পিএটিসি ডায়েরি: ২৯ জানুয়ারি


ডেটলাইন ২৯ জানুয়ারি ২০১৫

ভোরবেলায় পিটি’তে হাঁটবার সময় ‘অনুরোধের আসর’ বসে। যারা গাইতে জানে, তাদেরকে একেকজন একেকটা গান গাইতে বলে। আমাদের মধ্যে একজন লালনের গান খুব ভালো করেন। ওঁকে ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ গানটি করতে বললাম। গানটি করা সহজ নয়। উনি করলেন, ভালোই করলেন। আমার মতে, লালনের সবচাইতে কঠিন গান এটিই। গানটির অর্থ অতি দুরূহ। এটি বাংলা ভাষার দুর্বোধ্যতম গান কি না কে জানে! গানটি আদৌ লালনের কি না, এ নিয়েও বিতর্ক আছে। এই গানটি একটু শেয়ার করছি।

চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করব কী।
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম;
তারে তোমরা বলবে কে।

৬ মাসের এক কন্যা ছিল
৯ মাসে তার গর্ভ হল;
১১ মাসে তিনটি সন্তান
কোনটা করবে ফকিরি?

ঘর আছে তার দুয়ার নাই
লোক আছে তার বাক্য নাই।
আবার কে তাহারে আহার যোগায়?
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি?

ফকির লালন ভেবে বলে:
ছেলে মরে মাকে ছুঁলে,
আবার এই কয় কথার অর্থ নৈলে
তার হবে না ফকিরি…

গানটি কয়েক বার পড়ুন তো! কিছু বোঝা যায়? Charles Capwell গানটির অনুবাদ করেছেন, শেয়ার করছি। দেখুন তো, অনুবাদে এর প্রচ্ছন্নতা একটুও কাটে কি না?

One moon has touched the body of another,
what shall we do, having thought of that?
The mother's birth is from the daughter's womb;
what do you call her?

There was a girl of three months;
in nine months she conceived.
In eleven months there were three offsprings;
which one will the fakir take?

Sixteen arms, thirty-two heads;
the child speaks within the womb.
Who are its mother and father?
That's a question to be asked!

There is a room with no doors;
there is a man who doesn't speak.
Who furnishes his food:
who lights the evening lamp?
Lalon Shah, the fakir, says,
" If the mother touches, the son dies.
He to whom these words have meaning,
to him, indeed, belongs fakirdom.

লালনকে নিয়ে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করে আমার মনে হয়েছে, গানটির অর্থ এরকম হতে পারে:
# মায়ের ভ্রূণে গর্ভসঞ্চার হয়েছে। এখানে প্রথম চাঁদ হলো মা, পরের চাঁদ হলো ভ্রূণ। প্রত্যেক মা-ই তাঁর মেয়েকে ‘মা’ বলে ডাকেন। তাই মা হচ্ছেন তাঁরই মেয়ের ঝি, মানে মেয়ে।
# এখন মাসের হিসেবটা বলছি। মানবসন্তানের ভ্রূণে প্রাণের সঞ্চার হতে লাগে অন্তত ৬ মাস। আরও ৩ মাস লাগে পরিপূর্ণ মানবশিশুর আকৃতি ধারণ করতে, সব মিলিয়ে মোট ৯ মাস। ১১ মাসে মানবশিশু তিনটি স্তর পার করে। কী কী? এক। প্রথম ৬ মাসের স্তর। দুই। পরের ৩ মাসের স্তর। তিন। পরের ২ মাসের মধ্যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়ে যায় এবং শোওয়া, এপাশ-ওপাশ ফেরা, এসবও শিখে যায়। লালন এই ৩টি স্তরে মানবশিশুর ৩টি পর্যায়কে মানবশিশু হিসেবেই নির্দেশ করে এই প্যারার শেষ লাইনে জিজ্ঞেস করেছেন, কোন পর্যায়টি অধিক গুরুত্ব বহন করে?
# মায়ের গর্ভকে বলা হয়েছে ঘর, যেখানে দরোজা থাকে না। ওখানে শিশুটি আছে, যে কথা বলতে পারে না, মানে ওর বাক্য নেই। শিশুটির বিকাশে এবং জীবনীশক্তি সৃষ্টিতে মহান সৃষ্টিকর্তার রহস্যময় অবদানের কথা এখানে আছে।
# মৃত সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সব দোষ মায়ের উপর এসে বর্তায়। অথচ মৃত সন্তান প্রসব করার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। শেষ ২ লাইন দিয়ে সমাজের এই কুবিশ্বাসের প্রতি লালন তাঁর অনুসারীদের সচেতন করে দিয়ে বলেছেন, যে-সাধক কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, সে সাধকের সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় না।

আবার ডায়েরিতে ফিরে আসি। হেঁটে-যাওয়া গানের আসরে নানান স্বাদের গান হতে লাগল। পাশে দেখলাম, কী-একটা যেন প্রতিযোগিতা উপলক্ষ্যে সারামাঠে রংবেরঙের ফ্যান্সি কাগজ কেটে কেটে আঠা দিয়ে দড়িতে লাগানো হয়েছে। এটা দেখার পর কাউকে বলে দিতে হয় না, উৎসবের আমেজ চারদিকে। ছোটোবেলায় যখন বিভিন্ন উৎসবে গ্রামের বাড়ি যেতাম, তখন এই রঙিন বাহারি কাগজের সমারোহ চোখে পড়ত। যেতে যেতে একটা খালি জলের টাংকিতে দেখলাম, শিশিরভেজা ঝরাপাতা স্তূপ হয়ে আছে। ওটাকে দূর থেকে দেখাচ্ছে ভাঙাচোরা বাঁশের মাচার মতো। একটু পর দেখি, একটা আধপাকা ঘর। ওটার সামনের ছোট্ট উঠোনটিতে দুটি শিশু আর শুকনো পাতা এদিক-ওদিক উড়ছে। উঠোনের একপাশে ৩টা বেতের চেয়ার সাজানো। ঘরের পাশেই মুলোর খেত, পেছনের দিকে চোখে পড়ে বাঁধাকপির বাগান। ওপাশটায় বাঁশের মাচার ফাঁকে ফাঁকে লাউয়ের কচি লতানো ডগা হাঁটছে। ঘরের চালের ফুটোয় ফুটোয় কুয়াশা আটকে গেছে বোধ হয়। ও-ঘর থেকে দু-পা ফেললেই একটা পার্ক। পার্কটাতে কুয়াশার সাথে ধুলোর হাজার বছরের বন্ধুতা। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে কয়েকটা দোলনা। কাঁটা মেহেদির ঝোপে ঝোপে নানান ইংরেজি অক্ষরের ইঙ্গিত যেন। দোলনার আশেপাশে সি-স আছে ৪টা। পার্কের চারদিকের সরু রাস্তায় শুকনো পাতায় পাতায় রাতের হিমচুম্বনের অস্তিত্ব সুস্পষ্ট। চুম্বনের শেষ চিহ্নটুকু মুছে দিতে সূর্যের নিরন্তর চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। তবু অবোধ প্রেমের সঙ্গমসুখের নিশানা অত সহজে মোছে কি?

কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা ফাঁকি দিয়ে রোদ এসে পড়ছে আমাদের চোখে, মুখে, সারাশরীরে। ওটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকলে কিশোর এসে গান শুনিয়ে যায়। ‘আনন্দ আশ্রম’-এর ‘আশা ছিল ভালোবাসা ছিল’-র আবহ ওখানটায়; গানটা গুনগুন করতে করতে কোত্থেকে যেন কী এক বিরহের সুর এসে বিহ্বল করে দেয়। লাইন ধরে হাঁটছিই তো হাঁটছি। কেউ কেউ হঠাৎ দৌড় দেয়; এমনিতেই। ইন্সট্রাক্টরের বকা শুনে আবার লাইনে এসে যায় (আক্ষরিক অর্থেই!)। আজ পিটি’র সময় টেনিস কোর্টে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অন্তত ৫ মিনিট। এই খেলাটা ছোটোবেলার। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হতে থাকে, ওই বিশালে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছি, ওই উড়ে-যাওয়া পাখিগুলোর সাথে ফুড়ুৎফারুৎ করছি। আহ্‌! আজকের এই ছোট্ট শরীরমনে পুরোটা আকাশ এসে বাসা বাঁধল বলে! ওইদিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে কিছু সময় তাকিয়ে থাকলে কীরকম যেন মাতাল মাতাল লাগে।

পিএটিসি’তে সাঁতারও শেখায়। এখন তো শীতকাল, তাই ওটা আপাতত বাদ। গত ব্যাচের একজনের কথা শুনলাম। ওঁকে নাকি জলে নামানোই যেত না। জল দেখলেই ওঁর প্রাণ শুকিয়ে যেত, ভয়ে কাঁপতে থাকতেন। এমনকী উনি স্বপ্নেও দেখতেন, জলে ডুবে যাচ্ছেন। Richard Craze লিখিত The Dictionary of Dreams and Their Meanings বলে, এই ধরনের স্বপ্ন দেখার অর্থ হলো, ওই ব্যক্তি অন্তর্গত কিংবা বহির্গত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছেন। মানুষ ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিক আবেগের বেহিসেব কিংবা চাহিদার অভাববোধ থেকেও এই ধরনের স্বপ্ন দেখতে পারে। আমরা সেই ব্যাখ্যায় না গিয়ে মোটা দাগে ধরে নিচ্ছি, ওই ভদ্রলোক জল প্রচণ্ড ভয় পেতেন। সে ভয় থেকেই ওই স্বপ্নগুলো দেখতেন।

আজ এক স্যার পড়ালেন, যাঁর মুদ্রাদোষ হলো কথার মাঝে ‘এয়া’ বলা। “আপনাদের নেক্সট ক্লাসটা হবে এয়ার উপর”, “আপনাদেরকে কিন্তু পরীক্ষায় এয়া করতে হবে”, “আপনি যদি এরকম এয়া করেন, তবে আপনার এয়াতে কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে”। ভাবলাম, দেখি কত বার হলো। রীতিমতো খাতায় ট্যালি টেনে টেনে স্যারের মুদ্রাদোষ গুনলাম। মোট ৯৭ বার।

লাঞ্চের আগের ক্লাসটা ছিল গবেষণা পদ্ধতির উপর। স্যার বেশ মজার মানুষ। জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, আপনারাই বলুন, একটা গোলাপ দিয়ে সর্বোচ্চ কত জনকে খুশি করা যায়?” মনে মনে বললাম, “কেন স্যার? গোলাপের দাম কি খুব বেশি?” কিছু মজার তথ্য জানলাম। আফগানিস্তানে ছেলেরা মেয়েদের প্রেম নিবেদন করতে মেয়ের বাসার সামনে গিয়ে আকাশের দিকে পর পর ১৩ বার ফায়ার করে। এর মধ্যে যদি মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, তবে ধরে নিতে হবে, Love accepted! (এটা বলার সময় আমি ভাবছিলাম, মেয়েটির ঘরের ছাদে একটা বোমা মেরে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। মেয়ে ঘর থেকে বের হবেই হবে!) আফ্রিকার একটি দ্বীপরাষ্ট্রে মেয়েটা ভালোবাসার কথা বোঝাতে ছেলেটার বাড়িতে গিয়ে ওর হাতে জোরে একটা কামড় দেয়। যত জোরে কামড়, তত বেশি ভালোবাসা। (আল্লাহ্‌ আমাগোরে বাঁচাইসে!) স্যার একটা মজার কথা বললেন। যখন কেউ ‘যা পেয়েছি, আমি তা চাই না; যা চেয়েছি, কেন তা পাই না’ স্টাইলে বিয়ে করে, তখন প্রথম ২-১ বছর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাকে পায়নি, সে পুরোনো ওকে কল্পনা করেই কাটিয়ে দেয়। এভাবে করে সুখের অভিনয় করতে করতে একটা সময়ে সত্যি সত্যি সুখী হয়ে ওঠে। নতুন ভালোবাসার আগমনে পুরোনো ভালোবাসা সময়ের প্রয়োজনে প্রকৃতির নিয়মেই ফিকে হয়ে যায়। স্যার গবেষণার কাজে কীভাবে ভালো প্রশ্নমালা প্রস্তুত করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের অভিমত চাইছিলেন। আমি ক্লাসে ‘তুমি কেমন করে গান করো, হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি’-র দলে। কখনোই কিছু বলি না। আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলি, ভালো প্রশ্ন হবে এরকম, এই যেমন: “আপনি কি এখনও আগের মতো বউ পেটান?” টাইপের।

লাঞ্চের পরের ক্লাসটা সিঙ্গাপুরের সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন দিকের উপর। একজন ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরিয়ান নাগরিক এলেন ক্লাস নিতে। উনি এই সেক্টরে একজন এক্সপার্ট। কিছু ভালো ভালো কথা জানলাম। এই যেমন, সিঙ্গাপুরে সিভিল সার্ভিসের মূলমন্ত্র ৩টি: Integrity, Service, Excellence. সিঙ্গাপুরে সবচাইতে বেশি বেতন দেওয়া হয় শিক্ষকদেরকে। ওরা বলে, Teach. You will be amazed by the difference you can make. ওদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের দিকে তাকিয়ে লোকে বলে, If I were born again, I would join the police force. ওঁর শেষের কথাটা ছিল: Love yourself, because YOU MATTER!

ক্লাস থেকে ফেরার সময় কফি-কর্নারে বসে নেসক্যাফে’তে আয়েশ করে চুমুক দিতে দিতে দেখলাম, নিচের দিকে মুখ করে উইপিং দেবদারুরা কাঁদছে যেন। ওরা আজ ‘মন খারাপ’-দের দলে নাম লিখিয়েছে। থুজা গাছগুলো রোদের আলোয় সত্যিই ঝলমল করছে। গাঢ় সবুজের বিচ্ছুরণে ওদের চারপাশটাতে একটা মায়াবী আবহের সৃষ্টি হয়েছে। কফির উষ্ণ ধোঁয়া ওই মায়াতে ক্ষণে ক্ষণে মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল। খুব ইচ্ছে হলো, ওখানটায় চাদর বিছিয়ে বসে মাঘের এই বিকেলটা নারকেলের পুর আর খেজুরের গুড়ে ভর্তি ভাপা পিঠে খেতে খেতে কারও সাথে গল্প করতে করতে কাটিয়ে দেই। মাথায় বাজুক...পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেইদিন ফিরে আর আসবে কি কখনো...

বৃহস্পতিবার প্রায় সবাই-ই বাসায় ফেরে। পিএটিসি’তে এই উইকএন্ডের ছুটির জন্য একটা কমন ফরম্যাটে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে হয়। মেস কমিটিকে জানাতে হয় কোন কোন বেলা খাব না।

বাসায় ফিরলাম। বাসা মানে . . . ঘর।