ডেটলাইন ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
ভাইসব! ভাআআইসঅঅঅব্!! একটা রেক্টর মেডাল পাওয়া গেছে। উপযুক্ত প্রমাণ-সহ দ্রুত সংগ্রহ করুন। মেডাল পেতে আপনাকে ৩টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে:
এক। আপনি নিয়মিত তেলবাজি করে যাচ্ছেন তো?
দুই। ক্লাসে প্রশ্ন করার ছলে অবান্তর বিষয়ের অবতারণা করেন তো ঠিকমতো?
তিন। আপনি কি নির্ঘুম চোখে ক্লাস করেন?
যদি ৩টি প্রশ্নের উত্তরই হ্যাঁ হয়, তবেই আপনাকে এটা দেওয়া হবে।
আজ পিটি’তে হাঁটার সময় কয়েক জন এটা বলে বলে মজা করছিল। এই তো ৩দিন আগে রোদের উঁকিঝুঁকি দেখে মনে হয়েছিল, শীত পালাল বলে! কোথায় কী! শীত কথা রাখেনি। আজ ভোরে শীত যেন গতকালের চাইতে জেঁকে বসেছিল। ভোরের আলো ফুটেছে, ঝকঝকে হিমেল আলো। শুভ্র ভোরবেলায় মর্নিংওয়াকের শাদা পোশাকে সবাইকে অন্যরকমের সুন্দর লাগে। শুভ্রতার চাদরে সব কুৎসিত রূপ ঢেকে যায়।
ক্লাসে একটু আগেভাগে না যাবার শাস্তি হলো, সামনের রো’তে বসতে হয়। আজ আমি তা-ই পেলাম। ক্লাসে সামনের সারিতে বসে স্যারের সামনেই বসে ঘুমুতে ঘুমুতে শুনলাম, যুবতী নয়, বলতে হবে, যুবমহিলা। যুবক আছে, যুবতী নেই। ওটা ভালগার শোনায়। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’—এটা একটা স্লাইডে লেখা ছিল। স্যার একজনকে দাঁড় করিয়ে কী লেখা আছে পড়তে বললেন। ওই জনাব জোরে শব্দ করে পড়লেন, “স্যার, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” আমি মনে মনে গাইলাম, আমার বলার কিছু ছিল না।...চেয়ে চেয়ে দেখলাম, উনি ভালোবেসে গেলেন...
ক্লাসশেষে সবাই হুড়মুড় করে বেরোতে লাগল। স্যারের ক্লাস শেষ করতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। পরের ক্লাসে ঠিক সময়ে পৌঁছোতেই এই তাড়াহুড়ো। আমি প্রস্তাব করলাম, আমরা যাতে ঠিক সময়ে ক্লাসে পৌঁছাতে পারি, সেজন্য একটা এলিভেটেড করিডোর বানানো হোক। রব উঠিল, “সাধু সাধু!” এর পরের ক্লাসটা আইএলটিএস স্পিকিংয়ের উপর। চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ মুভির সেই অপূর্ব স্পিচটার কথা মনে আছে তো? আজ বুঝলাম, ওটার অসাধারণত্ব শুধু ডেলিভারিতেই নয়, আরও কিছু বিষয়েও নিহিত। স্পিচটা আজকের ক্লাসে আরও একবার দেখলাম। আজকের ক্লাসের বেস্ট পার্ট ছিল ওটাই। মাঝে মাঝে ক্লাসে লেকচারের চাইতে লেকচারের অনুষঙ্গ বেশি আনন্দ দেয়। ‘ফ্রোজেন’-এর ‘লেট ইট গো’ শুনলাম এবং আরও একবার প্রমাণিত হলো, ক্লাসে স্টুডেন্টদের ঘুম তাড়াতে বিদ্যা-দান অপেক্ষা বিনোদন-দান অধিক উত্তম।
এরপর ক্লাস নিতে এলেন ভূপেন হাজারিকা স্যার। “বেতন কেন ভাই? চাকরি আছে তো, তাই।” স্যার এটা বলে বললেন, আপনাদের বেতন যদি ইভ্যালুয়েশনের ভিত্তিতে দেওয়া হতো, তবে দেশের মানুষ বেটার সার্ভিস পেত। আমি কিন্তু আপনাদের, মানে সব চাকরির কথাই বলছি। কথাটি পছন্দ হলো। “মায়ের পায়ের তলায় বেহেস্ত। কিন্তু আসলে বেহেস্ত কই? আপনারা চেক করে দেখুন, মায়ের পায়ের তলায় কিন্তু জাস্ট ফ্লোর। তাহলে কেন ওটা বলা হলো? এখানে মায়ের যে-সব সন্তান আছেন, তাঁদেরকে এই লার্নিং নিতে হবে, হাউ টু ক্রিয়েট দ্যাট বেহেস্ত। একই সাথে জানবেন হাউ টু কন্ট্রোল বাচ্চাদেরকে।” এই কথাটি শুনে সবাই হাসতে হাসতে শেষ! স্যারের একটা মুদ্রাদোষ হলো, কথায় কথায় হাঁআআআ...বলা। আজ স্যার এটা বলেছেন মোট ১৫৩ বার! আমি খাতায় ট্যালি চিহ্ন এঁকে এঁকে এটা গুনেছি। আমি ঠিক করেছি, ক্লাসে স্যারদের মুদ্রাদোষ গুনবো। সবসময় তো আর ঘুম আসে না। ঘুম না এলে ক্লাসে আমার আর কীই-বা কাজ? ক্লাসে বসে বসে করবটা কী? কিছু একটা তো করা দরকার!
এরপর যিনি ক্লাস নিতে এলেন, ওঁর কণ্ঠস্বর অবিকল শচীন টেন্ডুলকারের মতো। উনি ক্লাসটি আমাদের দিয়ে প্রেজেন্টেশন করানোর মাধ্যমে নিলেন। ক্লাস নেবার খুবই ভালো একটা টেকনিক। লাঞ্চের আগে এটাই ছিল শেষ ক্লাস। আজ এই ক্লাসটার পর ক্লাস হবার কথা ছিল না। কিন্তু হলো। পিএটিসি’তে এটা একটা অতিসাধারণ ঘটনা। ক্লাস থাকে না, তবু ক্লাস হয়, হয়ে যায়। যিনি ক্লাস নিতে এলেন, উনি খুব সুন্দর করে সুইজারল্যান্ডকে উচ্চারণ করেন সুইসাইডল্যান্ড। ওঁর একটা ডায়লগ সেইরকম লাগল: Bengali books are written in Bengali. English books are written in English. স্যারের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের মাধ্যমে আমাদের বুক রিভিয়্যু ক্লাস শেষ হলো।
ক্লাসে বরাবরই কয়েকটা কাজ চলে। এই যেমন, ছোটো ছোটো কাগজে চিঠি-টাইপ কিছু-একটা লিখে পাশের জনকে কিংবা আশেপাশের কাউকে ছুড়ে দেওয়া। কাগজে কার্টুন এঁকে তার নিচে স্যারের কিংবা আমাদের কোনো ব্যাচমেটের নাম লিখে দেওয়া। (পিএটিসি আমাদের বয়স কতই-না কমিয়ে দিয়েছে! আহা আহা!) এসব করতে করতে আমি গুনে ফেললাম, স্যার ক্লাসে ‘অ্যাকচুয়েলি’ শব্দটি বলেছেন মোট ৭৩ বার (অ্যাকচুয়েলিই!) বুক রিভিয়্যু’র জন্য আমাদের সবাইকে লটারির মাধ্যমে একটা করে বই ঠিক করে দেওয়া হলো। বেশিরভাগই কাটখোট্টা টাইপের বই। আমার ভাগ্যে পড়েছে: ‘বাংলাদেশের পাখি’। অন্যদের বইয়ের নাম শোনার পর নিজেকে বড়োই ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।
বিকেলে ভলিবল খেলা শেষ করে কফি-কর্নারে বসে আড্ডা দিলাম। ৬ কাপ কফি গলাধঃকরণ করে সন্ধের পর অডিটোরিয়ামে কালচারাল কমিটির গানবাজনা ‘দেখতেই’ ও শুনতে গেলাম। এই রিহার্সাল প্রায় প্রতিদিনই হয়। সুরে আর বেসুরে সন্ধেটা কাটিয়ে ডিনার শেষে রুমে ফিরে স্বল্পদৈর্ঘ্য দীর্ঘায়ু ফরাসি ছবি ‘দ্য রেড বেলুন’ দেখলাম। ৩৪ মিনিটের শর্ট ফিল্মটি অ্যালবার্ট ল্যামোরিজের। প্যারিসের এক ছোট্ট ছেলে আর একটা লাল বেলুন নিয়েই ছবিটির গল্প। ভিত্তরিও ডে সিকার ‘বাইসাকেল থিভস’ মুভিটির মাধ্যমে আমরা পেয়েছি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ কিংবা বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমি’র মতো মাস্টারপিস। সেই মুভির শেষ দৃশ্যটার কথা একটু ভাবুন তো! ভিড়ের মধ্য দিয়ে বেচারা আন্তোনিও ছেলে ব্রুনোর হাত ধরে যাচ্ছে। বাপ-বেটা দু-জনেই কান্নারোধের চেষ্টা করছে। এরা কোথায় গিয়ে থামবে? এর উত্তর কোনোদিনই মেলেনি। হালের ‘দ্য পারসুইট অব হ্যাপিনেস’য়েও না। বাবা ক্রিস্টোফার গার্নারের পাশে হেঁটে গেছে ৫ বছর বয়েসি ছেলে। গ্রেট ফিল্মমেকারদের ক্রেডিট বোধ হয় এখানেই। সত্যজিৎ রায় ফিল্মমেকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন যে-মুভিটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে, সেই ‘বাইসাকেল থিভস’য়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র আন্তোনিওর অভিনেতা লামবার্তোর অভিনয়ের কোনো প্রশিক্ষণই নেই। তিনি ছিলেন একটি কারখানা শ্রমিক। আজ যে শর্ট ফিল্মটি দেখলাম, সেটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছে পরিচালকের ছেলে প্যাসকেল ল্যামোরিজ। নীল বেলুন হাতে অভিনয় করেছে ল্যামোরিজের মেয়েও। ‘বাইসাকেল থিভস’ দেখে বিখ্যাত ফরাসি নন্দনতাত্ত্বিক অঁদ্রে বাজাঁ বলেছিলেন, “বাইসাইকেল থিভস হলো বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান নিদর্শন। (এতে) না আছে কোনো অভিনেতা, না কোনো কাহিনি, না কোনো সেট; অর্থাৎ বাস্তবের নিখুঁত নান্দনিক ভ্রম সৃষ্টিতে (তথাকথিত) সিনেমাই আর নেই।” একেবারেই সহজ চিন্তা, সহজ ভাষা আর সহজ কথায় বলা একরৈখিক গল্পের ‘দ্য রেড বেলুন’ নিয়েও ফরাসি বোদ্ধার কথাটি খাটে।
মুভিবোঝাই ২টা টেরাবাইট হার্ডডিস্ক হাতের কাছে রেখেও মুভি না দেখে থাকা আর সুন্দরীর পাশে শুয়েও ঘুমিয়ে পড়া একই কথা। অনেক হয়েছে, আর নয়! এখন থেকে ‘পিএটিসি ডায়েরি’ একটু ছোটো করে লিখব আর বেঁচে-যাওয়া সময়ে আমার বায়োস্কোপের খেরোখাতা আরেকটুখানি ভরিয়ে নেব। এই বিশ্বস্ত পুরোনো অভ্যেসটাকে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।