নিঃসঙ্গতাযাপন

চেস্টার বেনিংটন, লিনকিন পার্কের এই বিখ্যাত লিড ভোকালিস্ট, যাঁর গলায় ছিল স্বর্গীয় স্বর, সেই গলাতেই একদিন ফাঁস লাগিয়ে হুট করে আত্মহত্যা করে বসেন।

ভ্যান গঘ, যাঁর তুলির আঁচড়ে জন্ম হয়েছিল দ্য স্ট্যারি নাইট-এর মতো বিখ্যাত সব পেইন্টিং, সেই তিনিই একদিন নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে নিজেকে মুক্তি দিলেন।

মেরিলিন মনরো। গুণী এই অভিনেত্রী তাঁর অভিনয় দক্ষতায় কেড়েছিলেন পৃথিবীবাসীর মন, সেই মনরোই নিজেরই সঙ্গে নিজের অবিরত অভিনয় বেশিদিন সহ্য করতে পারেননি। দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধ অতিসেবনের মধ্য দিয়ে তিনিও একদিন খুন করে ফেললেন নিজেকে।

উপরের তিন জন ব্যক্তিই ছিলেন ব্যক্তিজীবনে নিঃসঙ্গ। পৃথিবীভর্তি মানুষের ভিড়েও ছিলেন ভয়ানক একা।

মানুষ যে কয়েকটা বিষয়কে ভয়ানক রকমের ভয় পায়, সেগুলির মধ্যে নিঃসঙ্গতা হচ্ছে সবার ঊর্ধ্বে।

পৃথিবীতে যত বেশি জনসংখ্যা বাড়ছে, নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা তত হারে বাড়ছে।

মানুষ সবকিছু নিয়ে বাঁচতে পারলেও নিঃসঙ্গতা নিয়ে ঠিক বাঁচতে পারে না।

নিঃসঙ্গতা মানে কিন্তু মানুষের অভাব নয়। আমি নিঃসঙ্গ, এর মানে আমি আছি, কিন্তু আমাকে বোঝার মতো কেউ নেই। আমি নিঃসঙ্গ, এর মানে আমার সবকিছুই লোকে দেখতে পায়, শুধু হৃদয়ের রক্তক্ষরণটা কেউ ঠিক ধরতে পারে না। আমি নিঃসঙ্গ, এর মানে আমি সবাইকে গ্রহণ করতে পারলেও আমাকে ঠিক আমার মতো করে কেউই গ্রহণ করতে পারে না।

সারাদিন খিলখিল করে হাসতে হাসতে কারও গায়ে গড়িয়ে পড়া মানুষটি যখন কারও কাঁধে মাথা রেখে একটুখানি কাঁদতেও পারে না, তখন তার মনের অবস্থাটাকে নিঃসঙ্গতা বলে। ভূরি ভূরি সাফল্য, চোখ-ধাঁধানো বিলাসী জীবনের অপর পিঠে যে গভীর ক্ষত লুকোনো আছে, চোখ-ভেজানো দৈন্য আছে, তা যখন কাউকে সে দেখাতে পারে না, মানুষ তখন নিঃসঙ্গ।

আমার চোখে, নিঃসঙ্গতা এ পৃথিবীর ভয়ংকরতম অসুখ, যে অসুখ সঙ্গী পেলেও ঠিকভাবে সারে না। ধরা-না-পড়া ক্যানসারের মতো একটু একটু করে মগজের চারপাশটা আক্রান্ত হতে হতে মানুষ নিঃসঙ্গতার হাত থেকে বাঁচতে একদিন মহাপৃথিবীর ওপারের পথ বেছে নেয়।

শরীরের ক্ষত ওষুধে সারে, মগজের যে অংশগুলো অদৃশ্য নিঃসঙ্গতা গিলে খাচ্ছে ক্রমশ, তার কোনও প্রতিকার নেই, কোনও প্রতিষেধক নেই।

এ কারণেই, ঘরভর্তি আপন মানুষ, ব্যাংকভর্তি ধনসম্পদ আর মগজভর্তি মেধা থাকার পরও কেউ কেউ নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকেই বেছে নেয়।

এই নিঃসঙ্গতাযাপন ব্যাপারটি মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর!