পিএটিসি ডায়েরি: ৩০, ৩১ জানুয়ারি




ডেটলাইন ৩০, ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ (উইকএন্ড ডায়েরি)

মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সবচে' সুন্দর কথা: বাসায় ফেরা। বৃহস্পতিবার সন্ধের পর বাসায় ফিরলাম, থাকলাম শনিবার বিকেলের আগ পর্যন্ত।
বাসায় গেলে দুটো জিনিস বাড়ে : মায়া আর ওজন।
দুটোই খারাপ । দুটোই ভোগাচ্ছে !

ঘরে ফিরলাম। ঘরে ফেরা অদ্ভুত একটা ব্যাপার। ভাবতে ভালো লাগে, এমনি এমনি হাসতে ভালো লাগে, কেউ কষ্ট দিলেও ক্ষমা করে দিতে ভালো লাগে, বইয়ের ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগে, ঘরে-চিলেকোঠায় হাঁটতে ভালো লাগে, সব কিছুতেই ভালো লাগাতে ভালো লাগে।
এমনকী একা একা থাকতেও ভালো লাগে। যে এসেছিল, চলে গেছে—আবারও ফিরিয়ে এনেছিলাম চলে যাওয়াটা সহজ করে দিতে; তাকে ঘিরে-থাকা স্মৃতিগুলো তাড়া করে ফিরলেও ঠিক তাড়িয়ে দেওয়া যায়। আমি ভগবানকে এমনিতেই কম বিরক্ত করি; ঘরে থাকলে একদমই করি না; উনিও শান্তিতে থাকেন।

কষ্ট একটাই: ঘরে ফিরলে খুব কাছ থেকে দেখি, বাবা-মা কেমন যেন সত্যি সত্যি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বড়ো করতে করতে ওরা বুড়িয়ে গেল। যখন আমি অসহায় ছিলাম, তখন ওরা পাশে থেকেছে। যখন ওরা অসহায় হয়ে যাচ্ছে, তখন আমি পাশে থাকতে পারছি না। আমার সবটুকু স্বার্থপর অর্জন এই বোধটার কাছে অর্থহীন মনে হতে থাকে। ছোটো ভাই পাশে থেকে বাবা-মা'র যে-সেবাটা দিচ্ছে, তা দেবার সৌভাগ্যটা আমার হচ্ছে না। চাকরিকে মনে হতে থাকে নির্মম আইরনিক দানব; কেড়ে নেয়, অথচ কেড়ে-নেয় বলেই জীবনে কিছু যে আছে কেড়ে নেবার মতো, সেটা বোঝা যায়।

বয়স বাড়ছে, বাড়ুক। কিন্তু সাথে বাড়ছে কেন হতাশা? রংবেরঙের হতাশা। এমন কিছু উটকো ভাবনাও মাথায় এসে ভিড় করে।

ঘর কী?
যেখানে প্রিয় মানুষগুলো থাকে আমার ফেরার প্রতীক্ষায়। যেখানে আমার মা থাকে, বাবা থাকে, ছোটো ভাই থাকে, আমার বইগুলো থাকে। যেখানে ফিরলে, মায়ের সাথে না-বলা জমিয়ে-রাখা গল্পগুলো ফুরোনোর আগেই ছুটি ফুরোয়; যেখানে গেলে যে-কাজগুলো করব বলে ভেবে রাখি, সেগুলো করতে মনেই থাকে না। মন্দাক্রান্তা সেনের কবিতাতে ঘর যতটা ঘর হয়ে উঠেছে, ততটা আর কোথাও দেখি না। শেয়ার করছি:

ঘর বলতে ছায়ায় ঘেরা বাড়ি
দুয়োর খুলে উঠোনে পা পেড়ে
ঘর বলতে ফিরব তাড়াতাড়ি
ঘর বলতে তোমায় মনে পড়ে

ঘর বলতে মাঠের পরে মাঠ
আলের ধারে রোদ মেলেছে পা
দিঘির কোলে ভাঙা শানের ঘাট
ভাত রেঁধেছি, নাইতে যাবে না?
ঘর বলতে সন্ধে নেমে এলে
পিদিম জ্বেলে বসব পাশাপাশি
নিঝুম পাড়া, আটটা বেজে গেলে
দূরের থেকে শুনব রেলের বাঁশি
ঘর বলতে সমস্ত রাত ধরে
ঘুমের চেয়েও নিবিড় ভালোবাসা
ঘর বলতে তোমার দু'চোখ ভরে
স্বপ্নগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসা
ঘর বলতে এসব খুঁটিনাটি
ঘর বলতে আকাশ থেকে ভূমি
একদিকে পথ, বিষম হাঁটাহাঁটি
পথের শেষে, ঘর বলতে- তুমি।

আচ্ছা, জীবন কী? জীবন কোথায়? আমাদের বাসার খাওয়ার টেবিলের একটা কথোপকথন শেয়ার করি, কেমন?
: মা, আমি আরেকটা মাছ খাব।
: দাদা, কম খা কম খা। দুইদিন পর তো আর রিকশায়ও আঁটবি না। তুই রিকশায় উঠলে আমার রিকশাওয়ালার জন্যে মায়া লাগে।
: বাবা, ও একটা দুষ্ট ছেলে। তুই ওর কথা শুনিস না। খা খা। কই নে। এটা ভালো হইসে।
: কেন? বাটা-মাছটা আরও বেশি ভালো হইসে। ওইটা নে। (আমরা দুই ভাই মুখ চেপে হাসতে লাগলাম। কই মাছ রান্না করসে মা, বাটা রান্না করসে আমাদের হাউসমেইড। যে-কোনো মেয়েকেই রান্নার বদনাম করলে খেপে যাবে। এটা হলো বাবার মা’কে খ্যাপানোর বুদ্ধি।)
: হ্যাঁ, আমার রান্না তো আর কারও ভালো লাগবে না। আমি তো বুড়া হয়ে গেসি। (আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, নারদ নারদ...)
: দাদা, তোর যেটা ইচ্ছে, নে। চাইলে ফ্রিজ খুলে কাঁচা মাছও খেতে পারিস। সব মাছ একদম ফ্রেশ।
: থাপ্পড় খাবি। তুই খা। তুই তো একটা খাট্টাইশ!
: এহহ্‌! ঢং করার জায়গা পায় না। নিজে কোরিয়া গিয়ে কাঁচা শামুক-ঝিনুক খেয়ে আসছে।
: বাবা, আচারটা নাও। (বাবার প্লেটে আচার তুলে দিলাম।)
: দেখি, বলো তো, আচারটা কীসের?
: এটা...আমের না?
: না। এটা কাঁঠালের আচার, বাবা।
: যাহ্! কাঁঠালের আচার হয় নাকি? (বাবা, অতিসরল টাইপের মানুষ। বেশিরভাগ সময়ই, যা বলি, তা-ই বিশ্বাস করেন।)
: মা, তুমি বরইয়ের আচার খাইসো?
: তোর মাকে ঝাল আচার কম দে। বেশি ঝাল খেলে বেশি ঝগড়া করবে। এমনিতে যা রান্না করসে, ডগ ওউন্ট ইট!
: চুপ থাকো! কেন? আমি কি ঝগড়া করি?
: বাবা, তোমার মনে আছে, আমরা যখন ছোটো ছিলাম, তখন মা খুব সিলিসিলি ব্যাপার নিয়েও রাগ করত না?
: হুঁ, তোর মা'র রাগ তো এখন আর নাই। (বাবার কথা শুনে মা মুচকিমুচকি হাসতে লাগল।)
: বাবা, তুই কি আর কোনোদিনই বিয়ে করবি না? আমরা আমাদের ছেলেবউ দেখব না?
: পাপ্পু, তুই তাড়াতাড়ি সেটলড হয়ে বিয়ে করে বাবা-মা’কে ছেলেবউ দেখা।
: ঠিক আছে। আমার আপত্তি নাই।
: মানে? বাবা, এগুলো করিস না। দাদার আগে বিয়ে করা ভালো না।
: এই ফাজিল! তুই নিজে বিয়ে কর।
: বাবা, আমি বিয়ে করা ছেড়ে দিসি। হি হি হি . . .
: তোদেরকে আমি আর রান্না করে খাওয়াতে পারবো না। তোরা জীবনেও মানুষ হবি না।
: কেন মা? রান্না করতে পারবে না কেন? কাজের লোক আরেকটা রাখি?
: মা, দাদা বউদিকে দিয়ে কাজ করানোর ধান্দা করতেসে।
: মাইর চিনিস, মাইর? মাইর খাবি। আমি কি এটা বলসি নাকি?
: বাবা, তোমার নাকে আইসক্রিম লেগে আছে।
: তোর বাবা আইসক্রিম খেতে জানে না তো!
: এহহ্‌! তোমাকে যে আইসক্রিম খাওয়ায়ে দিতাম, মনে নাই? নিজে যেন কত পারে!
: মা, তা-ই নাকি? কখন কখন?
: তুমি আর জীবনেও মানুষ হবে না। ছেলেপেলের সামনে এগুলা কী বলো?

আহ্‌! এরকম একটা লাঞ্চের জন্যও তো বেঁচে থাকা যায়! জীবন কী? বাবা-মা-ভাই…মানে কাছের মানুষের সাথে খাবার টেবিলে বসে খুনসুটিই জীবন! জীবন কোথায়? আসুন, উত্তরটা ধার নিই মিলান কুন্দেরার কাছ থেকে: “Draw a line; draw a line that pleases you. And remember that it is not the artist's role to copy the outlines of things but to create a world of his own lines on paper.” (~~Milan Kundera, ‘Life is Elsewhere’) জীবন সেখানেই, যেখানে আমরা একে খুঁজে নিই কিংবা নিতে ভালোবাসি, নেবার স্বপ্ন দেখি।

শনিবার সন্ধে ৭টায় পিএটিসি’তে এলাম (বলছি না, ‘ফিরলাম’। একমাত্র নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও এলে সেটাকে ‘ফেরা’ বলতে আমার কষ্ট হয়।) ঘর, ঘরের সব কিছু ছেড়ে আসার সময় কুন্দেরার ‘Life Is Elsewhere’-এর জ্যারোমিলের মতো করে খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, “You are beautiful,"..."But I will have to leave you.”

ভাবছি, ৩টা ব্যাপার আমার ইচ্ছেমাফিক হলে বেশ হতো—কাকে গুডবাই বলব, কখন গুডবাই বলব, কোথায় গুডবাই বলব।