পরিচয় দেওয়া

কেউ যখন আপনার পরিচয় জানতে চায়, তখন পুরো পরিচয়‌ই দেওয়া উচিত, যদি আপনি খুব বিখ্যাত কেউ না হন। আপনি তো আর অমিতাভ বচ্চন নন যে কেবল "অ" বললেই লোকে আপনাকে অজগর না ভেবে বাকিটা ঠিকভাবে বুঝে নেবে!

: আপনার পরিচয় বলবেন?
: পরিচয় দিলে তো চিনবেন না। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।
: আপনি কে?
: জি...আমি সুমন।
: পুরো পরিচয় বলবেন?
: আপনি তো আমাকে চিনবেন না। পরিচয় দিয়ে তো লাভ নেই। আমি আপনাকে চিনি।
: পরিচয় না দিলে চিনব কীভাবে?
: পরিচয় দিলেও তো চিনবেন না। পরিচয় দেবার মতো আমার তেমন কিছু নেই। আমি আপনাকে আমার একটা কাজে নক করেছি। আমার সমস্যা হচ্ছে... ব্লা ব্লা ব্লা।

উপরের কথোপকথন পড়ে কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে না যে মিস্টার সুমন ধরেই নিয়েছেন, ওই লোক তাকে হেল্প করার জন্য হাঁ করে বসে আছেন? যার প্রতি মানুষের ন্যূনতম আগ্রহ‌ও নেই, তাকে মানুষ সময় দেয়? অন্তত সেই মানুষটা সময় দেয় না, যার সময় আপনার দরকার। কাউকে নক করে এরকম বিরক্ত করার মানে কী? মিনিমাম একটা সেলফ-রেসপেক্ট তো থাকা দরকার, তাই না? মাত্র এইটুকু কমনসেন্স‌ও যার নেই, সে একজন অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে হেল্প আশা করে কীভাবে? এইসব ফালতু লোক আসলে সবাইকেই কাস্টমার কেয়ারের প্রতিনিধি ভাবে।

মানুষ তাকেই সময় দেয়, যাকে সে সময় দিতে চায়। অপরিচিত কার‌ও কাছে সময় চাইবার আগে তার সঙ্গে পরিচিত হতে হয় এবং সেই পরিচয়টা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়, যেখান থেকে সে নিজেই আপনাকে সময় দিতে চাইবে। তার কাছ থেকে আপনার পাঁচমিনিট দরকার, এর চাইতে জরুরি হলো এটা যাচাই করে দেখা, আপনাকে তার পাঁচসেকেন্ডও দেওয়া দরকার কি না। যে আপনাকে চেনে না, আপনাকে সময় দিতে সে বাধ্য নয়। সময় পাবার জিনিস নয়, আদায় করার জিনিস।

কাউকে নক করেই নিজের প্রয়োজন সম্পর্কে বলতে থাকে যে, তাকে বেআক্কেল বলে। হয়তো আপনি যে সমস্যায় আছেন, তা আপনার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে দিচ্ছে, কিন্তু এতে এমন কারও কী এসে যায়, যে আপনাকে চেনেই না? নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য আপনি তাকে মহৎ, নিঃস্বার্থ, হৃদয়বান, স্যার বা মহাস্যার যা ইচ্ছে বলতে পারেন, কিন্তু ওসবে তার কী এসে যায়? নিজের প্রয়োজনে এরকম জোর করে কাউকে বড়ো বানায় যারা, ওদের ধান্দাবাজ বলে। কেবল সেই প্রশংসাই যথার্থ, যা মানুষ কোনও উদ্দেশ্য মাথায় না রেখে করে।

আপনি তাকে অনেক বড়ো ভাবেন, আপনি তাকে অনেক পছন্দ করেন, আপনি তার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারেন, অনেক আশা নিয়ে আপনি তার দ্বারস্থ হয়েছেন, আপনি সারাদিন তাকে নিয়েই পড়ে থাকেন, আপনি তাকে অনেক ভালোবাসেন বা সম্মান করেন... ইত্যাদি ইত্যাদি! ভালো কথা। কিন্তু এইসব তো আপনি করেন এইসব করতে আপনার ভালো লাগে বলে। এতে তার দায়টা কোথায়? ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, প্রত্যাশা...এ সবই হচ্ছে মানুষের পায়ে শেকল পরিয়ে দেবার একেকটা অব্যর্থ কৌশল।

তাই মিস্টার সুমন, কার‌ও কাছ থেকে সময় পেতে চাইলে আগে তার মধ্যে আপনাকে নিয়ে ন্যূনতম আগ্রহের জন্ম দিন। আপনার পরিচয় ঠিকভাবে না দিলে কোন জাদুর বলে তার মধ্যে আপনাকে নিয়ে আগ্রহ জন্মাবে? এইটুকু স্মার্টনেস তো থাকতে হবে ব্যস্ত কার‌ও কাছ থেকে সময় আদায় করতে চাইলে। যে সময় আদায় করে নিতে জানে না, তাকে সময় দেবার বেলায় সবাই-ই ব্যস্ত। আপনার প্রয়োজন আপনার কাছে অনেক কিছু, কিন্তু একজন অপরিচিত মানুষের কাছে আপনার প্রয়োজন কিছুই মিন করে না। পরিচয়, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব অনেক বড়ো জিনিস।

পুনশ্চ। আরেক শ্রেণীর আনস্মার্ট খ্যাত্‌মার্কা চিড়িয়া দেখি, যারা নক দেবার পর রিপ্লাই দিলে দুনিয়ার কাহিনি শুরু করে। 'হায় হায়! আপনি আমাকে রিপ্লাই করেছেন!' 'আপনি সত্যিই রিপ্লাই করেছেন? না কি অন্য কেউ রিপ্লাই করছে?' 'আপনি নিশ্চয়ই অন্য কেউ! ওঁর তো এত সময় নেই যে আমাকে রিপ্লাই দেবেন! লজ্জা করে না আপনার আরেকজনের নামে ফেইক আইডি চালাতে?' 'আপনি...আপনি আমাকে কীভাবে রিপ্লাই করলেন! আমার তো ইচ্ছে করছে খুশিতে মরে গিয়ে আমার দাদাজানের কবরের পাশে শুয়ে পড়তে!' এরকম হাজারো বেকুবমার্কা রিপ্লাই! সত্যিই ভীষণ ভীষণ বিব্রতকর! আবার এদের মধ্যে কেউ কেউ রিপ্লাইয়ের স্ক্রিনশট নিয়ে তা মাই-ডে দেওয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাইয়ের বিজনেস শুরু করে দেয়! এই ব্যাবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি-বাড়ি কিনে ফেলে। ইনবক্স মার্কেটিং খুব সহজেই পথের ফকিরকেও রাজাবাদশাহ্ বানিয়ে দেয়।

আমি যদি শাহরুখ খানকেও মেসেজ পাঠাই, তিনি যদি কোনও কারণে সেই মেসেজের রিপ্লাই দেন, এবং রিপ্লাই পেয়ে যদি আমি এরকম কাহিনি শুরু করি, তখন ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আমি কি রিপ্লাই পাবার জন্য তাঁকে মেসেজ পাঠাইনি? না কি আমাকে রিপ্লাই করে তিনি কোন‌ও মহাঅন্যায় করে ফেলেছেন? যার রিপ্লাই হজম করার মতো শক্তি আমার নেই, তাকে বিরক্ত করার মানে কী? মানুষ মানুষকে রিপ্লাই তো করতেই পারে। রিপ্লাই পাবার পর সহজভাবে কথা বলতে না পারলে নক করার কী দরকার? না কি আমি নিজেকে মানুষ মনে করি না, গরু মনে করি?

সবচাইতে বড়ো কথা, একজন মানুষের রিপ্লাই পেলে ওরকম ভিখারির মতো করার কী আছে? এই সামান্য আত্মসম্মানবোধ তো ভিখারির‌ও থাকে। আর এই কনভারসেশনের স্ক্রিনশট যখন আমি তাঁর অনুমতি না নিয়ে অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করি, তখন ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না? ইনবক্সের আলাপ তো কমেন্টের মতো পাবলিক কোন‌ও জিনিস নয়। এটাকে পাবলিক করতে হলে তো দুই পক্ষেরই অনুমতি দরকার। আসলে কী জানেন, যারা সারাজীবন মাঠেঘাটে উলঙ্গ বা অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে গোসল করতে অভ্যস্ত, তারা হঠাৎ গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে পড়লে অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের কারণে দরজা খোলা রেখেই উদোম শরীরে নিতম্ব নাড়িয়ে নাড়িয়ে গোসল করতে শুরু করে দেয়!