‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ (শ্লোক: ১)

‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ প্রকরণের প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রথম শ্লোক সংক্ষেপে নির্দেশ করছেন:




রূপং দৃশ্যং লোচনং দৃক্ তদ্দৃশ্যং দৃক্ তু মানসম্।
দৃশ্যা ধীবৃত্তয়ঃ সাক্ষী দৃগেব ন তু দৃশ্যতে।। ১




অন্বয়। রূপং দৃশ্যং, লোচনং (তস্য) দৃক্, তু তৎ (লোচনং) দৃশ্যং, (তস্য) দৃক্ মানসম্। ধীবৃত্তয়ঃ দৃশ্যাঃ, সাক্ষী দৃক্ এব, ন তু দৃশ্যতে।




অনুবাদ। রূপ-দৃশ্য বস্তু, চোখ তার দ্রষ্টা; কিন্তু চোখ আবার দৃশ্য বস্তু, মন তার দ্রষ্টা; আবার মন বা মনোবৃত্তিসমূহ (অহম্‌, বুদ্ধি, মন, স্মৃতি) দৃশ্য, সাক্ষী বা কূটস্থ চৈতন্য তার দ্রষ্টা। চৈতন্য সবসময় দ্রষ্টাই থাকে, কখনোই কারও দৃশ্য হয় না। (যা নিত্য, তা দৃশ্য হতে পারে না। দৃশ্য মাত্রই পরিবর্তনশীল। যা যে-ধাপের দ্রষ্টা, তা সেই ধাপে নিত্য বা অপরিবর্তনীয়।)




টীকা। এ সংসারে ‘রূপং’ বা রূপ চোখ বা দর্শনেন্দ্রিয়ের ‘দৃশ্যং’ বা গ্রাহ্য বা বিষয়। সকল রূপই কেবল দৃশ্য। ‘লোচনং’—সেই রূপের গ্রাহক চোখ (জীবের) নিজের বিষয় বা object তথা সেই রূপের সাথে সম্বন্ধ ধরে ‘দৃক্’ বা দ্রষ্টা হয়।




এক‌ই উপায়ে আবার ‘তৎ’—সেই চোখ তার নিজের চাইতে ভেতরে অবস্থিত মনের ‘দৃশ্যং’ বা দৃশ্য হয় এবং ‘মানসম্’ বা মন নিজের প্রকাশ্য বা বিষয় বা object চোখ-এর সাথে সম্বন্ধ ধরে ‘দৃক্’ বা দ্রষ্টা হয়।




চিত্ত বা মন দ্রষ্টা পুরুষ বা ব্রহ্ম এবং সকল ধরনের দৃশ্য ও ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে সকল বিষয়ের অবভাসক (প্রকাশক বা আরোপক) হয়—’তু’ পদ মনের সেই সামর্থ্যকে প্রকাশ করছে।




‘ধীবৃত্তয়ঃ’—অন্তঃকরণের যে-সকল বৃত্তির কথা পরে বলা হবে, তারা অবিদ্যার কাজ বলে জড়স্বরূপ, সে কারণেই তারা দৃশ্য। (জ্ঞানের অভাব নয়, বরং জ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতাই অবিদ্যা; ‘জ্ঞান’ বলতে ‘ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কিত জ্ঞান’ বোঝায়।)




‘সাক্ষী’—স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর (“পঞ্চভূত (পৃথিবী বা ভূমি, জল বা বরুণ, বায়ু বা বাতাস, অগ্নি বা আগুন, আকাশ বা স্থান) লয়ে যে দেহ, সেইটি স্থূলদেহ। মন, বুদ্ধি, অহংকার আর চিত্ত, এই লয়ে সূক্ষ্মশরীর। যে শরীরে ভগবানের আনন্দলাভ হয়, আর সম্ভোগ হয়, সেইটি কারণ শরীর (এই পর্যায়েই পরমাত্মার সাথে আত্মার সমাপ্তি ঘটে এবং সর্বোচ্চ পুরুষের সন্ধান অর্থাৎ ঈশ্বরের সন্ধান শেষ হয়)।”~~শ্রীরামকৃষ্ণ) হতে পৃথক প্রত্যক্‌ আত্মা বা প্রত্যগাত্মা অর্থাৎ অন্তরস্থিত আত্মা—দৃক্ এব ভবতি—দ্রষ্টার স্বরূপেই থাকেন। ‘এব’ পদ দ্বারা—জীবাত্মা দৃশ্য হতে পারেন না—এই কথা বোঝানো হলো, এবং এই শ্লোক স্পষ্টতই জীবাত্মার দৃশ্যত্ব বারিত করে তাঁর দ্রষ্টাত্ব দৃঢ় করার জন্য বলছেন—’ন তু দৃশ্যতে’—(প্রত্যক্‌) আত্মা কখনোই দৃশ্য হন না। এখানে এই দ্বিতীয় ‘তু’ পদ দ্বারা এটাই সূচিত হচ্ছে যে, প্রত্যগাত্মা বা কূটস্থ (আত্মা) সবচাইতে ভেতরে অবস্থিত বলে এবং তার ভেতরে সেই কূটস্থকে দৃশ্য (object) করার মতো অন্য কোনো দ্রষ্টা নেই বলে, কূটস্থে যে দ্রষ্টাত্ব বিদ্যমান আছে, তা-ই চরম দ্রষ্টাত্ব।




এ কারণেই চোখে ও মনে যে আপেক্ষিক দ্রষ্টাত্ব বিদ্যমান, কূটস্থের পরম দ্রষ্টাত্ব তা হতে স্থায়ী ও দৃঢ়। এই শ্লোকের ভাবার্থ এই যে, সাক্ষীর বা কূটস্থের দৃশ্যত্ব কোনোভাবেই প্রমাণ করা যায় না, তাই কূটস্থ ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সকল কালেই দ্রষ্টা—দ্রষ্টাত্বই তার একমাত্র স্বরূপ।




প্রথম শ্লোকটি গ্রন্থপ্রতিপাদ্য সারবস্তু নির্দেশ করছে। ‘রূপম্ দৃশ্যম্’ অংশ নিয়ে বলছি। বস্তুর লাল, নীল, হলুদ প্রভৃতি যে-সকল রূপের কথা আমরা সবাই জানি, তারা ‘দৃশ্য’ এবং নিঃসন্দেহে দৃষ্টিবৃত্তির (দেখার বৃত্তি বা কাজ) পরিধিভুক্ত হতে পারে। এখন কথা হচ্ছে, সেই দ্রষ্টা কী প্রকারের, যা দ্বারা সেই রূপ ‘ব্যাপ্ত’ বা সম্বন্ধযুক্ত হয়?




‘লোচনং দৃক্’, অর্থাৎ যা লোচন বা দর্শনেন্দ্রিয় বা চোখ, তা-ই সেই দ্রষ্টা। রূপজ্ঞান চোখের সাথে "অন্বয়-ব্যতিরেক" নিয়মের বশবর্তী, অর্থাৎ রূপ-জ্ঞান থাকলে চোখ রূপ টের পাবে, রূপজ্ঞান না থাকলে চোখ রূপ টের পাবে না। রূপ সম্পর্কিত সেই জ্ঞান চোখে থাকে না, অন্তঃকরণে থাকে। চোখকে দ্রষ্টা বলার ফলে কিছু অস্পষ্টতা তৈরি হয়। চোখের সামনে যা দেখা যায়, তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঘট বা দেহ বা বস্তু বা দৃশ্য। রূপ-জ্ঞান না থাকলে তো রূপকে রূপ বলে চেনাই যায় না কিংবা রূপের প্রকৃতি বোঝা যায় না। মন যদি অন্যদিকে থাকে, তাহলে তো চোখের সামনে কী আছে, তা খেয়ালই করা যায় না। তাই রূপকে দৃশ্য হিসেবে নির্ধারণ করে যে-চোখ, তা দ্রষ্টা বলে মনে হলেও দ্রষ্টা মূলত অন্তঃকরণ (অহম্, বুদ্ধি, মন, স্মৃতি)।




তাই এই শ্লোক বলছেন, তদ্দৃশ্যং দৃক্ তু মানসম্—রূপের সাথে সম্বন্ধ ধরে যে-চোখকে দ্রষ্টা বলা হলো, তা-ও দৃশ্য, দ্রষ্টা নয়, কেননা ‘মানসম্’ বা অহম্-বুদ্ধি-স্মৃতি-যুক্ত মন বা অন্তঃকরণ সেই দর্শনেন্দ্রিয়েরও দ্রষ্টা বা অস্তিত্বের সাধকরূপে রয়েছে। মন সচেষ্ট বা ক্রিয়াশীল থাকলে, চোখ আছে ও কাজে প্রবৃত্ত হচ্ছে বুঝতে পারা যায়—সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রাবস্থায় অবস্থায় সেই মন না থাকায়, চোখ বা অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব ও প্রবৃত্তি বুঝতে পারা যায় না।




মনে হতে পারে, মনই জীবাত্মা। এমন ভাবনাও ভুল, এটা বোঝা যায় শ্লোকের দ্বিতীয় অংশ থেকে। দৃশ্যা ধীবৃত্তয়ঃ—অন্তঃকরণ ও তার বৃত্তিগুলোকেই এখানে ‘ধীবৃত্তি’ বলা হচ্ছে। এইসব বৃত্তিও দৃশ্য (object), দ্রষ্টা (subject) নয়। এদের সাক্ষী চিদাত্মা (চৈতন্যরূপ আত্মা বা জ্ঞানময় ব্রহ্ম [(সংস্কৃত) চিত্ + আত্মন্] হচ্ছেন দৃক্ বা প্রকাশক বা দ্রষ্টা। অন্তঃকরণ কীভাবে দৃশ্য হয়? দেখা যাক।




শ্রুতি (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ১/৫/৩) থেকে সাহায্য নিচ্ছি:




লোকে এমন বলে, আমি আনমনা ছিলাম, তাই দেখিনি; আমি আনমনা ছিলাম, তাই শুনিনি। (ইন্দ্রিয় ও অর্থের সান্নিধ্য এবং আত্মার উপস্থিতি থাকলেও রূপ, শব্দ ইত্যাদির জ্ঞান হয় না; সুতরাং মন নিঃসন্দেহে ইন্দ্রিয় ও আত্মা হতে পৃথক।) অতএব, মনেরই দ্বারা লোকে দর্শন করে এবং মনেরই দ্বারা শ্রবণ করে। কাম, অকাম, সঙ্কল্প, সংশয়, শ্রদ্ধা, অশ্রদ্ধা, ধৃতি, অধৃতি, লজ্জা, প্রজ্ঞা, ভয় ইত্যাদি সমস্তই মন। (এখানে মন ও বুদ্ধিকে এক ধরা হয়েছে।) মন আছে বলেই পেছন হতে কেউ ছুঁলেও লোকে মনের সাহায্যে বিবেক দিয়ে তা জানতে পারে। (দৃশ্যমান জগত থেকে অদৃশ্য ব্রহ্মকে আলাদা করার ক্ষমতা, অর্থাৎ অভিজ্ঞতাগত জগৎ থেকে আত্ম বা আত্মাকে বোঝার ক্ষমতাই বিবেক। ত্বকের দ্বারা শুধু স্পর্শবোধ হয়; কিন্তু মন বুঝতে পারে—এটা হাতের স্পর্শ, এটা হাঁটুর স্পর্শ ইত্যাদি। বিবেকের এমন বিচারের জন্য মনের তাৎক্ষণিক উপস্থিতি থাকতেই হবে।)




এতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, মনের অস্তিত্বও অন্য দ্রষ্টার অধীন। এই মনের যে দ্রষ্টা, তা ‘সাক্ষী দৃক্ এব’ বা সাক্ষীই বা কূটস্থ চৈতন্যই এবং ‘ন তু দৃশ্যতে’ বা তা কিন্তু (কখনোই) দৃশ্য হয় না; তারও দৃশ্যত্ব স্বীকার করতে গেলে, অনবস্থা দোষ (প্রস্তাবের অ-অন্তিমতা বা বিবৃতির অন্তহীন ক্রম বা অসীম প্রত্যাবর্তন) ঘটে, অর্থাৎ দৃশ্য-দ্রষ্টা ধারার উপপত্তি বা বিশ্রান্তি হয় না। আর শেষে পৌঁছে একটা স্বতঃসিদ্ধ বস্তু স্বীকার না করলে ‘জগদান্ধ্যং প্রসজ্যেত’ বা ‘জগদান্ধ্য দোষের উদ্ভব হয়’, অর্থাৎ সমস্ত জগৎ অন্ধভাবে চালিত হচ্ছে, এরকম একটা অসংগতি দোষের উদ্ভব হয়।




তাই দ্রষ্টা-দৃশ্য বিষয়ে চরম দ্রষ্টার অনুসন্ধান, অস্বীকারের বৈদিক বিশ্লেষণের পদ্ধতি ‘নেতি নেতি’-এর মাধ্যমে সেই পর্যন্ত করতে হবে, যে পর্যন্ত না স্বপ্রকাশরূপে অন্যনিরপেক্ষ বা অনপেক্ষ স্ব-রূপের উপলব্ধি হয়। এই হেতু সাক্ষী বা কূটস্থ চৈতন্যই দ্রষ্টা, তিনি অন্য কারও দৃশ্য নন। যাকে বাদ দিলে যে-বস্তুর দ্রষ্টাত্ব সংগত হয় না, সেই দুইটি একই বস্তু; যেমন আগুন ও তার উষ্ণতা বা দহনকারিতা একই বস্তু। যে-বস্তু নিজের স্বভাবগত প্রকাশ দ্বারা রূপ বা ঘট পর্যন্ত সকলেরই দ্রষ্টা, মন ও চোখ (বা অন্যান্য ইন্দ্রিয়) তেমন দ্রষ্টা নয়। জল, লোহা প্রভৃতি বস্তুতে আগুনের আবেশবশত যেমন উষ্ণতার আরোপ হয়, তেমনি সাক্ষিচৈতন্যের আবেশবশত অন্তঃকরণে দ্রষ্টাত্বের আরোপ হয়।




এ কারণেই অন্তঃকরণ তথা মন হতে আরম্ভ করে রূপ বা বিষয় পর্যন্ত সকলই দৃশ্য—এটা নিশ্চিত জেনে কেবল চৈতন্যস্বরূপ অন্তরাত্মা বা জীবাত্মা, যা যাবতীয় দৃশ্যবস্তু হতে বিলক্ষণ বা পৃথক এবং সকল দৃশ্যের উপর দ্রষ্টা রূপে অনুস্যূত বা সম্পর্কযুক্ত, তাঁর স্বরূপ বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৩/৪/১-২ শ্লোকে এভাবে ব্যাখ্যা করছেন:




অতঃপর উষস্ত চাক্রায়ণ এঁকে প্রশ্ন করলেন। তিনি বললেন, “যাজ্ঞবল্ক্য, যিনি সাক্ষাৎ অপরোক্ষ (যা দৃশ্য নয় এবং উপলব্ধি করা যায় না, অর্থাৎ স্বজ্ঞালব্ধ; প্রমাণ, সাক্ষ্য, সচেতন যুক্তি বা কীভাবে জ্ঞান আহরিত হলো, তা জানা ছাড়াই জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতাকে স্বজ্ঞা বলে।) ব্রহ্ম, যিনি সর্বান্তর আত্মা (মানে, প্রত্যগাত্মা ও ব্রহ্ম অভিন্ন), তাঁর বিষয় আমার নিকট বিশেষরূপে বলুন।” “সর্বান্তর ইনিই আপনার আত্মা।” “যাজ্ঞবল্ক্য, কোন আত্মাটি সর্বান্তর?” (দেহ বা স্থূল শরীর, দেহমধ্যস্থ লিঙ্গশরীর বা সূক্ষ্ম শরীর বা মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার এবং যিনি সন্দিহ্যমান (যে-বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়) তৃতীয় (কারণ শরীর), এদের মধ্যে কোনটি সর্বান্তর আত্মা?” “যিনি প্রাণের (অভ্যন্তরীণ গতিশীল শক্তির) দ্বারা প্রাণক্রিয়া করেন, সর্বান্তর তিনিই আপনার আত্মা; যিনি অপানের (বাহ্যিক গতিশীল শক্তির) দ্বারা অপানক্রিয়া করেন, সর্বান্তর তিনিই আপনার আত্মা; যিনি ব্যানের (শক্তির সঞ্চালনের) দ্বারা ব্যানক্রিয়া করেন, সর্বান্তর তিনিই আপনার আত্মা; যিনি উদানের (মাথা ও গলার শক্তির) দ্বারা উদানক্রিয়া করেন, সর্বান্তর তিনিই আপনার আত্মা। সর্বান্তর ইনিই আপনার আত্মা। (চেতনের দ্বারা অধিষ্ঠিত না হলে কার্যকারণ সঙ্ঘাতের প্রাণক্রিয়াদি হয় না; অতএব আত্মা মূলত সঙ্ঘাত-বিলক্ষণ এবং চেতন, এই দুই বৈশিষ্ট্যের বিজ্ঞানময় সত্তা বা বুদ্ধি (চেতন) এবং পঞ্চেন্দ্রিয়ের (সঙ্ঘাত-বিলক্ষণ) সংমিশ্রণ।)




উষস্ত চাক্রায়ণ বললেন, “কেউ যেমন প্রতিজ্ঞার (প্রতিজ্ঞা বা Proposition হলো সত্য বা মিথ্যার অ-ভাষিক (ভাষাভেদে যার গঠন ভিন্ন হলেও প্রতিটি গঠনই একই ভাবার্থ প্রকাশ করে) বাহক, যা সত্য বা মিথ্যাকে প্রকাশ করে, এমন কোনো বাক্য তৈরি করে।) অননুরূপভাবে বলে, ‘গরু এরকম, ঘোড়া এরকম’, আপনার এই বিপরীত নির্দেশটিও তেমন হলো।” আরও ভেঙে বললে: কেউ গরু বা ঘোড়ার সুস্পষ্ট পরিচয় দেবে বলে যদি পরে বলে, “যে হাঁটে, সে গরু”, বা “যে দৌড়ায়, সে ঘোড়া”, তবে চলার ধরন উল্লেখ করে এরূপ পরোক্ষ পরিচয়প্রদান যেমন প্রতিজ্ঞার অননুরূপ হয়, তেমনি আপনি সরাসরি আত্মার পরিচয় না দিয়ে প্রাণক্রিয়াদি অবলম্বনে যে-পরিচয় দিলেন, তা ঠিক হলো না।




“যিনি সাক্ষাৎ অপরোক্ষ ব্রহ্ম, যিনি সর্বান্তর আত্মা, তাঁরই কথা আমায় বিশেষরূপে বলুন।” “সর্বান্তরবর্তী ইনিই আপনার আত্মা।” অর্থাৎ, আমি যে-উত্তর দিয়েছি ওটাই ঠিক। গরু, ঘোড়া ইত্যাদিকে যেমন সাক্ষাৎ জ্ঞানের বিষয় করানো চলে, তাই ওদের নিয়ে সরাসরি বলা যায়, আত্মাকে তেমন কিছু করানো চলে না; কারণ যে দর্শন-শ্রবণাদির দ্বারা বিষয়জ্ঞান হবে, আত্মা সেই দর্শনাদিরই স্বরূপ। সুতরাং তাঁকে আপনি কীসের দ্বারা দেখবেন বা শুনবেন?




(স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, “এই আত্মা কী? আমরা দেখিয়াছি যে, ইহা বুদ্ধিরও অতীত। কঠোপনিষদ্ হইতে আমরা জানি যে, এই আত্মা অনাদি অপরিবর্তনীয় সর্বগ; তুমি, আমি এবং আমরা সকলের মধ্যেই সর্বত্র বিদ্যমান। এই সর্বগ (সর্বত্রগামী, সর্বব্যাপী) আত্মা এক ও অদ্বিতীয়। দুইটি সত্তা সমভাবে সর্বগ হইতে পারে না—ইহা কীরূপে হইতে পারে? দুইটি সত্তা অনন্ত হইতে পারে না, এবং ফলে প্রকৃতপক্ষে একটি মাত্র আত্মাই আছেন, এবং তুমি, আমি ও সমগ্র বিশ্ব এক, শুধু বহু বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছি। ‘যেমন একই অগ্নি বিশ্বে প্রবেশ করিয়া নানাভাবে প্রকাশ পাইতেছে, তেমনি অদ্বিতীয় সর্বান্তরবর্তী আত্মা প্রতি জীবদেহে প্রতিভাত হইতেছেন।’ কিন্তু প্রশ্ন এই: যদি এই আত্মা পূর্ণ ও শুদ্ধ, এবং বিশ্বের একমাত্র সত্তা হন, তাহা হইলে অশুদ্ধ শরীরে, পাপীর দেহে, পুণ্যবানের দেহে এবং অন্যত্র প্রবেশ করিলে ইঁহার কী গতি হয়? কীরূপে ইহা পূর্ণ থাকিতে পারেন? একই সূর্য প্রতি চক্ষুতে দৃষ্টির হেতু, তথাপি কাহারও চক্ষুর দোষ সূর্যকে স্পর্শ করে না। কাহারও ‘ন্যাবা’ (জন্ডিস) হইলে সে সব জিনিসই হরিদ্রাভ দেখে। তাহার দৃষ্টির হেতু সূর্য, কিন্তু তাহার সব জিনিসকে পীতাভ দেখার রোগ সূর্যকে স্পর্শ করে না। ঠিক তেমনি এই একমেবাদ্বিতীয়ম্ যদিও প্রত্যেকের আত্মা, তথাপি বাহিরের শুচি-অশুচি ইঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। এই অনিত্য বিনাশশীল পৃথিবীতে যিনি নিত্য আত্মাকে জানেন, এই জড়জগতে যিনি চৈতন্যস্বরূপকে জানেন, এই বিচিত্র জগতে যিনি অখণ্ড আত্মাকে জানেন এবং নিজের মধ্যে দেখেন, তাঁহারই শাশ্বত সুখ, অন্য কাহারও নহে। সেই পরমাত্মা ব্রহ্মকে সূর্য প্রকাশ করে না, চন্দ্র ও তারকা প্রকাশ করে না, বিদ্যুৎও প্রকাশ করে না, অগ্নি আবার কীরূপে প্রকাশ করিবে? তিনি দীপ্তিমান বলিয়া সবই দীপ্তিমান, তাঁহার জ্যোতিতে এই সবই জ্যোতির্ময়। যখন হৃদয়ের সকল বাসনা দূরীভূত হয়, তখনই মানুষ অমর হয় এবং এই দেহেই ব্রহ্মানন্দ লাভ করে। যখন হৃদয়ের সকল গ্রন্থি ছিন্ন হয়, হৃদয়ের সকল বক্রতা দূরীভূত হয়, সকল সন্দেহের নিরসন হয়, তখনই মানুষ অমৃতত্ব লাভ করে। ইহাই পথ।”)




“যাজ্ঞবল্ক্য, কোনটি সর্বান্তর?” “দৃষ্টির দ্রষ্টাকে কেউ দেখতে পারেন না; শ্রবণের শ্রোতাকে কেহ শুনতে পারেন না; মনোবৃত্তির মননকারীকে কেউ ভাবতে পারেন না; বুদ্ধিবৃত্তির বিজ্ঞাতাকে কেউ জানতে পারেন না। সর্বান্তর ইনিই নিজের আত্মা; এ ছাড়া বাকি সব‌ই বিনাশী।”




দৃষ্টি দুই প্রকার: লৌকিক ও পারমার্থিক। চোখের সাথে সংযুক্ত অন্তঃকরণবৃত্তি-বিশেষকে লৌকিকদৃষ্টি বলে। লৌকিকদৃষ্টি বিষয়াকারে রঞ্জিত হয়, অর্থাৎ একেক দৃশ্য একেক দৃশ্যপটের জন্ম দেয়। এর উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। এটি পারমার্থিক দৃষ্টির সাথে সংসৃষ্ট বা সম্পর্কযুক্ত আছে বলে বোধ হয়। বস্তুত এটি পারমার্থিক বা আত্ম-দৃষ্টিরই প্রতিচ্ছায়ামাত্র এবং আত্মদৃষ্টির দ্বারাই এটি ব্যাপ্ত (শর্তহীন এবং ধ্রুবকরূপে সহগামী) হয়। আত্মদৃষ্টি কিন্তু আত্মারই স্বরূপ; এর উৎপত্তি বা বিনাশ নেই। সুষুপ্তিতে তিনি যে দেখেন না (বলে মনে হয়), তখন তিনি (বস্তুত) দেখেও দেখেন না; কারণ (দ্রষ্টা) অবিনাশী বলে দ্রষ্টার দৃষ্টির বিনাশ নেই; পরন্তু তিনি হতে আলাদা আকারে বিভক্ত সেই দ্বিতীয় বস্তু থাকে না, যা তিনি দেখবেন।




আগুন ও আগুনের প্রকাশ যেমন অভিন্ন, তেমনি আত্মা ও আত্মার জ্যোতি অভিন্ন। বস্তুত দ্রষ্টা হচ্ছেন কূটস্থ দৃষ্টি। সূর্য ও তাঁর প্রকাশ অভিন্ন হলেও লোকে যেমন বলে, সূর্য প্রকাশ করেন, তেমনি জ্ঞানরূপী দ্রষ্টা আত্মা এবং তাঁর দৃষ্টি বা চৈতন্য অভিন্ন হওয়ায় তিনি দর্শন-ক্রিয়ার কর্তা না হলেও বলা হয়, আত্মা দর্শন করেন। অবিদ্যাবস্থায় (না জানা, অনুধাবন করা, না বোঝা) জাগরণ ও স্বপ্নে যখন দ্বৈতবস্তুর বোধ হয়, তখন আত্মার বিশেষজ্ঞান হয় বলে মনে হয়; কিন্তু সুষুপ্তিতে তিনি পরমাত্মার সাথে একত্ব প্রাপ্ত হলে দ্বৈতভাব প্রতিরুদ্ধ হওয়ায় তিনি স্বয়ংজ্যোতি হয়েও বিশেষজ্ঞানশূন্য হন। (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ৪/৩/২৩)




চাঁদের নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের আলোতেই চাঁদ আলোকিত। সূর্য ডুবলে যখন চাঁদ আলো দেয়, তখন আমরা ওটাকে বলি ‘চাঁদের আলো’, যদিও তার মূল উৎস সূর্য। চাঁদের সাথে জগতের সম্পর্ক তাই দ্রষ্টা-দৃশ্য প্রকৃতির, চাঁদের সাথে সূর্যের সম্পর্ক দৃশ্য-দ্রষ্টা প্রকৃতির। এক‌ই চাঁদ এক ধাপে দৃশ্য, আরেক ধাপে দ্রষ্টা। সূর্য আলোর স্বাধীন বা অনপেক্ষ আধার, তাই সূর্য সকল পরিস্থিতিতেই দ্রষ্টা। মজার ব্যাপার, সূর্য চাঁদকে আলো দেয় মনে হলেও, সূর্য আসলে ‘আলো দান করার’ কাজটি সচেতনভাবে করেই না, সূর্যের প্রকৃতিই এমন। সূর্য স্বয়ংজ্যোতি, নিজেই আলো এবং আশেপাশের সব কিছুই আলোর ধর্মের কারণেই আলোকিত হয়, সূর্য এখানে সচেতন বা সগুণ (আলো দান করার গুণ বা বৈশিষ্ট্য-যুক্ত) কর্তা নয়। সূর্যের সাথে কূটস্থ চৈতন্যের সাযুজ্য খুঁজলে বুঝতে সহজ হয়।




প্রদীপ যেমন লৌকিক বা প্রত্যক্ষ বা ব্যাবহারিক জ্ঞানের দ্বারা প্রকাশ্য, অথচ নিজে ওই জ্ঞানকে প্রকাশ করতে পারে না, তেমনি লৌকিক দৃষ্টি আত্মদৃষ্টির দ্বারা উদ্‌ভাসিত হলেও আত্মদৃষ্টি ‘সাক্ষীস্বরূপ’ লৌকিক দৃষ্টিকে প্রকাশ করতে পারে না। লৌকিক দৃষ্টির সাথে সম্পর্ক ঘটে বলে, অর্থাৎ লৌকিক দৃষ্টি আত্মার দ্বারা ব্যাপ্ত হয় বলে, সাক্ষী আত্মাকে দ্রষ্টা, অদ্রষ্টা ইত্যাদি বলে মনে বোধ হয় যদিও বস্তুত তিনি ক্রিয়াহীন। বৃহদারণ্যকোপনিষদের ৪/৩/৭ শ্লোকে দেখি:




“আত্মা কোনটি?” “এ-ই, যিনি বুদ্ধিতে উপহিত (নিহিত), ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে অবস্থিত এবং বুদ্ধির অভ্যন্তরস্থ (স্বয়ং) জ্যোতিপুরুষ। তিনি (বুদ্ধির) সমানাকার হয়ে ইহলোক ও পরলোকের মধ্যে বিচরণ করেন এবং যেন ধ্যান করেন ও সচল হন, কারণ তিনি স্বপ্নে উপহিত বা নিহিত বা ধারণকৃত হয়ে অবিদ্যার বিবিধ পরিণামস্বরূপ সৃষ্ট এই (জাগ্রৎ-কালীন) জগৎকে অতিক্রম করেন।




আত্মা বুদ্ধির বিকার নন। আয়নায় প্রতিবিম্বিত আলো যেমন আয়নার আকার ও রং প্রাপ্ত হয়, বুদ্ধিতে উপহিত আত্মাও তেমনি বুদ্ধিসদৃশ হন। কাচের ভেতরের আলো যেমন কাচ ও তার চারপাশের বস্তুকে জ্যোতির্ময় করে, আত্মজ্যোতিও তেমনি বুদ্ধি, মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়কে সচেতনপ্রায় করে। লাল কাচে প্রতিফলিত আলোকে কাচের রক্তিমা হতে পৃথক করা যায় না। বুদ্ধির সাথে আত্মা এমন‌ই অভিন্ন হন। বুদ্ধিকে অবভাসিত বা অনুভব-বাহ্য করে আত্মা বুদ্ধি অবলম্বনে দেহেন্দ্রিয়-সঙ্ঘাতকেও অবভাসিত বা অনুভব-বাহ্য করেন, অর্থাৎ তাদের সামানাকার বলে প্রতিভাত হন। (দেহেন্দ্রিয়-সঙ্ঘাত হচ্ছে: ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে দেহ যা-কিছু করে)




আত্মায় ক্রিয়া না থাকলেও বুদ্ধিসাদৃশ্যবশত তাঁতে ক্রিয়া আরোপিত হয়। এভাবে বুদ্ধির সাথে তাদাত্ম্য বা অভেদের কারণে আত্মার স্বপ্ন এবং জাগরণ হয়। জাগরণে যিনি বুদ্ধিকে উদ্‌ভাসিত করেন এবং স্বপ্নেও যিনি জাগ্রদবস্থার অতীত হয়ে বুদ্ধিকে উদ্‌ভাসিত করেন, তিনি নিশ্চয়ই বুদ্ধি হতে ভিন্ন এবং কর্তৃত্বাদিশূন্য ও শুদ্ধ।




বাকি চারটি ইন্দ্রিয় সম্বন্ধেও এক‌ই বিষয় প্রযোজ্য। লৌকিক বোধ হতে পৃথক করে নিত্যবোধস্বরূপ আত্মাকে বুঝতে হবে। আত্মা সর্বান্তর, কূটস্থ ও নিত্যজ্ঞানস্বরূপ।




কেনোপনিষদের প্রথম খণ্ডের ৯টি শ্লোক ব্রহ্ম তথা পরম দ্রষ্টার সম্পর্কে যা জানাচ্ছেন, তা এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য:




শিষ্যের প্রশ্ন: আমাদের মন বিষয় হতে বিষয়ান্তরে যাচ্ছে। এটা কার ইচ্ছেয় হচ্ছে? কার দ্বারা হচ্ছে? প্রাণ-শক্তি কার দ্বারা নিযুক্ত হয়ে শরীর রক্ষা করে? আমরা যে কথা বলি, বাক্য উচ্চারণ করি, এটা কে বলায়? কথাগুলি কার অভিপ্রায় প্রকাশ করে?




আমাদের চোখ রূপ দেখে, আলোর সাথে তার যোগ। কান শব্দ শোনে, আলোতরঙ্গের সাথে তার কোনো যোগ নেই, শব্দতরঙ্গের সাথে তার যোগ। এই যে নিজ-নিজ বিষয়ে ইন্দ্রিয়গণের নিযুক্তি, এটা কে করল?




অথবা চোখের দেখার সাথে কানের শোনার যে একটা মিল আছে, তা কে ঘটায়? অনেক দিন আগে একজনকে দেখেছি। আজ তার আওয়াজ শুনে বুঝলাম, এটাই সেই দেখা লোকটির কণ্ঠস্বর। এই চোখের কাজের সাথে কানের কাজের মিল ঘটাল কে? এমন প্রত্যেকটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ই নিজ-নিজ বিষয়ে ঠিকভাবে টিকে থাকে, অথচ তাদের পরস্পরের সাথে যোগাযোগ আছে। এই কাজ কার কর্তৃত্বে সম্পন্ন হয়?




আচার্য শিষ্যের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন দ্বিতীয় মন্ত্র হতে। আচার্য বলছেন, একটি পরম বস্তু আছে, যা কানের‌ও কান, মনেরও মন, বাক্যেরও বাক্, প্রাণেরও প্রাণ, চোখের‌ও চোখ। সেই বস্তুটি হচ্ছে চৈতন্য।




কানের যে শব্দ চেনার ক্ষমতা, তা আত্মচৈতন্যে আছে বলেই সম্ভব। মনের যে স্বকীয় বিষয়ে সংকল্প বা অধ্যবসায়, তা আত্মচৈতন্যে বিদ্যমান আছে বলেই সম্ভব। বাক্যের যে শব্দোচ্চারণ-সামর্থ্য, তা-ও আত্মচৈতন্যের সত্তা আছে বলেই সম্ভবপর। প্রাণ-শক্তির যে জীবন-রক্ষণ সামর্থ্য, তা আত্মচৈতন্য না থাকলে সম্ভব হতো না। চোখের যে রূপ-গ্রহণের সামর্থ্য, তা আত্মচৈতন্যে অধিষ্ঠিত বলেই স্থির আছে।




চোখ, কান, বাক্, মন, প্রাণ এরা সকলেই করণ। এই করণগুলির যে কাজে প্রবৃত্তি, এটা হচ্ছে যাঁর কর্তৃত্বে, তিনি চৈতন্য-সত্তা। কুঠার যে গাছ কাটে, তার কর্তৃত্ব কুঠারীর হাতে ন্যস্ত। তেমনি চোখ কান যে দেখে শোনে, প্রাণ যে জীবনধারণ করে, মন যে ভাবনা করে—এদের সকলের প্রকৃত কর্তৃত্ব আত্মচৈতন্যে নিহিত। ইন্দ্রিয়গণকে স্বকীয় বিষয়ে নিযুক্ত রাখে ও পরস্পরকে সংযুক্ত করে রাখে আত্মচৈতন্যই, অপর কেউ নয়।




এই চৈতন্যই ব্রহ্মবস্তু। একে যতদিন না জানা যায়, ততদিন ইন্দ্রিয়গণকে কর্তা মনে হয়। দেহ নিজেকে কর্তা মনে করে ‘আমি’ ও ‘আমার’ শব্দ প্রয়োগ করে। এই চৈতন্য-সত্তাকে জানেন যাঁরা, তাঁরা ধীর। বিক্ষেপ বা বিকারের হেতু থাকা সত্ত্বেও যাঁদের চিত্তে বিক্ষেপ বা বিকার হয় না, তাঁরা ধীর।




ধীর ব্যক্তি যখন চৈতন্য-সত্তাকে জানেন, তখন তাঁর অবস্থা কী হয়? পুত্র-মিত্রে, পত্নীতে-বন্ধুতে আমি-আমার ভাব দূর হয়ে যায়। সব ধরনের এষণা দূর হয়ে যায়। তখন তিনি অমৃতময় হয়ে যান। ইহকালেই অমরণ-ধর্মী হন, মৃত্যুঞ্জয় হন।




এষণা অর্থাৎ ইচ্ছা, বাসনা, কামনা—পুত্র-বিত্ত-ধনৈশ্বর্য লালসা ত্যাগ হলে মানুষ সিদ্ধ হয়। যে সিদ্ধ হয়, সে মৃত্যুর পর পরকালেও অমৃতত্ব লাভ করে।




শিষ্য এই ব্রহ্মের বিষয়ে আরও জানতে চান। আচার্য বলেন, ব্রহ্মের বিষয়ে উপদেশ প্রদান করা কঠিন। কারণ, ব্রহ্ম কারও বিষয় নন। ব্রহ্মের কাছে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়গণ যেতে পারে না। বাক্ যেতে পারে না, মনও যেতে পারে না। আগেই বলা হয়েছে যে, তিনি চোখেরও চোখ, মনেরও মন। মন অন্য সকল বিষয়ে সঙ্কল্প ও অধ্যবসায় করতে পারে, কিন্তু চৈতন্য-বিষয়ে পারে না; কারণ তিনি মনেরও আত্মা। ইন্দ্রিয় ও মনের দ্বারা সকল বস্তুর জ্ঞান হয়। যেখানে ইন্দ্রিয় ও মন যেতে পারে না, সে বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞান হবার উপায় কোথায়?




তবে কি ব্রহ্মের কথা শিষ্যগণের কাছে আচার্য কিছুই বলতে পারবেন না? কিছু পারবেন, কারণ প্রাচীন জ্ঞানীদের বলতে শুনেছি যে, ব্রহ্ম জ্ঞাত বস্তুগণের মধ্যে পড়েন না, আবার অজ্ঞাত বস্তুর মধ্যেও পড়েন না। ব্রহ্ম প্রত্যক্ষাদি জ্ঞানগম্য নন বলে বিদিত-বস্তুর মধ্যেও পড়েন না, কিন্তু তাই বলে ব্রহ্ম বিদিতের বিপরীত অবিদিত নন।




ব্রহ্মা প্রত্যক্ষাধিগম্য বা প্রত্যক্ষভাবে বোধ্য নন, কিন্তু আগমগম্য (সিদ্ধান্ত-শাস্ত্রের মাধ্যমে গম্য বা বোধ্য)। সেই আগম, আচার্য-পরম্পরায় প্রাপ্ত হওয়া যায়।
‘ব্রহ্ম’ বস্তুটি কী এবং তা কী নন, তা পঞ্চম হতে নবম মন্ত্র স্পষ্টতর করছেন। যে-বস্তু দ্বারা বাকের অভ্যুদয় হয়, বাকের প্রকাশ ঘটে, কিন্তু বাক্ দ্বারা সেই বস্তু অনভ্যুদিত বা অপ্রকাশিত—তা-ই চৈতন্যময়-ব্রহ্ম। 'ইদং' পদটি উচ্চারণ করে যে-বস্তুকে উপাসনা করা হয়, তা ব্রহ্ম নয়। যা জ্ঞানের বিষয়, তাকেই ‘ইদং’ বলা চলে। ব্রহ্ম জ্ঞানের বিষয় নন। যা বাক্যের আশ্রয়, জ্ঞানের আশ্রয়, তা-ই ব্রহ্ম। যে-বস্তু আছে বলে মনের মনন-সামর্থ্য, মন তাঁকে চিন্তা করতে পারে না। যে-বস্তু আছে বলে চোখের দর্শনশক্তি, চোখ তাঁকে দেখতে পারে না। যে-বস্তুর বিদ্যমানতায় কানের শ্রবণ-সামর্থ্য, কর্ণ তাঁর কথা শুনতে পায় না। যে-বস্তু দ্বারা প্রাণ প্রণীত হয় এবং নিজ বিষয়ের প্রতি যথাযথভাবে কার্যকরী হয়, প্রাণ তাঁকে বিষয়ীভূত করতে পারে না। সেই বস্তুই চৈতন্য, সেই বস্তুই ব্রহ্ম।




যে যার জন্মের কারণ, সে তাকে জানতে পারে না। পিতা-মাতার বিবাহ (‘যৌনসংগম’ অর্থে) সন্তানের বিদ্যমানতার অপরিহার্য কারণ। এজন্য পিতা-মাতার বিবাহের সাক্ষ্য দেবার সম্ভাবনা নেই কোনো সন্তানের। বিজ্ঞাতা-রূপে মূলে ব্রহ্ম-চৈতন্য আছে বলে ইন্দ্রিয়গণ ও অন্তঃকরণ নিজ-নিজ কাজ করছে। এজন্য তারা কেউ ব্রহ্ম-চৈতন্যের সংবাদ জানতে পারে না। ইন্দ্রিয় ও মন যে-বস্তুকে জানে, তা তাদের 'বিষয়' (object)। নিকট বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করেই ‘ইদং’ শব্দ ব্যবহার চলে। সুতরাং যা ইদং-পদের লক্ষ্য, তা ব্রহ্ম হতে পারে না। সূর্যের জ্যোতিই জগতের সকল বস্তুকে দর্শন-যোগ্য করে। সূর্য অস্ত গেলে কোনো বস্তুরই ক্ষমতা নেই যে সূর্যকে দেখাবে অথবা নিজেকে দেখাবে। চৈতন্যের জ্যোতিতেই ইন্দ্রিয়গণ, মন, প্রাণ, বুদ্ধি, সকলই প্রকাশিত। চৈতন্য-সত্তা যদি নিজে প্রকাশিত না হয়, তাহলে মন, প্রাণ, ইন্দ্রিয়-গণ কারও যোগ্যতা নেই তাকে দেখিয়ে দেবে বা নিজের সত্তাকে প্রকটিত করবে।




নিষ্কর্য বা সারকথা এই যে, ব্রহ্মবস্তু জ্ঞানের মূলাশ্রয়, কখনও জ্ঞানের বিষয় নয়। ব্রহ্মবস্তু চিৎস্বরূপ, কখনও ‘ইদম্’ পদবাচ্য নয়।