ধর্মে বাঁচা ও বাড়া

যা প্রকৃতিগত, তা-ই ধর্ম। সেই প্রকৃতির প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যকে মেনে নিয়ে, সেই অনুযায়ী কাজ করাই ধর্মাচরণ। আমাদের যে দৈহিক ও মানসিক গঠন, কীভাবে তার সর্বাঙ্গীন বিকাশসাধন করা যায়; আমাদের যে সমাজ, আমাদের যে পরিবেশ, কীভাবে তার উন্নতি ও মঙ্গল করা যায়; কীভাবে তাকে ক্রমশ সাফল্যের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, তার চিন্তা করা এবং সেইভাবে কাজ করাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম।




প্রশ্ন আসতে পারে, কীভাবে আমরা বুঝব—এটা করলে মঙ্গল হবে, ওটা করলে হবে না? একটু চিন্তা করলে, একটু মনঃসংযোগ করলে নিজের ভেতর থেকেই বুঝতে পারব—কোনটা ঠিক, কোনটা অন্যায়। ভালো-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল বুঝতে কারুর অসুবিধা হয় না। এটা জীবেরই ধর্ম। ভেতরের সচেতনতার কাঁটাটা সবসময় একমুখী হয়ে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে—এটা ঠিক, ওটা ভুল; এটা ভালো, ওটা মন্দ। তা সত্ত্বেও অনেকে অনেকসময় কুকর্ম করে। করে ঠিকই, কিন্তু ভেতর থেকে ঠিক জানিয়ে দেয়—এটা ভুল করলে।




একজন শিকারি বাঘ মেরে বা সিংহ মেরে বাহবা পেতে পারে, আর সেই বাহবা পাবার নেশাতে আরও শিকার করে যায়; কিন্তু তার ভেতরকার যন্ত্র তাকে কখনও-না-কখনও ঠিকই জানিয়ে দেয়— এ কাজটা ঠিক হচ্ছে না। যদি তার মন-যন্ত্র বলে— তুমি যা করছ, ঠিকই করছ, তবে অবশ্য আপন চৈতন্যের সাড়া অনুযায়ী বলার কিছু নেই। ভেতরের সেই সজাগের বাণী অনুযায়ী কাজ করে গেলেই আর কোনও গোল থাকে না, কেননা আপন চৈতন্যের সাড়া অনুযায়ী আচরণ করাই ধর্ম, আর তার বিরুদ্ধাচরণ করাই অধর্ম। সুতরাং মনের সেই দিগ্‌দর্শন যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে কাজ করে যেতে হবে।




কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা গ্রহণ করা উচিত, কোনটা বর্জন করা উচিত, সে সম্বন্ধে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি খুবই সচেতন। ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে কার সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে বা না হবে, আমাদের সেন্স অর্গ্যান কাজ করার আগেই সে বিষয়ে সতর্ক করে দিচ্ছে, সজাগ করে দিচ্ছে। দিঙ্‌নির্ণয় যন্ত্রে যেমন কাঁটা সবসময় উত্তরমুখী হয়ে পথিকদের দিক ঠিক করে দেয়, দিগ্‌ভ্রান্ত হলেও সেই যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে পথিক আবার তার নির্দিষ্ট দিক ঠিক করে নিতে পারে, তেমনি প্রত্যেকের মনের মধ্যে একটা দিগ্‌দর্শন যন্ত্র তাকে ঠিক দিক দেখিয়ে দিচ্ছে, চলার গতির দিকটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, জানিয়ে দিচ্ছে: এটাই ধর্মের পথ, সত্যের পথ, কল্যাণের পথ, সুতরাং এ পথেই চলো।




আবার প্রকৃতি বা সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী সতর্কও করে দিচ্ছে—এটা ঠিক নয়, ওটা উচিত নয়। সেই সতর্কতার কাঁটার দিকে নজর স্থির রেখে পথ চললে দিগ্‌ভ্রম কখনোই হবে না। মাঝে মাঝে সাংসারিক ঝড়ঝাপটায় পথ হারিয়ে ফেললেও আবার তাকে খুঁজে পাওয়া যায়, গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছানো যায়।




একটা সহজ দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। জিহ্বাতে একটা বিশ্রী জিনিস এসে পড়লেই সে তাকে থু করে তৎক্ষণাৎ ফেলে দিচ্ছে। চোখে যদি ধূলিকণা এসে পড়ে, স্বাভাবিকভাবেই চোখের জল এসে তাকে বের করে দেবে। সেইরকম সমস্ত ইন্দ্রিয় সদাসর্বদা সতর্ক থাকে, সেখানে যাতে কোন‌ও ক্ষতিকারক কিছু এসে না পড়ে। অনিচ্ছাকৃতভাবে হঠাৎ কিছু এসে গেলে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সে তাকে দূরে ঠেলে ফেলে দেবে। যতক্ষণ সেটা না সরে যায়, ততক্ষণ সে ক্রমাগত যুদ্ধ করেই চলে। আর যেটা গ্রহণীয়, সেটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে গ্রহণ করে।




আমরা যে খাবার গ্রহণ করি, শরীরের পুষ্টির জন্য তার কতখানি গ্রহণীয়, আর কতখানি বর্জনীয়, শরীরের ভেতরকার যন্ত্রগুলোই তা ঠিক করে দেয়। যা গ্রহণীয়, তা স্বাভাবিকভাবে রক্তে গিয়ে মেশে; যা বর্জনীয়, তা আপনা থেকেই বেরিয়ে যায়। আবার অনেক খাবার আছে, যা খুবই মুখরোচক, কিন্তু শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। সে ক্ষেত্রে সেই খাদ্য গ্রহণ করার আগেই মনের সতর্কতার যন্ত্রটি বলে দেবে, এটা গ্রহণ না করাই ভালো। আমাদের চিন্তা করার আগেই যেন সে তাকে দূরে ঠেলে ফেলে দেয়। সতর্কতার সেই বাণী না শুনে লোভের বশবর্তী হয়ে যদি কেউ কখনও সে খাদ্য খেয়ে ফেলে, তবে সেটাকে বের করে দেবার জন্যই শরীরকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়, অর্থাৎ অসুখে ভুগতে হয়। ঠিক ওরকম সতর্কতার কাঁটা দেখে কাজ না করলে সমাজকেও রোগে ভুগতে হয়।




শরীরের মতো মনের ভেতরকার সমস্ত অংশও সবসময় জানিয়ে দিচ্ছে—আমরা যে কাজ করতে যাচ্ছি, সেটা কল্যাণমূলক, না অপরাধমূলক। সেই নির্দেশ মেনে না চললেই শারীরিক ভোগের মতো আসে মানসিক ভোগ। আর তার থেকেই শুরু হয় সামাজিক দুর্ভোগ, অশান্তি, অরাজকতা ইত্যাদি। সুতরাং মন-ইন্দ্রিয়ের সতর্কতার যন্ত্রের কাঁটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে, প্রকৃতির নিয়মকে উপেক্ষা না করে যদি চলা যায়, তবেই জীবনটা হবে সহজ, সরল, সুন্দর ও স্বাভাবিক। সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে চলাই হচ্ছে সৎভাবে চলা, আর সৎভাবে চলাই হচ্ছে ধর্ম।




প্রকৃতির নিয়মগুলিকে যদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লক্ষ করা যায়, তবে দেখতে পাবো, চলার পথে কতভাবে, কতরূপে সে সতর্কতার ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে। এগুলো হচ্ছে ন্যাচারাল গিফট—প্রকৃতির সহজাত দান। নিজের সুবিধামতো এর থেকে কিছুটা নিলাম, আর কিছুটা বাদ দিলাম; কখনো এর ইঙ্গিত অনুযায়ী কাজ করলাম, আর কখনো করলাম না—তা হলে তো চলবে না। তাতে সুফল হয় না, বরং সফলতার পথে বিঘ্নই ঘটে। ব্যক্তির সফলতা কিংবা সমষ্টির বা সমাজের সফলতা—সবকিছুই নির্ভর করে ভেতরকার যন্ত্রটি কী সাড়া দিচ্ছে, সেদিকে লক্ষ রেখে কাজ করার উপর।




আমাদের সমস্ত কাজই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই, অর্থাৎ ভবিষ্যতের জন্যেই। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের শুভ-অশুভ চিন্তা করেই আমাদের কাজ করা উচিত। অথচ ভবিষ্যৎ সাধারণত সকলের কাছেই প্রায় অজ্ঞাত। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে শুভ হবে কি হবে না, জানব কী করে? একটু চিন্তা করলে, একটু মনোনিবেশ করলে বুঝতে পারব, প্রকৃতি আপনা থেকেই ভবিষ্যতের শুভ-অশুভের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। কোনও কাজ করার পূর্ব মুহূর্তে মনে যদি কোনও রকম দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব না আসে, তখনই বুঝব, সে কাজ করা আমাদের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। মনের কাঁটা যখনই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলায় দুলছে, কোনও জায়গায় স্থির হচ্ছে না, তখনই বুঝব, সে কাজ করা সমীচীন নয়। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকেই আসে জিজ্ঞাসা; তখন যারা অভিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞ, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে নিতে হয়। এইভাবে যতক্ষণ না মনের চেতনার ট্রান্সমিটারে সায় দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেই যাব। বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতে করতে দেখব, একজায়গায়-না-একজায়গায় কারুর-না-কারুর কথায় মন ঠিক সায় দেবে—হ্যাঁ, এটাই ঠিক, এইভাবেই কাজ করা উচিত।




মনের সেই ইঙ্গিত কেউ ধরতে পারে, কেউ পারে না। আবার অনেকে ধরতে পেরেও সেই অনুযায়ী কাজ করে না। বাইরের প্রভাবটাই তার উপর বড়ো হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগতভাবেই হোক, আর সমষ্টিগতভাবেই হোক, মনের ইশারা না শুনে হুজুগে মাতলেই হোঁচট খেতে হয়। খাচ্ছিও তা-ই।




অনেকে আবার ভাবে, মনের সেই সতর্কতার ইঙ্গিতগুলো ভয়, ভীতি, দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু নয়। এ কথা ভুল। সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, জ্ঞানেন্দ্রিয়ে, মন-ইন্দ্রিয়ে, বিভিন্ন অণুতে পরমাণুতে সহজাত প্রতিরোধক ক্ষমতা আছে। মন ও শরীর একই ধাতুতে, একই বস্তুতে গড়া। জল ও বরফের মতো মন ও শরীর একই বিষয়বস্তুর দুইটি রূপ। সুতরাং শরীরের মতো মনেরও প্রতিরোধক ক্ষমতা আছে। কিন্তু তা এত সূক্ষ্ম যে, বাইরের কোনও অণুবীক্ষণ বা পরমাণুবীক্ষণ যন্ত্রেও তা ধরা পড়ে না। একমাত্র মন-ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির কাঁটার কম্পনে তাকে ধরা যায়। সেটা চোখে দেখার বস্তু নয়, উপলব্ধির বস্তু। বাতাসের মতো তা চোখে ধরা পড়ে না, অনুভূতিতে ধরা পড়ে।




মনের এই যে সতর্ক করে দেবার স্বাভাবিক ক্ষমতা, বেদ তাকে বলছে: চেতনশক্তি। এটা যখন জাগে, তখন সেই বীজ থেকে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অঙ্কুরগুলির সৃষ্টি হয়, সেগুলিই হচ্ছে যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেক, বিচার, বিবেচনা ইত্যাদি। এই বুদ্ধি-বিচার-বিবেচনার অঙ্কুর থেকে ঠিক ঠিকভাবে যে উদ্ভিদ মনের মাটি ভেদ করে বাইরে প্রকাশিত হয়, তা-ই কর্ম—জ্ঞানবৃক্ষের কাণ্ড… কর্মকাণ্ড। এই বিবেচনাজাত কর্মকাণ্ডই বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে, ডাল-পালা বিস্তার করে ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই সবগুলির একত্রিত নাম হচ্ছে 'জ্ঞান'। সেই চেতনা থেকে উদ্ভূত জ্ঞানবৃক্ষের ফলই হচ্ছে শান্তি, শৃঙ্খলা, উন্নতি, সমন্বয়, সহযোগিতা, সমাধান ইত্যাদি। এই জ্ঞানবৃক্ষকে আগাছা থেকে রক্ষা করতে পারলেই আমাদের প্রতিকাজে মনকে সতর্ক করে দেবার দায়িত্ব চৈতন্য পালন করে নিষ্ঠার সাথে। এই চেতনশক্তিই হচ্ছে জ্ঞানবৃক্ষের বীজ। তার স্বাভাবিক ক্ষমতা, অর্থাৎ সেই বীজ যখন অঙ্কুরিত হয়, অর্থাৎ চেতনা যখন জাগে, বেদ তাকেই বলছে চেতনশক্তি বা চৈতন্য।




সুপক্ব ফলগুলি পেতে তখন আর বেগ পেতে হবে না। তবে সে বৃক্ষকে আগাছা থেকে রক্ষা করা দরকার। চেতনা থেকে উদ্ভূত না হয়ে এদিক-ওদিকে কিছু মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেই বুঝতে হবে সেগুলি আগাছা—তৎক্ষণাৎ সেগুলিকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। তা না হলে ক্ষেত্রের ক্ষতি, বৃক্ষের ক্ষতি, পরিবেশেরও ক্ষতি। আগাছার শক্তিও তো কম নয়! তাই সেগুলিকে সমূলে উৎপাটিত করাই বিধি।




এই যে চেতনার বীজ থেকে বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে জ্ঞানবৃক্ষের উৎপাদন, আগাছা থেকে তাকে রক্ষা করা, এসবের মধ্য দিয়ে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী চলাই হচ্ছে ধর্ম। তাকে ঠিকমতো বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করা, তার ফলগুলিকে যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগানো, সেটাই ধৰ্ম। এ ছাড়া ধর্ম আলাদা কিছু নয়। একবাক্যে, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী চলাই ধৰ্ম। এককথায়, সত্যই ধর্ম।




বীজ থেকে গাছকে বিকশিত করতে হলে যেমন আগাছার উৎপাটন করতে হয়, তেমনি সত্য বা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে হলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে, অসত্যকে সমূলে বিনাশ করতেই হবে। সেটাও ধর্মের অঙ্গস্বরূপ। পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, দেব-দেবীর দোহাই দিয়ে, কাল্পনিক গল্পকথা বলে কেউ যদি আমাদের বোঝায়, এটা কোরো না, ওটা করো; ওটা ঠিক নয়, এটা ঠিক…মনের যন্ত্রে যাচাই না করে তাকে নির্বিচারে গ্রহণ না করাই ভালো। বেদ বলছে, তোমার সম্মুখে যা-কিছু আসুক, যার কাছ থেকেই আসুক, তোমার যুক্তির যন্ত্রে ফেলে আগে তাকে তন্নতন্ন করে বিশ্লেষণ করে বুঝে নাও, তারপর গ্রহণ করো। তোমার সেই যন্ত্রে যদি কোনও রকম সায় না পাও, তবে অবিলম্বে সে চিন্তা বর্জন করবে। কারুর কথায় বা কোন‌ও কিছুর দোহাইতেও তাকে গ্রহণ করবে না।




ধর্মাচরণ করতে হলে, ভগবৎদর্শনলাভ করতে হলে কামনাজয়ের সাধনা করতে হবে—এ কথা ভুল। ভগবৎদর্শনের ইচ্ছা…সেটাও তো একটা কামনা। ঈশ্বর সম্বন্ধে জানা—সেটাও তো একটা বাসনা। শুধু "নারীমুখ দর্শন করব না।" বললেই কি কামনাজয় করা হলো? ওতেই কামনাজয়ের সাধনা হয়ে গেল? নারীসঙ্গের জন্য ছোটাছুটি—সেটা যদি কাম হয়, তবে সাধুসঙ্গের জন্য ছোটাছুটি —সেটাই-বা কাম হবে না কেন? উভয় স্থানেই তো একই প্রতিক্রিয়া —সেই হা-হুতাশ—উঃ… আঃ, আর পারি না! একটু দর্শনের জন্য, একটু স্পর্শের জন্য ছোটাছুটি, কান্নাকাটি—বিরহ-বেদনা। কথা তো একই! তবে একটা ধর্ম, আর একটা অধর্ম হবে কেন?




বেদ বলছে, কাম কখনও বর্জন করা যায় না। দেহ যতক্ষণ আছে, দেহের সহজাত বৃত্তিগুলোও আছে। একমাত্র শ্মশানে গেলে সকল কামনা-বাসনা স্থগিত থাকে। তা-ও সেটা সাময়িক। যে বস্তুর দ্বারা শরীর গঠিত, শবের মধ্যে তো সেগুলি রয়েই গেছে। তার প্রতিক্রিয়ারও শেষ নেই। শবটিরও পরিবর্তন হচ্ছে—নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন আকার নিচ্ছে। তার থেকেই আবার সৃষ্টি হচ্ছে কত জীবাণু—জীবাণু থেকে জীব, কীট-পতঙ্গ, পোকা-মাকড় কত-কী! কামনা না থাকলে সৃষ্টি কখনও হয় না, হতে পারে না। সুতরাং দেখলাম তো—শ্মশানের শবটিও কামনা ছাড়তে পারেনি। কেউই পারে না।




কামত্যাগের উপরই যদি ভগবানকে পাওয়া নির্ভর করে, তবে আজ পর্যন্ত কেউ ভগবান পায়নি, পাবেও না। "কাম ত্যাগ করো, তবে ভগবানকে পাবে।" এসব কথা হচ্ছে বোড়ের চাল, লোক-ঠকানো কথা। যাঁরা একথা বলেন, তাঁরাও সেটা ভালো করেই জানেন।




এটা সত্যিই গ্লানির বিষয় যে, আজও হাজার হাজার সাধুসন্ন্যাসী আছেন, যাঁরা বলছেন, আমরা কাম বর্জন করেছি। তাঁরা শুধু কৌপীনই কষেছেন; নাক, মুখ, চোখ তো বন্ধ করতে পারেননি! সেগুলো তো খোলাই আছে। কানে কি তাঁরা সীসা ঢেলে দিতে পেরেছেন? পেরেছেন চোখে ঠুলি বাঁধতে? নাক-মুখ কি তাঁরা বেঁধে রেখেছেন? তবে একদিকের কষাকষিতে কী হবে? সবই তো একই ইন্দ্রিয়শ্রেণীভুক্ত। সংগীতের সুর, ফুলের গন্ধে যদি সাধনার বিঘ্ন না হয়, তবে ইন্দ্রিয়ের কোনও বৃত্তির নিবৃত্তিতেই সাধনার বিঘ্ন হবে না। নগ্ন‌ই থাকি আর বহুমূল্য পোশাকই পরি, প্রকৃতির নিয়মের পথে যদি ঠিক থাকা যায়, তবে ধর্মাচরণে কোনও কিছুই অন্তরায় হয় না।




মনের যে-কোন‌ও বৃত্তির উৎপত্তিই তো হচ্ছে 'কাম' থেকে। ইচ্ছাই হচ্ছে কাম। বৃত্তির নিবৃত্তিই হচ্ছে কামনার চরিতার্থতা। শুধু নারী-পুরুষের সঙ্গমই কাম নয়। সমস্ত ইন্দ্রিয় তৃপ্তিসাধনই কাম। চোখের তৃপ্তি, কানের তৃপ্তি, নাকের তৃপ্তি, ত্বকের বা জিহ্বার তৃপ্তি যদি ধর্মসাধনার অন্তরায় না হয়, তবে একটি ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধনই-বা কেন ধর্মের পথে বাধা সৃষ্টি করবে? সব ইন্দ্রিয়ই তো লিঙ্গবৎ। এর কোনোটাই ধর্মসাধনার অন্তরায় নয়। বরং এগুলোকে জোর করে অস্বীকার করলেই ধর্মের পথে, সত্যের পথে চলার বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। যত তাদের অস্বীকার করে ঠেলে ফেলে দিতে চাইব, তত‌ই তারা অন্য অন্য রূপ নিয়ে, কৌশল করে, ছদ্মবেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। তারই ফলে গজিয়ে ওঠে যত অসামাজিক কাজের আগাছা—চুরি, ডাকাতি, গুণ্ডামি, মারামারি, হানাহানি, রাহাজানি, এতে ভেজাল মেশানো, ওতে আগুন লাগানো, এর পেছনে লাগা, ওর সমালোচনা করা ইত্যাদি। এ সমস্তই আগাছা। চেতনার বীজ থেকে এদের উৎপত্তি নয়, এগুলিকে তাই বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। এগুলিই অধর্মাচরণ। এগুলো থেকেই সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, অশান্তি। সমাজে একটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়, যার ফলে এমন সুন্দর সাজানো জিনিস চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যায়।




কাম যখন বর্জন করা যায় না, তখন কামকে জয় করার চেষ্টা না করে তাকে মেনে নিয়ে, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে যাওয়াই তো ভালো, সেটাই ধর্ম। বেদ যে বলছে, স্বধর্মে নিধন হওয়া অনেক ভালো, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ। সেই স্বধর্ম বা পরধর্ম বলতে হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান ধর্মের কথা বলা হচ্ছে না। স্বধর্ম হচ্ছে, সহজাত যে ধর্ম, আর পরধর্ম হচ্ছে, সহজাত ধর্মের বিপরীত যে আচরণ। এখন "স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ।" কথাটার অর্থ, জীবের সহজাত ধর্মে, অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মে যদি ঠিক থাকা যায়, তবে সেটাই ভালো হবে—সেটাই প্রকৃত ধর্মাচরণ। আর তাকে অস্বীকার করে তার বিপরীত কিছু যদি করতে যাই, তবে সেই "পরধর্ম ভয়াবহ"—অর্থাৎ তাতে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে, তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ করছি বলেই আজকে আমাদের দেশের ও সমাজের এই ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে।




আজও চারিদিকে এমন অনেক লোক আছে, যারা পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, দেব-দেবীর দোহাই দিয়ে সমাজকে শুধু দোহন করেই চলেছে। সে দোহনে দুধ আসছে না, রক্তই শুধু নিঃশেষিত হচ্ছে। এরা অনিষ্টকারী, আগাছা সৃষ্টিকারী। এদের আমল না দেওয়াই ভালো। এরকম যেখানে দেখা যাবে, সেখানে লাঠি ধরতে হবে। ক্ষমার প্রশ্ন তো ওঠেই না। বরং সেক্ষেত্রে লাঠি যদি না ধরি, সে অপরাধ আমাদের উপর বর্তাবে। তাই পাপপুণ্যের দোহাইকে নর্দমার জলে ভাসিয়ে দিয়ে বিবেকের দোহাই অনুযায়ী কাজ করাই সমীচীন।




এই যে বলা হলো, আমাদের চেতনার কাঁটা যে দিক নির্দেশ করছে, সেইভাবে কাজ করতে হবে, এটাকেও বিনা বিচারে গ্রহণ করতে হবে না। ফেলি তাকে আমাদের মনের যন্ত্রে, দেখি, কম্পাসের কাঁটা কোন দিক নির্দেশ করছে, বুঝি তার ইঙ্গিত; তারপর সেই অনুযায়ী কাজ করি। দেখা যাবে, যা বলা হয়েছে, আমাদের চেতনার যন্ত্রও সেই কথাই বলছে। বাইরের প্রভাবে এ কথা হয়তো অনেকে অনেকসময় স্বীকার না-ও করতে পারে; কিন্তু মনের ঘরে ফাঁকি চলে না! সেখানে আমাদের স্বীকার করতেই হবে। মনের ডাকে সাড়া না দিয়ে বাইরের ডাকে সাড়া দেওয়া হচ্ছে বলেই আজকের সমাজে এত অশান্তি, এত অবিচার, এত অনাচার, এত অরাজকতা; দরদের বদলে এত গলদ।




যা নেই, তা কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যা আছে, তাকে কখনও অস্বীকার করাও যাবে না। আমরা যেখানে আছি, সত্যবস্তু—নিত্যবস্তু সেই একই জায়গায় আছে। দেবতাকে চাই? তাকে মাটিতেই সন্ধান করতে হবে। এই জীবজগতের প্রতিটি জীবকে, প্রতিটি বস্তুকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখব, তার মধ্যেই দেবতার মূর্তি, দেবতার পূর্ণ রূপ খুঁজে পাবো। দেবতা কে? কী তার অর্থ? বেদ বলছে, যিনি দান করেন, তিনি দেবতা। কী দান করেন? হ্যাঁ, আলোক দান দান করেন—জ্ঞানের আলোক। দীপ যেমন তার আলোকে সব কিছু দীপন (উজ্জ্বল) করে, তেমনি যে তার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির সহজাত দানগুলিকে, প্রকৃতির বিভিন্ন রূপকে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে দীপন করছে, অর্থাৎ আলোকিত করে দেখিয়ে দিচ্ছে—এটাই ঠিক, এটাই সত্য, এটাই নিত্যবস্তু, সে-ই দেবতা। প্রকৃতির সহজাত বিষয় বা গুণ সবার মধ্যেই আছে। সে গুণগুলিকে যে নিজের মধ্যে স্বচ্ছভাবে, দীপ্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে, সে-ই দেবতা। যার ভেতর দিয়ে বিরাটের সুর প্রকাশিত, বিরাটের রূপ প্রস্ফুটিত, সর্বগুণে যে গুণান্বিত, সেই সর্বগুণে গুণময়ই হচ্ছে দেবতা। সেই দেবতাকে খুঁজতে তো স্বর্গে যেতে হবে না, এ জগতেই তাকে পাওয়া যাবে। প্রকৃতির প্রতিটি জীবে, প্রতিটি বস্তুতে, প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে সে প্রকাশিত।




তার যে-কোন‌ও একটি ধারা ধরে ধারাবাহিকভাবে যদি বিশ্লেষণ করতে করতে এগিয়ে যেতে পারি, ঠিকমতো সাধনা করতে পারি, তবে দেখব, কত রহস্য তার মধ্যে। সেই রহস্য যত ভেদ করতে পারব, ততই আমাদের মনের প্রসারতা বেড়ে যাবে, আর বস্তুর বিশ্লেষণের ফলে কত নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হবে। আমরা যা চাইছি, তার সব কিছুই এর মধ্যে খুঁজে পাবো। জীবনের চলার পথকে সেগুলি সহজ করে তুলবে, ক্রমশ উন্নততর করে তুলবে। অনেক বাস্তব সমস্যা সমাধানের সাথে সাথে জাতি ও জীবন, সমাজ ও স্বদেশ সমৃদ্ধতর হয়ে উঠবে।




সৃষ্টি-রহস্যের একটি ধারার বিশ্লেষণেই এ-ই, আর তার সব ধারা যদি ধরে ধরে ধাবিত হওয়া যায়, ধ্যান করার মতো ধর্না দিয়ে যদি লেগে থাকা যায়, তবে তো কোনও কিছুই আর ধাঁধার মধ্যে থাকবে না। ধীরে ধীরে সব ধাঁধার সমাধান হয়ে যাবে। যা ধ্রুব, যা সত্য, তা ধ্বনিত হয়ে উঠবে। তখন স্বর্গের পেছনে আর ধাবিত হতে হবে না–- ধরাই স্বর্গধাম হয়ে উঠবে। আমরা আমাদের ইষ্টকে সেখানেই ধরতে পারব।