ডেটলাইন ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
আচ্ছা, ভোরবেলার রং কী? ছুঁয়ে দেখা যায়, এমন একটা রং? স্নিগ্ধ কিছু-একটা? হবে হয়তো! ওই ‘কিছু-একটা’ বিভিন্ন রকমের হয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানটার দিকে যখন তাকিয়ে থাকবেন, তখন রংটা মনে হবে ফুলের পাপড়ির। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখুন, রিকশার টুংটাংয়ে ওই রংটাকে খুঁজে পাবেন। গাছগুলোর সবুজে ভোরের রং খুঁজতে যাওয়াটাও অনেক প্রশান্তির। খুঁজে দেখুনই না! সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে একটা ভোরবেলা দেখার পর মনে হবে, ওই ঢেউয়ের রঙে ভোরের শুভ্রতা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে-পড়া কটেজের খড়খড়ে দরোজায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে শরীর-মনের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে ভোরটাকে আলতোভাবে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারেন। ওই রংটাকে মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না; চাইলেও না, হলফ করে বলতে পারি। পিএটিসি’র ভোরের রং ক্ষণেক্ষণেই বদলায়। পাঁচিলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় দানব ট্রাকের চাকার ভীষণ শব্দে ভেঙে-যাওয়া ধুলোঘরের রঙে ভোরটা ধরা দেয়। উঁচু উঁচু ভবনের সামনের ধূসর চত্বরটাতে কিছু কিছু শাদা-বাদামি চড়ুই দানা খুঁটে খুঁটে খায়। চড়ুইয়ের ফুড়ুৎফারুৎ ঢঙের আলাদা একটা রং আছে। সেটার সাথে বিশাল কংক্রিটের উঠোনের নিপুণ মিশেলে ভোরের রংটা হয় ভারি অন্যরকমের। গাছের পাতায় পাতায় শিশিরে-ভেজা হালকা আলোতেও ভোরকে খুঁজে পাবেন। রাজহাঁসের খামারটার পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ওদের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। ভোরের ওই রংটা শ্বেতশুভ্র কোলাহলের রং।
জগিং-ট্র্যাকের পাশ দিয়ে একটা ঢিবি পাশের কুয়াশার চাদরে ঘেরা মাঠটাকে আড়াল করে রাখে। ওটার ওপরে মাঝারি গড়নের ঝিরিঝিরি গাছগুলোর বিচিত্র সরু সরু পাতার ফাঁকে ফাঁকে যে-হিমকণাগুলি আটকে আটকে থাকে, ওদের স্পর্শ করলে ভোরের আরেক রং ছুঁয়ে দেখা যায়। এই রঙের জন্ম এখানে নয়, অন্যকোথাও। মেটেরঙের গাছগুলোতে ভোরের রংটা ভারি শান্ত। ওরা সবাই মিলে আমাদের আমন্ত্রণ জানায় একটা চড়ুইভাতির। শুকনো পাতা, কাঠখড়, এদিক-ওদিক ছড়ানো ইট, গাছের মরে-যাওয়া ডালপালা, কাটা মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি—আয়োজনের কী নেই এখানে? এখানের ভোরটা চড়ুইভাতি রঙের। এই রং অনাহূত আনন্দের। পাখির নিবিড় চোখের মতো যে-ভোরটা, ওর কোনো রং হয় না। ওর রঙের মহান শিল্পী—যে দেখে, সে-ই। পিএটিসি’তে এভাবে করে রং বদলে বদলে ভোর ধরা দেয়। আমরা এগিয়ে চলি। যেতে হবে, থামব ৩ কিলোমিটার পর। ভোরের মৃদু হাওয়া গাইছে: তুমি, নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে...তব, পুণ্য-কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে...
আমাদের রুমে যে-কম্বলটা দেওয়া হয়েছে, সেটাতে একটা বিশাল বেখাপ্পা বেঢপ সাইজের শাদা কভার লাগানো। এই কভার সাধারণত কম্বলে থাকে না, লেপে থাকে। কম্বল গায়ে দিতেই কম্বলটা ওই কভারের ভেতরে সাঁতরে সাঁতরে এক কোনায় থেমে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। গায়ের ওপরে পড়ে থাকে ওই নরম তুলোট কভারটা। কম্বলের কোনা ধরে টেনে এনেও ওটাকে ভেতরে ঠিকমতো রাখা যায় না। ওটা ঠিক ঠিক আবার সেই কোনায় জায়গা খুঁজে নেয়। রাতে গায়ে কম্বল থাকে না। কী আর করা! অগত্যা, কভারটাকে ছুড়ে ফেলে কম্বলটাকে বিবস্ত্র করেই রাখতে হলো। ভেবেছিলাম, এই সমস্যাটা আমার একার। পরে দেখলাম, না, এই সমস্যাটা সবারই হয়েছে। ভালো তো! সব শেয়ালেরই লেজ কাটা হলে তো আর কোনো শেয়ালেরই দুঃখের কিছু নেই।
কেউ কেউ আমাকে বলেছেন আমাদের রুমের কিছু বর্ণনা দিতে। আসলে, বর্ণনা করার মতো তেমন কিছু এখনও পাইনি। তবুও কিছু দিচ্ছি। একটা রুম। দুইটা খাট। আমি আর আমার রুমমেট দু-জনই নিরীহ ভদ্রগোছের মানুষ। রুমে ফিরে আমি লিখি, একটু গান শুনি, আধটু মুভি দেখি। গান শোনা আর ফেইসবুকিং করা—দুটোই কমে গেছে। ইদানীং লিখি বেশি, পড়ি কম, তাই লেখার মান অনেক কমে গেছে। সারাদিনে মিলে ফোনে কথা বলি মূলত বাসায়, কখনো কখনো অন্য কারও কারও সাথে। রুমে বাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়ি, কেক…এসব রাখি আর কোনো কারণ ছাড়াই ওসব চিবোই। মশা কামড়াতে শুরু করলে প্রথমে দেখি, কামড় সহ্য করা যায় কি না। একেবারেই অপারগ হলে আলসেমি রেখে কয়েল জ্বালিয়ে দিই। ‘পিএটিসি ডায়েরি’ লিখি। আমার টেবিলে চোখের সামনে একগাদা বই আমাকে বলে যায়, “আর লিখো না, এবার একটু পড়ো।” মোবাইল ফোন ইচ্ছে করে অফ করে রাখি। ততটুকুই ইউজ করি, যতটুকু না হলেই নয়—প্রযুক্তির এমন সীমিত ব্যবহারে অভ্যস্ত হবার দীক্ষা নিচ্ছি। টেকযন্ত্রণা থেকে দূরে থাকছি, বেশ ভালো লাগছে। খাটের মশারি সবসময়ই নামানো থাকে। ওটা তুলে রাখতেও আমার আলসেমি। লেপ-কম্বল, বিছানার চাদর, ঘরের কাপড়চোপড় কোনো কিছুই গুছিয়ে রাখি না। সামনে যা পাই, তা-ই পরে ক্লাসে চলে যাই। প্রতিদিন দুই ধরনের কাজ করে থাকি: যা না করলেই নয়, আর যা করতে আমার ভালো লাগে। রুমে যা-কিছু এলোমেলো আছে, সেগুলোকে কখনোই গুছিয়ে রাখি না। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলে কাজের সময় ওটা আর খুঁজে পাই না। মজার ব্যাপার হলো, আমার এলোমেলো জিনিসপত্র থেকে কেউ কিছু সরিয়ে রাখলে আমার ঠিকই চোখে পড়ে যে, ওটা ওই জায়গাতে নেই।
বাসা থেকে আসার সময় মা বডিলোশন, কোল্ডক্রিম এসব দিয়ে দিয়েছেন, যার কোনোটাই আমি আলসেমি করে লাগাই না। আমার একমাত্র যুক্তি—শরীর আর মুখ ফেটে তো আর রক্ত বেরোচ্ছে না। প্রতিদিন শেভ করি না, কারণ শেভ না করার জন্য পিএটিসি’তে কোনো শোকজ নাই। টেবিলের উপর বই-খাতা, মোবাইল চার্জার, ঘড়ি, চিরুনি, কানটুপি, ল্যাপটপ-সহ রাজ্যের জিনিসপত্র এলোমেলো পড়ে থাকে। আমার গুছিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না।...আর কী কী লিখতে হয়, বুঝতে পারছি না। পরে মনে পড়লে আবার লিখব। ও আচ্ছা, ভালো কথা। আমাদের রুমে টয়লেট একটা, এবং ওখানে এক জন এক জন করে যাওয়া যায়, কারণ কমোডও একটা।
আজ করিডোর ধরে ক্লাসে যাবার সময় লতার ‘তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগি, হ্যায়রান হু ম্যা...’ গানটা কোনো কারণ ছাড়াই মাথায় ঢুকে গেল। গেল তো গেলই! একবার কোনোরকমে মাথায় ঢুকে গেলে এসব গান আর বেরোবার নয়। সারাটা ক্লাস সেটা বাজতেই থাকল বাজতেই থাকল। স্যার আমার সামনে এসে চোখ বড়ো বড়ো করে কী সব যেন বলেন, আর আমি দেখি শাবানা আজমিকে। বড়োই যন্ত্রণার বিষয়! অবশ্য কিছু কিছু ক্লাস করার চাইতে প্রিয় গানের সুরে একটু একটু হেসে ওঠাও ভালো। হাসছি, আর গানটার কথা ভাবছি। গানটা গুলজারের লেখা। সেলিম খানকেও মনে পড়ছিল। কেন? উনি গুলজারের বন্ধু এবং চিন্তাভাবনার সঙ্গী। তাঁদের আড্ডা থেকে বেরিয়ে আসত অনেক গান, কাহিনির প্লট। একটু হেল্প করি। নিচের ডায়লগগুলো মনে আছে কি না দেখুন তো?
: মর্দ হোতি তো দর্দ নেহি হোতি।
: ডন কো পাকারনা মুশকিল ভি নেহি হ্যায়, নামীমকিন হ্যায়!
: তুমহারা নাম কেয়া হ্যায়, বাসন্তী? (হোয়াট অ্যা সেন্স অব হিউমার!)
বলিউডকে উনি এইরকম অসংখ্য সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ করেছেন। ‘শোলে’ ওঁর লেখা। আরও আছে। আওয়ারা, দিওয়ার, জাঞ্জির, ডন, মিস্টার ইন্ডিয়া। সায়মন বিওফয় তাঁর সাথে তিন দিন কথা বলে ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’ লেখার রসদ জোগাড় করেন। জাভেদ আখতার তাঁরই আবিষ্কার। আগে সিনেমায় কে সিনেমাটা লিখলেন, সেটা পোস্টারে ছাপতো না। এখন ছাপে। এই অবদানটা সেলিম খান আর জাভেদ আখতারের। তাঁরা দু-জন মিলে সারারাত ধরে শহরের সব পোস্টারের গায়ে লিখে দিয়েছিলেন, স্ক্রিপরাইটার: সেলিম খান।
ওঁর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যথাগুলো নিয়ে জানলে বোঝা যায়, লতার গাওয়া ওই গানটি তাঁর পক্ষেই লেখা সম্ভব। না, তিনি ওটা লেখেননি। গুলজার যেদিন ওটা লেখেন, তার দু-একদিন আগে সেলিম খানের সাথে তাঁদের নিজেদের কিছু জীবনদর্শন নিয়ে আলাপ হয়। গানটির কথা ভাবলে বোঝা যায়, ওটা মাথা দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে লেখা।
ওঁর আরেকটা ছোটো পরিচয় দিই। ওঁর ছেলে বলে ওঁর পরিচয়ে ওঁর ছেলে অনেক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে থাকেন। ইয়ে মানে, ওঁর ছেলেও কিছু সিনেমা-টিনেমা করে বিখ্যাত হয়েছেন।
কাইফি আজমিকে যেমনি ‘শাবানা আজমির বাবা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না, তেমনি সেলিম খানকেও ‘সালমান খানের বাবা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে চাইলে দেওয়া যায়, তবে দিতেই হয়, কিছুতেই এমন নয়! যদি দিতেই হয়, তবে এই না-জানাটা সত্যিই অস্বস্তিকর।
কথায়-বেকথায় অনেক দূরে গিয়ে পৌঁছেছি। ক্লাসে ফিরে আসি। ইন্ডিয়ান মুভির যে-লাইনটি বাইরের বিশ্বে সবচাইতে বেশি পপুলার, সেটি খুব সম্ভবত: কোয়ি বাত নাহি, সেনোরিটা, কোয়ি বাত নাহি। বড়ো বড়ো দেশো ম্যায় অ্যাইসি ছোটি ছোটি বাত্যে হোতি রেহতি হ্যায়...(মানে, আরে ব্যাপার না, সেনোরিটা, কোনো ব্যাপার না! বড়ো বড়ো দেশে এমন ছোটোখাটো জিনিস হয়েই থাকে...) ডিডিএলজে’তে শাহরুখ ব্ল্যাক সানগ্লাসটা খুলে যে ইউনিক স্টাইলে এই ডায়লগটা দিয়েছিলেন, সেটা কপি করাটা সহজ নয়, এই তো সেদিন ওবামাও পারেননি। ভালো কথা, আমি এটা নিয়ে কোনো ধরনের আর্গুমেন্ট আশা করছি না। আমি জানি, ওঁর সেটি কপি করতে পারার কথাও নয়। ভাববেন না যে, নমস্তে...এটা বলে দিল্লির সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে হাজির হাজার দুয়েক দর্শক-শ্রোতাকে সম্ভাষণ জানিয়ে ওভাবে করে এসআরকে’তে মিস্টার প্রেসিডেন্ট কেন গিয়েছিলেন, আমি সেটা না বুঝেই এটা লিখেছি। আমি এটা লিখেছি, কারণ আজকের ২ ঘণ্টার প্রথম সেশনটা করার পর আমি নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি এই বলে: আরে ব্যাপার না, সুশান্ত, কোনো ব্যাপার না! বড়ো বড়ো ক্লাসে এমন ছোটোখাটো লেকচার হয়েই থাকে...আজকের ক্লাসে আমার আরেকটা উপলব্ধি হল: Sometimes you need better referee more than you need a good player. যারা করে, বলে না; যারা করে না, বলে। আসুন শিখি, কোথায় শুরু করতে হবে। শুরু করেই যদি ফেলি, তবে আসুন শিখি, কোথায় থামতে হবে, অন্য কেউ থামিয়ে দেবার আগেই!
পরের ক্লাসের গল্প বলি।
স্যার ক্লাসে বুকের ওপরে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “এই জায়গাতে কী থাকে?” আমি “হার্ট” বলতে যাব, এর আগেই কয়েকটা কণ্ঠে উত্তর এল, “নেমব্যাজ, স্যার!” (অ্যান্ড, দে রিয়েলি মেন্ট ইট!) কিচ্ছু করার নাই! পিএটিসি-কা সাইড ইফেক্ট! ওএমকে (ও মোর খোদা!)
“আচ্ছা, একটা সার্ভে করা যাক। ধরুন, আমি জানতে চাইছি, আপনাদের ক্লাসের চেয়ারগুলো কমফোর্টেবল, এটা মনে করেন কে কে?” এটা বলামাত্র অনেকেই চেয়ারে হাত দিয়ে দেখলেন। (এর আগপর্যন্ত কারও মাথায়ই কখনো আসেনি, এটাও যে একটা ভেবে দেখবার বিষয় হতে পারে! চেয়ারে বসছি, ঠিকই আছে, এই তো! জুতো আবিষ্কার হলো, আর লোকে ভাবতে শুরু করল, পায়ে ধুলো লাগানো যাবে না! বলি, আগে কী লাগত হে?)
“আমি আরেকটা সার্ভে করব। স্লিপিং টেনডেন্সি অব দ্য স্টুডেন্টস ইন দ্য ক্লাসরুম—এটার উপর।” অনেকেই দুম করে চোখদুটো বড়ো বড়ো করে খুলে আশেপাশে দেখতে লাগল, কে কে ঘুমোচ্ছেন। ভাবখানা এমন যেন, এতক্ষণ উনি নিজে জেগে ছিলেন। বিচিত্র হিউম্যান সাইকোলজি! মজার না?
“আপনারা ভাববেন না যে, আমার বয়স ৩০ নয় বলে কখনোই আমার বয়স ৩০ ছিল না। এখন আমার বয়স ৫৭। আমিও একদিন আপনাদের ওই চেয়ারটায় বসতাম এবং আমারও আপনাদের মতোই ক্লাসে ঘুম পেত। ক্লাসে ঘুম পেলে আমি কী করতাম, জানেন?” (স্যারের রাশভারী কণ্ঠে সিরিয়াসনেসের সুর। আমরা ভাবছি স্যার কী-না-কী বলে আমাদের ঝাড়ি দেবেন! যারা ঘুমোচ্ছিলাম, তারা চোখ কচলাতে কচলাতে খরগোশের মতো কানদুটোকে খাড়া করে রাখলাম স্যার কী বলেন, তা শুনতে।) বেশ কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে স্যার আবারও শুরু করলেন, “ক্লাসে ঘুম পেলে আমি...ঘুমিয়ে পড়তাম।” আহা! মনে হতে লাগল, Sometimes teaching everything is simply teaching nothing! ততক্ষণে মাথায় বাজছে...কেউ বলে বুড়ো ভাম, কেউ বলে পাজি, কেউ বলে এইবার বেটা মরলেই বাঁচি!
এসব ভাবছি। এমন সময় স্যারকে চেঁচাতে শুনলাম মনে হলো, “৫৩৫! ৫৩৫!! কী ব্যাপার! এই রোল নাম্বারটা কার?” আশেপাশে তাকাতে লাগলাম। “কার এই রোল নাম্বারটা? বেআক্কেলটা সামনে যায় না কেন? স্যার ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছেন!” এসব ভাবছি আর পাশের জন বলে উঠলেন, “সুশান্তদা, স্যার আপনাকে ডাকছেন তো! ওদের সাথে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান।” আমি হুড়মুড় করে রীতিমতো সামনের টেবিল-সহই উঠে পড়লাম! পায়ে ব্যথাও পেলাম। মেন্টাল অ্যাবসেন্স আর কাহাকে বলে! নিজের রোল নাম্বার শুনেও অন্যকাউকে খুঁজছিলাম!
আজকের দিনের শেষ ক্লাসটা ছিল ট্যুরিজমের উপর। পুরো ক্লাসটা ২টা ট্যুরিজম প্রমোশন ভিডিয়ো-ক্লিপ দিয়ে শেষ হলো। অডিয়ো-ভিজ্যুয়াল সেশন। এই ছবি আর শব্দের আয়োজনে আমরা (না ঘুমিয়ে) যা বুঝলাম, যা শিখলাম, সেটা ৩ ঘণ্টার লেকচারেও শেখা সম্ভব হতো না। আমি ভাবছি, এই ছয় মাসের ট্রেনিং প্রোগ্রামে যদি শুক্র-শনি বাদে বাকি প্রায় ১৩০ দিনে প্রতিদিন ২টা করে ২৬০টা বাছাই-করা মুভি দেখানো হতো, তবে দুটো ব্যাপার ঘটত। এক। আমরা কেউই ক্লাসে ঘুমোতাম না। দুই। আমরা সত্যিই আরও অনেক বেশি কিছু শিখতে পারতাম। ঠাট্টা নয়, আজকের ক্লাসের পর আমার এটা মনে হয়েছিল। And, I really meant it!
বিকেলে খেলার মাঠে গিয়ে দেখলাম, আজকের আকাশটা একটু অন্যরকম। আকাশটাকে যদি একটা ক্যানভাস ভাবি, তবে ওটার দিকে তাকালেই খুব ভাবতে ইচ্ছে করছিল, আনাড়ি কোনো শিল্পী যেন পেইন্টিং-ব্রাশ দিয়ে ক্যানভাসের গায়ে যেখানে যেভাবে ইচ্ছে রঙের খেলা খেলেছে। আজকের আকাশটা স্পোর্টসের আকাশ নয়। এই আকাশ অভিমানী প্রেমিকার হাত ধরে হাঁটবার আকাশ। ঠিক পা ফেলে নয়, বরং পা-দুটোকে একটুখানি ছুড়তে ছুড়তে দু-জন দু-দিকে তাকিয়ে একই রেখায় হাত-বাড়ালেই-ছোঁয়া-যায় দূরত্বে পাশাপাশি হাঁটবার আকাশ। একটু আড়চোখে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসিতে হারিয়ে যাবার আকাশ। ওর হাত ধরে মাঠের ঠিক মাঝখানটায় বসে চোখদুটোকে নাচিয়ে নাচিয়ে মিষ্টি রোদে স্নান করতে করতে ‘বিকেলের শেষ আলো একটু থাকো...’ গাইবার আকাশ। কার্জন হলের বাগানের ঘাসের ওপর কিংবা শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়ে বসে বসে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে বাদামদুটো ওর হাতে দিয়ে ওর হাত থেকে আবার হুট করে নিজের মুখে পুরে দেবার খুনসুটি করার আকাশ আজকের এই আকাশ। পড়ন্ত বিকেলবেলায় কোলাহল থেকে দূরে নদীতীর ধরে নিরুদ্দেশ হেঁটে যাবার আকাশ। আজকের আকাশটা শুধুই ভালোবাসতে ইচ্ছে হবার আকাশ।
আকাশ কখনও পুরোনো হয় না।—কোথায় যেন পড়েছিলাম এই কথাটা? সুনীলে? শীর্ষেন্দুতে? না কি সমরেশে? ভুলে গেছি। না কি ভুলে যেতে ভালো লাগছে? না কি কখনোই কোথাও পড়িনি? এই মুহূর্তে যা চলছে, সেটা ভাবনার মন্তাজ-খেলা মাত্র!