বাঙালি স্বভাবতই ধর্মপ্রাণ; তাদের অগাধ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসকে মূলধন করে ধর্মের নামে আজ সমাজে যে ব্যাবসা চলছে, বেদে তাকেই 'অঘটন' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেন্টিমেন্টের ব্যাবসা অঘটন ছাড়া আর কী? সাধারণের সেন্টিমেন্টের সুযোগ নিয়ে একদল 'গুরু', 'মহান' সাজল। তাদের মধ্যেই কয়েকজনকে ভক্ত, চেলা সাজিয়ে ব্যাবসায়িক বুদ্ধিতে চিন্তা করতে লাগল, কী করে নিজেদের সঞ্চয় বাড়ানো যায়, ঠিক যেমনভাবে নিলামে মালের দর বাড়ানো হয়।
ভেতরের বণ্টনের ব্যাপার আগেই ঠিক করে বাইরে চলতে থাকে রঙ্গমঞ্চের অভিনয়। নানারকম ভৌতিক ক্রিয়াকাণ্ড দেখিয়ে মানুষকে বিস্মিত, বিভ্রান্ত করে দিয়ে, আনুষঙ্গিক নানারকম কার্যকলাপ করে তাদের মন জয় করে যেন-তেনভাবে ভক্ত-শিষ্যের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলে। আজকাল আবার অনেক জায়গায় প্রতিনিধি দিয়েও শিষ্যসংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এগুলোই তো 'অঘটন'।
আপনারা শুনেছেন নিশ্চয়ই, অনেকে হয়তো পেয়েছেনও একটা করে পোস্টকার্ড; তাতে অমুক বাবার নামে কিংবা তমুক সন্ন্যাসীর নামে দিব্যি দিয়ে লেখা আছে, "এই কার্ড পাওয়ামাত্র এইরকম আরও নয়টা পোস্টকার্ড কপি করে নয় জনের কাছে পাঠাবে, তাহলে নয় দিনের মধ্যে এর একটা সুফল পাওয়া যাবে; না দিলে নয় দিনের মধ্যে মহাবিপদ।" মানুষের মন এমনই কুসংস্কারে আবদ্ধ যে, তারা ঠিকই বুঝছে, এটা কিছু না, তবুও ভয়ে-ভীতিতে অনেকেই আবার চিঠি লিখে চলেছে।
প্রকৃতির নিজস্ব স্বাভাবিক গতিতে যা কিছু ঘটে চলেছে, তা-ই ঘটনা। উদ্দেশ্যমূলকভাবে জোর করে যেটা ঘটানো হচ্ছে, সেটাই হচ্ছে অঘটন। চিঠি লেখার ব্যাপারটা যে একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষয়, সেটা বুঝতে তো অসুবিধে নেই! হয় সেই অমুক পাহাড়ের বাবার প্রচার, নাহয় মানুষের সেন্টিমেন্টের সুযোগ নিয়ে পোস্টকার্ডের ব্যাবসা চালু রাখার উদ্দেশ্যেই এটা শুরু হয়েছিল। যেখানে মাসে একটা পোস্টকার্ড কিনলে হয়ে যায়, সেখানে দশটা কিনতে হচ্ছে। নিজেদের একটা উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই এটা করা। সে কথা বুঝেও আজ আমরা সংস্কারকে কাটাতে পারছি না।
একটা দিব্যির ঠেলাতেই এ-ই! ধর্মস্থানে তো এর চেয়েও বেশি বাজে দশা। সাধারণ, সরলপ্রাণ, নিরীহ ভালোমানুষদের সেন্টিমেন্টের সুযোগ নিয়ে মন্দভাগ্য, কর্মফল, গ্রহের দশা, স্বপ্নাদেশ ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, তাবিজ-কবচের নামে ঘটে চলেছে কত অঘটন! কত যে ফন্দি, কত যে ফিকির শুরু হলো—মুক্তি হবে, স্বর্গবাস হবে, সুখে-শান্তিতে থাকবে। কে কার উপর দিয়ে টেক্কা মারবে, তারই যেন প্রতিযোগিতা! কেউ মঠ করছে, কেউ মন্দির করছে, কেউ-বা আশ্রম করছে।
ধর্মের নামে ব্যাবসা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তার আরও দৃষ্টান্ত দেখা যাক। মা-বাপের প্রতি সকল সন্তানেরই স্বাভাবিক একটা সেন্টিমেন্ট থাকে। সেন্টিমেন্ট আরও বেড়ে যায় তাঁদের দেহরক্ষার পর। হয়তো কোনও সন্তান পিতার পিণ্ড দিতে গেছে, তাকে বলা হলো, 'অমুক' লাগবে, 'তমুক' লাগবে, ‘হ্যান’ চাই, ‘ত্যান' চাই। প্রথম সে খুশিতে করল। কাজ আরম্ভ হতেই দেখা গেল, রাস্তা থেকে আরম্ভ করে মন্দির পর্যন্ত প্রতিটি দুয়ারে দুয়ারে শতেক ব্যক্তি হাত পেতে আছে। প্রত্যেকেই বলছে, এটা না দিলে বাপের উদ্ধার হবে না, ওটা না করলে তোমার হাতের জল শুদ্ধ হবে না। পিতা-মাতার ব্যাপার, না দিলে সত্যিই যদি উদ্ধার না হয়! তাই কষ্ট হলেও দিয়ে গেল।
এতেও শেষ না। দিতে দিতে শেষে এসে ঠেকেছে ঝাড়ুদারের হাতে। ঝাড়ুদার বলছে, "একটা ঝাঁটার বাড়ি না খেলে তোমার পাপ দূর হবে না, বাপের উদ্ধার হবে না।" এখানেও সেই সেন্টিমেন্টের ব্যাবসা। সন্তান ভাবল, এতই করলাম, এতই খরচ হলো, এতজনের এত চাহিদা মেটালাম, আর একটা ঝাঁটার বাড়ির জন্য সব ঠেকে থাকবে? এতে যদি বাবা মুক্ত হয়ে যান, তবে একটা কেন, না হয় দু-চারটা খেলামই। কিন্তু তাতেই কি সব? ঝাঁটার বাড়ি এমনি এমনি দেওয়া হবে না, কিছু চাই।
এসব বিষয় কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, একবার ভাবুন! কী করলে মানুষের মনে লাগবে, মানুষ বাধ্যবাধকতায় এসে পড়বে, তারই চিন্তা করে নানা কৌশলে, নানা ফন্দিফিকির করে চলেছে সেন্টিমেন্টের ব্যাবসা। এর ফলে, অনেক সাধুব্যক্তি আছেন, যাঁরা সত্যিই মহান, উদার এবং ত্যাগী ও সেবাগতপ্রাণ, যাঁরা মনে-প্রাণে সন্ন্যাসী, তাঁরাও আজ ঠগের ছকে পড়ে যাচ্ছেন। তাঁরা যখন চিৎকার করে সকলকে জানাতে চেষ্টা করছেন, দেশ আজ উজবুকের দেশে পরিণত হতে চলেছে, এখনই সাবধান হও, তখন আবার অনেকে মনে করছে, এটাও হয়তো ব্যাবসার আর-একটি চাল।
কিন্তু তা নয়। সত্যিই দেশ আজ উজবুকের দেশে পরিণত হয়েছে। সিংহশাবকদের ভেড়া করে রাখা হয়েছে। সেই যে গল্পে আছে, এক রাজ্যে নরবলি হতো। রাজা দুই বিদেশিকে ধরে এনেছেন বলি দেবার জন্য। দুই বন্ধু ভাবছে, কী করে মুক্তি পাওয়া যায়! সারারাত ধরে তারা পরামর্শ করল। সকালে রাজার লোক এল, একজনকে বেদীর জন্য নিয়ে যেতে হবে। এসে দেখে, দুই বন্ধু তুমুল ঝগড়া শুরু করেছে—এ বলে, "আজ বলিস্থানে আমি যাব।", ও বলে, "না, আমি যাব।" ঝগড়া থেকে হাতাহাতি শুরু হলো। রাজা খবর পেয়ে ছুটে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? দুই বন্ধুই হাতজোড় করে বলল, "মহারাজ, কাল রাত্রে আমরা দু-জনে স্বপ্ন দেখেছি, আজ যাকে বলি দেওয়া হবে, তার অনন্ত স্বর্গবাস।" তার পরেই মহারাজের দুই পা জড়িয়ে ধরে দুই বন্ধুরই কাকুতি-মিনতি এই বলে… "আমাকে আজ বলি দিন, বেদীতে আমাকেই উৎসর্গ করুন।" মহারাজ ভাবলেন, আমার বেদীতে বলি হয়ে অন্যরা স্বর্গে যাবে? আচ্ছা, রাখ। এই সুযোগ! তারপর নিজেই স্নান করে, শুদ্ধ বস্ত্র পরে বেদীতে মাথা পেতে দিলেন।
…এই হলো আমাদের দেশ, আর এই হলো আমাদের দেশের লোক। এমনই উজবুক, এমনই সরল, এমনই ধর্মভীরু যে, তারা বুঝতেও পারে না, কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা। যা বোঝানো হয়, তা-ই বোঝে। তাদের সেই ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে, তথাকথিত সাধুসন্ন্যাসীরা নিজেদের সঞ্চয় বাড়িয়ে চলেছে, আর কতগুলো ভিক্ষুকের সৃষ্টি করছে।
বেদে ‘আশ্রম', 'সাধু', 'সন্ন্যাসী', 'ভাগী', 'মহান', 'উদার', 'বিরাট' এই উপাধিগুলো কোনও বিশেষ ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানকে উল্লেখ করে বলা হয়নি। কথাগুলো সবই বেদে আছে; বিভিন্ন শ্লোকে এদের গুণ বর্ণনা করা আছে। সেই গুণগুলি আমরা যেখানে, যার মধ্যে ঠিক ঠিক দেখতে পাবো, তাকেই সেই উপাধিতে ভূষিত করতে পারব। যেমন ধরুন 'আশ্রম' কথাটা। বেদ বলছে, যেখানে আশ্রয় পাওয়া যায়, তা-ই আশ্রম। সেদিক থেকে পিতামাতাও আশ্রম। মন যার দ্বারস্থ হয়, তা-ই মন্দির। সংসার হচ্ছে সর্বোত্তম মন্দির।
সৎভাবে জীবনযাপন করাই সন্ন্যাস। তার জন্য মস্তক মুণ্ডন করতে হয় না, গেরুয়াও ধারণ করতে হয় না, কিংবা ফোঁটা-তিলক কাটারও প্রয়োজন হয় না। যখন যেভাবে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, যদি কোনও ব্যক্তি সৎভাবে জীবনযাপন করে, বেদ তাকেই সন্ন্যাসী আখ্যা দিয়েছে। এইভাবেই 'ত্যাগী', 'উদার', 'মহান' কথাগুলো বেদে ব্যবহৃত হয়েছে।
নিজের সুখ-দুঃখের কথা চিন্তা না করে অন্যের উপকারের জন্য যে সবকিছু অনায়াসে দিয়ে দিতে পারে, সে-ই ত্যাগী। বাইরে যতই দানধ্যান করুক, ভেতরে ভেতরে নিজেরটা ঠিক রেখেছে, তাকে কখনই ত্যাগী বা যোগী বলা হবে না। মা সন্তানের কাছে ত্যাগী। কারণ নিজের খাওয়া-পরার চেয়ে সন্তানের খাওয়া-পরার চিন্তাটাই তার কাছে বেশি। সন্তানের জন্য সে সব কিছু করতে পারে, এমনকী জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করে না। এ শুধু কর্তব্য নয়, এতেই তার আনন্দ। এই যে নির্দ্বিধায় মন-প্রাণ, শক্তি-সামর্থ্য সকল কিছু আনন্দের সঙ্গে অপরের কল্যাণে উৎসর্গ করা, এটাই হচ্ছে পরম ত্যাগী বা যোগীর অবস্থা। সেদিক থেকে মা হচ্ছে পরম ত্যাগী ও সাধ্বী।
এইভাবে মায়ের মতো যিনি সমস্ত মানবজাতিকে আপন সন্তান মনে করে তাদের কল্যাণার্থে সব কিছু সঁপে দিতে পারেন, তিনিই হলেন উদার ও মহান, তিনিই হলেন প্রকৃত সন্ন্যাসী। এর জন্য আলাদাভাবে জঙ্গলেও যেতে হয় না, দণ্ডও নিতে হয় না। প্রত্যেকের মনেই সন্তানের জন্য স্নেহ, ভালোবাসা, উদারতা আছে। সেগুলিকেই সঙ্কীর্ণ গণ্ডি থেকে ব্যাপকতায় ছড়িয়ে দিলে আর কোনও ভাবনা থাকে না। যিনি সে চেষ্টা করেন, তিনিই সাধক। আপনি হয়তো বলবেন, নিজের সন্তানের জন্য যতটা স্নেহ, অপরের সন্তানের জন্য ততটা স্নেহ আসে না। কী করব?
এটা খুবই সত্য, বাবা-মা তার নিজের ছেলে-মেয়ের জন্য যতটা করবে, ভাইয়ের ছেলে-মেয়ের জন্য ততটা করবে না। আবার জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে-মেয়ের বেলায় ভালোবাসার পার্সেন্টেজ আরও কমে যায়। সে ক্ষেত্রে কী করা যায়? একান্নভুক্ত পরিবারের কী হয়? সকলের জন্য হাঁড়িতে অন্ন-ব্যঞ্জন রান্না হচ্ছে, সেখান থেকেই সকলের খাদ্য পরিবেশন করা হচ্ছে। একই অন্ন সকলে ভোগ করছে বলে কেউই সেখানে ভেজাল মেশাতে পারছে না। কারণ ভেজাল মেশালে নিজেকে এবং নিজেদের সন্তানদেরও সেই ভেজালমিশ্রিত খাদ্যই গ্রহণ করতে হবে, তাই ভেজাল মেশানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না।
ঠিক সেই রকম করে সকলের স্নেহ-ভালোবাসা এবং সকলের জন্য স্নেহ-ভালোবাসা এক জায়গায় সঞ্চয় করতে হবে। সেখান থেকেও স্নেহের ধারা, প্রেমের ধারা, সকলের জন্য সর্বদিকে সমমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ুক। তবেই সমস্যার বাঁধ সেই ধারার গতিতে আপনিই ভেসে যাবে। বেদেও এই ধরনের ইঙ্গিত আছে। সেখানে বলা হয়েছে, সকলের অর্জিত ধন এবং ধান একই জায়গায় সঞ্চয় করা হোক। সেই সাধারণ জায়গা থেকে যে যার প্রয়োজন মতো বস্তু নিয়ে যাক। তার ফলে এতে কেউই ভেজাল মেশাতে পারবে না। কারণ, যে মেশাবে, তাকেও তো আবার সেখান থেকেই জিনিস নিতে হবে। সুতরাং নিজের কথা চিন্তা করেই সে অন্যের ক্ষতি করতে চাইবে না।
…ঠিক যেভাবে এত বড়ো জীবনবীমার ব্যাবসাটা চলছে। নিজের জীবন সহজে কেউ দিতে পারবে না—এই সহজ সত্যটা জানা আছে বলেই লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এতগুলো টাকার রিস্ক নিতে পেরেছে। কয়েক-শো টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে হাজার হাজার টাকা ইনশিওর করার পর কোম্পানি তো তাদের ক্লায়েন্টের পেছনে লোক পাঠায় না…তারা কোথায় গেল, কী খেল ইত্যাদি জানার জন্য! তারা জানে, প্রত্যেকেই নিজের নিজের জীবন ঠিকই রক্ষা করবে। তার জন্য পাহারার দরকার হবে না।
'আত্ম', অর্থাৎ নিজের প্রতি মায়া সকলেরই আছে। এই নিজের বা আত্মীয়ের গণ্ডিটাকে যদি বড়ো করে টানা যায়, অর্থাৎ অনেকদূর পর্যন্ত তার সীমানাটা বিস্তৃত করা যায়, তবে সকল কিছুই নিজের মধ্যে এসে পড়বে। যেমন ধরুন, আমার পরিবারের লোকেদের আমার ভালো লাগে। চিন্তাটাকে আরও একটু ব্যাপক করলে আমার গ্রামের সব লোকেদেরই আমার ভালো লাগবে। নিজেকে বাঙালি ভাবলে সমস্ত বাংলাদেশের লোকদেরই নিজের মনে হবে। 'আমার'-টাকে আরও বাড়ান, মনে করুন, আপনি বাংলাদেশি, কেবলই হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান নন, তবেই বাংলাদেশের সব লোক আপনার আত্মীয় হয়ে গেল। মনটাকে আরও প্রসারিত করুন; দেশান্তরে নিয়ে গিয়ে ফেলুন, তখন আপনি পৃথিবীর লোক, বিশ্ববাসী আপনার আত্মীয়।
এইভাবে মনটাকে আরও আরও টানতে থাকুন; দেখবেন, সবার জন্য আপনি ভালোবাসা অনুভব করছেন, সকলকে আপনার ভালো লাগছে, প্রত্যেককে আপনার আপন মনে হচ্ছে, সবাই আপনার আত্মীয়ের মধ্যে এসে পড়ছে। এইভাবে সকলেই যখন সকলকে আপন বলে, নিজের বলে মনে করবে, তখন আর কোনও সমস্যাই থাকবে না।
প্রকৃত ধৰ্ম আজ কতটা বিকৃত, তা একটা উদাহরণেই বুঝতে পারবেন। সহস্র লোক কীর্তন করতে করতে এগিয়ে চলেছে। কীর্তনের পদটি হচ্ছে, 'পতিতে তারিতে হবে তারিণী'। মিছিলের সামনের দিকের লোকেরা ঠিকই গাইছে, কিন্তু পেছনের লোকেরা গেয়ে চলেছে, 'পঁচিশ তারিখে হবে বারুণী'। এই গানেই তারা তাল দিয়ে চলেছে। মিছিলে যত নতুন লোক এসে যোগ দিচ্ছে, সকলেই চিৎকার করে এই গানই গাইছে৷ গানের সুরে আর মুখরোচক পদে সকলে এমনই মুগ্ধ এমনই মত্ত যে, এটা যে কীর্তনের পদ নয়, হতে পারে না, সে কথা আর কারুরই মনে আসে না। ভিড়ের তালে চলে কত মানুষ যে বেতাল হয়ে সর্বস্ব হারায়, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
দু-একজন, যাদের মনে উদয় হয়, এটা তো হতে পারে না, তারা তখন একে 'ভোগের কারবার', 'ব্যাবসা' ইত্যাদি বলে মিছিল ছেড়েই চলে যায়। আমাদের দেশে 'ধর্ম' আজ এই অবস্থায় এসেছে; 'পতিত উদ্ধার' আজ 'বারুণী উৎসব'-এ পরিণত। সেই জন্যই ধর্মের নামে আজ অনেকের মনে ভয়, ভীতি, সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে—তারা একে এড়িয়ে চলছে। কিছু সংখ্যক আবার ধর্মকে মিথ্যা, ভণ্ডামি বলে উড়িয়েই দিচ্ছে। আর বেশিরভাগ লোক এর বিকৃত রূপ নিয়ে এমনই মশগুল হয়ে আছে যে, তাদের কিছু বলতে গেলেই তারা তেড়ে মারতে আসছে। কিন্তু সত্য তো উদ্ধার করতেই হবে। তাই যারা এ লাইনে আছে, তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। যে যে বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ তার কথা, তার চিন্তাধারা যতটা বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণীয়, অন্যদেরটা ততটা নয়। কারণ সাধারণ ব্যক্তিরা কল্পনা ও ধারণা থেকে কথা বলে।
প্রকৃত ধর্ম ভীতির বস্তু নয়, প্রকৃত ধর্ম কল্পনার বস্তু নয়, প্রকৃত ধর্ম অলীক বস্তু নয়, প্রকৃত ধর্ম অস্বাভাবিকও নয়। ধর্মের নামে যা আজ দেখতে পাচ্ছি, সেটা ধর্মের একটা বিকৃত রূপ। সেই বিকৃত রূপের নেশায় আজ সকলে মত্ত বলেই সত্যরূপ আর চোখে পড়ছে না। ধর্মের নামে আজ যা চলছে, সেটাই বরং বেঠিক। যখনই আপনারা বুঝতে পারছেন, এটা ঠিক নয়, তখনই আপনাদের বোঝা উচিত, একটা তবে ঠিক বস্তু আছে। বেঠিকটা হলো কী করে? ছায়া যখনই দেখবেন, তখনই বুঝবেন, আলো নিশ্চয়ই আছে। আলোটা খুঁজে বের করতে হবে। ছায়া দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলে আলোটাকেও যে ছাড়তে হয়।