এই পৃথিবীর নিয়ম হলো এ-ই……
সবচাইতে সুন্দর যারা দেখতে, আমরা কেউই তাদেরকে চিনি না, কারণ ওরা নাটক-সিনেমায় আসে না।
সবচাইতে ভাল যারা লেখে, তাদের লেখা কোনও বই নেই।
সবচাইতে জ্ঞানী যারা সক্রেটিসের মতো, তারা নিজেরা কিছুই লিখে যান না।
সবচাইতে চমৎকার ভাবনা যাদের, তাদের কারওই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই।
সবচাইতে অসাধারণ কণ্ঠ যাদের, তাদের গান আমরা কেউই কোনওদিনও শুনতে পাবে না।
সবচাইতে স্মার্ট যারা, তাদের কেউই মিডিয়াতে আসেনি।
সবচাইতে মেধাবী যারা, তাদের কেউই কখনও স্কুলে যায়নি।
সবচাইতে বেশি মুগ্ধ হওয়ার মতো করে বলে যে, তার কোনও ভিডিও আমরা কোনওদিনও ইউটিউবে পাবো না।
সবচাইতে ভাল নাচে যে, সে ঠিক করেছে, সে কখনওই ক্যামেরার সামনে নাচবে না।
সবচাইতে ভাল রান্না করে যে, তার রান্না আমরা কেউই এখনও খাইনি।
সবচাইতে ভাল মনের মহৎ হৃদয়ের মানুষটিকে আমরা কেউই চিনি না, কারণ তিনি কাজ করে যান গোপনে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে নাজিম হিকমতের ভাবনা থেকে ধার নিচ্ছি—
যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠে নি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলিনি।
বলতে পারেন, ‘সবচাইতে ভাল’ বলে তো আর কিছু নেই। যাকে আমি পছন্দ করি, তার সব কিছুই আমার চোখে ‘সবচাইতে ভাল’। ভালোবাসে বলেই ছেলেটি অফিস থেকে ফেরামাত্রই ওকে জোরে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে-খেতে মেয়েটি নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে, “তোমাকে এই ঘামে-ভেজা শার্টেও অসম্ভব হ্যান্ডসাম দেখায়!” তবুও কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজেরদের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে সব কিছুর ঊর্ধ্বে প্রচ্ছন্নভাবে প্রোজ্জ্বল হয়েই থাকেন। এ পৃথিবীর নিয়মই হলো, আমরা কোনওদিনই জানতে পারবো না, কাদেরকে কোনও গ্রামারেই ফেলা যায় না। কারণ, ওদের ক্ষেত্রে নিয়মহীনতাই একমাত্র নিয়ম। রামানুজন কীভাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা গণিতবিদ হলেন, সেটা জানতে আমাদের বুদ্ধি কোনওদিনও যথেষ্ট হবে না। অন্নপূর্ণা দেবীরা রবিশঙ্করদের জন্য সবসময়ই আত্মত্যাগ করে গেছেন। আইনস্টাইনের স্ত্রীর যে যোগ্যতা ছিল, তাতে বলা যায়, হয়তোবা উনি আইনস্টাইনের চাইতেও বড় হতে পারতেন, যদি উনি আইনস্টাইনকে আইনস্টাইন হওয়ার সুযোগ দিতে সব কিছুতে ছাড় না দিতেন। কে বলতে পারে? পৃথিবী প্রকৃত নায়কদের ইতিহাস লেখে না।
কোনও এক গ্রামের কোনও এক সাদামাটা দুপুরবেলায়, যখন মায়েদের কাজ ঘুমানো, বাবাদের কাজ কাজ করা, আর ছেলেদের কাজ মায়ের চোখ আর বেত ফাঁকি দিয়ে মাঠে দৌড়াতে-খেলতে পালিয়ে যাওয়া, সেইসময় ৭-৮ বছরের রবি মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে পুকুরের পাড়ে বসে-বসে কোনও এক পাখির বাসায় ঢিল ছুঁড়ে-ছুঁড়ে বাসাটাকে ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছিল। ওর মা ওর ছোটবোনটিকে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন, বাবা দোকানদারিতে ব্যস্ত। ও পুকুরের পাড়ে যে গাছের গুঁড়িতে বসে আছে, মাঝেমাঝে সেটিতেই লাফাতে-লাফাতে গুঁড়িটি ভেঙে ফেলার অক্লান্ত বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। হাতে যে লাঠিটা ধরে আছে, সেটার মাথায় একটা সাপের ছেড়ে-দেয়া খোলস পেঁচিয়ে লাঠিটাকে কীভাবে যেন ঘুরাচ্ছে। নতুন-নতুন শিষ দিতে শিখে সে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে কোন পাখির ডাকের সাথে ওর শিষটা মিলে যায় পুরোপুরি। কারও সাথে মিলছে না দেখে সে বিরক্ত হয়ে পুকুরের পানিতে খুব জোরে-জোরে ক্রমাগত ঢিল ছুঁড়েই যাচ্ছে ছুঁড়েই যাচ্ছে। হঠাৎই একটা গোলাপী রঙের শাপলায় ওর চোখ আটকে গেল। মাটির ঢিল ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ করে সে একটা লম্বা ডাল দিয়ে ফুলটিকে টেনে নিজের কাছে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করা শুরু করলো। কিন্তু শাপলা যে খুব শক্ত করে নিচের বোঁটায় আটকে আছে, সে খবর ছোট্ট রবি জানবে কী করে? ওই বয়সের ছেলেদের মাথায় যেটা একবার ঢোকে, সেটা থেকে ওকে বের করে আনাটা রীতিমতো অসম্ভব। প্রায় ২০-২৫ মিনিট নিরন্তর চেষ্টা করার পরেও যখন ফুলটি ওর কাছে আনতে পারল না, তখন সে আগপাছ কিছু না ভেবেই ফুলটি ছিঁড়ে আনতে পুকুরে লাফ দিল।
রবি সাঁতার জানত একটু-আধটু, সেটা পুকুরপাড় থেকে ২০-২৫ হাত দূরে অন্তত ৫ ফিট গভীরতায় টিকে থাকার সাঁতার নয়। কিন্তু ওই বয়সের দুরন্ত ছেলের ওইটুকু ‘মুহূর্তের বুদ্ধি’ হওয়ার কথা নয়। ও কিছুদূর যেতে না যেতেই ভারসাম্য হারিয়ে ভয়ে চিৎকার করা শুরু করে এবং হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে-করতে পুকুরের মাঝখানের দিকে যেতে থাকে। কিছু সময়ের মধ্যেই আশেপাশে বেশ কয়েকজন লোক জমে যায়। সবাই শুধু রবি কেন বোকার মতন ওখানে লাফ দিল, ওকে বাড়ির লোক আটকে রাখলো না কেন, ওই পুকুরে ডুবে প্রায়ই লোক মরে, সে ভয়ে কেউই ওখানে গোসল পর্যন্ত করে না, এসব বলাবলি করছিল। সেখানে রবির সেজোকাকা ছিলেন। উনি রবিকে বাঁচাতে লাফ দেবেন, এমন সময়ে উনার স্ত্রী, মানে রবির সেজোকাকি উনাকে শক্ত করে ধরে বলতে লাগলেন, “পাগল হয়েছো তুমি? এই পুকুরে অপদেবতা আছে, সে কথা ভুলে গেছো? সেদিনও তো ওই পাড়ার দাশুকে পা টেনে নামিয়ে ফেলেছিল। পরে ওকে বসা-অবস্থায় পাওয়া গেছে! সমস্ত শরীর পাথরের মতন শক্ত হয়ে গেছে, এমনকি চোখজোড়া পর্যন্ত শক্ত করে আটকে ছিল। তোমার বৌদি জানে না সে ঘটনা? ওরকম দস্যি ছেলেকে ফেলে কেউ ঘুমায়? মরুক ওই বান্দর ছেলে!” হয়তো এসব কথা ঠিক, তবুও এমন বিপদের সময়ে ধর্মকথা বড্ডো বেমানান।
রবির কাকা স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে লাফ দেবেন-দেবেন করছেন, ঠিক ওই মুহূর্তেই কোত্থেকে যেন ৩০-৩৫ বছরের এক লোক লুঙ্গি কোঁচ দিয়ে বেঁধে খালি গায়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ওদিকে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে-করতে রবি পুকুরের প্রায় মাঝখানটিতে গিয়ে হারিয়ে গেছে। ওকে আর দেখা যাচ্ছিল না, তবে পানির বিক্ষেপণ দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিল, ও কোথায় আছে। লোকটি ডুবসাঁতার দিয়ে প্রায় ৭-৮ মিনিট পর অজ্ঞান রবিকে পাড়ে তুলে নিয়ে এলেন। এরপর উনি নিজেই কৃত্রিম উপায়ে রবির শ্বাসপ্রশ্বাস চালনার ব্যবস্থা করলেন। রবি একটুখানি চোখ মেলে তাকানোর পর উনি ঝড়ের গতিতে শার্টটা গায়ে চাপিয়েই যে সাইকেলে এসেছিলেন, সেটাতেই ছুটে চলে গেলেন। ঝড়ের মতো এসে ঝড়ের মতোই হারিয়ে গেলেন। হৈচৈ থামলে ওই লোকটিকে সবাই খুঁজতে লাগল, তবে তাড়াহুড়োয় কেউ তেমন একটা খেয়াল করেনি উনাকে। ২-৩ জন বললেন, লোকটি সে গ্রামের পাশে অমুক গ্রামের তমুকের ছেলে, একটা প্রাইমারি স্কুলে দারওয়ানের কাজ করেন। রবিকে নিয়ে ওর পরিবারের সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল বলে সেদিকে কেউই খুব একটা খেয়াল করেনি। ওরা রবিকে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মানুষ বোধহয় এভাবেই বিপদ কেটে গেলে বিপদ থেকে উদ্ধার করার মূল মানুষটিকেই ভুলে যায়। যিনি না থাকলে রবিকে কিছুতেই বাঁচানো যেত না, উনাকে খুঁজে বের করে ন্যূনতম একটা ধন্যবাদ দেয়ার কথা কারওই মাথায় এল না। হায়! এ-ই হয়! এই অকৃতজ্ঞতা আমাদের রক্তে হাজার-হাজার বছর ধরে মিশে আছে। ইতিহাস বলে, বাঙালি প্রায়ই অকৃতজ্ঞ, এমনকি কখনও-কখনও কৃতঘ্নও! ইতিহাসের এ পাঠটি এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি নির্ভুল।
জ্ঞান ফিরে এলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভয় কাটিয়ে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া আর যত্নআত্তিতে রবি আস্তে-আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল। সুস্থ হওয়ার পর ও প্রথমেই যে আপ্যায়নটি ওর মায়ের কাছ থেকে পেল, সেটি হল প্রচণ্ড বকাঝকা, কয়েক দফায় কিল আর চড়। এটা ভিন্ন রকমের কোনওকিছু নয়। আমি নিজেও ছোটবেলায় একবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে দুষ্টুমি করে রিকশা চালাতে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে বাহু আর পায়ের উপরিভাগের কিছু অংশ ছিলে ফেলেছিলাম। এই কাজের রিওয়ার্ড হিসেবে পেয়েছিলাম, সে ক্ষতের উপরেই দফায়-দফায় বেতের বাড়ি। অবশ্য মা-ই পরবর্তীতে সেই ডাবল-ক্ষত ডেটল আর তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। চিরন্তন বাঙালি মায়ের বৈশিষ্ট্য, ছেলে দুষ্টুমি করতে গিয়ে আহত হলে প্রাথমিক চিকিৎসাই হলো মাইর, পরে অন্য কিছু। রবির মাও আমার এবং আপনার মায়ের মতোই ছিলেন। যা-ই হোক, রবির উপর ১৪৪ ধারা জারি করা হলো, ঘর থেকে বের হলেই মেরে তক্তা বানিয়ে সে তক্তায় মজবুত চৌকি বানানো হবে! সে চৌকিতে রবির মা আরাম করে বিশ্রাম নেবেন।
একদিন পর সন্ধ্যার দিকে সেই লোকটি একে-ওকে জিজ্ঞেস করে খোঁজ নিয়ে-নিয়ে রবিদের বাড়িতে এলেন। উনাকে দেখে মাত্র দুইজন চিনতে পারলেন। পরে উনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “আমি রবিকে দেখতে এসেছি। ও এখন কেমন আছে?” রবির রুমে গিয়ে রবির কপালে চুমু খেয়ে উনি বললেন, “ঠিক আছে, এখন আমি আসি।” উনাকে অনেক জোর করা সত্ত্বেও উনি “আমার একটু তাড়া আছে” অজুহাতে কিছুই মুখে দিলেন না। পরে একটা পর্যায়ে রবির বাবা উনাকে হাজার দুয়েক টাকা দিতে চাইলে উনি শার্টে চোখ মুছতে-মুছতে বললেন, “স্যার, আপনাদের অনেক দয়া। আমি খুশি হয়েছি। আমার টাকা লাগবে না। আপনারা রবিকে দেখে রাখবেন।” এটা বলেই রবির বাড়ির কাউকেই আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে সাইকেলে চেপে দ্রুত চলে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কেমন যেন বোকা হয়ে গেল।
ব্যাপারটিতে কেউ-কেউ, বিশেষ করে রবির সেজোকাকা খুব অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। উনি রবির বাবাকে বললেন, “দাদা, উনি সেদিন না থাকলে রবিকে আমরা আর পেতাম না। উনিই আমাদের রবির জীবন বাঁচিয়েছেন। আমাদের উচিত উনার বাসায় গিয়ে উনার পরিবারের সাথে দেখা করে আসা। আর উনি তো অনেক গরীব, উনাকে কিছু টাকাপয়সা দেয়াও উচিত।” “আমি তো আজকেই দিতে চাইলাম, উনি তো নিলেন না।” “এতো কম দিলে কি হয়, দাদা? এই বাজারে দুই হাজার টাকায় কী হয়? আপনি কিছু বাড়িয়ে দিন।” পরের দিন ভোরেই খোঁজখবর নিয়ে রবির বাবা আর সেজোকাকা সাড়ে তিন হাজার টাকা সাথে নিয়ে লোকটির বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। লোকটির বাড়ি পাশের গ্রামে। ভ্যানে যেতে দেড় ঘণ্টার মতো লাগে। সেই লোকের ছনের ছাউনি-দেয়া মাটির ঘর। উনি ঘরের সামনেই ছিলেন। উনাদের দেখে মোড়া নিয়ে উঠোনে বসালেন। মুড়ি, পাটালি গুড় আর পানি খেতে দিলেন। লোকটি নিজে তেমন কিছুই বলছিলেন না, মাথা হেঁট করে বসেছিলেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর রবির বাবা আর কাকা আর কোনও কথা না বলে ভীষণ কষ্টে আর লজ্জায় মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে-ফেলতে ওই বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিলেন।
কথা বলে জানা গেল, ওই লোকটির একমাত্র মেয়েটি রবির সমবয়সি। সে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে ছিল কিছু দিন ধরেই। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ছিল সে। অবস্থা একটু উন্নতির দিকেই যাচ্ছিল কিন্তু সেদিন সকালে হঠাৎ করেই জ্বর প্রচণ্ড বেড়ে গেল। একেবারে যায় যায় অবস্থা। উনার কানে খবরটি পৌঁছে অনেক দেরিতে। খবর পাওয়ামাত্রই উনি স্কুল থেকে অনেক কষ্টে ছুটি ম্যানেজ করে মেয়েকে দেখতে ছুটে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে পুকুরপাড়ে হৈচৈ শুনে সাইকেল থামিয়ে কাছে গিয়ে ব্যাপারটি বোঝামাত্রই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে রবিকে উদ্ধার করেন। রবির জ্ঞান ফিরলে উনি দ্রুতই সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে ছুটে যান। ওখানে গিয়ে দেখলেন, একটা বেডের চারদিকে কয়েকজন দাঁড়িয়ে, সেখানে উনার স্ত্রী মৃত মেয়ের নিথর দেহটি কোলের উপর শুইয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে শেষ মুহূর্তেও মেয়ে কান্না করে-করে বলছিল, “মা, বাবা আসবে না? বাবা আসবে না? আমি বাবাকে দেখবো। মা, বাবাকে আসতে বলো। মা, আমি চলে যাচ্ছি, আমি বাবাকে দেখবো। আমাকে বাবাকে দেখতে দাও, মা!”
উনি কাউকেই আজও বলতে পারেননি, কেন সেদিন উনার দেরি হয়েছে। এই সত্যটি সবার সামনে বলার মতো শক্তি উনি কখনওই সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি। উনি শুধু এইটুকু জানতেন, উনার সবচাইতে বড় ভালোবাসার ধনটি না-ফেরার দেশে চলে গেছে এবং ওর শেষ ইচ্ছেটুকু পূর্ণ হয়নি স্রেফ উনার কয়েক মিনিট দেরি হওয়ার কারণেই। এর চাইতে বেশি কিছু ভাববার সাহসও উনার কোনও দিন হয়নি।
রবি এখন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। অনেক টাকা বেতন পায়। কিন্তু তার কাছে সেই মানুষটিকে একটি পয়সাও দেয়ার মতো অতো টাকা নেই, যে মানুষটির জন্য সে সেদিনের পর এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে এবং ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো’র মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেটে চাকরি করছে। তার বায়োলজিক্যাল ফাদারের চাইতে কোনও অংশেই কম নন তার সেই দ্বিতীয় পিতা। তিনিই তো রবিকে সেদিন দ্বিতীয় জন্ম দিয়েছিলেন! রবির সমস্ত সম্পদ একসাথে জড়ো করলেও সেদিনের ঋণের তুলনায় অতি তুচ্ছ হবে। রবি কখনওই এতোটা মাইনে পায়নি, যেটা দিয়ে ওর দ্বিতীয় পিতার জন্য একটা সস্তা লুঙ্গি আর শার্ট কিনে দিতে পারে! ওর চাইতে দুর্ভাগা এ পৃথিবীতে আর কে-ই বা আছে? আজকের এই ব্যর্থতার দায় রবির একার নয়। মেয়ের মৃত্যুর পর উনি প্রাইমারি স্কুলে দারওয়ানের চাকরিটা ছেড়ে দেন, কারণ সে স্কুলে উনার মেয়েটি পড়ত। পরবর্তীতে উনি উনার স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় চলে যান, সে খবর রবিদের পক্ষে আর নেয়া সম্ভব হয়নি, কিংবা ওরা নেয়নি।
প্রকৃত নায়করা এভাবে করেই সবসময়ই আমাদের হারিয়ে দিয়ে নিজেরা বড় থেকেই চিরতরে সবার চোখের আড়ালে চলে যান।