দেয়াল


যে সমস্ত বিপদের আশঙ্কায় আমরা তটস্থ হয়ে থাকি, প্রায়ই দেখা যায়, সেগুলির একটাও ঘটে না। মাঝখান থেকে আমরা আমাদের মানসিক শক্তির কিছু অংশ অপচয় করি। কী হবে কী হবে, এরকম ভেবে ভেবে বর্তমানতাকে নষ্ট করি, অথচ ভবিষ্যতের বিভিন্ন অনিশ্চয়তার উপর প্রায়ই আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ বা ধারণা কোনোটাই থাকে না। অতীতে কী করলাম, কী করলাম না, তা নিয়ে মন খারাপ করে করে আমরা জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট করি, যে সময়ে আমরা নতুন কিছু করে ফেলতে পারতাম। অতীত নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে বর্তমানটাকে উপভোগ কিংবা ব্যবহার করতেই মনে থাকে না। এরকম করতে করতে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি, এবং এ ধরনের উদ্‌বেগ আমাদের বর্তমানের অসুখ ও দুঃখ দুই-ই বাড়িয়ে দেয়। অতীত কষ্ট ও বর্তমান কষ্ট, এই দুইয়ের মধ্যে যে বন্ধুত্ব, তার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমরা আমাদের কাছের মানুষদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করে করেও আমাদের জীবনীশক্তির অনেকটুকু ক্ষয় করে ফেলি। অথচ কার জীবনে কী হবে কী হবে না, তা অনেকটাই, যার জীবন, তার নিয়ত ও নিয়তি দ্বারাই নির্ধারিত হয়।


তবে কি আমরা যা নিয়ে টেনশন করি, তার পুরোটাই অমূলক? না, তা নয়। গবেষণা বলছে, আমরা যা-কিছু উদ্‌বিগ্ন হয়ে থাকি, তার মাত্র শতকরা আট ভাগ ঘটে, বাকিটা ঘটেই না।


আমরা যখন কোনও একটা ঝামেলায় পড়ি, তখন আমরা সবচাইতে বেশি সময় নষ্ট করি ঝামেলাটা কেন হলো, তা ব্যাখ্যা করার পেছনে। যা হয়েছে, তা থেকে মুক্তির উপায় খোঁজার চেয়ে বরং আমরা ব্যস্ত হয়ে থাকি তার কারণ ব্যাখ্যার পেছনে। এতে টেনশন বাড়ে। যদি ঝামেলার কারণ খুঁজলে ঝামেলার সমাধান বেরোয়, তবে কারণ খোঁজা যৌক্তিক, নতুবা তা কেবলই বাড়তি টেনশন তৈরি করে। ঝামেলা কারণ নিয়ে বেশি ভাবলে আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে। এতে সংশয় ও বিষণ্ণতারও সৃষ্টি হয়।


আরেকটা কাজ আমরা করি, তা হলো, সেই ঝামেলা নিয়ে এমন লোকজনের সঙ্গে আলাপ করি, যারা ঝামেলাটা সমাধান করতে কোনও ভূমিকাই রাখতে পারবে না, কিংবা পারলেও রাখবে না। কী লাভ হয় ওদের সাথে কথা বলে? মানসিক স্বস্তি আসে? ঝামেলার কারণ নিয়ে গবেষণা করা যায়? ঝামেলাটার জন্য যে বা যারা দায়ী, তার বা তাদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা যায়? বুঝলাম, এর সবই করা যায়। কিন্তু লাভ কী এতে? ঝামেলাটা কমে? না কি ঝামেলাটা সমাধানের দিকে এগোয়? বরং এতে নিজের মানসিক শক্তি কমে, ঝামেলার সমাধানের জায়গাগুলি থেকে ফোকাসটাই সরে যায়। আমি নিজে যখন বিপদে পড়ি, তখন অপ্রয়োজনীয় লোকের ফোন ধরাই বন্ধ করে দিই। বিপন্ন মানুষ তার নিজের প্রশংসা, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সান্ত্বনাবাক্য, কারও প্রতি বিষোদ্‌গার এসব শুনে কী করবে? বিপদের সময় আত্মতৃপ্তি নয়, বিপদমুক্তি দরকার। বিপদ কেটে যাওয়ার পর ইচ্ছেমতো গবেষণা করার সময়-সুযোগ পাওয়া যাবে।


জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাদের হতে হয়, যেগুলির তেমন কোনও ব্যাখ্যা নেই। আছে হয়তো, তবে তা আমাদের বোধের অতীত কিংবা ওই সময়ে মাথায় আসে না। কেন আমার সাথেই এমন হচ্ছে! আমি কি এটা ডিজার্ভ করি? আমার দোষটা কোথায় এখানে? অমুক খারাপ, তমুক খারাপ, আমি তো খারাপ নই!...এইসব নিয়ে আমরা যত ভাবব, ততই আমরা মানসিকভাবে দুর্বল হতে থাকব এবং পরিস্থিতির সমাধান খোঁজার চেয়ে বরং পরিস্থিতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের উপর রাগ ঝাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। এতে করে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে পড়বে। আর আমাদের চোখের সামনেই ঝামেলা বাড়তেই থাকবে।


জীবনের কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা খোঁজার চেয়ে বরং সেগুলি মেনে নিলেই ভালো। যা-কিছুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কোনও লাভ নেই, তা-কিছু সহ্য করতে শিখে নেওয়াই বিচক্ষণতার লক্ষণ। যে দুঃখকে মনে পুষে রেখে সেই দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, তা ভুলে গেলেই বরং মঙ্গলজনক। জীবনকে ব্যাখ্যা করার চাইতে অনেক ভালো হচ্ছে জীবনকে যাপন করা। যাপন করতে করতেই জীবনের সব ব্যাখ্যা এক এক করে চোখের সামনে এসে ধরা দেয়। জীবনের সবকিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, তবে জীবনের প্রতিটি কিছুরই যাপন করা যায়।


আমার শার্ট-প্যান্ট এলোমেলো পড়ে থাকে। বইপত্র এলোমেলো পড়ে থাকে। আমার এরকম অনেক কিছুই এলোমেলো পড়ে থাকে। তবে তা আমার জীবনযাপনে কোনও বাধার বা ঝামেলার সৃষ্টি করে না। সেগুলি গুছিয়ে রাখলেই বরং আমি পরে আর খুঁজে পাই না। আমার মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে মোবাইলের স্ক্রিনে একটু ভেঙে গেছে। তবে সেটা নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ নেই, কেননা গত দেড় বছরে ওই ভাঙা অংশের কারণে আমার মোবাইল চালাতে কখনওই কোনও সমস্যা হয়নি। যে ঝামেলা আমাদের জীবনে কোনও ঝামেলা তৈরি করে না, তা সারাতে গিয়ে আমরা প্রায়ই এমন ঝামেলা সারানোর সময় কিংবা সুযোগই পাই না, যে ঝামেলাটা সারানো দরকার। তাই আমি সবসময়ই নিজেকে বলি, তোমার যে ঝামেলাটা নিয়ে তোমার জীবনে কোনও ঝামেলাই হয় না, সে ঝামেলাটা নিয়ে ঝামেলা করার কোনও দরকারই নেই। জীবনে সবকিছু পারফেক্ট অবস্থায় পাওয়া যায় না। যদি জীবনযাপনে বড়ো কোনও অসুবিধে না হয়, তবে কিছু ইমপারফেকশন মেনে নিতে আমার কোনও আপত্তি নেই।


আমি সবসময়ই পকেটে রুমাল ক্যারি করি। এটা আমার অভ্যাস। আমি জানি, এখন টিস্যু সহজলভ্য, রুমাল তাই অনেকেই ক্যারি করে না। তবে আমার অভ্যাসটা আমাকে স্বস্তি দেয়। আমাকে অনেকে বলে, তুমি এখনও পকেটে রুমাল রাখো? কেন রাখো? আমি ওদের কিছুই বলি না। আমি জানি, ওরা রুমাল ক্যারি করার স্বস্তিটা পায় না। যে যেখানে স্বস্তি পায়, সে সেখানে থাকুক। এখানে অসুবিধে কোথায়? আমরা মানুষকে গায়ে পড়ে পরামর্শ দেওয়ার সময় ধরেই নিই, একমাত্র আমিই এটা বুঝি, বাকিরা সবাই ঘাস খায়। অনেকে ঘড়ি পরে না, মোবাইলে সময় দেখে। ওরা আবার অন্যদের বলে, ঘড়ি কিনে পয়সা নষ্ট করার কী দরকার? ঘড়ি পরা তো একটা ঝামেলা! মোবাইলেই তো সময় দেখা যায়! আমি ওদের দেখে মনে মনে বলি, পয়সাটা তো আমার পকেট থেকে নষ্ট হচ্ছে, তোমাদের কী সমস্যা? ঝামেলাটা তো ক্যারি করছি আমি, তোমাদের কী সমস্যা? ঘড়ি কিনতে যে পয়সা লাগে, তা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়ে তিনি বিশ্ববাসীর যে উপকারটা করলেন, তার জন্য পরের বার তিনি যেন নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন!


আমার যে সীমাবদ্ধতা কিংবা ঝামেলা আমি নিজেই ক্যারি করতে পারি, তা নিয়ে আমাকে জাজ করে যারা, ওদের আসলে মাথাতেই সমস্যা! আমরা যেন মাথায় রাখি, আমার চোখে যা বাড়তি ঝামেলা, হয়তো অন্য কারও চোখে তা-ই স্বস্তির উপকরণ। এটা নিয়ে বেশি কথা বলাটাই বেআক্কেলের কাজ। যার ছেলের হাগু আপনাকে সাফ করতে হয় না, তার ছেলে ঘন ঘন হাগলে আপনার কী সমস্যা? যে আপনার খেয়ে মোটা হচ্ছে না, কিংবা যার ভার আপনাকে বহন করতে হচ্ছে না, সে মোটা কি চিকন, তা নিয়ে আপনার এত গবেষণা কীসের? কারও ঠোঁট কালো দেখলে আমরা অনেকেই বলি, ব্যাটা নিশ্চয়ই সিগারেট খায়! আরে ভাই, খেলে খায়! আপনার টাকায় খায় নাকি? না কি আপনি তাকে লিপকিস করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন? তার ঠোঁট কালো কি গোলাপি, তা নিয়ে আপনার কী সমস্যা? কোনও মেয়ে যখন আমাকে ডিওডোরেন্ট উপহার দেয়, তখন চট করে আমার মাথায় আসে, মেয়েটার ধারণা, আমার গায়ে দুর্গন্ধ এবং সে নিশ্চয়ই আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায়! আমাকে এক মেয়ে একবার ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি গিফট করেছিল। আমি ওই মুহূর্তে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, তার নিজের কোনও বিশেষ সুবিধের কথা ভেবে সে আমাকে ওই উপহারটা দিয়েছিল কি না! হা হা হা...


তো যে প্রসঙ্গে ছিলাম! যখনই আমাদের ভেতরের অহেতুক অস্থিরতাগুলি একটা একটা করে কমতে থাকে, তখনই আমাদের মধ্যে পরিস্থিতিকে মেনে কিংবা পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগোনোর ইচ্ছে ও শক্তিটা তৈরি হয়। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না, এর ফলে বাজে পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে যাওয়ার রাস্তাটাও চোখের সামনে কিছুতেই আসে না। আমাদের খুব ভালো করে বুঝতে হবে, কখন যুদ্ধ করতে হয় আর কখন সহ্য করতে হয়। সহ্য করার নাম পরাজিত হওয়া নয়, এর নাম জয়ের জন্য নিজেকে ক্রমেই প্রস্তুত করে তোলা। আমরা যুদ্ধ করতে শিখেছি, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে শিখিনি। আমরা কনফিডেন্ট হতে জানি, তবে কী নিয়ে কনফিডেন্ট হওয়ার কোনও দরকার নেই, সেটাই জানি না।


এই কাজটা কেন আমাদের জন্য সহজ নয়? কেননা আমাদের ছোটোবেলায় শেখানো হয়েছে, কঠিন অবস্থা থেকে মুক্ত হতে চাইলে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় এবং একে শেষ করে দিতে হয়। অল্প বয়সে এই কৌশলটা কাজে দেয়, কেননা তখন আমাদের সামনে যে সমস্যাগুলি আসে, সেগুলি খুব একটা টেকসই কোনও সমস্যা নয়, ঠিকভাবে লড়াই করলে সেগুলিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া কঠিন নয়। ছোটোবেলায় আমরা অনেক কিছু নিয়েই কনফিডেন্স শো করি, যেগুলি নিয়ে আমাদের আদতে কোনও ধারণাই নেই। ছোটোবেলায় মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনকেও চোখের সামনে পেলে বন্ধু ভেবে জড়িয়ে ধরি, যেমনি করে জড়িয়ে ধরি আমাদের প্রিয় বন্ধু অপদার্থ সুশান্তকে। মাথায় যখন বোধবুদ্ধি অল্প থাকে, তখন জ্ঞানী আইনস্টাইন ও অথর্ব সুশান্তর মধ্যে কোনও পার্থক্য করা যায় না। সরল ও বেকুব, এই দুই শ্রেণির মানুষরাই সবাইকে বন্ধু ভেবে বসে থাকে।


বড়ো হওয়ার সাথে সাথে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। আমাদের পৃথিবী যতটা বড়ো বলে আমরা সবসময় ভেবে এসেছি, বড়ো হওয়ার পর আমরা বুঝে ফেলি, পৃথিবীটা আসলে ততটা বড়ো নয়। আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারণে হোক কিংবা প্রয়োজনেই হোক, আমাদের পৃথিবীকে ছোটো করে ফেলতে বাধ্য হই। তখন সেই ছোটো পৃথিবীতে যে দেয়ালগুলি আমাদের সামনে আসতে থাকে একের পর এক, প্রায়ই দেখা যায়, সেগুলি ভেঙে ফেলে সামনের দিকে যাওয়া মোটামুটি অসম্ভবই! তখন ছোটোবেলার পাঠকে আরেক বার অন্যভাবে পড়তে হয়। দেয়ালকে না ভেঙে বরং দেয়ালের মধ্যেই থেকে লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া ঢের সহজ।


দেয়াল জিনিসটা সবসময় খারাপ নয়। দেয়ালের মানেই শুধু বাধা নয়, কখনওবা দেয়ালের নাম ধাক্কা, যে ধাক্কাটা না খেলে হয়তো জীবনে বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ত, জয়ী হওয়া তো অনেক দূরের কথা! তাই আমাদের সামনের দেয়ালের নাম যদি হয় ধাক্কা, তবে সেটাকে সানন্দে মেনে নিয়ে নিজেকে পরের ধাক্কা থেকে সুরক্ষিত করে ফেলাই ভালো।


দেয়ালের আরেকটা নাম হতে পারে সীমানা। মানুষ প্রায়ই নিজের সীমানা সম্পর্কে বুঝতে পারে না। কেউ যদি তার সীমানা চিনতে না পেরে তা অতিক্রম করে বিপদে পড়ে যায়, তবে সে বিপদ থেকে মুক্ত হতে যে পরিমাণ সময়, অর্থ ও শক্তির খরচ হয়, তার চেয়ে বরং চলার পথে দেয়াল এসে যাওয়াই ভালো। দেয়ালের মানে, এখন এগোনোর সব রাস্তাই শেষ, তা নয়; দেয়ালের মানে, এখন অন্য রাস্তা ধরতে হবে!


সব দেয়াল ভাঙতে হয় না। নিজেকে চিনতে ও সামলে রাখতে জীবনে কিছু দেয়াল থাকা ভালো। সব দেয়াল শত্রু নয়। কিছু দেয়াল বন্ধুর মতো আমাদের সমস্ত কান্নাকে প্রতিধ্বনিত করে আর বলে, ভয় পেয়ো না, আমি তো আছি!