দো দিল বান্দা, কলেমাচোর, না পায় বেহেস্ত, না পায় গোর

আমি ঢাকায় এলে সাধারণত মাহবুবের বাসায় থাকি। ও আমার খুব-খুব প্রিয় একজন মানুষ, সবচাইতে কাছের ছোটভাইদের একজন। আমি জীবনে যে ক’জন অসাধারণ ভালমানুষ দেখেছি, ও তাদের অন্যতম। আন্টিও আমাকে বড়ছেলের মতই দেখেন, এমনকি সময়ে-সময়ে শাসনও করেন। আমি সাধারণত কারও কাছ থেকে উপহার নিই না। কিন্তু গত ঈদে আন্টি যখন আমাকে একটা নতুন পাঞ্জাবি দিয়ে বললেন, “আমার বড়ছেলে নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া ঈদ করবে, তা কী করে হয়?” আমি আর কিছুই বলতে পারিনি। আজকেও ওর বাসায় উঠলাম। সকালে ওর সাথে ব্রেকফাস্ট করার সময় কিছু কথা শেয়ার করলাম, যে কথাগুলি লিখতে ইচ্ছে করছে। (ভুল হল একটু, ওরা বাসাটা এখন আর ‘ওর বাসা’ বলার মতো অবস্থায় এ পরিবারের সাথে আমার সম্পর্কটা নেই। কখনও-কখনও অধিক আন্তরিকতায় অধিকার জন্ম নেয়। বাসাটা এখন ‘আমার বাসা’। ভালোবাসায় বাসা গড়ে ওঠে, কত সহজেই!)

সে সময় অন্য কোনও চ্যানেল ছিল না; ছোটবেলায় রাত ৯টায় বিটিভি’তে নাটক চলত। ওই সময়ে পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে স্বাভাবিকভাবেই মা নাটক দেখতে দিত না। আমাকে আমার পড়ার রুমে দরোজাজানালা বন্ধ করে আটকে রেখে পাশের রুমে লো ভলিয়্যুমে টিভি দেখত। মা’র ওভাবে করে নাটক দেখতে খুব কষ্ট হত, সাউন্ড শোনাই তো যেত না! আমার রুমে অতো সাউন্ড আসত না, তবে আমি যেটা করতাম, সেটা হল, জানালার ফোকর দিয়ে দেখতাম, তৌকির কী বলে, কীভাবে বলে, বিপাশা কেন হাসে, কতটুকু ঠোঁট বাঁকায়। (মেয়েরা অবশ্য এমনিই হাসে, তবে এটা বোঝার বয়স ১২-১৩ নয়।) এভাবে করে ১ ঘণ্টা পেরনোর জন্য ওয়েট করতাম। মা কখনও আমাকে ওরকম চুরি করে নাটক দেখতে খেয়াল করলে খুউব বকে দিতেন। তখন আবারও একটুখানি পড়তাম। ওই বয়সটা ছিল, ‘পড়াশোনা না করলে তো বাবা-মায়ের লস, আমার তো কোনও লস নাই’, এটা বিশ্বাস করার বয়স। সেই ১ ঘণ্টা না হত পড়াশোনা, না হত নাটক-দেখা। ১ ঘণ্টা পার হলেই আমার ছুটি। যেহেতু আমাকে টিভি দেখতে দেয়া হয়নি, সেহেতু ১০টার পর পড়লেও আমার ইচ্ছা, না পড়লেও আমার ইচ্ছা। সে সময় টিভি না দেখার স্যাক্রিফাইস অনেক বড় স্যাক্রিফাইস। মাঝেমাঝে যেটা হত, বাবা পেছন থেকে এসে জানালার ফাঁকে নাক সেঁটে-দেয়া আমার কাঁধে হাত রাখত, আর বলত, “টিভি দেখবি? যা, দেখ গিয়ে!” আমি তো মহাখুশি! আমাকে টিভিরুমে দেখলে মা খুব রেগে উঠতেন, আর তখন বাবা বলতেন, ও একটু নাটক দেখুক না! খাওয়ার পর ও ২ ঘণ্টা এক্সট্রা পড়ে নেবে। “কী রে? পড়বি তো?” আমি তো ওতেও রাজি! সে সময় মনে হত, আমাকে যে নাটকটা দেখতে দেয়া হচ্ছে না, ওটাই সবচাইতে সুন্দর নাটক। নাটক দেখার কিছু নিয়ম ছিল। যেমন, ধারাবাহিক নাটক দেখা যাবে, কিন্তু প্যাকেজ কিংবা সাপ্তাহিক নাটক দেখা যাবে না। কারণ, ধারাবাহিক নাটক দেখতে না দিলে নাটকের কোনও পর্বই দেখে কোনও লাভ নেই। অবশ্য কারেন্ট চলে গেলে তখন আর কিছুই করার থাকত না। সেটাকে আমরা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতাম। আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য কারেন্ট চলে যাওয়ার রাত ছিল বারান্দায় বসে-বসে রাত দেখার ও বোঝার রাত। শিক্ষক ছিল আমার বাবা। (এটা নিয়ে অন্য একটা লেখায় লিখেছি, তাই এখানে আর লিখছি না।)

নাটক দেখতে দিলে তো বাড়তি কিছু সময় পড়াই যায়। সে সময় আমাদের বাসায় ডাইনিং টেবিল ছিল না; নাটক দেখা শেষ আমরা সবাই ফ্লোরে মাদুর পেতে একসাথে খেতে বসতাম। তখন বাবা বলত, “মম, ওকে মাঝেমধ্যে টিভি দেখতে দিয়ো। নাহলে তো ও পড়েই না। ১ ঘণ্টা না হয় পড়া, না হয় টিভি-দেখা।” (আমার মায়ের নাম মমতা, ডাক নাম মম।) আমি তো শুনে খুশিতে নাচতে থাকতাম। বেড়ালের মতো বাবার কোল ঘেঁষে বসতাম আরও। তখন বাবা আমাকে বলত, “বাবা, একসাথে এমন দুইটা কাজ করবি না, যে দুইটা কাজই তোর ভালভাবে করা দরকার। দো দিল বান্দা, কলেমাচোর, না পায় বেহেস্ত, না পায় গোর।” “বাবা, এটার মানে কী?” “এটার মানে হল, তুই প্রার্থনা করার সময় অন্য কাজ মাথায় রাখলে প্রার্থনা ঠিকমতো হবে না। পড়াশোনাটা প্রার্থনা করার মতো। এটা করার সময় অন্য কাজ করার কথা মাথায় আসলে সেটা করে ফেলবি। এরপর কিছুটা বাড়তি সময় ধরে পড়াশোনা করে নিবি। প্রার্থনাও এরকম। ঠিক সময়ে না করলে বাড়তি কিছু পরিশ্রম করে নিতে হবে। নাহলে সেটা পূর্ণ হবে না।” সে সময় অতো বুঝতাম না। শুধু ‘দো দিল বান্দা, কলেমাচোর, না পায় বেহেস্ত, না পায় গোর।’ এ কথাটা মোটিভেশন হিসেবে কাজ করতো। বাবা ওটা প্রায়প্রায়ই বলতো।

আজ বুঝি, আমরা যতক্ষণ কোন একটা মিশনে থাকি, ততক্ষণই আমাদের ইবাদতের সময়। ইবাদতের সময় অন্য কোনও ভাবনা মাথায় আসলে কোনওভাবেই ইবাদতের পরিপূর্ণ ফল পাওয়া সম্ভব নয়। যারা কোনও একটা উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কাজ করার সময়ে বাকি অন্য সব কাজকেও প্রাধান্য দেয়, তাদের কোনও কাজই ভালভাবে হয় না। ইবাদতের সময় যেমন অসম্ভব কষ্ট স্বীকার করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয়, ঠিক তেমনি একটা মিশনে থাকার সময় আরাম আর সুখের সাগরে ডুবসাঁতারে সে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। যেকোনও ধরনের পড়াশোনা করাটা ইবাদতের মতই। প্রচণ্ড ধৈর্য, আন্তরিকতা আর ইচ্ছাশক্তি না থাকলে পৃথিবীর কোনও ইবাদতই সফল হত না। যুগে-যুগে পয়গম্বর, মহাপুরুষরা এটাই প্রমাণ করে গেছেন। ইবাদতের সময় অনেক কষ্টস্বীকার করে শুধু ইবাদতই করে যেতে হয়। অন্য কোনও বিষয়কে ইবাদতের সময় মাথায় আনা যাবে না। এতে ইবাদতের বরকত নিশ্চিতভাবেই কমে যায়, আমি এটা মনে করি। ইবাদতের সময় নিয়তের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। নিয়তের জোর যার কত কম, প্রাপ্তির পরিমাণ তার তত কম। হাদিসে আছে, “ইন্না মাল আ’মালু বিন্নীয়্যাত।” এর মানে, প্রত্যেকটা কাজ মানুষের নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিয়ত ঠিক থাকলে এবং সেই নিয়তের প্রতি একনিষ্ঠ থাকলে যেকোনও কাজেই সফল হওয়া সম্ভব।

Intuition is much more important than logic. কোনও একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় যদি দ্বিধায় থাক, কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়, তবে সে সময় নিজের ভেতরের ‘আমি’কে জিজ্ঞেস করে দেখ। ও কী বলে দেখ। ওটাই হল ইনটিউশন বা সজ্ঞা। যদি লজিক অন্য কিছুও বলে, তবুও তুমি তোমার ভেতরের ‘আমি’র কথাই শোনো। কেন? দুটো কারণে।

এক। তুমি প্রায়ই দেখবে, তোমার ইনটিউশন যা বলে, তা কোনও না কোনওভাবে ঠিক। কখনও-কখনও পৃথিবীর কিছু সাময়িকভাবে (for the time being) ব্যাখ্যাতীত বিষয়ের উত্তরও আমাদের রহস্যময় মস্তিষ্কের কোনও এক গূঢ়তম অংশে লুকিয়ে থাকে, যেটার খোঁজ আমরা হয়তো বা কখনওই পাই না। হঠাৎ-হঠাৎ তেমন কোনও চেষ্টা ছাড়াই একেকটা উত্তর সিগন্যাল (signal) আকারে বেরিয়ে আসে। সেটা দ্রুত গ্রহণ (receive) করার মতো ক্ষমতা যার যত বেশি, সে তত দ্রুত সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারে।

দুই। যদি তুমি তোমার ইনটিউশনের কারণে কোনও ভুল সিদ্ধান্তও নাও, তবুও সেটার ফলে তোমার যে ক্ষতিটা হবে, সেটা মেনে নেয়ার মানসিকতা আর ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তোমার মধ্যে অবচেতনভাবেই তৈরি হয়ে যায়। ধর, ইনটিউশনের পথে না গিয়ে লজিকে চলে যদি তুমি একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে। যদি সে সিদ্ধান্ত তোমাকে লেভেল-৫ এ পৌঁছে দেয়, তবে ধরে নিচ্ছি, সেখান থেকে লেভেল-১০ এ পৌঁছাতে তোমার সময় লাগবে ১০-১২ বছর। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ধর তুমি তোমার ইনটিউশনের কথা মেনে একটা আপাত ভুল সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললে, আর তুমি নেমে গেলে লেভেল-০’তে। সে সময় তোমার মধ্যে একটা প্রচণ্ড আফসোস কাজ করে যেটার সাথে নিজের ভাললাগাকে দাম দিতে গিয়ে ভুল করার ভালোবাসামাখা আফসোস আর অসীম দায় জড়িয়ে থাকে। সে ভালোবাসাটা তোমার মধ্যে যে ড্রাইভটা তৈরি করে, সেটার আবেগজড়ানো শক্তি (impulse) তোমাকে অনেক-অনেক দ্রুত সামনের দিকে ঠেলে দেয় আর তুমি এমন শক্তিতে সে একই লেভেল-১০ এ পৌঁছে যাও, যেটা অন্য সব সাধারণ মানুষের অতীত অভিজ্ঞতার বিচারে সম্পূর্ণই অভিনব ও অলৌকিক। এ কাজটা করতে তোমার সময় লাগতে পারে বড়োজোর ৩-৪ বছর। মানে, ইনটিউশন পাওয়ারকে ঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে একজন আপাত ব্যর্থ মানুষ একজন সফল মানুষের তুলনায় অনেক কম সময় একই উচ্চতায়, এমনকি এর চাইতেও বেশি উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারে! এমন দৃষ্টান্ত অসংখ্য।

“ভাইয়া, আপনি আসামাত্র বললেন, কালকে বাসে ওরা আপনাকে কম্বল দেয়নি, তাই এসি’র ঠাণ্ডায় আপনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি, রাস্তাও নাকি ভীষণ এবড়োথেবড়ো ছিল। নাস্তা করে এসেই ২-৩ ঘণ্টা ঘুমাবেন, ঘুম থেকে উঠে ঘুরতে বের হবেন। অথচ, আপনি এসেই লিখতে বসে গেলেন। এই এনার্জি কই পান, ভাইয়া?”

“ব্যাপারটা এনার্জির না, মাহবুব, ব্যাপারটা প্যাশনের। সবাই সব কাজ পারে না। তুমি যে কাজটাকে ভালোবাস, সে কাজটার প্রতি তোমার অনেক ভাললাগা কিংবা মুগ্ধতা কাজ করে, যেটার কোন মূল্যই হয়তো অনেকের কাছে নেই। কিন্তু তোমার প্যাশনের প্রতি তুমি নিজে আন্তরিক আর বিশ্বস্ত থাকবে। এটা খুব বেশি দরকার। প্যাশনকে ভালোবাসতে হয়, বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে নয়, নাহলে তুমি তোমার প্যাশন থেকে বাড়তি কিছু পাবে না। এটার প্রতি আন্তরিকতা তোমার পরিশ্রম করার ক্লান্তিও দূর করে দেয়। মানুষ কিন্তু ক্লান্ত হয় যতটা না শারীরিক কারণে, তার চাইতে ঢের বেশি মানসিক কারণে।”