পিএটিসি ডায়েরি: ১৫ ফেব্রুয়ারি (১)


ডেটলাইন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ (১ম অংশ)


গতরাতে যখন বৃষ্টি হচ্ছিল, তখন আমি ঘুমিয়ে। আজকের ভোরটা কুয়াশায় নয়, বৃষ্টিতে ভেজা। দুটো সময়ে সবচাইতে বেশি ঘুম আসে। ঝুমবৃষ্টির সময়ে আর শীতের সকালে। আজ যখন পিটি করতে বের হচ্ছি, তখন বৃষ্টি ছিল না, এটা ঠিক, তবে জলের নিশিচুম্বনের ছাপ ছিল স্পষ্ট; আর সাথে শীত তো ছিলই!

ছোটোবেলায় কিংবা কিশোরবেলায় দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি সময়টাতে ঝুমবৃষ্টি নামলে চারিদিক অন্ধকার হয়ে যেত। এখনও হয় বুঝি? কতদিন সেই ছোটোবেলার অন্ধকার দেখি না। আমাদের বাসায় কাঠের জানালা ছিল। জানালা বন্ধ করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমমাখা চোখে সিলিংয়ের কোনায় টিকটিকির ঝগড়া দেখতাম। দেখতে শাদা শাদা যত টিকটিকি, ওরাই বেশি ঝগড়ুটে। মাঝে মাঝে কাকগুলো কাকভেজা হয়ে জানালার নিচে কার্নিশে এসে আশ্রয় নিত। ভেজা কাকগুলো ডাকে, কাঁক কাঁক কাঁক...বাসার ঘুলঘুলিতে চড়ুইয়ের বাসা ছিল। ওরা বৃষ্টির ছাটে কাঁপত আর ওদের বাচ্চাগুলো কিঁউকিঁউ করত। মা বলত, “আহারে!” বাবা কোর্ট থেকে ফেরার আগেই মা জলরুটি বানিয়ে ফেলত। সন্ধের আগেই উঠে একটু করে ‘রুশদেশের উপকথা’, ‘জাদুমানিক আখারনাবো’ এসব থেকে দু-একটা গল্প পড়ে নিতাম। আহা, সেইসব গল্প-পড়ার দিন আর কখনও ফিরে আসবে না! এই ভূতুড়ে বৃষ্টিভেজা গোধূলিবেলায় ভয় পেতে ইচ্ছে করে না কোন ভীতুর ডিমের?

আচ্ছা, যেখানে ছিলাম। আজকের এই ঘুমঘুম ভোরে করিডোর ধরে হাঁটছি, কে যেন পেছন থেকে বলে উঠল, “দাদা, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটছেন?” বললাম, “না আপু, হাঁটতে হাঁটতে ঘুমোচ্ছি।” শাদা পিঁপড়ের দল ভেজা বাগানের পাশ দিয়ে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে চলেছে। অর্কিডের ফুলপাতা জানিয়ে দিল, আজকের ভোরে শীত নেই, চোখজুড়ে ঘুম আছে। আজকের সব কুয়াশা যেন রাতের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। যে-বসন্ত এখনও শীতের হাত থেকে পুরোপুরি ছাড়া পায়নি, সে বসন্তকে ভিজিয়ে দিলে ওটা হয়ে যায় বিষণ্ণ বসন্ত। প্রকৃতির বিমর্ষতা আমাদেরকেও প্রচণ্ডভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শরীরে আর মনে এর প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজকেও তা-ই। খুব ক্লান্ত মন নিয়ে শরীর একেবারেই চলে না। হাত-পা ছুড়ছি, তবে ওতে জোর নেই। শরীর ভেঙে পড়ছে যেন। ইন্সট্রাক্টরেরও একই হাল। পিটি নয়, এক ঘণ্টা কমেডি-শো করে রুমে ফিরলাম। বুঝি পৃথিবীর সব সঙ্গমই প্রথমেই হতে হয় প্রকৃতির সাথে। এর অন্যথায় হলে ওতে নিয়মরক্ষা হয় শুধু, তৃপ্তি মেলে না কিছুতেই।

সকালে স্নান করার সময় মাথায় ‘হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছ তুমি...’ ঢোকার কী মানে? একে তো শীত, তার উপরে স্লো গান। এইডা কিসু হইল? গানটা বাজতেই থাকল, ব্রেকফাস্ট হয়ে ক্লাসেও। যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদেরকে অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়। এই যেমন, আমি ব্রেকফাস্টে ঢুকি ৮:১০টার পরে। ওঁদেরকে ব্রেকফাস্ট শুরু করতে হয় আরও আগেভাগেই। খুব বেশি হলে ৮:০৫টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট শেষ করেই মাল্টিপারপাজ শপের ওদিকটায় স্মোকিং জোনে সিগারেট খেতে ছুটতে হয়। আমরা জায়গাটার নাম দিয়েছি ইটভাটা। ইটভাটায় যেমনি চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হতে থাকে, তেমনি সবাই মিলে সিগারেট খাওয়ার সময় ওদিকটায় ওপরের দিকে ফানেলের মতো করে সরু হয়ে ধোঁয়া উঠতে থাকে। দূর থেকে ওপরের ওই দৃশ্য দেখলে মনে হবে, ও নির্ঘাত ইটভাটা। ওখানে যাবার তাড়াতে অনেকে ধীরেসুস্থে ‘চা-টা’ খাওয়ার সময়ও পান না। ধূমপান করেই আবার দৌড়! ৮:২৫টার মধ্যে ক্লাসে পৌঁছাতে হয় যে!

ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ার একটা বিশেষ কায়দা আছে। ঘুমোনোর আগমুহূর্তে স্যারকে একটা প্রশ্ন করতে হবে। ঘুম ভেঙেই স্যার ওই মুহূর্তে যা বলছেন, সেটা নিয়ে খুব প্রাসঙ্গিক কিছু-একটা জিজ্ঞেস করতে হবে। এতে বোঝা যাবে, আপনি ক্লাসে মনোযোগী, মানে অ্যাক্টিভ পার্টিসিপেন্ট। আমার ক্লাসে ঘুমভাগ্য সেইরকম। এখন পর্যন্ত কোনো ক্লাসেই ধরা খাইনি। আজ প্রথম দুটো ক্লাসের সময় ক্লাসে ঘুমিয়ে-পড়া দু-একজনকে কোর্স অ্যাডভাইজর স্যার পিঠে মৃদু চাপড় মেরে জাগিয়ে দিয়ে বাইরে ডেকে কিঞ্চিৎ অম্লমধুর ঝাড়ি মারলেন। এদেরই একজন ব্রেকের সময় আমাকে বললেন, “সুশান্ত ভাই, আপনি পুরো ক্লাসেই ঘুমান, আপনার কিচ্ছু হয় না। আর আমি একটু করে ঘুমালাম আর স্যারের কাছে ধরা খেলাম।” আমি বললাম, “কী করবেন ভাই! খুন যে করে, তার তো আর ফাঁসি হয় না। যে ধরা খায়, ফাঁসি হয় তার।” পিছনের বেঞ্চে ঘুমোনোর একটা বুদ্ধি আবিষ্কার করেছি। সামনের বেঞ্চের একজনকে আমরা সবাই মিলে ‘কফি দিয়ে ভাড়া’ করলাম। ওঁর সাথে কন্ট্রাক্ট হচ্ছে এই: উনি স্যারকে বিভিন্ন টাইপের সিলি সিলি প্রশ্ন করে আটকে রাখবেন যাতে করে স্যার পেছনের দিকে আসার সময়ই না পান। বুদ্ধিটা আজকের ক্লাসে পরীক্ষামূলকভাবে অ্যাপ্লাই করা হলো।...ইয়েএএএ...মিশন অ্যাকমপ্লিশড! স্যারের একেবারে সিলি সিলি কথায়ও পোলাপান সমানে হাসতে থাকে। আমি অনেক চেষ্টা করেও হাসি আনতে পারি না। ঠোঁটদুটোকে বাঁকা চাঁদের মতো করে রাখি, দেখতে পুরাই ক্যাবলা ক্যাবলা টাইপ দেখায়। বুঝতে পারছি না, স্যারের কথাগুলো কি আসলেই হাসির না, না কি আমার হিউমার সেন্স অনেক উঁচু লেভেলে পৌঁছে গেছে, না কি আমি দিনদিন এক্সপ্রেশনলেস রামগরুড়ের ছানা হয়ে যাচ্ছি? শেষের অভিযোগটি জনৈকার।

পরের ক্লাসটা আইটিসি’র অডিটোরিয়ামে। আইটিসি মানে, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং কমপ্লেক্স। এই বিশ্বমানের অডিটোরিয়ামটির ওয়াশরুমের বাথরুমের লকগুলো নষ্ট। ওখানকার চেয়ারগুলো সিনেমাহলের চেয়ারের মতো। উঠে দাঁড়ালেই পেছনের দিকটা হেলে গিয়ে সামনের দিকটা ওপরের দিকে উঠে যায়। বড়োই বিরক্তিকর। ঘুমোনোর জন্যও ভালো না। বিশাল রুমটার ডিজাইন এমন যে, ওয়াশরুমে যেতে হলে সবার সামনে দিয়ে ‘এই দেখো, আমি হিসু করতে যাচ্ছি।’ এটা জানাতে জানাতে যেতে হয়। মাঝের জন বের হবার সময় পাশের সবাইকেই উঠে দাঁড়াতে হয়। ব্যাপক ঝামেলামার্কা ক্লাসরুম! এই সেশনটা প্রফেসর ডক্টর মোজাম্মেল স্যারের। আমরা আজ আগেই এই নীতিগত সিদ্ধান্তে এলাম যে, আগের ক্লাসে স্যার আমাদের কয়েক জনকে ঝাড়ি দিয়ে ক্লাসরুমে সাইডটক করার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ‘অপরাধে’ ইভ্যালুয়েশন ফর্মে স্যারকে ‘ফেইল’ করিয়ে দেবো। যাঁরা আমাদেরকে ভালো বলেন না, আমরা তাঁদের সকলের নিঃশর্ত ফাঁসি চাই। এই যেমন, আজকের দিনে প্রথম দুটো সেশনে স্যার যেমনই পড়ান না কেন, আমাদের কাউকে ঘুমোনোর জন্য, এমনকী পাশের জনের সাথে ফিসফিস করে গল্প করা সত্ত্বেও কিছুই বলেননি বিধায় ওঁকে আমরা একেবারে হাইয়েস্ট গ্রেড দিয়েছি।

আজকের ক্লাসরুম বেলুন আর জরির সুতো দিয়ে সাজানো। হয়তো কোনো অনুষ্ঠান ছিল। গেইটে, রুমে আর ডায়াসের চারিদিকে লালনীল বেলুনের ছড়াছড়ি। দেখলেই মনটা খুশি খুশি হয়ে ওঠে, সবকটা বেলুন সুই দিয়ে ফটাস ফটাস করে ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ডায়াসের এককোনায় ক্লাস অ্যাটেন্ডেন্টরা বসে আছেন। ওঁদের কাজ ক্লাসের যাবতীয় কাজে আমাদেরকে আর স্যারদেরকে অ্যাসিস্ট করা। ওঁদের পায়ের কাছে ২টা হারমোনিয়াম রাখা; পাশে বাঁয়া-তবলাও আছে। দেখলে মনে হয়, এই বুঝি মঞ্চে বসে হারমোনিয়ামের কর্ডে বাজাতে শুরু করবেন, আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি...

স্যার আজ ক্লাসে রেশিও-স্কেল পড়ালেন। সুবিধেমতো যে-কোনো একটা ভ্যালুকে জিরো ধরে নিয়ে এই স্কেলটা সাজানো হয়। এই স্কেলে জিরো মানে জিরো নয়। স্যার উদাহরণ দিলেন, এই যেমন ধরো, কারিনা কাপুরের জিরো ফিগার। এর মানে কিন্তু শরীরে কিছুই নেই, এমন কিছুতেই নয়। একটা স্ট্যান্ডার্ড ভ্যালুকে আইডিয়াল কিংবা জিরো ধরে নিয়ে হিসাব করতে হয়। (জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে করল, “ইয়ে মানে, স্যার, কারিনা কাপুরের শরীরে ‘কিছুই নেই’ ব্যাপারটা একটু ভেঙে বলবেন কাইন্ডলি?” প্রবল জ্ঞানতৃষ্ণা চেপে গেলাম। . . . স্যারের কথাটা শোনামাত্রই আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল এবং আমি অনেক কিছু কল্পনায় এনেও ফেলেছি!)

এরপর স্যার পড়ালেন কোয়ান্টিটেটিভ ভ্যারিয়েবল আর কোয়ালিটেটিভ ভ্যারিয়েবল সম্পর্কে। মাঝে মাঝে কোয়ালিটেটিভ ভ্যারিয়েবলে ভুলবশত ভ্যালু অ্যাসাইন করার প্রসঙ্গ টানতেই আমি দুষ্টুমি করে উদাহরণ দিলাম, “স্যার, এটার একজাম্পল হলো ১০০% লাভ।” স্যার বললেন, “আরে, ওইরকম কোনোকিছু আছে নাকি? আসলে ‘১০০% লাভ’ মানে ‘নো লাভ’।” আমি সাথে সাথেই বললাম, “না, স্যার, এইক্ষেত্রে রেশিও-স্কেলে জিরো ভ্যালু হচ্ছে মাইনাস ১০০!”

কী-একটা যেন প্রসঙ্গে ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ কথাটি এল। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, জয় তো করলাম। এরপর? এরপর কী হল?” আমি বললাম, “স্যার, এরপর হারিয়ে গেলাম। Veni, vidi, vici, peri.”

যাঁরা কথাটি বুঝতে পারেননি, তাঁদের জন্য ভেঙে বলছি। মূল কথাটি হলো, Veni, vidi, vici. মানে, I came, I saw, I conquered. রোমান সিনেটকে লেখা এক চিঠিতে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার প্রথম এই কথাটি ব্যবহার করেন। venire, videre, and vincere এই তিনটি ল্যাটিন verb-এর মানে হলো "to come", "to see" এবং "to conquer"...verb তিনটিকে ফার্স্ট পারসনে পারফেক্ট ফর্ম করলে দাঁড়ায় veni, vidi, vici. ল্যাটিন ভাষায় to lose-কে বলে perdet. আগের তিনটা verb-এর মতো ওটার ফার্স্ট পারসনে পারফেক্ট ফর্ম peri. প্রায়ই দেখা যায়, লোকে জেতে, এরপর হারিয়ে যায়—বিনয়ের অভাবে, অবহেলায়, কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে। তাই আমি ওই কথাটাকে স্যাটায়ার করে বানিয়েছি, Veni, vidi, vici, peri. মানে, I came, I saw, I conquered, I lost!

স্যার শুনে সাথে সাথেই বললেন, “একদম পারফেক্ট! লোকে আসে, দেখে, জয় করে, এরপর আর খুঁজেই পাওয়া যায় না, একেবারেই ফুটুস!”

স্যার পার্টিসিপেটরি অবজারভেশনের একজাম্পল দিলেন এইভাবে: “ডাক্তাররা রোগী দেখেন প্রতিদিন ৭০-৮০ জন আর ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে শো করেন ৭-৮ জন। এক ইনকাম ট্যাক্স ইন্সপেক্টর ডাক্তারের চেম্বারে গেছেন। ওঁর সিরিয়াল পড়ল ৬৭ নাম্বারে। সেদিন উনি কিছু না বলে ডাক্তার দেখালেন, আর পরের দিন ওঁর ট্যাক্স ফাইল চেক করতে আগের দিনের রিসিপ্টটা সাথে করে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার সাহেব তো পুরাই ধরা! একেই বলে পার্টিসিপেটরি অবজারভেশন, মানে নিজে অংশগ্রহণ করে কোনো কিছুকে অবজারভ করে ডাটা কালেক্ট করা।”

“আপনারা ঠিকমতো অবজারভ করতে শিখলে অনেক কিছু দেখেই বুঝে নিতে পারবেন, আসলে ঘটনা কী। এই ধরুন, গতকালকে ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে অনেক কাপল রিকশাতে করে ঘুরতে বেরিয়েছে। যদি দেখেন, ছেলেটা তাকিয়ে আছে ডানদিকে, মেয়েটা বামদিকে আর ওদের দু-জনের মাঝখান দিয়ে সোজা রিকশা চলে যাচ্ছে, তাহলে বুঝতে হবে, ওরা হাজব্যান্ড-ওয়াইফ। আর যদি দেখেন, ওদের মধ্যে ইটিশপিটিশ হচ্ছে, তারপর ইয়ে হচ্ছে...আপনারা তো বোঝেনই, কী আর বলব!...তাহলে ধরে নিতে হবে, ওরা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড!”

“আমি দীর্ঘকাল ধরে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পড়াতে গিয়ে দেখেছি, নতুন নতুন ফ্যাকাল্টি হওয়া টিচারদের কাছে পোলাপান পরীক্ষা দিতে চায় না, কারণ ওরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম মার্কস দেয়। পরীক্ষা দেবার জন্য সাধারণত সিনিয়র স্যাররা ভালো; দুনিয়াদারি দেখেছেন বেশি, তাই ভাব-টাব কম।”

‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ওয়ার্ল্ড লিটারেচারে শ্রেষ্ঠ ৩০টি ওপেনিং লাইনের তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই লিস্টে প্রথম স্থানেই ছিল জেন অস্টিনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’-এর প্রথম লাইনটি: “It is a truth universally acknowledged, that a single man in possession of a good fortune, must be in want of a wife.” কথাটাকে একটু এদিক-ওদিক করে লিখি, কেমন? It is a truth universally acknowledged, that a new faculty in possession of bad marks, must be in want of experience. ক্লাসে স্যারের কথাটা শুনে আমি মনে মনে কথাটিকে এভাবে করে ঘুরিয়ে ভাবলাম। আসলে বড়ো মানুষেরা ছোটো কাজে মাথা খারাপ করেন না। ছোটোলোক ছোটোকাজে বড়ো তৃপ্তিলাভ করে। শেক্সপিয়ারের Much Ado About Nothing কমেডি নাটকটিতে মেসিনা শহরের পুলিশপ্রধান ডগবেরি চরিত্রটিকে দেখা যায় তার কনস্টেবলদের বলছে, “ডিউটিতে থাকার সময় একটু ঘুমিয়ে-টুমিয়ে নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। কখনো কখনো ছোটো চোরকে দেখে ঝামেলা বাধালে বরং আরও বড়ো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে, এতে করে বড়ো চোরের পালানো সহজ হয়ে যায়।” সত্যিই তা-ই। অনেকেই আছেন, যাঁরা ছোটো চোরদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বড়ো চোরদের সুবিধা দিতেই। এই কমেডির শিরোনামে একটা মুভিও হয়েছে। সেখান থেকে ওই প্লটটা শেয়ার করছি:

Dogberry: Are you good men and true?
All: Yea.
Dogberry: Being chosen for the Prince's watch. This is your charge: You are to bid any man stand, in the prince's name.
Francis Seacole: How if a' will not stand?
Dogberry: Why, then take no note of him, but let him go.
Verges: If he will not stand when he is bidden, he is none of the prince's subjects.
Dogberry: True. and we are to meddle with none but the prince's subjects. You shall also make no noise in the streets.
George Seacole: We will rather sleep than talk.
Dogberry: Why, you speak like an ancient and most quiet watchman, for I cannot see how sleeping should offend.

“আগে ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেবার সময় বাবা-মা’কে কিছুটা হলেও interviewer–এর রোল প্লে করতে হতো। এখন দিন বদলেছে। এখন ওরা নিজেরা নিজেরাই পছন্দ করে নেয়। এখন বিয়ের সময়ে বাবা-মা থাকেন স্রেফ facilitator. এ নিয়ে আবার কোনো কোনো বাবা-মা’র আফসোসের সীমা নাই। কিন্তু কীই-বা করার আছে!” ওইসময়ে আমি মনে মনে বলে উঠলাম, স্যার, সবাই তো আর স্টাইল করে দাড়ি রেখে দেয় না, কারও কারও সত্যিই শেভ করার পয়সা থাকে না। আমি একজন আফসোসহীন মাতা-পিতা’র সন্তান।

এক মুসাফির হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে এক বাড়ির দরোজায় নক করে রাতের জন্য আশ্রয় চাইলেন। বাড়ির কর্তা দরোজা খুলে বিনীতভাবে বললেন, “আমার বাড়িতে বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে। আপনি দয়া করে অন্য বাড়িতে চেষ্টা করুন।” এরপরের ২টা বাড়িতেও একই ধরনের উত্তর এল। ক্লান্ত মুসাফির ভাবলেন, এভাবে করে লোকের বাড়ির দরোজায় কড়া নেড়ে নেড়ে বিরক্ত করাটা ঠিক না। তা ছাড়া সে নিজেও বার বারই প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিব্রত হচ্ছে। তারচে’ অন্য বুদ্ধি বের করা যাক। উনি চতুর্থ বাড়ির দরোজায় কড়া নেড়ে বাড়ির কর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “জনাব, আপনার বাড়িতে কি বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে?” কর্তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?” মুসাফিরের ঝটপট জবাব, “আমি রাতে থাকতে চাই, তাই।”

আজকের ক্লাসে স্যার কমিউনিকেশন প্রবলেম পড়ানোর সময় এই কৌতুকটা বললেন। কৌতুকটা আগেও শুনেছিলাম কিংবা দেখেছিলাম। আচ্ছা, দিলদারের কোনো একটা মুভিতে এই কৌতুকের অংশটা আছে না? ঠিক মনে করতে পারছি না। কারও জানা থাকলে একটু বলবেন?

আজকের এই ক্লাসটাতে একটুও ঘুম আসেনি। ভাবতে লাগলাম, সমস্যাটা কোথায়? না ঘুমিয়ে ক্লাস করার ব্যাপারটা তো আমার অভিধানে নেই! পরে বুঝলাম, হ্যাঁ, কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা অভিধানকেও বদলে দিতে পারেন। স্যারের ক্লাস না করলে বোঝা কঠিন, ‘রিসার্চ মেথডোলজি’-র মতো কাটখোট্টা বিষয়ও কতটা সহজ সাবলীলভাবে পড়ানো যায়! স্যার মেডিক্যাল কলেজে পড়ান, মানে উনি আমার বস হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবুও স্যারের অকুণ্ঠ প্রশংসা করছি। জ্ঞানী মানুষের প্রশংসা না করলে পাপ হয়। কখনো কখনো তো নিতান্ত অনিচ্ছাতেও বসকে ‘ভালো বলতে হয়’, তাই না? তবে যদি কাউকে ‘ভালো বলতে ইচ্ছে করে’, বলব না কেন?