দ্বিতীয় জন্ম

হুমায়ূন আহমদের বই খুব বেশি পড়িনি। হাতেগোনা কয়েকজন উন্নাসিক বাংলাদেশি পাঠকের মতো দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমিও সেই পাঠক-বয়সটা পার করে এসেছি, যখন মনে হত, হুমায়ূন আহমেদ না-পড়াটাই ভাল পাঠকের লক্ষণ। আমি হুমায়ূন আহমেদ পড়ি না, বলে বেড়িয়ে লুকিয়ে-লুকিয়ে দুএকটা পড়ে নেয়াটাই ফ্যাশন ছিল সে বয়সে। হুমায়ূন পড়া শুরু করেছি অনেক দেরিতে। যে কয়েকটা পড়েছি, সেগুলির মধ্যে ‘অপেক্ষা’কেই এগিয়ে রাখবো। নীললোহিতের ‘এক-একটা দিন অন্যরকম’ পড়ার সময় যে আমেজটা অনুভব করেছিলাম, সেটিই আবারও হঠাৎ করে ফিরে এলো ‘অপেক্ষা’র দুটি লাইনে : “………..মানুষের জীবনে একেকটা দিন একেক রকম হয়ে আসে। কোনও-কোনও দিনে মন খারাপ হবার মত ব্যাপার ঘটলেও মন খারাপ হয় না, বরং মন ভাল হয়ে যায়।” ‘অক্টোবর’ সিনেমায় সারি-সারি মদের গ্লাস ও টিনের সেনাদের পরপর সাজিয়ে চলচ্চিত্রের আদিগুরু আইজেনস্টাইন যেভাবে করে দৃশ্যপটের সাথে কেরেনেস্কির ক্ষণভঙ্গুরতার কথা প্রতিষ্ঠিত করেছেন মন্তাজের আশ্রয়ে, ঠিক তেমনি করেই সুনীল-হুমায়ূন মানস একই বিন্দুতে এসে মিশেছে নিতান্তই পট-আকস্মিকতায়।

‘অপেক্ষা’র ওই কথাটি খুবই অদ্ভুত রকমের সত্যি কথা!

ব্যবসা করতাম। আমি চাকরি করবো, এটা কোনদিনও ভাবিওনি। জীবনে একটাই চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করেছি, এবং ভাগ্যের জোরে পেয়েও গেছি। এতটা ভীষণভাবে পাবো, সেটা তো কল্পনাও করিনি কোনও দিনও। একটা চাকরিই চেয়েছিলাম, আর কিছু না। জানতাম, এ চাকরির পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার মত একটা ব্যাপার আছে, যেটার যোগ্য আমি নই। সে সময় বিভিন্ন বিসিএস পরীক্ষায় যারা প্রথম হয়েছে, তাদের নাম শুনতাম আর ওরা দেখতে কেমন হয়, দেখতাম। আইসিএস পরীক্ষায় প্রথম-হওয়া অ্যালিয়েনদের সাক্ষাৎকার পড়তাম নেটে খুঁজে-খুঁজে।

চাকরি পেতে কেমন লাগে, এটা চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত কেউই জানে না। মনে হতে থাকে, এটা খুবই আনন্দের কিছু একটা হবে, যখন চাকরিটা সত্যি-সত্যিই পেয়ে যাব, কাছের মানুষগুলো খুশি খুশি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, জীবনটা হঠাৎ করেই হয়ে যাবে, সব-পেয়েছি’র জীবন! সবাই ভাববে, বাহ! এই গাধাটাও তো পারে দেখছি!

বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার একটা নিয়ম আছে। নিয়মটা হল, আপনি যখন বিসিএস-এর রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে করে থাকবেন, তখন প্রতিদিনই মনে হবে, আজই রেজাল্ট বের হওয়ার দিন। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এমন গুজব আকাশেবাতাসে আর ফেসবুকের গ্রুপগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাসতে থাকবে। ৩০তম বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য আমরা কিছু নেই-চাকরি গোছের মানুষ প্রতিদিনই অপেক্ষা করে থাকতাম। অপেক্ষা? না, ভুল হল। ওটা ছিল, প্রতীক্ষা।

২০১১ সালের ১ নভেম্বর রাত ১১টা। আমি অনেক ভাবতে-ভাবতে রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ডিঅ্যাক্টিভেট করে রাখবো। কেন ভাবলাম? এজন্য যে, খুব টেনশনে থাকলে ভাল কথাও ভাল লাগে না। মন খারাপের মুহূর্তে হ্যাপি বার্থডে পর্যন্ত শুনতে ইচ্ছে করে না। আর আধা ঘণ্টা পরেই তো ১২টা বাজবে, সবাই জেনে যাবে, ১২টার পর, মানে ২ নভেম্বর আমার বার্থডে, আমাকে উইশ করবে আর আমিও খুব খুশি হয়ে উঠবো। জীবনে কখনও-কখনও এমন কিছু সময় আসে, যখন নিজেকে এ জগতসংসার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে, অপাংক্তেয় ভাবতে ইচ্ছে করে, এটা বিশ্বাস করে বাঁচতে ইচ্ছে করে যে, আমি ভাল কিছু পাওয়ার যোগ্য এখনও হইনি। আমাকে কেউ ভালো না বাসুক। আমি কারও ভালোবাসার পাওয়ারও অযোগ্য। নিজেকে শুধুই কষ্টে রাখতে ইচ্ছে করে। নিজেকে আঘাত করতে-করতে জীবনের অর্থ বুঝতে ইচ্ছে করে। মাথা নিচু করে মুখটা বন্ধ রেখে সবার বড়-বড় কথা নীরবে সহ্য করতে ইচ্ছে করে। অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সামনের পথটায় হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। আমিও ওরকম করে ভাবতাম। মনটা সবসময়ই ছোট করে রাখতাম। আমি লাইফ অব পেন্যান্সের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। এটা কী, এটা বুঝতে আমাকে কোন থিওসফিক্যাল লেকচারের শরণাপন্ন হতে হয়নি; আমার নিজের জীবন থেকেই বুঝেছি, শিখেছি। এতে যে কী লাভটা হয়েছে, সেটা বলে বোঝাতে পারব না!

যে কথায় ছিলাম! দিলাম অ্যাকাউন্টটা ডিঅ্যাক্টিভেট করে! কেউই আমাকে উইশ না করুক! থাকি না একটু অগোচরে! আমাকে সবাই-ই তো শুধু কষ্টই দিল! দেবেই তো! আরও দিক! ওরা যতটা দিচ্ছে, আমি নিজেকে আরও বেশি দিই! আমিও যে আমার মা-বাবা-ভাইকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি। জন্মদিন এলো চুপি-চুপি। মা এসে কপালে চুমু খেলেন। ছোটভাই জড়িয়ে ধরে হ্যাপি বার্থডে বলল। বাবাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করার পর বুকে টেনে নিয়ে বললেন, “বাবা, ভালভাবে বেঁচে থাক্।” আর আমি? বারবার চোখ ভিজে উঠছিল এ অসহ্য ভালোবাসায়। আহা, কত কষ্টই না দিচ্ছি ওদেরকে! আমার জন্য ওদেরকে লোকে কী অবলীলায় বড়-বড় কথা শুনিয়ে যায়! ওদের চোখের জল চাপা-কষ্টের সাক্ষ্য দিয়ে চলে। তবুও ভালোবাসে! এতটা!! বাথরুমে গিয়ে কেঁদেছিলাম খুউব! বড় হতে-হতে কখন কীভাবে যেন দেখিয়ে কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম। কাঁদতে গেলে সাহসটাও লাগে। সেটাও কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ছোটভাইয়ের আনা কেকটা খুব মন-খারাপ-করা চেহারা নিয়ে কেটেছিলাম। “দাদা, কেকের উপরের লেখাটা সুন্দর হইসে না?” কষ্টভরা রাগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা আনসিস কেন? তুই টাকা কোথায় পাইসিস?” “আজকে টিউশনিতে বেতন দিসে, দাদা।” আর কিছু বলার ক্ষমতা আমার ছিল না। ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে-কাঁদতে বলছিলাম, “আমাকে ক্ষমা করে দিস, ভাই। আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারতেসি না।” “ধুর বোকা! ধর, কেক খা!” মাকে দেখলাম, আঁচলে মুখ লুকাচ্ছে। বাবা সেই চিরচেনা সারল্য নিয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে হাসছেন। এসব দেখে মাথা ঝিমঝিম করছিল। ঘড়ির কাঁটা ১টা ছুঁই-ছুঁই। সেইরাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। চোখের জলেও যে সত্যিই বালিশ ভেজে, জীবনে প্রথমবারের মত বুঝলাম।

২ নভেম্বর সারাদিন বাসা থেকে বের হইনি। জন্মদিনের উইশ পেয়েছি কয়েকটা মাত্র। যারা জানত, তারাই শুধু ফোন করেছে, টেক্সট পাঠিয়েছে। সেদিন সকাল থেকে জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, আজকেই রেজাল্ট হয়ে যাবে। ওইদিনের গুঞ্জনটায় জোর ছিল অনেক বেশি। ফেসবুক গ্রুপগুলোর ওয়ালে ঝড় উঠেছিল, ‘রেজাল্ট হবে, হবেই হবে!’ সে ঝড়ে একেবারেই চুপচাপ-থাকা মহারথীদের কেউ-কেউও দুলছিলেন। ওদের দোলাটা আমাকেও যে স্পর্শ করেনি, এ কথা জোরগলায় বলি কীভাবে? দুপুরে মা অনেকটা জোর করে ভাত মেখে খাইয়ে দিলেন। এরপর মায়ের হাতের পায়েস খেলাম। খুব দুঃখী মানুষও তার জন্মদিনে মায়ের হাতের পায়েস খেতে পায়। দুপুরের পর ফেসবুকে দেখলাম, অনেকে নিশ্চিতভাবেই বলছে, আজকে বিকেলে রেজাল্ট হবে। পিএসসি’র কার-কার কাছ থেকে যেন ব্যাপারটার সত্যতা নিশ্চিত করা গেছে। টেনশনে সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো। সেই সময়ে আমি টেনশন দূর করার টেকনিক হিসেবে সাধারণত মুভি দেখতাম। ঘড়িতে ২টা বাজতে ১৭ মিনিট। মুভি দেখতে শুরু করলাম। খেয়ালই ছিল না যে, অতি-টেনশনে ভুলে টেনশন-বাড়ানোর মুভি দেখতে বসে গেছি। গদফাদার-২। বেশিক্ষণ দেখতে ইচ্ছে করল না। নেক্সট, দ্য ৪০০ ব্লৌজ। দেখার সময়ই ৩টা ফোন পেলাম এমন ৩জনের কাছ থেকে যারা ইরেসপন্সিবল কথা বলার কথা না। ওরাও বলল, রেজাল্ট হবে আজকে সন্ধ্যার আগেই। ৪টা বাজার একটু আগেই খবর পেলাম, রেজাল্ট হয়ে গেছে আর ৩০২৬৫৩ রোল নাম্বারটা নাকি বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ ক্যাডারের সিরিয়ালের প্রথমেই আছে। আমি ফোনে চিৎকার করে বললাম, “এটা কীভাবে হয়? আমার রোল নাম্বারটা আছে কি না শুধু এইটুকু বলেন!” “আরে ভাই, আছে তো! প্রথমেই আছে। আপনি ফার্স্ট হইসেন।” ধুর্! ফার্স্ট হয় নাকি আবার!—এটা মাথায় রেখে পিএসসি’র ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। রেজাল্ট সত্যিই দিয়েছে। পিডিএফ ফাইলটা ডাউনলোড করে দেখলাম, যে ফন্টে রেজাল্ট দিয়েছে, সে ফন্টটাই পিসি’তে ইন্সটল করা নাই। ফন্টটা নামালাম, ইন্সটল করলাম। খুব ভয় আর অসীম বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার রোল নাম্বারটা আসলেই প্রথমে আছে। দুইজনকে ফোন করে নিশ্চিত হলাম, রোল নাম্বার প্রথমে থাকার মানে হল, প্রথম হওয়া। আমার রোল নাম্বার ওয়েটিং লিস্টে নেই, এর মানে হল, আমি আসলেই চাকরির জন্য মনোনীত হয়েছি। ‘আমি আর বেকার নই!’ হঠাৎ করেই এটা ভাবতে পারার অনুভূতি যে তীব্র, সেটা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। ভেতরে-বাইরে সব কিছু একেবারে ওলটপালট হয়ে যায়! মাত্র ২ সেকেন্ডের ব্যাবধানে জীবন কেমন বদলে যায়!

চাকরি পেতে কেমন লাগে, সেটাই তো জানতাম না। যে চাকরিটা পেয়ে গেলে জীবনে সব কিছু পাওয়া হয়ে যাবে বলে ভাবতাম, সে চাকরিটা একেবারে প্রথম হয়ে পেলে কী করতে হয়, সেটা জানার তো প্রশ্নই ওঠে না! শুধু একটা মুহূর্তের ব্যবধানে জীবনটাকে অন্য রকম মনে হতে পারে, প্রচণ্ডভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হতে পারে, এই মুহূর্তে আমিই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ। এ পৃথিবীতে সবকিছুই সুন্দর! মা’কে জড়িয়ে ধরে খবরটা দেয়ার পর মা আমাকে ভীষণভাবে চুমু খেয়ে-খেয়ে কাঁদতে লাগলেন; আর আমি বুঝতে পারছিলাম, এই অশ্রুর অর্থ ভিন্ন। বাবাকে ফোন করলাম। বাবা ফোনে খুব আবেগজড়িত কণ্ঠে উঁচুগলায় বললেন, “আমি এখুনি কোর্ট থেকে বাসায় আসতেছি।” আমার ছোটভাই টিউশনিতে বসেই অসম্ভব শব্দ করে হাসতে-হাসতে জিজ্ঞেস করলো, “দাদা, আমি আজকে আর পড়াবো না, বাসায় চলে আসতেসি। তোর জন্য কী আনবো, বল!” সে দিন কী হয়েছিল, সব কিছু মনে নেই। ছোটভাইকে জড়িয়ে ধরে নাচছিলাম। মা-বাবার চোখেমুখে হাসি, যে হাসিটা শুধু আমার জন্যই। এ দৃশ্য বড় আনন্দের দৃশ্য। তখন চট্টগ্রামের সবচাইতে নামকরা মিষ্টির দোকান ছিল সুইটম্যাক্স, জিইসি’র মোড়ের ওদিকে, যেটা এখন আর নেই, বন্ধ হয়ে গেছে। সেখান থেকে দুইভাই গিয়ে ৩০ কেজি মিষ্টি কিনে আনলাম সবাইকে দেয়ার জন্য। সে মুহূর্তে আমার একটাই অনুভূতি সবচাইতে তীব্রভাবে কাজ করছিল: আমার জন্য আমার বাবা-মা’কে আর কাঁদতে হবে না, কারও কাছে মাথা নিচু করে থাকতে হবে না, সবাই ওদের অনেক সমীহ করবে। আমার ছোটভাইটাকে ওর বন্ধুদের সামনে আমার প্রসঙ্গ এলে আর প্রসঙ্গ বদলানোর বুদ্ধি খুঁজতে হবে না। আমার কষ্টের সময়ে যে দুএকজন পাশে ছিলেন, তাঁদেরকে ফোন করে বলতে পারব, “আপনি ছিলেন বলেই আজকে আমি আছি! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।” বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময়ের সকল কষ্ট, যন্ত্রণা, দুঃখ মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেলাম। পৃথিবীর সব নিষ্ঠুর মানুষকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করলো। জীবনটাকে মনে হতে লাগলো, নিশ্চিন্ত, নির্ভার, নিরুদ্বিগ্ন, নিঃশঙ্ক, আর খুব খুব খুব সুন্দর! আমাকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করত না, এমন লোকজনও ফোন করে করে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। আইডেন্টিটি ক্রাইসিস কী, এটা বোঝার জন্য আমাকে কখনও গুগলকে জ্বালাতে হয়নি। জীবন থেকেই শিখেছি, কারও পাত্তা না পেয়ে থাকাটা যে কী কষ্টের! যার থাকা না-থাকায় কারও কিচ্ছুটি এসে যায় না, সে এ পৃথিবীতে বড় অসহায়ভাবে একা-একা বাঁচে। সেদিন এটা উপলব্ধি করেছিলাম, আইডেন্টিটি ইজ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান একজিস্টেন্স। বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে চাকরি বড়, নাকি প্রাণ বড়, এ বড় কঠিন দ্বন্দ্ব। চাকরি না থাকলে যে প্রাণই থাকে না!

২০১১ সালের জন্মদিন ছিল আমার একমাত্র জন্মদিন, যে জন্মদিনে আমাকে কেউ কোনও উপহার দেয়নি। অথচ সেদিনের উপহারটি আমার আগের ২৬টা জন্মদিনের সব উপহারকেই ম্লান করে দিয়েছিল। জীবনে প্রথমবারের মত সরাসরি স্রস্টার কাছ থেকে জন্মদিনের উপহার পেলাম। সে উপহার তো আর ছোট হতে পারে না! স্রষ্টা আসলেই কাউকেই চিরদিন অসম্মানিত করে রাখেন না। উনার দেয়া উপহার অনেক বড় উপহার। সেটা পাওয়ার জন্য বিনীতভাবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। সাথে কঠোর পরিশ্রম।

হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’য় ছিলাম। সত্যিই আগের দিনের দুঃখী সুশান্তের সাথে পরের দিনের সুখী সুশান্তের কোন মিলই ছিল না। যে জন্মদিনটা কষ্টের হবে বলেই ধরে নিয়েছিলাম, সেটিই জীবনের সেরা জন্মদিন হয়ে গিয়েছিল। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, স্রেফ একটা মুহূর্তও আপনাকে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ করে দিতে পারে। আপনি কখনওই জানতে পারবেন না, স্রস্টার কোন ইশারায় কোন ব্যাপারটা ঘটছে। সেদিনের সব কিছুই ভাল লাগছিল। এক প্রতিবেশী আঙ্কেল এসে বললেন, “বাবা, তোমার বাবার আর চিন্তা নাই। কাস্টমসের চাকরি তো ঘুষের চাকরি। অনেক টাকাপয়সা কামাতে পারবে।” হায়! এমন দিনেও মিষ্টি খেতে-খেতে এমন বিশ্রী কথা বলতে পারার অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন ঈর্ষাপরায়ণ মানুষও আছেন এ সংসারে! নাহ! আমি কিছুই বলিনি, এমনকি সুইটম্যাক্সের ঢাউস সাইজের সন্দেশটি উনার নাকে চেপেও ধরিনি। এখন বুঝি, অমন আঙ্কেলের ছেলেরাও যে আমার ফ্রেন্ড-ফলোয়ার লিস্টে আছে। ওদের দোষ দিই কী করে? ওরা যে ছোটবেলা থেকে শিখেছে, কীভাবে অন্যের সুখে দুঃখী হওয়া যায়। অন্যের সুখ সহ্য করার পারিবারিক শিক্ষা অনেক বড় শিক্ষা। এ শিক্ষা বাবার শিক্ষা। আজকে বুঝি, বাবা কত বড় একজন শিক্ষক! পাশের বাসার আন্টি দেখা করতে এসেছিলেন। উনার নাতিকে কোলে নিতে দেখি সে অপূর্ব চোখে নিষ্পাপ হাসি হাসছে। মনে হতে লাগলো, আমার এ সুখের দিনে সেও আমার সুখে হাসছে। ঠিক পরক্ষণেই অনুভব করলাম, সে হাসি সুখের হাসি বটে, তবে সে হাসি আমার রেজাল্টের সুখে নয়, আমার কোলে হিসু করে দেয়ার সুখে। একটুও রাগ হয়নি। বরং খুশিতে ওকে চুমু খেতে লাগলাম। মনে হতে লাগল, আহা শুধু এ হিসুর উষ্ণতার জন্যও তো বেঁচে থাকা যায়!