পিএটিসি ডায়েরি: ৯ ফেব্রুয়ারি



ডেটলাইন ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি। খাওয়া শেষ, প্লেট খালি, বসে আছি। ওয়েটার এসে ঠিক ঠিক জিজ্ঞেস করবে, “স্যার, খাওয়া শেষ?” মানে? ব্যাটা বলতে চায়টা কী? সেদিন তো পিৎজা-হাটে ওরকম প্রশ্ন শুনে বলেই ফেললাম, “না ভাই, প্লেটটা এখনও বাকি!” কিন্তু সবাই তো আর আমার মতো শাখামৃগ প্রজাতির না। আচ্ছা, এসব কথা কেন? হ্যাঁ, সেকথাই বলছি।

আজ এত গুরুত্বপূর্ণ একটা একজাম, সারারাত পড়াশোনার পরেও শেষ হইয়াও হইল না শেষ ভেবে ভোররাতের ল্যাম্পপোস্টের কুয়াশামাখা নরোম আলোর নিচে শিট রেখে বেচারি অধ্যয়নে রত আর ৪টা ইটলা-বিটলা পোলাপান সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই বসল, “আপু, পড়াশোনা করছেন?” মেয়েটা সহজেই বলে ফেলতে পারত, “আরে নাহ্‌! দেখছ না, হাতে গ্ল্যাডিওলা নিয়ে তোমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি!”, তা না বলে লাজুক ভঙ্গিতে হেসে বলল, “হ্যাঁ, একটু রিভিশন দিচ্ছি।” শাদা বান্দরগুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একসাথেই বিশাল এক স্যালুট ঠুকল। ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব ডুম’ মুভিতে ইন্ডিয়ানা জোনস পেয়ারায় কামড় বসাতে বসাতে মেয়েটাকে বলেছিল, “Nothing shocks me–I’m a scientist.” আজকের আপুটি ওই সমবেত স্যালুটের পর নির্লিপ্তভাবেই আবার পড়তে লাগল। এখনও ৬টা বাজেনি, পিটি শুরুর বাঁশি বাজার আগে যতটুকু পড়ে নেওয়া যায়, ততটুকুই লাভ! আমি বড়ো সৌভাগ্যবান, এই অভূতপূর্ব বিদ্যাসাগরীয় দৃশ্যটি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। আপুটিকে দেখে মনে হলো, হয়তো ঠিক সে মুহূর্তে উনি মনে মনে বলছেন, “Nothing shocks me–I’m a nerd.” খুব ইচ্ছে করছিল, একটা টর্চ আপুর শিটের ওপরে ফেলে ফেলে আপুর পাশে পাশে হাঁটতে থাকি আর বেচারিকে রেক্টর মেডেলটা যে করেই হোক পাইয়ে দিই। সৈয়দ মুজতবা আলী ইতালির মহিলা-কবি ফিলিকাজা থেকে ধার নিয়ে লিখেছিলেন,
রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়!
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়।

আমারও ইচ্ছে হলো, গুরু মুজতবা থেকে ধার করে লিখি,
রেক্টর মেডেল, এত মোহ তুমি কেন ধরেছিলে হায়!
পিএটিসি’র আঁতেলগোষ্ঠী জীবন ভুলিয়া লুটাইল তব পায়।

বাঁশি বাজল। হাঁটা শুরু। ঘন কুয়াশা। আবছা আলোর ফাঁদ। ওতে আটকে-পড়া কিছু হিম হিম ঘুম। গাছের আড়মোড়া ভাঙা। পাখিদের দিনের শুরু। বাঁশি বাজল। হাঁটা শেষ। ডরমেটরিতে ফেরা। ঘুম শুরু।

আজকের পিটি অফ। কেন? কেন আবার! আজ যে ‘মডিউল ১’-এর একজাম! পড়াশোনা করতে হবে না? ভালো মার্কস পেতে হবে, টপ থার্টিতে থাকতে হবে। লেখাপড়া করে যে, বিদেশ ঘুরতে যায় সে! আমার খুশি দেখে কে! আমাদের মোট ২৩টা মডিউল। তার মানে, অন্তত ২৩ দিন পিটি অফ! পিটি অফ মানে, ভোরের সুখনিদ্রা। আহা, একজাম এত সুন্দর কেন! মডিউল আরও কয়েকটা বাড়লে কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হতো? আমরা যে শিখতে চাই, মানে আরও বেশি বেশি একজাম দিতে চাই! বোঝে না পিএটিসি, বোঝে না...

আজ এই প্রথম বারের মতো পিএমসি (প্রেসিডেন্ট অব দ্য মেস কমিটি) সকালের নাস্তায় ডিম পাড়েনি; ইয়ে মানে, ডিমের ব্যবস্থা করেনি। সবাই বেজায় খুশি। আজ একজামে কেউই ডিম পাড়বে না, এই খুশিতে খুশি। পিএমসি’র হিউমার সেন্সকে স্যালুট। এই পিএমসি’র ফুড ম্যানেজমেন্ট, মেন্যু সিলেকশন এমনিতেই বেশ ভালো, তার উপরে আজকের এই মজাটা বেশ ভালো লাগল। সবাই দেখলাম, বেশ উদ্‌বিগ্ন। একজামের আগে টেনশন করাটাও একটা সাধারণ ভদ্রতা। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি একটু পর যে-একজামটা শুরু হতে যাচ্ছে, ওটা নিয়ে একটু হলেও টেনশন করতে, সিরিয়াস হতে, কিন্তু কিছুতেই পারলাম না; বরং বাকিদেরকে দেখে কেমন জানি হাসি পাচ্ছিল। সিরিয়াস একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাই, এই মুরগিটা কি দেশি ফার্মের? না কি পাকিস্তানি ফার্মের? এটা তো বোধ হয় মুরগি না, মোরগ। ঠিক না ভাই?” এর উত্তরে উনি কিছুই বললেন না।

একজাম হলো। যুদ্ধ যুদ্ধ সাজ। প্রশ্নপত্র এল। বড়োই মন ভালো-করা প্রশ্ন! মুখস্থ করে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। যারা মুখস্থ করে-টরে এসেছে সবাই নগদে ধরা! পিএটিসি’কে ধন্যবাদ। খুবই সুন্দর সৃজনশীল টাইপের প্রশ্ন। লেকচার শিট থেকে কিছুই আসেনি। কমনসেন্স থেকে বানিয়ে লিখতে হবে। আমার খুশি দেখে কে! লিখতে আরম্ভ করলাম। কী কী লিখেছি, সেগুলোর মধ্য থেকে দু-একটা বাংলায় শেয়ার করছি:
# আপনার ক্যাডার দেশের নাগরিকদের কীভাবে সেবাদান করে, সেটি লিখুন।...আমি যা জানি এবং যা জানি না, সব লিখে দিয়েছি। সুখের এবং আশার কথা, আমার ক্যাডারের কেউ এখানে ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে নেই। অতএব, আমি যা-ই লিখি না কেন, তা-ই ঠিক।
# শুধু আর্থিক সততাই একজন সরকারি কর্মকর্তাকে মূল্যায়নের একমাত্র মাপকাঠি নয়—ব্যাখ্যা করুন।...সাহিত্য, ইতিহাস, কাব্য—সব কিছুর জগা খিচুড়ি রান্না করে দিয়েছি।
# এই ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্সের শিক্ষা আপনি কীভাবে আপনার অফিসে কাজে লাগাবেন?...মনের মাধুরী-ঐশ্বরিয়া-ক্যাটরিনা সব কিছু মিলিয়ে-মিশিয়ে যা মাথায় এসেছে এবং আসেনি, তা-ই লিখে দিয়েছি।

আজকের একজামে কোনো কোনো পাবলিক সমানে লুজ শিট নিয়েছে। আমি তো যে-খাতাটা দিয়েছে, সেটার শেষের ৩ পৃষ্ঠা শেষ করতেই পারিনি। এক ঘণ্টার একজাম আমার ৫০ মিনিটেই শেষ। খাতা জমা দিতে চাইলাম, ওরা নিল না। সবাই লিখতে ব্যস্ত। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। এই সুযোগে ক্লাসের সুন্দরীদের চোখ ভরে দেখে নিলাম। আহা, লাভলি একজামিনেশন! দুর্গাপুজোর অঞ্জলির সময় আর একজামের সময়—এই দুটোতে মিল কোথায়? দুটোতেই আমি থাকি, কিন্তু ওই সময়টাতে আমার করার মতো কোনো কাজ থাকে না। সময় নষ্ট করা ঠিক নয়, গুণীজনেরা বলেছেন। অগত্যা, কী আর করা!

একজাম শেষে বিদ্যাসাগর আপুর সাথে দেখা। পালাচ্ছিলাম, এর আগেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, “একজাম কেমন হল?” ৩২টা দাঁত বের করে বললাম, “খুব ভালো হয়েছে। ৩টা লুজ শিট নিয়েছি। আপনি কয়টা নিলেন?” শীতে ঠোঁট ফেটে গেলে আমরা যেরকম করে হাসি, উনি ঠিক সেভাবে হেসে বললেন, “অ্যাঁ! ৩টা! আমি মাত্র ১টা নিয়েছি। আচ্ছা ভাইয়া, ওরা আজ এমন করল কেন? শিট থেকে যদি প্রশ্ন না-ই আসে, তবে শিট দেবার দরকারই-বা কী?”

গতরাতের কথা মনে করলাম। পরীক্ষার পূর্বরাত্রি। এই রাতে কী করবেন? আইএমডিবি’র টপ টু-ফিফটি’র টপে-থাকা ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’-এর অ্যান্ডি ডুফরেস্নের ফিলসফিটাকে আমি পরীক্ষার পূর্বরাত্রির একমাত্র ফিলসফি মনে করি: Get busy living, or get busy dying. প্রিপারেশন আছে? ওকে, ঝালিয়ে নাও। প্রিপারেশন নেই? ওকে, ঘুমিয়ে নাও। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, দুটোতেই পরীক্ষা কমবেশি একই রকমেরই হয়। অতএব, নেই কাজ তো মুভি ভাজ। তনুজাকে ধন্যবাদ।

আজ ক্লাস করে দুটো ব্যাপার মনে হলো:
এক। গুলির ভয় ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ আপনি গুলিটা ছুড়ছেন না। গুলিটা ছুড়ে ফেললেই কিন্তু আপনার ক্ষমতা শেষ। The best power is not to use the power.
দুই। লোকে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা বলার সময় যদি নিজ থেকেই, মাস্টার্স কোথা থেকে কমপ্লিট করেছেন, ওইটুকুই শুধু বলেন, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরে নিতে হবে যে, উনি গ্রাজুয়েশন খুব একটা ‘ভালো প্রতিষ্ঠান’ থেকে করেননি।

যখন স্টুডেন্ট পড়াতাম, তখন স্টুডেন্টদের জন্য ইংরেজি নোট করার সময় সবচাইতে কঠিন কঠিন জিআরই ওয়ার্ড আর প্যাঁচানো প্যাঁচানো সেনটেন্স দিয়ে নোট করতাম। আমার কী দোষ? স্কুল-কলেজের স্যাররা ২০০ বছর আগের ইংরেজিতে মার্কস বেশি দিতে পছন্দ করেন। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ওরকম করে নোট করতাম। এই যেমন, হেডমাস্টার/ প্রিন্সিপ্যালের কাছে অ্যাপ্লিকেশনের শুরুটা ছিল এরকম: With due veneration and humble submission, I beg to lay before you the following prayer of mine for favour of your sympathetic consideration and kind perusal. শেষটা ছিল এরকম: Under the circumstances furnished above, may I, therefore solicit and aspire that the splendidly benign personality and generosity you are fully endowed with would be softened enough to grant...আর মনে নেই। আমার স্টুডেন্টদের কারও যদি এই লেখাটা চোখে পড়ে, তাহলে একটু মনে করে দেখো তো, কী ভয়ংকর ভয়ংকর সব ইংরেজি শিখে-টিখে অল্পবয়সে দাঁত খুইয়েছিলে না?! এখন ভাবি, ২০০ বছর আগের ইংরেজিকে আঁকড়ে ধরে রাখলে স্মার্ট ইংরেজি শিখতে আমাদের আরও ২০০ বছর লেগে যাবে। যাঁরা খাতা দেখেন, তাঁরা এই ব্যাপারটা একটু দয়া করে ভেবে দেখবেন কি?

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যার ক্লাসে বলতেন, “একজন আধুনিক মানুষের ৩টি জিনিস জানা থাকতে হবে: কম্পিউটার। ইংরেজি। ড্রাইভিং।” আমি একটু অ্যাড করছি। ইংরেজি শেখার বেলায় বলতে গেলে আমি কথাটাকে একটু বদলে দেবো এভাবে: একজন আধুনিক বাঙালির...আসলে আমরা ইংরেজি শিখি কেন? আমার কাছে প্রায়ই মনে হয়, আমরা ইংরেজি শিখি আমরা গরিব বলে। ওটা না শিখলে কী হয়? বিশ্বের অনেক উন্নত রাষ্ট্রের জনগণ ইংরেজি জানে না, এবং এটা নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। বরং প্রয়োজনে ইংরেজরা ওদের ভাষা শিখে নিচ্ছে। আচ্ছা, আমরা যারা ইংরেজিতে ফটফট করি, তারা বাংলা কতটুকুই-বা জানি? এখন বাংলায় লিখলেও একটা সময়ে আমি কেবলই ইংরেজিতে লিখতাম। এবং আমি এটা বিশ্বাস করি, ভালো বাংলা না জানলে ভালো ইংরেজি লেখা যায় না। যাদের ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ বাংলা, তাদের ক্ষেত্রে একথা পুরোপুরি খাটে। এর বিরুদ্ধযুক্তি হিসেবে আপনাদের কেউ কেউ অরুন্ধতী রায় কিংবা বিক্রম শেঠের উদাহরণ টানতে পারেন। তাঁদের বলছি, বাঙালি বাবা কিংবা মা’র ঘরে জন্ম নিলেও ওঁদের কারও ই ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ বাংলা ছিল না।

আজ ক্লাসে কিছু মজার জিনিস অনেক দিন পর মনে পড়ে গেল। এই যেমন, পাগুটাদীপতি, কিলাইয়া হাঁকাইয়া ডাকাত মারিলে দেশে শান্তি মিলিবে, মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়ে, বাবার হইল আবার জ্বর সারিল ওষুধে, পিসি চল যাই, আমার মানুষেরা গান করে এইচ, এবং এরকম আরও কিছু। বন্ধুরা, আচ্ছা দেখি বলুন তো, এসব নেমোনিকে কী কী হয়? মনে পড়ে?

পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে এসেছে। মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হলো, “দেখি, ‘ষ’ বানান কর তো!” মেয়েকে হেঁটে দেখাতে বলা হলো। মেয়ের বাবাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনার জায়গাজমি কী পরিমাণ আছে? বিয়েতে খরচাপাতি কেমন করবেন?” আচ্ছা, আমরা এত খাটাশ কেন? মেয়েপক্ষ এমন লোকের সাথে কথা বলেই-বা কোন রুচিতে? আজ ক্লাসে কারও কাছে কিছু-একটা শুনে এই ভাবনাটা এল।

১৯৮৩ সালের ২৬ জুলাই তারিখে প্রিন্সেস ডায়ানা গ্রিমসবাই শহরে একটা হসপিটাল উদ্‌বোধন করতে যান। সেদিনের বাঁধভাঙা ভিড়ের মাস-হিস্টিরিয়া দেখে পরের দিন ‘দ্য সান’ খবরের কাগজে বেরিয়েছিল, “IT’S DI-MANIA! 100 collapse as fans go wild on walkabout.” আমরা অপেক্ষায় আছি, নারীসমাজের কল্যাণে একদিন আমরাও একটা শব্দ ইংরেজিতে পেয়ে যাব: Sal-Mania! দেখি, পেপারগুলো দেদারসে লিখে যাচ্ছে: Saifreena. ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবরের দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া একটা খবরের শিরোনাম ছেপেছে এভাবে: Saifeena to ring in their wedding anniversary at the Nawab’s Pataudi Palace. এখন কথা হলো, Saifreena কী বস্তু? তেমন কিছু না। সাইফ আলী খান আর কারিনা কাপুরের নামের নিওলোজিজম। সাধু সাধু! কিন্তু আমরাই বা কেন ‘উত্তচিত্রা’ করছি না? কী সমস্যা? আমরা চাফি (চা+কফি) খেয়েই যাচ্ছি, মোটেলে (মোটর+হোটেল) থাকছি, ম্যাক্সি (মোটর+ট্যাক্সি)-তে চড়ব চড়ব করছি, অথচ সাইকেল+ট্যাক্সি’তে চড়তেই যত আপত্তি! ওটাকে যে ছোটো করে বলতে কেমন জানি কেমন কেমন লাগে! ঠিক আছে, ওটা নাহয় বাদ! কিন্তু কই, এই সমস্যা তো উত্তচিত্রা’য় নেই। তবে কেন আমরা বাংলা সিনেমার ক্রেইজটাকে হারাতে দিচ্ছি? এপার বাংলাই-বা বাদ যাবে কেন? আচ্ছা, শুরুটা আমিই করে দিচ্ছি। এখন থেকে ‘দর্পচূর্ণ’-র ‘তুমি যে আমার কবিতা’ শোনার সময়ে বলে উঠুন, “আহা, রাজ্জাবরীর সোনালি দিনগুলি!” কী, বলবেন তো?

আমি কিন্তু ঠিক করেছি, বিয়ে করার পর আমাদের দু-জনের ওরকম কিছু একটা নাম-টাম দিয়ে দেবো। যদি শুনতে খারাপ শোনায়, তবে প্রয়োজনে ওর কিংবা আমার নামটাকে বদলে দিয়ে আমাদের পছন্দমতো একটা নাম দিয়ে দেবো। হা হা হা হা...কেন জানি পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’-এর একটা কবিতার কিছু লাইন মনে পড়ে গেল। ডুয়েট ঢঙের এই কবিতাটি কয়েকটা জায়গায় কয়েক জন সুকণ্ঠী সুন্দরীর সাথে দ্বৈতআবৃত্তি করেছি। সেখান থেকে শুভঙ্কর-নন্দিনী’র কিছু কিছু স্বপ্নের কথা শেয়ার করছি:
চাঁদের গা ছুঁয়ে বাড়ি,
রহস্য উপন্যাসের মতো ঘোরানো-প্যাঁচানো সিঁড়ি
বাঁকে বাঁকে সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো স্বপ্নদৃশ্য
শিং-সমেত মায়া-হরিণের মুন্ডু
হাসছ কেন? বলো, হাসছ কেন?

- কাটা হরিণ দেয়ালে ঝুলবে, অসহ্য!
হরিণ থাকবে বনে, বন থাকবে আমাদের
খাট-পালঙ্কের চারধারে
খাট-পালঙ্কের নিচে ছোট্ট একটা পাহাড়,
পাহাড়ের পেট চিরে ঝর্না।

- আচ্ছা তা-ই হবে।
পাহাড় চিরে ঝর্না, ঝর্নার উপরে কাশ্মিরী কার্পেট
সিলিং-এ রাজস্থানী-ঝাড় জলের ঝাঁঝরির মতো উপুড়-করা
জানলার গায়ে মেঘ, মেঘের গায়ে ফুরফুরে আদ্দির পাঞ্জাবি,
পাঞ্জাবির গায়ে লখনৌ-ই চিকনের কাজ।
হাসছ কেন? বলো, হাসছ কেন?

আজ বিকেলে বাস্কেট বল কোর্টে কার্টুনের মতো বাস্কেট বল ড্রিবলিং করে-টরে রুমে ফেরার পথে দেখলাম, অরণ্যের মতো সাজ-নেওয়া এলোমেলো গাছের ঝরাপাতায় ঢাকা মেঠোপথের ধারে একটা ছাউনি। ওটার ভেতরের ঘোরানো বেঞ্চিতে বসা যায়, কফির ধোঁয়ায় আড্ডা জুড়ে দেওয়া যায়। ভাবতে থাকলাম, ওখানটাতে কোনো একটা ধ্যানী মাঘের হিমহিম সন্ধেয় কফির আবেশে উষ্ণতা খুঁজে ফিরব। ওটার আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। শুধু আছে বিশ্বস্ত গাছগুলো, ওদের পাতা-ঝরার নৈঃশব্দ্য। ওখানটায় বসে বসে পৃথিবীটাকে অন্য গ্রহ বানিয়ে দেওয়া যাবে খুব সহজেই। নির্জনতার আয়োজনে জীবনের খোঁজ পেতে এখানেই ফিরে ফিরে আসতে হবে।

আজকের শিডিউলটা আমাদের জন্য পিএটিসি’তে এখনও পর্যন্ত সবচাইতে হেকটিক শিডিউল। আজ স্পোর্টসের পরেও সন্ধেয় ২ ঘণ্টার একটা সেশন ছিল। সেশনটা কিছু ইকনোমিক থিওরির উপর। কন্ডাক্ট করলেন একজন সিনিয়র সহকারী সচিব। স্যার ২ ঘণ্টায় যা পড়ালেন, সেটা আইবিএ’তে আমাদেরকে ইকনোমিকস কোর্সে ৩টা ক্লাসে পড়ানো হয়েছিল। কিছু গ্রাফ-টাফও ছিল ওঁর লেকচারে। উনি নিজেও আইবিএ ম্যাটেরিয়াল (পড়ুন, ‘অ্যালামনাই’। ওঁকে ‘ম্যাটেরিয়াল’ বলতে ইচ্ছে হলো, তাই বললাম।)। সাড়ে ছ-টায় শুরু, সাড়ে আটটায় শেষ। ২ ঘণ্টা উড়ে গেল। আমাদের মতো ম্যাঙ্গোপাবলিককে ওরকম ক-টা ক্রিটিক্যাল থিওরি আর গ্রাফ বোঝানো সহজ ছিল না। ক্লাসটা কেমন ছিল? শুধু এইটুকুই বলব, উনি পেরেছেন। একটু নেপোটিজম করি, কেমন? আইবিএ রকস!!

আমি সাধারণত খুব সিরিয়াস টাইপের কারও সাথে খুব একটা মিশি-টিশি না। ক্লাস শেষে ওরকম একজন আমার দিকে এগিয়ে এলেন, সকালের মতোই আমি দ্রুত হেঁটে পালাতে যাব, তার আগেই উনি এসে পড়াতে জিজ্ঞেস করলাম, “নমস্কার, দাদা। কেমন আছেন?” ওঁর উত্তর, “আপনি তো আইবিএ’তে ছিলেন, না? আমাকে IS-LM মডেলটা একটু বুঝিয়ে দিন।” যে-ব্যক্তি নমস্কারের উত্তরে পড়া ধরে, তার কাছে বেশিক্ষণ থাকাটা নিরাপদ নয় ভেবে আমি ওখান থেকে কোনোরকমে পালিয়ে গিয়ে আমার বিশাল আইবিএ-প্রতিভার পরিচয় দিলাম। ‘প্যারাডাইজ রিগেইনড’-এ মিলটন লিখেছিলেন:
The childhood shows the man,
As morning shows the day.

ওটা লেখার আগে এই দাদার সাথে দেখা হলে মিলটন নির্ঘাত লিখতেন,
The greeting shows the nerd,
As morning shows the evening!