পিএটিসি ডায়েরি: ৪ ফেব্রুয়ারি



ডেটলাইন ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

খড়ের নাড়ার মাঠ শীতের ভোরে ভেজা ভেজা হয়ে থাকে। ওখানটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এবড়োখেবড়ো মাটির ঢেলাগুলোর ভেতর থেকে যে হালকা সবুজ কচি দূর্বার ডগা উঁকিঝুঁকি দেয়, সেটার পেছনেও ‘নিশির শিশির’। আজ ভোরে ওরকম একটা মাঠ দেখতে দেখতে এগুচ্ছি আর ভাবছি, সেই ছোটোবেলাতে কোথায় যেন ওরকম ঢেলায় হাঁটতে গিয়ে পা মচকে পড়ে যাই। মা সেখানটায় কোথায় একটু আদর করে মলম-টলম লাগিয়ে দেবে, তা না, ধরে সে কী মার! সাথে হুংকার: “তুই ওখানে গিয়েছিলি কেন?” আচ্ছা, কোথায় যেন ছিল ওটা? মেজোপিসির বাড়িতে না? এই তো সেদিন পিসিমা মারা গেলেন। ছোটোবেলায় কত জ্বালিয়েছি পিসিমা’কে! ওঁদের বাড়িতে গিয়ে দুপুরবেলায় কোকিলের সাথে কুউউউউ...স্বর নকল করে সুর মেলাতাম আর ওই বেচারি ওর সঙ্গীকে খুঁজে ফিরত। পাখিগুলো বড্ড বোকাবোকা ভালোমানুষ!

আজ ভোরের আলো একটু আগে আগেই ফুটেছে। আলো এসে রঙ্গন-গাঁদা-সিলভিয়া বাগানে মাঘের হিমেলরাঙা আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা করিডোরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ওদের দিকে স্রেফ তাকিয়েই যেন হাতের আঙুলে ওদের কোমল পাপড়িগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছি আর যাচ্ছি। প্রতিদিন ভোরবেলায় রিসেপশনের সামনে পিঁপড়েদের সারি এসে থামে। ওটা সবার জংশন। ওখান থেকে সকালের পিটি শুরু হয়। ৬টা বাজতে তখনও বাকি। পাখিদের ঘুম ভেঙে গেছে আগেই। ওদের কিচিরমিচির শুনতে শুনতে বডি ওয়ার্মআপ করছি, এই সময় দেখি, বিপিএটিসি স্কুল অ্যান্ড কলেজ-এর বাসে শুধু ‘পি’ অক্ষরটাতেই ঘষামাজা করা। আসলে ওটাতে কেউ ঘষামাজা করেনি। প্রকৃতির নিয়মেই ওটার রং ক্ষয়ে ক্ষয়ে ওরকম হয়ে গেছে। তবুও খুব করে ভাবতে ইচ্ছে হলো, ওটা প্রতীকী নয় তো? বিপিএটিসি’র পি’তে হয় পাবলিক। বাংলাদেশে এই পাবলিক, মানে ‘সাধারণ জনগণ’-ই সবচাইতে বেশি ঘষামাজার শিকার। আমরা সাধারণ মানুষেরা আসলেই বড়ো বেশি অসহায়। তাজা তাজা প্রাণ ঝরে যায় মুহূর্তের ইশারাতেই। বেঁচে আছি, এ-ই বেশি—এমনটা ভাববার সময় এসে যাচ্ছে। ভাবতে কষ্ট হয় খুউব! কারও ইচ্ছে-অনিচ্ছা, গোঁয়ার্তুমি কিংবা খেয়ালের হাতে জিম্মি হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। এই দেশ আমার, এটা ভাবতে ভালো-লাগানোতেও পাপবোধ জন্মাতে আরম্ভ করছে। আমার মনে হতে লাগল, ওই পি’টা যে আছে, এ-ই তো বেশি, সে যেমনভাবেই থাকুক না কেন। না থাকলেই-বা কার কী এসে যেত?

শ্বেতভাল্লুকের দল এগিয়ে যাচ্ছে। লেফট রাইট! লেফট রাইট! পাশে পার্কের বেঞ্চিগুলো ইশারায় ডেকেই চলেছে…একটু বসে যাও, ভায়ারা! আহা, তা করার যে জো নেই, সময় নেই; আছে ইন্সট্রাক্টরের কড়া হাঁক, জোরকদমে জোরসে চল! আমরা তা-ই চলেছি! দূর থেকে দেখা যায় লেকের শানবাঁধানো ঘাট। ওর ইটগুলো বেরিয়ে-টেরিয়ে আছে। এপার থেকে ওগুলোকে ইটের টেক্সচার ভাবতে বেশ লাগে। ঘাটের ওপরের দিকে বসার পাকা আসনটিতে শুকনো পাতা আর শ্যাওলার লেপটে-যাওয়া কালচে সবুজ বিন্যাস দেখলে মনে হয়, ওতে বুঝি ফ্রেস্কোর কাজ-করা। সেদিনের মতো আজও টেনিস কোর্টের মেঝেতে শুইয়ে ব্যায়াম করাল। ওগুলো বেশ কঠিন। কত রকমের কসরত করে হাত-পা রাখতে, বাঁকাতে, ঘোরাতে আর তুলতে বলে। চিৎ হয়ে শুয়ে পা-দুটোকে একসাথে করে হাত-দুটোকে মাথার পেছন দিকে আঙুলগুলো ক্রস করে দিয়ে হাঁটু সোজা রেখে দুই-পা একসাথে ৬ ইঞ্চির মতো উচ্চতায় ২-১ মিনিট রাখতে বলে। এতে নাকি ভুঁড়ি কমে। উফফ্‌! এ-ও সম্ভব! থাকুক ভুঁড়ি। বাবা ভুঁড়ি, বেঁচে থাক, সাথে আমিও বাঁচি!

আজকের ব্রেকফাস্টে দিল সেদ্ধডিম, পাউরুটি-জেলি আর কলা। পিএটিসি’তে চামচ, কাঁটা-চামচ আর ছুরি দিয়ে খেতে হয়। এক আপুর কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে করে একটা কাঁটা-চামচ দিয়ে আটকে ধরে রেখে আরেকটা চামচ দিয়ে লেবু চিপতে হয়। ওই আপু কিছুতেই হাত দিয়ে খান না। “Why use 2 sticks when you have 5 fingers?” আমি কিন্তু আবার এই নীতিতে বিশ্বাসী। (তবে ইদানীং ওসব স্পুন, নাইফ আর ফর্কে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।) আজ প্লেটে খাবার নিয়েই ওঁর কাছে ছুটে গেলাম। উনি পাশের টেবিলেই বসেছিলেন। গিয়ে বললাম, “আপু, নাইফ-ফর্ক দিয়ে ডিমের খোসা ছাড়ায়ে দেন, কলা ছুলে দেন। আমি পারতেসি না।” শুনে উনি হেসেই খুন। বললেন, “সুযোগ পেয়ে মেরে দিলে, না?” (বলুন তো, কে সে আপু? এটা আমার কলিগদের জন্য ক্যুইজ।) আজ ক্লাসে যাবার সময় নেমব্যাজ হারিয়ে ফেললাম। এবং একজন সত্যিকারের পুলিশ ওটা পরে খুঁজে দিলেন। আমি ওটার জন্য থানায় জিডি করিনি, পুলিশ নিজ দায়িত্বেই ওটা খুঁজে দিয়েছেন…তা-ও আবার এএসপি! ভাবা যায়! বেঁচে থাকুক পুলিশ!

পিটি’র সময় আমাদের দুই-পা যতটুকু সম্ভব ফাঁক করে দাঁড়াতে হয়। ওই সময়ে ইন্সট্রাক্টররা বলেন, Leg Apart! Leg Apart! মানে দুই পা দুইদিকে দূরে রেখে দাঁড়াও। আরও বলেন, Maximum! Maximum! ওই দুইটি কথা এখন আমাদের মুখে মুখে। আমরা বলি, ম্যাক্সিমাম! আগের কথাটাকে ছোটো করে বলি, লেগাপার্ট! (Leg+Apart= Legapart!) এটা করিডোরে হাঁটবার সময়, ডাইনিংয়ে, ক্লাসে মজা করে বলি। কথা সেটা নয়। কথা হলো, আজ ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে শুনি, লেগাপার্ট ম্যাক্সিমাম! বলে বলে চ্যাঁচানোর জন্য ২ জন নাকি শোকজ খেয়েছেন। আজব, পুরাই! (কেউ কি আবার কথাটার লিটারেল মিনিং ধরে-টরে বসল নাকি?) ভালো কথা, পিএটিসিলিকসে প্রকাশ, আমাদের এক কলিগ নাকি ৩ দিন ঘুমের মধ্যেই চেঁচিয়েছেন, লেগাপার্ট! লেগাপার্ট!! ম্যাক্সিমাম! ম্যাক্সিমাম!! লেগাপার্ট ম্যাক্সিমাম! ম্যাক্সিমামের কাহিনি ওয়াশরুম পর্যন্ত বিস্তৃত। পোলাপান ওইখানে গিয়ে চিল্লায়, ম্যাক্সিমাম প্রেশার! ম্যাক্সিমাম প্রেশার!! বুঝুন অবস্থাটা!

‘পপাই, দ্য সেইলর ম্যান’ কার্টুনের ব্লুটোর মতো দেখতে চমৎকার ভালোমানুষ টাইপের এক ভদ্রলোক ক্লাস নিতে এলেন। অনেক জানেন, অনেক ঘুম পাড়াতেও পারেন। ছোটোবেলায় দেখতাম, চাচা চৌধুরী’র কমিকসে লেখা থাকত, চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি কম্পিউটারের চাইতেও প্রখর। স্যারের সম্পর্কে একটা কথাই বলব, স্যারের কথা স্লিপিং পিলের চাইতেও কার্যকরী। আমি মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্ন দেখলাম, নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে কিনারায় এসে ধপাস করে নদীতে পড়ে গেছি। পড়েই স্বপ্নভঙ্গ! ঘুম ভেঙে দেখি, পাশের কলিগ গুঁতো মেরে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছেন। এই জাতীয় ফলিং ড্রিম দেখার মানে কী? আমার কাছে স্বপ্ননামা (আই মিন, খোয়াবনামা) টাইপের যে কয়েকটি বই আছে, সেগুলো পড়ে জেনেছি, এই ফলিং ড্রিম হচ্ছে সবচাইতে কমন ড্রিমগুলোর একটা। এটি দেখা অনিরাপত্তা, অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তার লক্ষণ। এটি বলে দেয়, আমি আমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিংবা কর্মক্ষেত্রে খুব চাপের মধ্যে আছি। আমি সবার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছি না। আমি কোনো কিছু হারানোর ভয়ে ভীত। আরও কী কী যেন লেখা আছে। কথা সেটা নয়। কথা হলো, এতসব কিছু হয়ে যাচ্ছে, তা-ও আবার ক্লাসরুমে! আর আমি এর কিছুই জানি না! স্যার, তুসি গ্রেট হো! ভালো কথা, ফলিং ড্রিমের ফ্রয়েডিয়ান ব্যাখ্যাটা দেই? ইয়ে মানে, না থাক। আমি প্রায়ই ঘুমোনোর সময় উঁচু উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাই, একলাফে আকাশে উঠে লাফিয়ে লাফিয়ে উড়তে থাকি, আরও কী কী সব যেন করি। আমার খোয়াবনামার কাহিনি বিশাল। আজ থাক, এসব নিয়ে আরেকদিন লিখব।

অডিটের ক্লাস নিতে এলেন অডিটের একজন স্মার্ট অফিসার। স্যারের মাথায় চুল একটু কম। স্যার বললেন, যখন কেউ আমাকে বলে, “স্যার, আপনার চুল গেল কই?” তখন আমি ভাবি, “ব্যাটা, আমার চুল যে নাই, এটা আমি খুব ভালোভাবেই জানি। তোমাকে এটা আর মনে করিয়ে দিতে হবে না।” আবার যখন কেউ বলে, “স্যার, আপনার মাথায় এত চুল এল কীভাবে? আমি গত মাসেও তো এত দেখি নাই।” তখন আমি মাথায় হাত দিয়ে দেখতে থাকি, আসলেই চুল বেড়েছে কি না। বাড়েনি, জানি; কিন্তু এটা ভাবতেই ভালো লাগে। ওই লোকটাকে ভালো মনে হয়। কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয় মিথ্যা প্রশংসাও আমাদের খুশি করে দেয়।

লাঞ্চের পরের সেশনটা ছিল সোশ্যাল এটিকেটস অ্যান্ড টেবল ম্যানারসের উপর। স্যার প্রথমেই বললেন, ঘটনাক্রমে আমরা যখন অফিসার হয়েই গেছি, তখন তো আমাদের কিছু কিছু দায়বদ্ধতা এসে গেছে। ওগুলো মেনে চলতে হবে। আমরা যখন কোথাও যাব, এমন কোথাও, যেখানে আমরা কখনোই যাইনি, তখন আমরা ওখানকার ম্যানারস কীভাবে শিখব?
আমরা উত্তর দিলাম, স্যার, সবাই যা যা করে, তা তা দেখে দেখে শিখব। সবাই যা করে, আমিও তা-ই করব।
স্যার বললেন, আহা, তুমি তো আর সবসময়ই ফলো করে করে শেখার সুযোগ পাবে না। এই যেমন ধরো, তুমি একটা আন্তর্জাতিক মানের হোটেলে কীভাবে স্নানখানা কিংবা টয়লেট ইউজ করতে হয়, সেটা তো আর কারও কাছ থেকে দেখে শিখতে পারবে না!

এরপর স্যার একটা গল্প বললেন।
একবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কুলিজ তাঁর কিছু বন্ধুকে হোয়াইট হাউজে দাওয়াত দিয়েছেন। বন্ধুরা এল। কিন্তু ওরা জানত না কীভাবে প্রেসিডেন্টের দাওয়াতে খেতে হয়। ওরা ঠিক করে এসেছিল, প্রেসিডেন্ট যা যা করবেন, ওরাও ঠিক তা-ই তা-ই করবেন। প্রেসিডেন্ট কুলিজ ওঁর কফিটুকু পিরিচে ঢেলে দিলেন। ওঁর দেখাদেখি বাকিরাও ওঁদের কফিটা পিরিচে ঢেলে নিলেন। একটু পর প্রেসিডেন্ট সেই পিরিচটা ওঁর বেড়ালের দিকে এগিয়ে দিলেন। বেড়াল চুকচুক করে কফি খেতে লাগল। এটা দেখে তো বাকিদের ‘ভিক্ষা চাই না, মা, কুকুর সামলাও’ অবস্থা। ওখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে আর কি!

বিদেশিরা সবাইকেই নাম ধরে ডাকে। ওরা ওদের প্রফেসরকেও নাম ধরে ডাকে। ওদের দেশে কোনো ‘স্যার’ নেই। আমরা যখন একই ব্যক্তিকে কেউ চাচা, কেউ খালু, কেউ দাদা, কেউ দোস্তো, কেউ রহিম নামে ডাকি, তখন ওরা অবাক হয়ে ভাবে, একটা মানুষের এত নাম হয় কী করে?

খাবারের টেবিলে বসে হইচই করে গাপুসগুপুস খাবার খাবেন না। প্রয়োজনে একটা ফর্মাল ডিনারে যাবার আগেই বাসা থেকে বের হবার সময় কিছু খেয়ে যাবেন। কখনো কি খেয়াল করেছেন, বিয়ের ভিডিয়োতে খাওয়ার টেবিলের দৃশ্যটাই সবচাইতে বিশ্রী? খাওয়া শেষ হয়ে গেলে নাইফ আর ফর্ক প্লেটের উপরে রেখে দিতে হবে ঘড়ির কাঁটায় ১০:২০টা কিংবা ১০:৪০টা স্টাইলে।

সেশনশেষে রুমে ফিরছি। গোলাপের বাগানে দেখলাম, ৫ জন মালী গাছগুলোর পরিচর্যা করছেন। তাঁদের মধ্যে ২ জন গোলাপের কাছে গিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছেন। নিজের সব সৌভাগ্যকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে ওঁদেরকে ঈর্ষা করতে ইচ্ছে হলো। ভাবতে লাগলাম, আহা! কী সৌভাগ্য! আমাদের ওইদূরে যাবার অনুমতি নেই। আচ্ছা, অনুমতি নেই বলেই কি অত আকর্ষণ? যদি ইচ্ছে হলেই প্রেয়সীর কাছে যাওয়া যেত, তবে কাছে যাবার আকুতি কি থাকত অত? ডাকলে যদি সে আসত, তবে কি আমি ওকে ফিরিয়ে দিতাম না? একটু দূরে লকলকে লাল আগুনের ফোয়ারা। বিকেলের শেষ আলো সারি সারি সিলভিয়ার উপরে এসে পড়ছে। এত রং ধরতে জানে ও! আহা! শুধুই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ডরমেটরির বাইরে রাস্তার পাশে বালুর উঁচু স্তূপ। ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সেই ছোটোবেলায় বালুর ঢিবির ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে করতে লাফালাফি করতাম না? গায়ে-চুলে বালু-টালু মেখে একাকার। চুল আর বাহু ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে আবারও দে লাফ! কী অপূর্ব সুন্দর ঝলমলে ছোটোবেলার দিনগুলি! এই বড়োবেলার অনেক কষ্ট। বড়ো হবার কষ্ট, বেড়ে ওঠার কষ্ট। বেদনার সাতকাহন ফুরোতেই চায় না।

৩ সপ্তাহ কেটে গেল। এই ৩ সপ্তাহে এমন অনেক কিছুই হয়েছে, যা আগে কখনোই হয়নি। এই যেমন, আমি সত্যি সত্যি অনেক ডিসিপ্লিনড হয়ে গেছি, এখনও পর্যন্ত একটাও শোকজ খাইনি। নিয়মের মধ্যে থাকতে আমার কোনোদিনই ভালো লাগেনি, এখন অতটা খারাপ লাগছে না। (চাকরির চাইতে ট্রেনিং অনেক ভালো।) বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত বাদে অন্যদিনগুলোতে সারাদিন মোবাইল ফোন অফ করে রাখি। এতে একধরনের আনন্দ আছে। সবটুকু সময়ই নিজের বলে মনে হয়। সন্ধেয় খেলার মাঠ থেকে ফিরে ইচ্ছে করেই মোবাইল ফোনটা অন করি না। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে মায়ের সাথে কথা বলার জন্য অন করি। বাবার সাথে, ছোটোভাইয়ের সাথে কথা বলি। বাবার মনেই থাকে না যে, আমার ফোনটা দিনের বেলায় বন্ধ থাকে, কোর্ট থেকে ফোন করে বসেন। পরে আমার মিসড কল অ্যালার্ট মেসেজ আসে, ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা ফুটে ওঠে, কলব্যাক করি। ভাবি, বাবা-মা’র পাশে আমার ছোটোভাইটা না থাকলে খুব সমস্যায় পড়ে যেতাম। ওর জন্য মায়া হয়। ওকে পড়াশোনা করতে হয়, বাসার অনেক কাজ সামলে রাখতে হয়, বাবা-মা’র সেবা করতে হয়। কত কষ্ট করছে ও! আমি যে কিছুই করতে পারছি না। বাবা-মা’র সেবা করতে না পারাটা বড়ো কষ্ট দেয়। ভালোভাবে বাঁচব বলে বেঁচে থাকার অবলম্বনদেরকে দূরে ঠেলে কী স্বার্থপরভাবে বেঁচে আছি! জীবিকার কাছে জীবনের কী নির্মম পরাজয়! জীবনকে বাদ দিয়ে জীবনের অর্থহীন আয়োজন! কী আইরনি! হয়তোবা, এই আইরনিই জীবন। কে জানে!

লিও টলস্টয়ের বিখ্যাত ছোটো গল্প ‘তিনটি প্রশ্ন’-এ যে তিনটি প্রশ্ন করা হয়েছে সেগুলো হলো:
# কোনো কাজ করার সঠিক সময় কোনটি?
# আপনার জীবনে সবচাইতে প্রয়োজনীয় ব্যক্তি কারা?
# সবচাইতে দরকারি কাজ কোনটি?

আমি নিজে যেভাবে করে ভাবি, সেভাবে করে উত্তরগুলো দিচ্ছি:
# আমার জীবনে ইলেভেন্থ আওয়ার সিনড্রোম খুব প্রবল। আমি এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ কাজই করেছি একেবারে শেষমুহূর্তে এসে। এবং সৌভাগ্যবশত কোনো কাজই খুব-একটা বাজেভাবে শেষ করিনি। যে-মুহূর্তে কাজটি না করলেই নয়, আমার কাছে সেটিই কোনো কাজ করার সঠিক সময়। আলস্য যদি উপভোগই না করলাম, তবে অলস হয়ে আর কী লাভ? সত্যি বলছি, অলস না হলে আমি আমার জীবনের অনেক কাজই ভালোভাবে শেষ করতে পারতাম না। আলস্যের জয় হোক।
# আমার জীবনে সবচাইতে প্রয়োজনীয় ব্যক্তি আমার মা, বাবা, ছোটোভাই আর যাঁরা আমাকে দয়া করে সহ্য করেন। যাঁরা আমার ভালো কাজের প্রশংসা করেন না, কিন্তু ঠিকই খারাপ কাজের সমালোচনা করেন, এমন ‘পরম পরোপকারী বন্ধু’-র বিন্দুমাত্রও প্রয়োজন আমার জীবনে কোনোকালেই ছিল না, আজও নেই। শাসন করা তারেই সাজে, সোহাগ করে যে—আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী। আপনি বলতে পারেন, নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো। আমি বলি, আপনার ইচ্ছে, আপনি বাসেন গিয়ে যান! আমার এত ভালোবাসাবাসির টাইম নাই। সরি।
# সবচেয়ে দরকারি কাজ, এই মুহূর্তে যা করছি, তা-ই। যা করিনি, তা নিয়ে ভাবি না। যা করব, তা নিয়েও ভাবি না। আমার সব ভাবনা এই মুহূর্তটাকে নিয়ে। আমি প্রতিমুহূর্তের দুনিয়ায় বেঁচে-থাকা মানুষ। তিব্বতের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একটা কথা আমার খুব প্রিয়: “আমরা কখনোই জানতে পারি না কোনটি আমাদের জীবনে আগে আসবে: আগামীকালটা? না কি আগামী জীবনটা?” কাল কী হবে? আরে ভাই, আগে আজ বাঁচি তো!

আমার খুব প্রিয় ‘কাল হো না হো’ মুভির একটা চমৎকার ডায়লগ দিয়ে লেখাটা শেষ করছি: Tumhe aisa kyun lagtha hai ki duniya ki sari museebatein tumhari kamzor kandhon par hai? Tum hain kon? Who are you?...Ishwar ki prarthona karne ka kya fayeda jab uski di hui zindagi ki kadar na ki jaaye...suno, jiyo...khush raho...Muskurao...kya pata...Kal Ho Na Ho!
(তুমি কেনই-বা ভাবছ যে, পৃথিবীর সমস্ত বোঝা তোমাকেই নিতে হবে? তুমি এমনই-বা কে?...ভগবানকে ডেকে তোমার কীই-বা হবে যদি তুমি ওঁর দেওয়া জীবনটার অর্থই না বোঝো?...শোনো, বাঁচো...খুশি হয়ে ওঠো...হাসো...কে জানে! হয়তো কালকের দিনটার সাথে তোমার আর দেখাই হবে না!)
Content Protection by DMCA.com