ডেটলাইন ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/ কারও দানে পাওয়া নয়...আব্দুল লতিফের এই গানটা পিটি’র সময় প্রতিদিন শুনতে শুনতে হাঁটি। আমাদের এক কলিগের খুব পছন্দের গান, উনি প্রতিদিনই ভোরে হাঁটবার সময় এটা করেন। আজকের ভোরটায় দেখলাম, লাল-নীল আলো জ্বেলে একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে। এই শান্ত ভোরে পাখিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ও চলে যাচ্ছে—ওড়ায় আর শব্দে; সেই ছোটোবেলাতে যে প্রচণ্ড শব্দে চমকে উঠতাম, সে পুরোনো শব্দ করতে করতে। ছোটোবেলায় একেকটা প্লেন উড়ে যেত, আর আমরা মাথা আকাশের দিকে ছুড়ে ছুড়ে দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম; ভাবতাম, ওটা কি অনেক বড়ো? তাহলে এই দুই আঙুলের ফাঁকে আটকে যায় কীভাবে? তর্জনী আর বুড়োআঙুলের মাঝে ছোটোবেলার ছোট্ট দূরত্বে ওটাকে নিয়ে এসে পুরো প্লেনটাকেই পকেটে পুরে রাখতাম। ওই সময়টাতে শব্দদূষণ বোঝার বয়স হয়নি, তাই ওই সময়টাতে শব্দদূষণও ছিল না। যা-কিছু জানি না, বুঝি না, সেটির অস্তিত্ব কতটুকুই-বা?
একটা ব্যাপার ঘটে। আমি যখন লিখি কিংবা কোনো কিছু নিয়ে ভাবি, তখন হঠাৎ হঠাৎ একটা পুরোনো ভাবনা কিংবা স্মৃতি মনের কোণে উঁকি দিয়ে আবার হারিয়ে যায়। ঠিক একটু আগেই এটা হলো। গতকালকের ডায়েরি আজ লিখছি। প্লেনের কথা লিখছি আর ভাবছি, আজ শুক্রবারে কফি-কর্নারে কফি পাওয়া যায় কি না। এরই মাঝে ভাবনাটা এসে আবার হারিয়ে গেল। এইসব হারিয়ে-যাওয়া ভাবনার দাম লক্ষ টাকা। মুহূর্তের গাফিলতিতে কত কিছু হারিয়ে যায়! কেমনটা লাগে বলুন তো!
ওই যে দূরে যেখানটায় আলো জ্বলছে আর নিভছে, সেখানটাতে কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের পেছনে ইটের লাল লাল তিনটা বিল্ডিং। আলোগুলোতে প্রাণ জ্বলে আর নিভে। আজকের ভোরটাতে ওগুলো অন্যরকম হয়ে গেল নাকি? প্রতিদিনই তো দেখি ওগুলোকে। কই, এমন তো হয় না কোনো দিন! তাহলে কি কোনো কোনো দিন অন্যরকমই? না কি কোনো কোনো দিনে কোনো কোনো কিছু অন্যরকম? হলদেটে চাঁদটা উঠছে। এই চাঁদের সাথে দেখা হয় না কতদিন! ইটপাথরের মায়া বড়ো বিশ্রী মায়া! চাঁদকে দেখে হাসা হয় না কতদিন, চাঁদের আলোয় স্নান করা হয় না কতদিন, রাতের মুগ্ধ আবেশে হারাইনি কতদিন! চাঁদের গায়ে ভোরের আকাশটা লেপটে আছে। আলো ফুটবে কি ফুটবে না, প্রভাতরবির সাথে গতরাতের ঝগড়া দেখতে দেখতে জগিং-ট্র্যাকে একদল শাদা শাদা মানুষ এগিয়ে গেল। আমরা হাঁটছি কাঁটাতারের ঘেরা-দেয়া উঁচু উঁচু পাঁচিলের পাশ দিয়ে। পাঁচিলের ওপারে ভোরের নৈঃশব্দ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দানব ট্রাকগুলো ছুটে চলেছে। যখন ছোটো ছিলাম, তখন ওরকম কাঁটাতারের পাঁচিল টপকে ক্রিকেটবল আনতে যেতাম না? কতদিন হাফপ্যান্ট ছিঁড়ে গেছে, হাঁটুর কাছটায় ছিলে গেছে। মায়ের হাতে মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছি। ওই দুষ্টুমির দিনগুলি কোথায় লুকিয়ে আছে?
পার্কের ওধারটায় পাথরের স্তূপ। ছোটোবেলায় রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাথর কুড়োতাম না? দু-একটা অস্পষ্ট ধবধবে শাদা রঙের পাথর জুটে গেলে তো বেশ! পকেট ছিঁড়ে যেত ছোটোমানুষের ‘অমূল্য’ সম্পদে। ওগুলোকে বাসায় এনে মনে হতো, এই বুঝি সাত রাজার ধন নিয়ে ফিরলাম!
‘চ্যাপলিন’-এর ‘পাতাঝরা বৃষ্টি’ গানটা গাইতে গাইতে যাচ্ছি, এমনসময় দেখি, পাতাঝরা বনে এলোমেলো শীর্ণ গাছগুলোর আঁকাবাঁকা পোর্ট্রেট আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলছে, “দুষ্টুমি, না?” আবাসিক এলাকার সামনে দিয়ে যাচ্ছি। এক কলিগ মনে করিয়ে দিলেন, রেসিডেনশিয়াল এরিয়া, গান বন্ধ! হাঁটছি, দেখছি ওপরের দু-দিক থেকে ছুঁয়ে-থাকা ঝিরিঝিরি গাছগুলোর পাতায় পাতায় কী এক সবুজাভ বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে। হাওয়ায় হাওয়ায় অভিমানের সুর বাজছে। ওদেরকে বললাম, মন খারাপ কোরো না, এই তো আবার গাইব। পায়ের কাছে, পথের পাশে লজ্জাবতীরা লজ্জা পাবার প্রতীক্ষায় নিজেদের মেলে ধরেছে। ওদের ছুঁয়ে দিলাম। লজ্জা পেয়ে সে কী খুশি! ওদের ওই কুঁকড়ে যাওয়াতেই আনন্দ! এই একটুখানি লজ্জা পেতে কত অধীর আগ্রহ নিয়ে কত সময় ধরে ওদের এই বসে থাকা! মুলো-বাঁধাকপি-কুমড়োর ক্ষেতে শীতের নাচন জেগেছে। লাউয়ের খসখসে পাতাগুলো শিশিরে ভেজা ভেজা। মায়ের হাতে রাঁধা কচি মুলো দিয়ে কই মাছের ঝোল দিয়ে ফুলের মতো গরম গরম ভাত খাওয়ার ইচ্ছেটা টেনিস-কোর্টের হাত-পা ছুড়ে ছুড়ে ফ্রন্ট-ব্যাক, লেফট-রাইট’য়ে খুন হয়ে গেল মুহূর্তেই।
আজ বৃহস্পতিবার। বিকেলে স্পোর্টস নেই। আজ সবার বাড়িতে ফেরার দিন। পিটি সেশনে এমনিতেই ট্রেইনাররা আদিরসাত্মক কথাবার্তা বলেন। পেট-কোমর-উরু’র ব্যায়ামগুলোর নাম ওঁরা দিয়েছেন, ‘সিক্রেট এক্সারসাইজ’। এমন এমন কথাবার্তা চলে, যা শুনলে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের কান গরম হয়ে ওঠার কথা। ভাগ্যিস, পিটি’র সময় ওয়ার্মআপের জন্য আমাদের কান এমনিতেই গরম থাকে, তাই ওসব শুনে আর গরম হয় না—ইয়ে মানে, কান গরম হয় না।
সকালের সোনাঝরা রোদে আগুনে-সিলভিয়ার ভিড়ের প্রেমে পড়তে পড়তে প্রথম সেশনটাতে গেলাম। এই কয়দিন ধরে দেখছি, বাঙালি অফিসাররা বড়ো লাজুক প্রাণী। আমরা ফেইসবুকে একে অন্যের সাথে কানেক্টেড, ইনবক্সে মাঝে মাঝে হাই-হ্যালোও হয়, অথচ সামনাসামনি পড়লে, “আমি কেন নিজ থেকে আগে কথা বলব?”...এই ভাব। আমি ভাবি, কী হয় একটু করে হাই বললে? ওরাও ভাবে, কী হয় একটু করে হাই বললে? ওইটুকু সংকোচের স্টেশনেই থেমে থাকে অপরিচয়ের ট্রেনটা। ওটাতে স্টার্ট দেবে কে? আমি লোকের নাম মনে রাখতে না পারার অসীম স্মৃতিশক্তি নিয়ে জন্মেছি। লোকের চেহারা মনে থাকে, নাম যে কোথায় থাকে, আমি জানি না। ভাগ্যিস, ক্লাসে সবার বুকের কাছে নেমব্যাজ ঝোলানো থাকে, নাহলে ‘এই যে ভাই’ দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হতো। নিজের বেলায় অবশ্য আমি পিতৃপ্রদত্ত নামটা মনে রেখে এখনও পিতৃঋণ শোধ করে যাচ্ছি।
নীরদ সি চৌধুরীর শেষ বইটি বের হয় তাঁর ৯৯ বছর বয়সে। খুশবন্ত সিং ৯৫ বছর বয়সে ‘দ্য সানসেট ক্লাব’ উপন্যাস লেখেন। বড়ো বড়ো মানুষ শেষ বয়সে এসেও তাঁদের সৃষ্টিশীলতা ধরে রাখেন। যাঁরা আরও বড়ো, তাঁরা চান এবং অন্যদের মনে করিয়ে দেন, যাতে অন্যরা তাঁদের নিয়ে সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে। জর্জ অরওয়েলের অ্যানিম্যাল ফার্ম উপন্যাসের মতো করে বলি, সকল বড়ো মানুষই বড়ো, কেউ কেউ অন্য বড়োদের চাইতেও বড়ো। এসব ভাবছি আর পেছনের সারিতে বসে বসে ঝিমুচ্ছি। কোর্স কো-অর্ডিনেটর স্যাররা আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছেন, কেউ ঘুমিয়ে পড়লে কাঁধেপিঠে আলতোভাবে হাত রেখে জাগিয়ে দিচ্ছেন। আমি মনে মনে ম্যাপিং করছি, স্যার কোন কথার পর কোন কথাটা বলতে পারেন। মজার ব্যাপার হলো, বেশ কিছু মিলেও যাচ্ছে। আহা! ভাবছি, একটা ‘যুগান্তকারী’ প্রশ্ন করে স্যারকে খুশি করে দেবো নাকি? কিন্তু এত তেল পাই কই? ১ যুগ হতে চলল চুলে তেল দিই না। বসে বসে একটা থিওরি আবিষ্কার করে ফেললাম। থিওরির নাম সময়ের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। “ইন্টারেস্টিং ক্লাসগুলোতে ঘড়ি ফাস্ট চলে এবং বোরিং ক্লাসগুলোতে ঘড়ি স্লো চলে।” এটা প্রমাণের গুরুদায়িত্ব স্যারদের উপরে ছেড়ে দিয়ে একটা সুন্দরী মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে ক্লাস করতে লাগলাম। আহ্! বুঝি না এমন মেয়ে কী করে বানালে ঈশ্বর!
সিভিল সার্ভেন্ট অশোক মিত্র তাঁর নিজের জীবন আর কর্ম নিয়ে ‘তিন কুড়ি দশ’ লিখেছিলেন, আরেকজন সিভিল সার্ভেন্ট অন্নদাশংকর রায় লিখেছিলেন, ‘জীবন যৌবন’। বইদুটো পড়ে জেনেছি, ওঁদের বর্ণাঢ্য জীবনে ওঁরা কতটা ‘কম বোরিং’ ছিলেন। ওঁদের জীবিকা ছিল জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে জীবন কাটানি বলেই এখনও আমরা ওঁদের স্মরণ করছি। একই কথা এপার বাংলার শহীদুল জহির, হাসনাত আবদুল হাই, আবদুস শাকুর, আকবর আলি খান প্রমুখের ক্ষেত্রেও খাটে। আমলাদের লেখালেখি করার ট্র্যাডিশন কিন্তু অনেক পুরোনো। সেই চতুর্দশ শতকে ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিওফ্রে চসারের হাত ধরে এর যাত্রা শুরু। এখনও চলছে। চলবেও। এতসব কিছু কেন ভাবছি? কেনই-বা লিখছি? জানি না।
বাগানবিলাসের কথা মনে পড়ছে। পিএটিসি’র বাগানে এই ফুলের কয়েকটা গাছ আছে। আমরা করিডোরে হাঁটার সময় ওরা যেন অভ্যর্থনা জানায় পরম আদরে। ওদের নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে। কিন্তু ক্লাসে কেন? জানি না। ঠিক এ সময় প্রশ্নোত্তর পর্ব এল। কত প্রশ্ন করে রে! আহা, কাউকে কাউকে মুখ খোলার আগমুহূর্ত পর্যন্ত স্মার্ট মনে হতে থাকে। প্রশ্ন শুনছি আর ভাবছি, এইসব প্রশ্নও মাথায় আনা যায়! গুগলে ‘স্টুপিড কোয়েশ্চেনস’ লিখে সার্চ দিলে এসব চলে আসে নাকি? তবে সুখের বিষয়, প্রশ্নের মান দিনে দিনে উন্নত হচ্ছে।
পরের ক্লাসটাতে স্যার আমাদের উপর প্রচণ্ড রেগে গেলেন। উনি এমনিতে খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ, রেগে গিয়ে রীতিমতো কাঁপছিলেন। কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আমরা যে-এক্সকিউজই দিচ্ছি, এর কোনোটাই স্যারের পছন্দ হচ্ছে না। স্যারের রাশভারী চোখে আর চেহারাতে প্রচণ্ড রাগ আর অভিমান। স্যারকে দেখছি আর মাথায় ভর করছে ‘দ্য গডফাদার’-এর আল প্যাচিনো: “Only don’t tell me that you’re innocent. Because it insults my intelligence and it makes me very angry.”
পরের ক্লাস। স্যারের একটা কথায় আমার কোরিয়া-ভ্রমণের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। কোরিয়াতে রাস্তায় একটা ময়লাও নেই (আক্ষরিক অর্থেই)। সেখানে কেউই রাস্তায় ময়লা ফেলার কথা ভাবতেও পারে না। এমনও হতো, আমি একটা টিস্যু কিংবা একটা চুইংগাম ফেলার জন্য একটা ডাস্টবিনের খোঁজে অপেক্ষা করতাম। চুইংগামটাকে টিস্যুতে মুড়িয়ে ব্লেজারের পকেটে রেখে ঘুরতাম। অথচ সেই আমিই যখন বাংলাদেশে ফিরলাম, তখন যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলতে এতটুকুও লজ্জা লাগত না। গাড়ির গ্লাসটা নামিয়েই বিস্কিটের প্যাকেটটা ছুড়ে মারতাম। ভাবতাম, সবাই তো ফেলে। এটা ভাবতাম না যে, আমি তো আর সবাই না। ভিন্ন ভিন্ন দেশে বাঙালির আক্কেলের ভিন্ন ভিন্ন হাল। পরের দেশে গেলে আমরা জেন্টলম্যান হয়ে থাকি, আর দেশে ফিরলেই পুরোনো চেহারাতেই ফিরে আসি। বিদেশি কুকুররা গুডবয় আর দেশি কুকুররা ব্যাডকুত্তা। ওদের স্নান করাই শ্যাম্পুতে আর এদের করাই পচাসাবানে। You’re a gentleman. Well. A gentleman by choice? Or, a gentleman by force?
আজ এনভাইরনমেন্টাল পল্যুশনের উপরে ক্লাস ছিল। আমরা ক্লাসে স্যারকে এমনভাবে প্রশ্ন করছিলাম যেন স্যার নিজেই সব দূষণের জন্য দায়ী এবং উনি চাইলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রশ্ন করার সময়ে আমরা ভুলে যাই, স্যার এসেছেন ক্লাস নিতে, প্রবলেমগুলোকে অ্যাড্রেস করতে, সলভ করতে নয়। আজকের ক্লাসে একটা মজার ব্যাপার দেখলাম। স্যার প্রজেক্টরের পর্দায় এয়ার-পল্যুশনের একটা ভিডিয়োক্লিপ দেখাচ্ছেন। ওটার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে, সৌমিত্র-সুচিত্রার ‘সাত পাকে বাঁধা’র শেষ দৃশ্যের মিউজিকটা। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এটা কি সিমিলি? না কি মেটাফোর? না কি রীতিমতো অ্যালিগরি? না কি জাস্ট ঘোড়ার ডিম? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলাম, স্যার বলছেন, বাংলাদেশে রিসার্চের চিত্র হলো, একটা প্রজেক্টে হাত দেয়, ওটার টাকা আনে, সেই টাকাটা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়; ওটা করতে করতেই ওটারই কোনো একটা অংশ নিয়ে আরেকটা প্রজেক্ট বানায়, ওটার জন্যও টাকা আনে, এরপর সে টাকাও ভাগ হয়। এভাবেই চলতে থাকে টাকা কামানোর ধান্দা। প্রজেক্ট আর কমপ্লিট হয় না। আমরা তো জেগে জেগে ঘুমাই, আমাদের উন্নতি হবে কীভাবে? এটা শুনেই কান খাড়া হয়ে গেল। ফিসফিস করে বললাম, স্যার সবাই ওরকম না, কেউ কেউ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জাগে।
আগামী সোমবার একটা একজাম আছে। লাঞ্চের পরের সেশনটা ছিল ওটার ওপরে। ছোট্ট সেশন, একজাম কেমন হবে, প্রশ্নের ধরন কেমন হবে, কোন মডিউলে, স্যার এসব নিয়ে কথা বললেন। এই সেশনটা খুবই সিলি একটা সেশন। সেশনশেষে সবাইকে জিজ্ঞেস করা হলো কারও কোনো প্রশ্ন আছে কি না। এই সেশন নিয়েও প্রশ্নব্যাংক মহোদয়গণের প্রশ্ন থাকতে পারে, এটা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার সব ভাবনাকে মিথ্যে করে দিয়ে প্রশ্ন এল:
# স্যার, আমার একটা প্রশ্ন আছে। অবশ্য এটা না করলেও চলে, তবে এটা জিজ্ঞেস করাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে...(প্রশ্নের গৌরচন্দ্রিকা শ্রবণে মনে মনে প্রমাদ গুনিলাম! ও পাগ্লা! অ্যাত্তো বিনুদুন ক্যারেএএএএ...??)
# স্যার, প্রশ্ন আর উত্তরপত্র কি একসাথেই থাকবে? না কি আলাদা আলাদা থাকবে?
# স্যার, প্রশ্নের উত্তর কি সিরিয়াল মেইনটেইন করে লিখতে হবে?
# স্যার, আপনি বলেছেন, প্রশ্নের উত্তর বাংলা অথবা ইংরেজি যে-কোনো একটা ভাষায় লেখা যাবে। আমি কি একটা বাংলায় আরেকটা ইংরেজিতে, এভাবে করে লিখতে পারব?
# স্যার, সিটপ্ল্যান দেওয়া হবে?
আমি তো ভাবছিলাম, এরকম কিছু প্রশ্নও আসবে, এই যেমন, “স্যার, যে-কোনো কালির কলম দিয়ে উত্তর করা যাবে?” “স্যার, প্রশ্নের উত্তর করার সময় কোন রঙের কালির কলম দিয়ে লেখাটা রিকমেন্ডেড?” “পরীক্ষা চলাকালীন হিসু আসলে হিসু করতে যাওয়া যাবে, না কি চেপে রাখতে হবে?”
স্যার ওদিকে আরেক কাঠি সরেস। একটা প্রশ্নের উত্তরে বললেন, আপনাদের ৭টি প্রশ্ন থেকে যে-কোনো ৫টির উত্তর দিতে হবে। কেউ যদি ৫টির কম উত্তর দেন, তবে ওঁর খাতাটা, যে ক-টি উত্তর দিলেন, সে ক-টির উপরেই মূল্যায়ন করা হবে।
একটি কাল্পনিক প্রশ্নোত্তর দিয়ে লেখাটা শেষ করছি:
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কবিতাটি কার লেখা?
উত্তর: স্যার, এখানে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ কথাটি কেন বলা হয়েছে? কবিতাটি উনি লিখেছেন বলে? না কি কবিতাটি ওঁর সংগ্রহে ছিল বলে?
পুনশ্চ। আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে না।
. . . আমরা সবাই মিনি আমাদের এই মিনির রাজত্বে! আমরা সকলে মিনি-অফিসার।