, সে দুঃখগুলো নিয়ে কিছু বলার মতো সামনে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, কিংবা তখন যারা নিজেকে এসব পরিস্থিতির সাথে ঠিক মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকতে পারে না, তারাই চলে যায় চিরবিদায় নিয়ে।


এমন একটা বিষয় নিয়ে একসময় আমার উপর প্রবল ঝড় গেছে। আমার কাবিন হয় এবং কাবিনের প্রায় আট মাস কি তার একটু বেশি সময় হবে, ঠিক এ সময়, আমি পিয়াসের দেওয়া মানসিক চাপগুলো আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তখনও আমি আমার বিয়ের চূড়ান্তঅনুষ্ঠান নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। প্রতিনিয়তই ও এক এক ভাবে আমাকে মানসিক চাপ দিচ্ছিল। আবার নিজের ইচ্ছাতেই আমি বিয়ে করেছিলাম বলে কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। কাবিনের এত অল্প পরেই যখন সে এবং আমি সংসারে কিংবা বিবাহিতজীবনে প্রবেশ করি, তখনই এসব সমস্যায় আমি নিজে এমনভাবে চারদিক থেকে আটকে যাচ্ছিলাম যে আমি ঠিক কোন পথে পা বাড়াব অথবা কী হবে আমার জন্য সঠিক এবং উপযুক্ত, সেটা বোঝার ন্যূনতম জ্ঞান, শক্তি, বুদ্ধি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। এদিকে তখনই ডিভোর্সের চিন্তা মাথায় আনা আমার কাছে একরকম ভুল সিদ্ধান্ত মনে হচ্ছিল, আবার বিয়ের মতো জীবনের এমন ঝড়, এমন বড় একটা সিদ্ধান্ত, যা আমাকে সারাজীবনই বয়ে বেড়াতে হবে, সে বিষয়ে আমি ছিলাম সন্দিহান। আমার তাৎক্ষণিকভাবে মনে হচ্ছিল, আমি ওর সাথে আরও একটু থাকি এবং দেখি যে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয় কি না। আবার এও মনে হচ্ছিল, যে বিয়ের আগে থেকেই এমন মানসিক চাপের মধ্যে আমায় রেখেছে এবং যে তার কথামতো, তাকে ঠিক করতে গিয়ে, কাবিন করার পরও ঠিক হয়নি বরং তার যথেচ্ছাচারের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল, তার সাথে আমি কি সত্যিই সংসার করতে পারব? আবার বিয়ের এত অল্প সময় পরেই আমার এমন সিদ্ধান্ত আমাকেই কঠিন অবস্থার সম্মুখীন করতে পারে। আমি সব দিকই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবছিলাম, আর যেন কাছের কোনও মানুষ খুঁজছিলাম পাগলের মতো, এই আশায় যে, কোথাও কোনও উত্তর যদি পাই! কিন্তু যতই গভীরে যাচ্ছিলাম, ততই অন্ধকার মনে হচ্ছিল সবকিছু, আর এ বিষয়ে আমাকে উপযুক্ত পরামর্শ দিতে পারে, এমন কাউকেই আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না, যার কারণে আমি একরকম বোবা হয়ে ছিলাম। এইসব চিন্তা আমাকে আমার শারীরিক সুস্থতা থেকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে আনছিল।


চেনাস্বর বদলে গেলে কিন্তু ঠিকই ধরেফেলা যায়। পরবর্তীতে আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি। আমি তখন বিষয়টা যতটা কঠিন ভেবেছিলাম, প্রকৃতপক্ষে বিষয়টা ততটা কঠিন তো ছিলই না, বরং এর সমাধান আমি তখনই করে ফেলতে পারতাম। লাইফকে ফেস করতে হয় লাইফের সামনে দাঁড়িয়ে, ব্রেইনের সামনে দাঁড়িয়ে নয়। আসলে আমি শুধু আমার আবেগের কাছে হেরে যাচ্ছিলাম বিধায় বিয়েতে সামনে এগোতে বাধ্য হই, যা কিনা পরবর্তীতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় এবং সেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তই আমাকে পরে নিতে হয়। যা-ই হোক, সময়গুলো তখন এতটাই কঠিন হয়ে গিয়েছে যে মাঝে মাঝে আমার আত্মহত্যা করতে মন চাইত। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, ততটা সাহস আমি সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। তবে বেশ কিছুদিন যাবার পর আমি আমার সাথে ওই সংসারে আমার যা ভবিষ্যৎ দেখতে পেলাম, সেখানে আমার ওর সাথে শুধু নিরাবেগ বোঝাপড়া ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল বলে আমি মনে করিনি। তখনই আমি আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই এবং অবশেষে জীবনের খেলা সম্পর্কে আমার প্রকৃত ধারণা জন্মে। জীবন হয়তো তাকেই বাঁচিয়ে রাখে, যে তার এসব নোংরাখেলার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। যখন জীবনের এসব খেলার পদ্ধতি বা কৌশলগুলো মানুষ বুঝে ফেলে, তখন সে জীবনকে হারিয়ে দিতে পারে এবং জীবনকে তার নিজের উপর জয়ী হতে দেয় না। তাকেই হয়তো জীবন সব থেকে বড় কিছু উপহার দেয়।


আমরা সবাই জানি, আত্মহত্যা মানে জীবনের কাছে হেরে-যাওয়া এবং এটাই মানুষের সব থেকে বড় পরাজয়। কিন্তু যে সময় বাজে অভিজ্ঞতাগুলো মেনে নিয়ে বেঁচে-থাকাটা সত্যিই কষ্টকর হয়ে পড়ে, তখন লোকে অত কিছু না ভেবে আত্মহত্যার মতো এমন একটা চরমসিদ্ধান্তে চলে আসে। বেঁচে থাকলে জীবন আমাদের কিছু উপহার দেবে ভেবেও আমরা হয়তো কখনও জীবনের নানান কষ্টের সাথে লড়াই করে করেও আর টিকে থাকতে পারি না, তখনই আমরা আত্মহত্যার মতো একটা কঠিন কাজ করে সবার কাছে নিজের বোকামির পরিচয় তুলে ধরি। ব্যাপারটা হলো, আমি বেঁচে আছি কি মরে গেলাম, এটা নিয়ে সত্যিই কি তেমন কারও কিছু এসে যায় আদৌ? আমি মরে গেলাম, দুইএক দিন কিছু লোক আমাকে মাথায় রাখল, এর পর যে যার মতো। এটাই তো, না? হ্যাঁ এটা সত্য, আত্মহত্যা একটা সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান, কিন্তু আমরা তা মানি না। আমাদের সাথে ওই চিরস্থায়ী ব্যাপারটার অর্থও দাঁড়ায় ঠিক ওই মুহূর্তটাই, যখন আমরা আর বেঁচে থাকতে পারছি না। আমরা ঠিকই বুঝি, কষ্টের দিন একসময় শেষ হবে, অথচ সেই বিষণ্ণ মুহূর্তটুকু আমাদের কাউকে কাউকে শেষ করে দেয়, আর জীবন আমাদের হেরে-যাওয়ায় আনন্দে হেসে ফেলে। জীবন তো চাইবেই যে করেই হোক, আমাদের হারিয়ে দিতে। আমরা কেন নিজেকে ভালোবাসবো না? কেন আমরা ভালোরাও খারাপটাকে গ্রহণ করব? কেন বারবার আমরা জীবনকে আমাদের উপর হাসতে দেবো? কেন জীবনকেই চাবুক মারতে পারব না? কেন জীবনকেই হেরে যেতে দেবো না?


আমাদের উপর জীবনের এমন অনেক ঘটনা আছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। জীবনের এমন অনেক রহস্য আছে, যা আমরা উদঘাটন করতে অক্ষম। কেউ যদি আমাদের জীবনের কাছে হেরে যেতে বাধ্য করতে থাকে, আমাদের তখনই বোঝা উচিত, সে আসলে আমাদের আবেগ নিয়ে খেলছে এবং সে চায় আমরা যেন জীবনের কাছে হেরে যাই, আমরা যেন আর উঠে দাঁড়াতে না পারি, উঠতেই না পারি আর কখনও, আমরা যেন হারিয়ে যাই দূরে কোথাও। যারা নোংরা মূল্যবোধ বা নৈতিকতা বহন করে, তারা এমনটাই করবে। তারা শুধু ক্ষমতার দম্ভের বাইরে আর কিছুই বোঝে না। শুধুই তাদের খেলার পাত্র না হতেও তো তাদেরকে হারিয়ে দেওয়া যায়। তাই আমরা আত্মহত্যার মতো এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াতে পারি। আমরা জিতে গেলে তারা কিন্তু হেরে যায়। আমরা বেঁচে থাকলে তারা কিন্তু ভেতরে ভেতরে মরতে থাকে, পুড়তে থাকে। তাদের নিয়েও কিন্তু খেলা যায়, তাদেরকেও হারিয়ে দেওয়া যায় অন্যভাবে, অন্য কোনও সময়, অন্য কোনও পথে। তবে তার জন্য আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আমরা সবই পারি যদি আমরা চাই। কারণ আমরা জানি, আমরা আসলে নিজেকে ভালোবাসি এবং এইসব নোংরা মানুষ কখনওই আমাদের মতো ভালো মানুষের উপরে থাকতে পারে না। নিজেকে সম্মান করতে হবে সবার আগে। যে মানুষটা নিজেকে সম্মান করে না, তার পক্ষে অন্য কাউকে সম্মান করা কখনওই সম্ভব না। আর যে নিজেকে সত্যিই সম্মান করে, সে নিজেকে শেষ করে দেয় আবার কীভাবে?


আমি শুধু চাইছিলাম, আমার জীবনের পুরনো কোনও ঘটনা যেন আমার বর্তমানটাকে ঘোলাটে করে না দেয়। আমি কোনও বানোয়াট ধারণার জন্ম দিতে চাইনি এবং লোক-দেখানো মেকি কোনও কাজ করিনি। আমি সব সময়ই সৎ ছিলাম এবং চেয়েছি সততা দিয়েই সব কিছু অর্জন করতে, কেননা এতে মন শান্তি পায়। আমি বর্তমানটাকে ভালো রাখতে এবং ভবিষ্যতটাকে সুন্দর করতে কিছু অতীতকে মন থেকে মুছে দিতে চাইছিলাম এবং এজন্যই এসব নিয়ে কারও সাথে গভীর আলোচনায় যেতে আমি অপছন্দ করতাম। আমি জানতাম, পূর্বে আমি যা করেছি, ওগুলো ছিল এক একটি ফাঁকাভয় মাত্র এবং সেসব বিষয়ে আমার পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব। মানসিক পরিপক্বতা থাকলে আমি ওসব কখনওই হয়তো করতাম না। যা হয়েছে আমার সাথে, তার কিছুই হতো না হয়তো। আমার মতো তারও আমার বিষয়ে, অর্থাৎ আমাদের বিষয়ে সেও যদি স্বচ্ছ ধারণা রাখত এবং সত্যিই যদি সে আমার ব্যাপারে মনোযোগী হতো, তবে তার ফল ভালো হতো। তবে, কোনটা যে ভালো, তা ঈশ্বরই ভালো জানেন। হয়তো আমি আসলে বেঁচে গেছি, যা আমি এখন বুঝতে পারছি না! সময়ই সবকিছু বলে দেবে।


কোনও মানুষ যদি তার পরিবারকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে এবং সে কাজে উনি সফল হন, তা হলে তিনি হয়তো রাষ্ট্রকেও পরিচালনা করার যোগ্যতা রাখেন। এখানে সাফল্য বলতে শুধু তাঁর পরিবারের সদস্যদের মাঝে অর্জিত সাফল্যকে বোঝায় না, আবার শুধু তাঁর বাহ্যিক পরিবেশ-পরিস্থিতিগত সাফল্যও বোঝায় না। এখানে সাফল্য হলো এমন একটি বিষয়, যেখানে পরিবারের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও শান্তি, পরিবেশগত সামঞ্জস্য অর্থাৎ প্রতিবেশী ও সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব এবং নিজের মানসিক প্রশান্তিকে বোঝায়। অনেক গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী, যিনি পরিবারের সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন বা দায়িত্ব পালন করেন, তিনি তাঁর কোনও কাজের জন্য বা সব কাজের জন্য তাঁর স্ত্রী বা স্বামীর এবং প্রয়োজনে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করেন না কিংবা কোনও প্রকারের জবাবদিহিতার প্রয়োজন মনে করেন না, ফলে সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে শুধু নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, এমন কেউ না তাঁর পরিবারকে শ্রদ্ধা করেন, না তাঁর প্রতিবেশীকে শ্রদ্ধা করেন, এমনকি তাঁর রাষ্ট্রকেও তিনি ভালো চোখে দেখেন না। যখন আমরা আমাদের কাজের জন্য পরিবারের কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করি, তখন এর সাথে সাথে আমাদের পরিবারের সকল সদস্যের মাঝে একটি আন্তরিক এবং ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। অন্যদিকে, অচিরেই এটি খারাপ রূপ ধারণ করতে পারে, যদি আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা ও সিদ্ধান্ত অন্যের উপর চাপিয়ে দিই। যিনি বা যাঁরা পরিবারের প্রত্যেককে ভালোবাসেন, তিনি অবশ্যই নিজেকে এবং তাঁর রাষ্ট্রকেও ভালোবাসেন। নিজের ব্যক্তিসত্তার সাথে পরিবারের সদস্যদের মানিয়ে নেন ও নিজের সাথে নিজের মনের সামঞ্জস্য রক্ষা করেন, এটি পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমিকভাবে তাঁকে তাঁর পরিবার ও পরিবেশ-প্রতিবেশীর সাথে একটি অদৃশ্য, তবে মানিয়ে-নেওয়ার মতো সম্পর্ক তৈরিতে প্রভূত সাহায্য করে। যখন আমাদের প্রতিবেশীর সাথে আমাদের ঠিক খাপ খায় না, অথচ আমাদের তাদের সাথেই একটা অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়, যে বন্ধনের দাবিতে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ওদের কাছে সহযোগিতা পাই, সে ক্ষেত্রে তাদের সাথে কিছুটা ছাড় দিয়ে মানিয়ে নিতে হয়।


ঠিক এ কাজগুলোই রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ক্ষেত্রেও করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্র চালাতে গেলে প্রতিবেশী দেশগুলো আমাদের পাড়ার প্রতিবেশীদের ভূমিকাই পালন করে। রাষ্ট্রীয় সরকারের পার্লামেন্টের প্রত্যেকটা সদস্য ঠিক আমাদের পরিবারের সদস্যদের মতোই সেখানে কাজ করে। এতে নিহিত থাকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। আবার এগুলো নিয়ে ঠিকভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে গেলে আগে আমাদের নিজেদের শক্ত থেকে যোগ্য করে নিতে হয়। যেকোনও গাছ অথবা প্রশস্ত কোনও কিছু বড় হবার পেছনে এর ভিত্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিত্তি শক্ত ও মজবুত হলে গাছ অনেক মজবুত হয় এবং অনেক ঝড়েও টিকে থাকে। এসব ক্ষেত্রে সততার যেমনি দরকার আছে, তেমনি দরকার আছে বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, দূরদর্শিতা, সহনশীলতা, সামঞ্জস্য রক্ষা করার ক্ষমতা, মানসিক ও অভ্যন্তরীণ শক্তি, শারীরিক সুস্থতা, নৈতিক গুণাবলি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করার ক্ষমতা, দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের যোগ্যতা, সাহস, কৌশল, রুচিশীল মানসিকতা, আত্মিক শান্তি, পর্যবেক্ষণক্ষমতা, যৌক্তিক ধর্মীয় অবস্থান ও জ্ঞান, যেকোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্তরাখা, চিন্তা করার ক্ষমতা, সম্পর্ক ঠিকরাখার দক্ষতা ইত্যাদি। সর্বোপরি, আমি মনে করি, যে তার জীবনসঙ্গীকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, তাকে নিজের জীবনের জন্য অপরিহার্য এবং যোগ্য মনে করে, জীবনের সব কাজের অনুপ্রেরণা মনে করে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যেকোনও পরিস্থিতিতে তার সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে ছায়া হয়ে পাশে থাকার জন্য নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মনে করে এবং সর্বক্ষেত্রে একে অপরের সকল বিষয়ে জবাবদিহিতা করতে পারার মতো অদৃশ্য দায়িত্বপালনকে অপরিহার্য এবং কর্তব্যকর্ম মনে করে, একমাত্র সে-ই পারে একটা সুন্দর পরিবার তৈরি করতে। সে-ই তার পরিবারকে সুখী করতে পারে যে তার প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় এবং সামাজিক পরিবেশরক্ষায় নিজেকে বদ্ধপরিকর করে দেয়। সে ব্যক্তি তার রাষ্ট্রপরিচালনা করারও সকল যোগ্যতা রাখে। তবে একটা কথা। জীবনে সুখী হতে চাইলে সবচাইতে জরুরি হলো, সময় নিয়ে ভেবে এমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করা যে আপনাকে বুঝবে ও আপনাকে আপনার মতো করেই গ্রহণ করবে। যে জীবনসঙ্গী একইসাথে ভালোবাসে ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে, তেমন কারও সাথে জীবন কাটানোর চাইতে বড় দুঃখ আর কিছু নেই। বাঁচতে হলে ভালোবাসার চাইতে শান্তি ও স্বস্তি জরুরি।


আজকে সারাদিন শুধু শুধু কথা-কাটাকাটি আর মুখগোমড়া করে কাটিয়ে দিলাম। আমি জানি এসবে কিছুই হয় না, শুধু মনখারাপই বাড়তে থাকে। তার পরও বোকার মতো বারবার ভুল করতে থাকি। অবশ্য, বুদ্ধিমান মানুষেরা কখনও তাদের অতীতক্ষতি নিয়ে ভাবতে চান না বরং খুশিমনে ক্ষতিকে কীভাবে পুষিয়ে নিয়ে জীবনে কিছু অর্জন করা যায়, সেটা নিয়ে বেশি ভাবেন। সমস্যা হলো, আমি বুদ্ধিমান মানুষ নই।


চলমান অঙ্গুলি যে লিখে চলে দ্রুত,
লেখা হলে না থেমে সে ভাবেই সতত।
যা কিছু হলো লেখা, মুছে না তা কখনও,
শত অশ্রুজল তাতে পড়েই না তখনও।
একটা মানুষ সারাদিন যা চিন্তা করে, দিনের শেষে যা ভাবে, তার নিজেকে নিয়ে, যা ভাবে তার জীবনযাপন নিয়ে, যা ভাবে তার চারপাশটা নিয়ে, সে মূলত ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে ওঠে। চিন্তা করার মানে কী? এর মানে হলো, সমস্যাটা কী এবং কোথায়, সে বিষয়ে ঠান্ডামাথায় ভেবে তার সমাধানের জন্য চেষ্টা করা। আর দুশ্চিন্তা হলো, পাগলের মতো সমস্যাটাকে নিয়ে এলোমেলোভাবে ভেবে ভেবে ঘুরপাক খাওয়া। বড় হতে গেলে তো আগে ছোট হতে হয়! তো ছোট আছি তো ভালোই আছি! এই বিপর্যয়ে যদি ভেঙে পড়ি, তা হলে কেউ মূল্য দেবে না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার সব গোলমালের মূল আসলে আমি নিজে। আমার শরীরে বা মনে আসলে কিছু হয়নি। পারিপার্শ্বিকতা আমায় শান্তি দিচ্ছে না, বরং আমি যা ভাবছি, তা-ই দিচ্ছে। মানে আমি যতই ভাবছি, আমি অশান্তিতে আছি, আমি সত্যি সত্যি ততই অশান্তি পাচ্ছি। আমি যতই ভাবছি, আমি ডিপ্রেশনে আছি, আমি তত আরও বেশি করে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি। একটা মানুষ তার হৃদয় দিয়ে যা চিন্তা করে, সে আসলে তা-ই। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই একটা সুযোগ আমাকেও দেবেন। পৃথিবীর সবার জন্যই সৃষ্টিকর্তা অন্তত একটা করে সুযোগ রাখেন। সমস্যা হলো, সবাই সে সুযোগটা সময়মতো চিনতে পারে না এবং গ্রহণ করতে জানে না।


আমাকে আমার নিজের সমালোচনা নিজেরই করতে হবে। যেহেতু আমার সামনে কেউ আমার সমালোচনা করে না, অথবা আমাকে বোকা বলে না, সুতরাং আমার এই সমালোচনার কাজটা আমার নিজেরই। এই যে সবাই আমাকে কত ভালো ভালো কথা বলে, আমার প্রশংসা করে সামনাসামনি, এসবের মানে নিশ্চয়ই এটা নয় যে, আমার কোনও ভুল হয় না। আমি অবশ্যই নির্ভুল নই। আমি নিজেকে শুধরাতে চাই। নিজের কাছে নিজের কাজের জন্য জবাবদিহি করা হয়তো খুব কঠিন কাজ। আমরা যখন অন্য কারও কাছে কোনও কাজের জন্য জবাবদিহি করি, তখন হয়তো নিজেদের ভুলগুলো, যে করেই হোক, সব সময়ই, যতটা সম্ভব, লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু যখন নিজের কাছেই নিজের কাজের বিষয়ে জবাবদিহি করতে সাহস করব, তখন আমরা আমাদের প্রকৃত ভুলগুলো ধরতে পারব এবং নিজেকে সংশোধন করতে আর বেগ পেতে হবে না। নিজের দোষগুলো তখন বের হয়ে আসবে। এটা খুব কষ্টের হলেও খুব মজার একটা ব্যাপার এবং আমি এটা করে দেখেছি, প্রথম প্রথম মেনে নিতে কান্না পেলেও পরবর্তীতে ভালো হয়।


ভাগ্য খুলতে সময় লাগে না। ঈশ্বর সবার মনের খবর ভালোই জানেন। আমি যদি ঈশ্বরের প্রিয় সৃষ্টি হয়ে থাকি, যদি আমি সব সময় ঠিক থাকতে পারি, ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমাকে সবার চাইতে অনেক বেশি ভালো রাখবেন, আর হঠাৎ করেই আমার সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। এরকম হয় তো অনেকের সাথে, আমি দেখেছি। তবে হ্যাঁ, তার জন্যে চেষ্টা করে যেতে হবে, নিজেকে হেরে যেতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না!


জীবনে প্রথমবার আমি সৎ থেকেও হেরে গেলাম। জীবনে প্রথমবার আমার সততা পরাজিত হলো। মিথ্যার জয় হলো। হয়তোবা এখানে অন্য কোনও ইশারা ছিল, হয়তোবা আমার সততার জয় হলে তা আমার জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসত না, তাই সততা এবার হেরে গেল। কিছু হারের মধ্যেই মঙ্গল নিহিত থাকে। অনেক জয়ই আছে, যা মানুষকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। এটা আগে থেকে বোঝার কোনও ক্ষমতা মানুষের নেই। তাই এটা নিয়ে অত না ভেবে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। চলুক জীবন তার নিজের নিয়মেই! দেখিই না জীবন আমায় কোথায় নিয়ে যায়!


যেদিন ঠিক আমার মতো করে আঘাতে আঘাতে তুমিও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, সেদিন দেখবে, এসব দুঃখ নিয়ে বলার মতো তোমার পাশে কেউ নেই। কেউ নেই তোমার হাতটা ধরার মতো। ছায়ার মতো তোমার পাশে পাশে থেকে তোমাকে আরও একটু সামনে এগিয়ে দিতে কেউ আর আসবে না। পৃথিবীর প্রতি অবাক হয়ে সেদিন তুমি শুধু আমার কথাই মনে করবে, আর তোমার সেই প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে বোঝাবে, ঠিক এভাবেই আমি কতটা কষ্টে ছিলাম, কতটা একা হয়ে আমি আমার গোটা পৃথিবীর সাথে লড়েছি! সেদিন তুমি শুধু আমাকে ভেবেই কাঁদবে, কেননা সেই আগের মতো আমি তোমাকে সব কষ্ট থেকে আড়াল করে সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা হিসেবে আর পাশে থাকবো না। আমি সত্যিই আর তোমাকে নিয়ে ভাবব না, কারণ আমি তো তোমাকে ঠকাইনি। আমি চাই একদিনের জন্য হলেও তুমি বোঝো, কতটা কষ্টে আমার জীবনের সেই মুহূর্তগুলো কেটেছে। তুমি আমাকে নিয়ে যতটা খেলেছ, ততটা আকস্মিকতায় আমি অবাক হওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত পাইনি! আমি সব মেনে নিয়েছি। আমি জানি আর শুধু আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন, আমার মনে কী ছিল! তিনিই জানেন, আমার সাথে কী হয়েছে এবং সেখানে আমার ভূমিকাটা কী ছিল, আমার দোষটাই-বা কী ছিল! আমার সৎভালোবাসার প্রতিদান এভাবেই পাওয়া হলো!


একটা কোনও বিষয়ে খুব একেবারে জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বসেথাকা ঠিক নয়। ব্যাপারটা দেখলে এমন লাগে যেন পৃথিবীর জ্ঞান যা আছে, তা আমার নিজের মাথাতেই আছে, বাকিরা সবাই রামছাগল! ফেসবুকে আসি আর এমন রামছাগল দেখে হাসি।


আবেগের কথাগুলো আবেগ থাকা অবস্থাতেই লিখতে হয়। যত বড় আবেগের কথা মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে তৎক্ষণাৎ, সেই পরিমাণ মানসিক আবেগ কিন্তু পরে আর কাজ করে না। সেক্ষেত্রে আগের সেই আবেগীয় মানসিকতায় পুনরায় ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকাই ভালো, তা না হলে আবেগের ঠিক প্রকাশটা কিছুতেই হবে না। আসলেই আমি একটা বোকা। নিজেকে বলি, মেয়ে, তুমি হিসেব কেন বোঝ না? এজন্যই তো দুনিয়ায় সবাই তোমাকে ঠকায়! আগে জীবনের এক দুই শেখো, পরে নাহয় দশ এগারো বারো এসব মুখে বোলো। হায়, যখন নিজের হাজারটা কাজের জন্য নিজের কাছেই নিজেকে জবাবদিহি করতে হয়, তখন আর কিছু বলার থাকে না! দীর্ঘ দশ বছরের ভালোবাসার সম্পর্কের পর পিয়াস যদি সফল হয় নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলতে, তা হলে সে তো তার মতো করেই ভালো আছে! আমিই-বা তার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছি কেন? একপক্ষ ভুলে যেতে পারলে অন্যপক্ষকেও ভুলে যেতে পারতে হয়। এটাই নিয়ম। সে তো কেবলই আমার প্রিয় মানুষ ছিল না, আমার বন্ধুও তো ছিল। আমার সবচাইতে কাছের বন্ধুটিই সে ছিল। আমার এতদিনের বন্ধুও যদি এমন করতে পারে, তবুও আমি এমন সস্তা একটা মেয়ে হয়ে থাকব যাকে চাইলেই পাওয়া যায়, যার জন্য কিছু হতে হয় না, যার জন্য নিজেকে বদলে ফেলতে হয় না, বরং যে নিজেকে কারও জন্য বদলে ফেলবে? পিয়াস, শুনে রাখো, এই সময়গুলো একদিন আমারও আসবে। সেদিন সবকিছু বদলে যাবে। একদিন সবকিছুই এর বিপরীত হবে। হবেই হবে! আমার ঈশ্বর আমার সাথে আছেন। সবই পাল্টে যাবে, কেননা আমি শতভাগ সৎ ছিলাম। ঈশ্বর ছাড়া এই মুহূর্তে আমাকে সাহায্য করার মতো আর কেউই নেই।

আমরা আমাদের কষ্টের সময় কিংবা কঠিন সময়গুলোতে তাদের কাছে সাহায্যের আশা করি, যারা আমাদের ক্ষতি করার জন্য সব সময় একটা সুযোগের অপেক্ষা করে থাকে। আমরা ভাবি, তারাই আমাদের প্রকৃত ভালো চায়, তারাই আমাদের কাছের বন্ধু। বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটাই ইদানীং পাল্টে যাচ্ছে! হায়, সৃষ্টিকর্তা আমার কলিজাটা কেড়ে নিয়ে আমার বিশ্বাসটা পরীক্ষা করলেন! জীবনের সব থেকে কঠিন পরীক্ষা সৃষ্টিকর্তার কাছে দিতে হয়, আর তখন জীবন হয়তো থেমে থাকে না, তবে থমকে তো দাঁড়ায়ই! মাঝে মাঝে কেউ যখন আমার জায়গা থেকে আমার অবস্থা না বুঝে মন্তব্য করে, তখন আমি খুব একটুতেই ক্লান্ত হয়ে যাই। কাউকে আর কিছু বোঝাতে মন চায় না। ভাবি, যে বুঝবে আশা করেছিলাম, সে-ই তো বুঝল না! সে কী যে বুঝে আস্তে আস্তে করে সরে গেল, আমি সত্যিই জানি না। বাকিরা আমায় কী আর বুঝবে! ওদের জন্য কতটুকুই-বা করেছি আমি? আমি কারও জন্য কিছু করিনি, আমি কাউকে কিছু বোঝাতে পারি না, এটা আমার দোষ। আমি ওদেরকে বোঝানোর ক্ষমতা রাখি না। এই জীবনে যাদের জন্য করেছি, তারাই আমার পাশে দাঁড়াল না, উল্টো ক্ষতি করল বা করার চেষ্টা করল। আর যাদের জন্য কিছু করিনি, তারা পাশে দাঁড়াবে, এমনটাই-বা কেন ভাবছি? যে মানুষটাকে আমি আমার সবকিছু দিয়ে বিশ্বাস করেছি, সে মানুষটা এখন আমার কষ্টের সময় নেই, আর যে মানুষটা আমাকে ঠিকভাবে চিনে না পর্যন্ত, আমি তার কাছেই কিনা সবকিছু চেয়ে বসে আছি! এ আমার নির্বুদ্ধিতা! এ আমার ভুল!


ঈশ্বর সবাইকে সবকিছু দেন না। ঈশ্বর মানুষ বুঝে সৌভাগ্য দান করেন। নিজেকে আগে যোগ্য করে তুলুন, এর পর সৌভাগ্যের কথা ভাবুন। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে যারা, তাদেরকে ঈশ্বর সারাজীবনই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ করে দেন। মজার ব্যাপার হলো, যারা ছোটলোক, তারা বুঝতেই পারে না, কোনটা তুচ্ছ আর কোনটা তুচ্ছ নয়। যে মানুষ তুচ্ছ কি বৃহৎ, তা বুঝতে বুঝতেই বা তুচ্ছকেই বৃহৎ করে দেখতে দেখতেই জীবনটা কাটিয়ে দেয়, সে মানুষ কোনও দিনই বড় কিছু পায় না। ছোটলোক ছোটকাজে আনন্দ পায়। অসুস্থ ব্যক্তিত্বের মানুষ অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় ভাবতে পছন্দ করে। জানি, এতেও আনন্দ আছে। জগতটাই তো আনন্দের জন্য, তবুও সবকিছুতে আনন্দিত হয়ে-ওঠা কোনও কাজের কথা নয়। সবকিছু থেকেই আনন্দ নেওয়া থেকে যে করেই হোক, বিরত থাকুন আর নিজেকে ওইসব জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন। রাস্তায় ছিন্ন পোশাকের ভিখারিনীর গ্লানিতেও কেউ কেউ এক ধরনের সুখ অনুভব করে। সুখ অনুভবের ধরন দেখে মানুষ চেনা যায়। নিজের রুচি, ভাবনা ও মানসিকতাকে সুন্দর করে তুলতে পারলে আপনার কাজ অন্য দশজনের কাজের চাইতে আলাদা করে চোখে পড়বে। অন্যথায় আপনিও জীবনটাকে স্রেফ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে যাওয়া একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু নন। আলাদা করে সম্মান পেতে চাইলে তো আগে আলাদা একজন মানুষ হতে হবে। অন্য দশজনের মতো বেঁচে থাকলে তো আর আলাদা করে সম্মান পাওয়া যাবে না।


প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, একজন সফল নারীর পেছনে কোনও পুরুষেরই অবদান থাকে না। নারীকে এগিয়ে যেতে হয় নিজের সিদ্ধান্তে, নিজের চেষ্টায়, নিজের কৌশলে। সেক্ষেত্রে নারীর শক্তি পুরুষের শক্তির চাইতে বেশি, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একজন পুরুষ যতটা সহজে উন্নতির শিখরে পৌঁছে যায়, একজন নারী ততটা সহজে তা করতে পারে না।


ঘুম আসছে না। মাঝে মাঝে এমন হয়। ইদানীং বেশি হচ্ছে। আর যেহেতু হচ্ছে, সেহেতু ঘুমাতে হবে, এমনটা জোর নিজেকে করছি না। এভাবেই হয়তো পরিবর্তনগুলো মানুষের মাঝে স্বাভাবিক গতিতেই আসে। যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন জীবন সম্পর্কে এত ঝামেলা চোখে পড়ত না। সবকিছুকে এত নোংরা লাগত না। জীবন তখন সহজ ছিল, সুন্দর ছিল। পৃথিবীর অনেক কিছুই তখনও নিজেই নিজের সম্পর্কে আমাকে দিয়ে ডায়রিতে নানান কথা লিখিয়ে নিয়েছে, যেগুলোর অর্থ মাঝেমাঝে আমি হয়তো টেরও পেতাম না। মন যখন অস্থির হয়ে থাকে, কোন দিকে যাবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কোনও কারণে অহেতুক হলেও যখন মনে ভয় জন্ম নেয়, যখন কোনও কিছুই ঠিক বোঝা যায় না, তখন হয়তো অদ্ভুত রকমের কিছু ভয় মনের মধ্যে বসে যায়। তখন যা মনে আসে, তা-ই লিখতে বসে, বসে থাকতে থাকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ভাবি, আমার জীবন বারবার কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, আমি তো জানি না। আবার শুধু বেঁচেথাকার জন্যই বেঁচে থাকতে আমি চাই না, অর্থপূর্ণ কিছু করেই জীবনের এবং জন্মের সার্থকতা নিতে চাই। মাঝেমধ্যে ক্লান্ত হতে থাকি দুশ্চিন্তায়। মেয়ে হিসেবে সব সময়ই সব পরিস্থিতিতে নিজেকে স্থির রাখতে চেয়েছি। কখনও কষ্টে অথবা সুখে ভেঙে পড়তে চাইনি। কখনও কোনও দুশ্চিন্তায় নিজেকে শেষ করে দিতে চাইনি। আমি যতটা পেরেছি, পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন, তার সাথে মানিয়ে চলেছি। হয়তো কখনও পেরেছি, নয়তো নিজের ভেতরে অবসাদে কুঁকড়ে গেছে। তবু ভেঙে পড়তে দিইনি নিজেকে কখনও। এসবই ভেবেছি আমি বরাবরই। আমি এমনই। আমি এমনই থেকে যেতে চাই।


এখনও যখন মাঝে মাঝে একা থাকি, মন খুব খারাপ থাকে, তখন নিজের অজান্তেই মনে মনে চাই, কেউ এসে পাশে বসুক, খুব শক্ত করে হাতটা ধরে বলুক, ‘আমি তোমার!’ কিন্তু এমনটা হয় না। কেন জানি মনে হয়, আমার মনের সাথে তার নিজের মনটা মিলানোর মতো যোগ্য কাউকেই পাই না। আমার কেন জানি মনে হয়, ওরা কেউ পারবে না আমাকে ম্যানেজ করতে, ম্যানেজ করে চলতে। আমি তো নিজেকে চিনি। বারবার নিজের সাথে হয়েযাওয়া ঘটনায় আমি যেন নিজেই নিজের সাথে মাঝেমধ্যে পেরে উঠি না। মনের মধ্য থেকে কে যেন বলে ওঠে, যদি সে আমায় না বোঝে, তখন কী হবে? মনে হয়, সে পারবে তো আমায় শান্ত রাখতে? ধীরে ধীরে জীবনের এক একটা খেলায় এতটা কঠিন আর শক্ত হয়ে গিয়েছি যে, কেন জানি মনে হয়, খুব কঠিন কেউ, আমার থেকেও খুব শক্ত কেউ আমার জীবনে না এলে সে বুঝি আমাকে বুঝতেই পারবে না! যে আসবে, তারও যে কষ্টগুলো পেতে হবে ঠিক আমারই মতো করে! আমি এখন বুঝি একমাত্র কঠিন কেউই পারে কঠিনকে ভাঙতে। কাচ দিয়েই কাচ জোড়া লাগে। ভালোবাসাই পারে ভালোবাসতে। ঘৃণাই পারে ঘৃণা করতে। পাথর ভাঙতে পারে এক পাথরই। জানি না হয়তোবা তেমন কাউকেই আমার জীবনে পাঠানো হবে। আমার জন্য তেমন কেউই আসবে। ঈশ্বরই জানেন সব।


মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার মতো এত শক্ত আর কেউ হতে পারে না। আবার মনে হয়, আমার জীবনে যে আসবে, অবশ্যই সে আমার সমপরিমাণই আঘাত সহ্য করেছে। মাঝেমধ্যে আমি নিজেকে নিজেই বলি, কে তুমি আমার জীবনে এসেছ সবকিছু ভেঙে দিয়ে? কত কত ঘটনা আমি নিজেই চাইনি! যা আমি নিজেই চাইনি, সে সবই তো ঘটে গেল! অথচ মনে হয়, তুমি আসবে বলেই এমনভাবে সব ঘটল। তোমার ভালোবাসার শক্তি আমাকেও হার মানালো। তোমার কাছে আমিও হেরে গেলাম! তুমি আসবে বলে…আসলেই কি তা-ই? সত্যিই কি এই জন্যই বেঁচে আছি এতটা কষ্ট সহ্য করেও? সত্যিই কি এমন কিছু হবে আমার জীবনে? মাঝেমধ্যে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না। কী জানি…হয়তো হবে! হয়তো হবে না! আবার বিশ্বাস করতে মন চায় শুধু এই ভেবে যে, এরও তো একটা ফল আছে! যে কষ্টগুলো আমি ধীরে ধীরে জীবনের কাছ থেকে পেয়ে সহ্য করেছি, সেগুলো সবই কি বৃথা যাবে? শুনেছি, উত্তমের ফল তো শুধু উত্তমই হতে পারে। তবে এমন তো হয় না সব সময়ই। এমন কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে মানুষের জীবনে! তবু, আমি তো মানুষ! আমি তো ভালো কিছু পাওয়ার আশাতেই বেঁচে আছি। আশা নিয়েই তো মানুষের জীবন! এই আশাই যদি না করি, তা হলে আর কী নিয়ে বাঁচব? কেমন করে? এই আশাই যদি না করি, তা হলে আর বেঁচে থেকেই-বা কী লাভ? কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে হলেও তো ঈশ্বর কোনও না কোনওভবে সে মানুষটার মধ্যে আশা দিয়ে রাখেন! ঈশ্বর তো সারাজীবনই কাউকে কষ্টে রাখেন না। তাই না জ্ঞানীরা বলেন, আগে খারাপটা খাও, পরে বাকিগুলো খেতে ভালো লাগবে। আমিও তো তা-ই করেছি। আমার জীবনে তা হলে এমন কেন হচ্ছে?


বাইরে বৃষ্টি। ভালো লাগছে। আজ আমার মায়ের শরীরটা বেশি ভালো ছিল না। মনটা খারাপ হয়ে পড়ে ছিল। মাঝে মাঝে অনেক কিছু নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যখন অন্য কারও উপর ভরসা করতে হয়, তখন আর ভালো লাগে না। মন খারাপ হয়ে যায়। মার শরীর খারাপ, মন চায়, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তাঁর রোগ সারুক, আমার মনটা তো শান্তি পাবে! আমি বেঁচে থাকতে মা-বাবার কিছু হবে, তাও আবার চিকিৎসা বা যত্নের অভাবে, এ যেন আমি কোনওভাবেই মেনে নিতে পারি না। কখনও আমার অক্ষমতার কারণে ওদের খারাপ কিছু হয়ে গেলে যতদিন বাঁচব, নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। শুধু বাবা-মার চিকিৎসার দরকার হলেই আমার মনে আসে, আমি যেন সেই যোগ্যতাটুকু অর্জন করতে পারি, যাতে অন্তত আমার আরামের আগে তাঁদের জীবনের ন্যূনতম কষ্টের মুহূর্তগুলোও আমি সুখে পরিণত করতে পারি। শুধু এইজন্য হলেও ঈশ্বর আমাকে ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতেই তো পারে! আমি অন্যান্য অনেক সত্যের মতো এটাও জানি, বাবা-মার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে, আমি নিজেই শেষ হয়ে যাব। আমার এই ছোট্ট পৃথিবীতে ওঁরা দুজন আছেন, যাঁরা আমার জন্য সবচাইতে জরুরি মানুষ। আমার এই ছোট্ট পৃথিবী ছেড়ে তাঁরা চলে গেলে ওটা আরও ছোট হয়ে যাবে। তখন নিজেকে ঘিরে আমি নিজেই আর থাকতে পারব না। আমি ওঁদের ছাড়া বাঁচতেই পারব না।


কেন জানি বলতে পারি না, বোঝাতে পারি না কিছুই। হয়তোবা কিছু করে দেখানোটাই হচ্ছে বলা। মুখে বলাটা আসলে কোনও বলার মধ্যেই পড়ে না। বাবা-মায়ের জন্য সেই কিছুটাই তো করতে পারছি না, তাই আমার বলাটা আর হচ্ছে না। আমি এইজন্যই কাউকে কিছু বোঝাতে অপারগ থেকে যাই, কাউকে কিছু বোঝানোটা আর হয় না। মাঝে মাঝে যখন নিজেকে নিয়ে খুব হতাশ থাকি, কোনও দিকেই কিছু করে উঠতে পারি না, কোনও তীর খুঁজে পাই না, তখন মনে হয়, একটু গা এলিয়ে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে বিশ্রাম দিই! এ জীবনে যা হয় হোক! যা খুশি যেভাবে খুশি, তা-ই হয়ে যাক! অথচ তা করতে পারি না, যখন দেখি, আমার এই ভালোথাকার শক্তির উপর ভরসা করে আমার পুরো পরিবার বেঁচে আছে। ওরা জীবনে স্বপ্ন দেখে আমাকে দেখেই। এসব মাথায় এলে তখন আমি আর কিছুতেই গা এলিয়ে দিতে পারি না। আমার ঘুম আসে না। যদি আমার শক্ত-থাকাতে, শুধু আমাকে শক্ত থাকতে দেখেই ওঁরা সবাই ভালোভাবে বাঁচতে পারে, তা হলে যে করেই হোক, আমাকে সকল কষ্ট ভুলে ভালো থাকতে হবে। আমাকে তাদের জন্য হলেও ভালো থাকতে হবে। তাদের সুখে রাখতে হলে আমাকে দেখাতে হবে---আমি নিজে খুব খুশি আছি, আমি ভালো আছি, আমি একটুও কষ্টে নেই। তারা আমার সাথে খারাপ আচরণ করলেও আমি সেগুলো গায়ে না মেখে ভালো থাকবো। মন খারাপ করে থাকলে চলবে না। এসব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে না পারলে ওঁরা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন, ভয়ে থাকবেন…আমি যদি ভেঙে যাই! আমি সব কষ্ট মেনে নিয়েও শুধু আমার পরিবারকে সুখে রাখতে ভালো থাকব। আমার মনে যতই শূন্যতা থাকুক, আমি কাউকেই কিছু বোঝাব না। আমি শূন্যতা অনুভব করছি, এটা কাউকে বোঝাব না। কেননা আমি শেষ হয়ে গেলে আমার পরিবার শেষ হয়ে যাবে। আমি ভেঙে পড়লে আমার পরিবার সম্পূর্ণই ভেঙে পড়বে। শুধু আমার উপর সব কিছু নির্ভর করছে। আমার ভরসার উপর আমার পুরো পরিবার টিকে আছে। যেখানে ভিত্তিটা আমার থেকেই শুরু, সেখানে আমি ভেঙে গেলে সব কিছুই ভেঙে যাবে। আমি তো ওটা চাই না। আমি আমার পরিবারকে ভালো থাকতে দেখতে চাই। আমি চাই, আমার পরিবারের সকলে সুখে আছে, সুস্থ আছে, ভালো আছে, এমন দেখতে। আমি ভেঙে গেলে তারা আর নিজেদের জোড়া লাগিয়ে রাখতে পারবে না।


আমি কখনও কখনও ইচ্ছে করেই তাদের সাথে খারাপ আচরণ করি, কেননা আমি তাদের বোঝাতে চাই, আমি স্বাভাবিক আছি। আমি যদি সবসময় ভালো আচরণ করি, তা হলে আমার পরিবার ধরে নেয়, আমি বোধহয় ভালো নেই, আমি ভালোথাকার অভিনয় করে যাচ্ছি। এই ধারণা থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে আমি খারাপ আচরণ করি। কখনও ভালো, কখনও খারাপ থাকাটাই জীবনের নিয়ম। আর আমিও এই নিয়মের অধীনে আছি। কখনও কখনও অযথাও যথাযথ হয়ে আছি। আমার রাগ কখনও কখনও তাদের শান্তি দেয়। আমি অনুভূতিহীন আর নিস্তব্ধ হয়ে থাকতে পারি না। আমি পারি না আমার অবস্থান দিয়ে তাঁদের মানসিকভাবে আঘাত করতে। আমার কোনও অধিকারই নেই আমার কষ্টের জন্য অন্যকে কষ্টে রাখতে। আমি কষ্ট পাচ্ছি বলে তার দায়দায়িত্ব পুরো পৃথিবীর ঘাড়ে চাপানোর কোন অধিকার আমার নেই। এইসব বুঝে বাঁচার নামই বাঁচা।


(চলবে…)