পৃথিবীর মানুষেরা যেমন

মানসিকভাবে যখন তুমি বিধ্বস্ত থাকবে, তখন...
পৃথিবীর সব কিছু তোমার কাছে বিরক্তিকর মনে হবে,
সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার‌ও তোমার কাছে অখাদ্য মনে হবে,
পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর জায়গায় দাঁড়িয়েও সব কিছু তুচ্ছ মনে হবে,
সবচেয়ে ভালোলাগার গানটি শুনলে তোমার মনে হবে, কী বাজে এক সুর,
সব থেকে কাছের মানুষদের নজর এড়িয়ে চলতে ইচ্ছে হবে,
খুব গোছানো রুমটাও নোংরা আর এলোমেলো মনে হবে,
সব থেকে পছন্দের পোশাক তখন পরতে ইচ্ছে হবে না,
নিজেকে জঞ্জাল মনে হবে,
অন্য সবাইকে জঞ্জাল মনে হবে,
তখন তোমার কোথাও যেতে ইচ্ছে হবে না, কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হবে না, কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে হবে না।

এরকম মুহূর্তে পৃথিবীর সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে খুব একলা লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে হবে, 
প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা এড়াতে, সব কিছু ভুলে থাকতে দিনের পর দিন তোমার শুধু ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছে হবে।
তখন কাউকে কোনো কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছে হবে না, নিজের মানসিক অবস্থার কথা কাউকে বলতে ইচ্ছে হবে না, একটা সময় কারও কোনো করুণা, কোনো এক্সপ্লেনেশন কিছুই তোমার আর চাহিদা থাকবে না, তুমি শুধু নিজের সাথে নিজেকে নিয়ে একটু বাঁচতে চাইবে, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে নিজের সাথে মানিয়ে নিতে চাইবে।

আমরা অনেকেই জানি না, মানুষ আসলে নিজেকে হারিয়ে ফেলার এবং নিজের কাছে হেরে যাবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যায়। নিজেকে তলিয়ে যেতে দেখাটা যতটা কঠিন, তার থেকেও অনেক বেশি কঠিন নিজেকে নিজের ব্যর্থতা-সহ মেনে নিতে শেখা, নিজের ব্যর্থতার সাথেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং রোজ এভাবে বেঁচে থাকা।

মানসিক শান্তির বিষয় আমরা খুব কম ভাবি, কেননা জীবনের ব্যস্ততায় কাজের ভিড়ে সে সময় সবার হয় না, কিন্তু যে-ব্যক্তি মানসিক শান্তিটা কিছুতেই আর কোথাও খুঁজে পায় না, তার পক্ষে অন্যদের ভালো রাখা অনেক অনেক কঠিন। আমরা নিজেরা মানসিক শান্তিতে থাকলেই পরিবার এবং সমাজের চিন্তাটা করতে পারি, দায়িত্বের বোধটা কাজ করে। যে নিজের সেই মানসিক শান্তিটা আর কিছুতেই নিজেকে দিতে পারে না, সে তার আশেপাশের সবাইকে ভীষণ কষ্ট দেয়, বিরক্ত করে। সে বোঝে এই বিষয়গুলো, এজন্য সে নিজেকে গুটিয়ে নেয় অন্যদের বিরক্তির কারণ হতে চায় না বলে, কিন্তু অনেকসময় সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং অন্যদেরকেও সেই যন্ত্রণার ভাগীদার করে। এজন্য কখনো কখনো নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হলেও মানুষের অন্যদের খুশি করার কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে হয়। নিজেকে কিছুটা মানসিক শান্তি দিতে গিয়ে অনেকসময় অনেক মানুষকে মানুষ অখুশি করে ফেলে। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

নিজের শান্তিটা নিজে আদায় করে না নিলে কেউই আমার হয়ে সেই শান্তিটা এনে দিতে আসবে না, আমি নিজে ছাড়া আর কেউই আসলে আমার জন্য সেই কম্প্রোমাইজটা করবে না। সেজন্য অনেক চেষ্টা করে, অনেকের ঘৃণার পাত্র হয়ে, অনেকের চক্ষুশূল হয়ে হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের সেই মানসিক শান্তিটুকুর ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হয়। এতে করে অন্যেরা যা খুশি ধারণা করার করুক, তাতে কিছুই এসে যায় না।

দিনশেষে, আমি কথা কম বললে অহংকারী, আবার কথা বলতে পারার মানসিক স্থিতিশীলতায় না থাকলেও আমি অন্যদের কাছে অহংকারীই।

আমি জেদ দেখালে বেয়াদব আর জেদি, কিন্তু আমি হয়তো কোনো কারণে মানসিকভাবে চরম দুর্দশার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি—এ কথাটা কেউ তার বোধেই আনবে না; আমি কোনো একটা কারণে নিজেকে নিজের মানসিক অবস্থানটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না, সেটা কারও ধারণায় কখনও আসবে না; হয়তো আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি, এটা কারও মনেই হবে না।

এ পৃথিবী আসলে এতটাও আনফেয়ার ছিল না কখনও, কেবল আমরাই এখন অন্যদের বেলায় সবসময় জাজমেন্টাল, কুরুচিপূর্ণ এবং আনফেয়ার। আমি মনে করি, পুরো পৃথিবীর বিপক্ষে গিয়ে হলেও কখনো কখনো নিজের মানসিক শান্তিটা নিজেরই আদায় করে নেওয়া উচিত। লোকে তো কবরে শুইয়ে দিতে গিয়েও বলে: লোকটা গতকাল অনেক নাক ডেকেছিল, সেই শব্দে আমার ঘুম হয়নি!