দৃগ্-দৃশ্য-বিবেক (প্রথম অংশ)

বেদান্ত বলে, আমাদের চারপাশের সবকিছুর মধ্যেই চৈতন্যের অসীম অধিষ্ঠান রয়েছে। এর কোনও সৃষ্টি, বৃদ্ধি ও বিনাশ নেই। চৈতন্যের আলো গিয়ে যেখানে পড়ে, সে জায়গাটা আলোকিত হয়ে ওঠে। এই যে আমাদের চারিদিকে এত মানুষ, গাছপালা, অন্যান্য প্রাণী এবং জড় বস্তু, এমনকী গ্রহ-তারা-নক্ষত্র-ছায়াপথ রয়েছে, তার সব‌ই প্রকৃতপক্ষে চৈতন্যের একেকটি আধার, যদি আমরা ওরকম করে দেখতে পারি বা বুঝতে পারি।




নিজের হৃদয়ের দিকে যখন গভীরভাবে তাকাই, তখন বুঝতে পারি, আমরা কেবলই দেহ ন‌ই, সূক্ষ্ম বিবেচনায়, আমরা মূলত আমাদের মন, চিন্তা, আবেগ, ধারণা, বিশ্বাস ও স্মৃতির সমন্বয়। বেদান্ত শেখায়, এই সবকিছু মিলেমিশে একটি অভিন্ন সত্তা হয়ে প্রতিভাসিত হয়, যার নাম চৈতন্য বা সচ্চিদানন্দ। অস্তিত্ব, চেতনা ও সুখ কিংবা সত্য, চেতনা ও আনন্দ এই চৈতন্যের প্রতিনিধিত্ব করে।




অজ্ঞতা ও জ্ঞান, জানা ও না জানা, দ্রষ্টা ও দৃষ্ট... এমন বিপরীত কিন্তু সহযোগী সত্তার মধ্যকার যে সেতু, তার নাম‌ই বেদান্ত। স্বামী বিবেকানন্দ প্রায়‌ই পাশ্চাত্যের লোকজনকে বলতেন, তুমি সত্যিই যা, তা যদি তুমি জানতে, অর্থাৎ তোমার নিজেকে অবিকল তোমার মতো করেই যদি জানতে পারতে, তবে দেখতে পেতে, তুমি আসলে চৈতন্যের এক মহাসমুদ্র বাদে আর কিছু ন‌ও। তোমার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট তখন দূর হয়ে যেত এবং তুমি নিজেকে নির্ভার অনুভব করতে, আর অন্তরস্থিত সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে পরম সুখাবস্থায় বাঁচতে পারতে। এই আত্মিক সুখপ্রাপ্তিই বেদান্ত এবং সকল ধরনের আধ্যাত্মিকতার মূলকথা।




বেদান্তের সমস্ত মূলকথা নিয়ে যে কয়েকটি ছোটো আকৃতির গ্রন্থ রয়েছে, সেগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে দৃগ্-দৃশ্য-বিবেক। অদ্বৈত-বেদান্তের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার বিদ্যারণ্য, মতান্তরে তাঁর শিক্ষক ভারতী তীর্থ এই গ্রন্থের রচয়িতা। গ্রন্থটির মোট দুইটি ভাষ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। একটি ব্রহ্মানন্দ ভারতীকৃত, অপরটি আনন্দগিরিকৃত। স্বামী নিখিলানন্দজি অনূদিত যে ইংরেজি ভার্সন থেকে আমি এই গ্রন্থটি পড়েছি, সেখানে ৪৬টি শ্লোক আছে। ওখান থেকে প্রথম ৭টি শ্লোক নিয়ে আমি আজ বলার চেষ্টা করছি।




১. যখন আমরা কোনও কিছু দেখি, শুনি, তার ঘ্রাণ বা স্বাদ নিই, কিংবা তাকে অনুভব করি, তখন তা সম্পর্কে আমাদের মনে একটা ধারণার সৃষ্টি হয়। ঘুমন্ত অবস্থায় এটি ঘটে না। এক‌ই বিষয় নিয়ে সবার মনেই কি অভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হয়? না, হয় না। কেন হয় না? কারণ একেক মানুষের বুদ্ধি, বোঝার ক্ষমতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস একেক রকমের। মন যতটুকু গ্রহণ বা বর্জন করল, তার কতটুকু থেকে যাবে বা চলে যাবে, তা ঠিক করে দেয় আত্মা বা বোধ। এটাই সর্বোচ্চ স্তর। দৃষ্টের যাত্রা এখানেই শেষ। এর পরে যাবার আর জায়গা নেই। ইন্দ্রিয় শুরুতে যা গ্রহণ করল, তা যদি আমাদের বোধের স্তরে এসে মেশে, তবে আমাদের ভেতরের আমি এবং শুরুর সেই বস্তু বা দৃষ্ট... এই দুই মিলে এক হয়ে যায়। এভাবে করেই দৃষ্ট বা বস্তু পুরোপুরি মিশে লীন হয়ে যায় চেতনা বা বিবেকের সাথে। যাকে জানা হলো এবং যে তা জানল... এই দুইয়ের সমন্বয়ে চৈতন্যের জাগরণ হয়।




পুরো প্রক্রিয়াটিতে, প্রথম ধাপের দ্রষ্টা হচ্ছে চোখ, নাক, কান, জিভ বা ত্বক, কিংবা এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের যে-কোন‌ও ধরনের সমন্বয়। একটি আম আস্বাদনের সময় চারটি বা পাঁচটিই ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে, আবার দূর থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক অনুভব করতে কেবল কানই ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয় ধাপের দ্রষ্টা হচ্ছে আমাদের মন। মন যদি থাকে অন্যদিকে বা অন্য কোথাও, তবে প্রথম ধাপ পেরিয়ে দৃষ্ট বা বস্তু আর পরের ধাপে পৌঁছায় না। যখন আমরা বলি, “খেয়াল করতে পারিনি!”… তখন আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয় ওখানে থাকলেও মনটা ছিল অন্য কোথাও। তৃতীয় ও শেষ ধাপের দ্রষ্টা হচ্ছে আমাদের চৈতন্য। দীর্ঘসময় পর গিয়েও যা টিকে থাকে, তা দৃষ্ট বা দ্রষ্টা কোনোটিই নয়, বরং এই দুইয়ের একটি একীভূত অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা বা চেতনাবোধ। এখান থেকেই জন্ম হয় অভ্যাস, বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের।




বর্তমান সময়ে অদ্বৈত-বেদান্তের সবচাইতে বিখ্যাত বক্তা স্বামী সর্বপ্রিয়ানন্দজির মতে, প্রথম শ্লোকটিই সবচাইতে বেশি গুরুত্ব বহন করে।




২. আমরা বস্তু বা দৃষ্টের যে আকার বা রূপ প্রত্যক্ষ করি, তা লাল-সবুজ-নীল ইত্যাদি রঙে, ক্ষুদ্র বা বৃহৎ পরিসরে, হ্রস্ব বা দীর্ঘ আকৃতিতে, সূক্ষ্ম বা স্থূল অবয়বে আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ধরা দেয়। ওদের এরূপ বৈচিত্র্য থাকলেও প্রথম ধাপের দ্রষ্টা, অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে ও পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার পঞ্চইন্দ্রিয়ের কোনোরূপ বৈচিত্র্য নেই, বরং সেগুলি ধ্রুব ও অপরিবর্তনীয় হয়েই থেকে যায়। আমরা যা উপলব্ধি বা প্রত্যক্ষ করি, তা স্থান ও সময়ভেদে একেক রকমের হলেও এক‌ই ব্যক্তির বেলায় প্রথম ধাপের দ্রষ্টা, অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয় অপরিবর্তনীয় হিসেবে পরিগণিত হয়।




একটু ভেঙে সহজ করে বলি। যদি কেউ ধরে নেয়, সাপ, লাঠি, জলের বা বিদ্যুতের লাইন, মালা ইত্যাদি দেখতে বা অনুভব করতে দড়ির মতন, তবে সবশেষে তার চৈতন্যে যে বোধটি টিকে থাকবে, তা হচ্ছে সে দেখেছে বা অনুভব করেছে দড়িসদৃশ কোনও বস্তু। যদি সে দড়ির জায়গায় সাপকে মূল বা ভিত্তি হিসেবে রাখে, তবে অবশেষে সাপের বোধটিই টিকে থাকবে। মূল বা ভিত্তির উপর নির্ভর করেই দ্রষ্টার চৈতন্য বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের জন্ম দেয়। তাই এই মূল বা ভিত্তির যে ধারণা, তার জন্মের উপরই নির্ভর করছে ব্যক্তির সকল আদর্শ এবং সমগ্র জীবনাচরণ।




রামকৃষ্ণের সেই সুন্দর-অমোঘ-শাশ্বত উচ্চারণ... "যত মত, তত পথ।"... আমি মনে করি, এটিই সব চৈতন্যের মূলকথা। যে তার মতে দড়ি রেখেছে, তার চলার পথ, … যে তার মতে সাপ রেখেছে, তার চলার পথের অনুরূপ কিছুতেই নয়। তাই মূল বা ভিত্তি মতের সতর্ক নির্বাচন চৈতন্যের জাগরণপ্রক্রিয়ায় খুবই জরুরি। যার যতটুকু ভাব, তার ততটুকু লাভ।




৩. এখন ধরা যাক, প্রথম ধাপের দ্রষ্টা, অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা ও অবস্থা অপরিবর্তনীয় নয়। বোঝার সুবিধার্থে চোখের কথাই ধরি। অন্ধ-চোখ যা দেখে, সুস্থ-চোখ কি ঠিক তা-ই দেখে? তীক্ষ্ম দৃষ্টিশক্তির মানুষ যা দেখে, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির মানুষ কি ঠিক তা-ই দেখতে পায়? টগবগে তরুণের দেখার ইচ্ছে বা ক্ষমতা যতটা, ক্লান্ত-জীর্ণ বৃদ্ধের দেখার ইচ্ছে বা ক্ষমতা কি ঠিক ততটাই? নিশ্চয়ই নয়! তা যদি না হয়, তবে যা দেখা হচ্ছে, তার ধরন সম্পর্কে উদ্‌ভূত বোধটি দ্বিতীয় ধাপের দ্রষ্টা, অর্থাৎ মনের কাছে গিয়ে ব্যক্তির অবস্থা ও অবস্থানভেদে স্বাভাবিকভাবেই বদলে যাবে।




অন্ধ লোকটি ভাবে, "আমি যে অন্ধ!” ... সুস্থ লোকটি ভাবে, "আমি তো দেখতে পাই!" ... তাই দুই জনের উপলব্ধি নিশ্চয়ই দুই রকমের হবে। মনকে যদি অপরিবর্তনীয় রেখেও দিই, তবু প্রথম ধাপের দ্রষ্টার পরিবর্তনের কারণে দ্বিতীয় ধাপের দ্রষ্টা, অর্থাৎ মনে সৃষ্ট চিত্র একেক রকমের হবে।




প্রথম ধাপের দ্রষ্টা চোখ এখানে নিজেই বস্তু বা দৃষ্ট, যা অপরিবর্তনীয় নয়। দ্বিতীয় ধাপের দ্রষ্টা মন এখানে অপরিবর্তনীয়। চোখের জায়গায় কান, নাক, জিভ বা ত্বকের কাজ বিবেচনায় আনলেও এক‌ই অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়।




৪. দ্বিতীয় ধাপের দ্রষ্টা মন কিন্তু তৃতীয় ও শেষ ধাপের দ্রষ্টা চৈতন্যের জন্য বস্তু বা দৃষ্ট হিসেবে কাজ করে। মনে যে ছবি আঁকা হয়, তা পরের ধাপের জন্য ইনপুট। এক্ষেত্রে তাই চৈতন্য‌ই অপরিবর্তনীয়, মন নয়।




চৈতন্যের ঘরে যখন মন প্রবেশ করে, তখন চৈতন্য মনকে নানান দিক থেকে উদ্দীপ্ত ও জাগ্রত করতে পারে। কীরকম? এই যেমন,




মনের মধ্যে ইন্দ্রিয়সুখের তাড়না বা আকাঙ্ক্ষা জাগতে পারে।




প্রথম ধাপের দ্রষ্টা, অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয়ের যে-কোনোটি বা তাদের সুসংহত সমন্বয় বস্তু বা দৃষ্ট সম্পর্কে যে অনুভূতির জন্ম দেয়, তা নিয়ে নিশ্চিতাবস্থা কিংবা সংশয় মনে তৈরি হতে পারে।




কর্মফল এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে মনে একধরনের প্রত্যয়ের উৎপত্তি কিংবা উৎপাদন করার সংকল্প কখনও কখনও দেখা যায়।




মানুষ যখন শারীরিক বা অন্য কোনও কারণে ক্লান্ত থাকে, তখনও তাকে মানসিক শক্তি পরিচালিত করতে পারে, যদি সে তা উৎপন্ন করতে সক্ষম এবং অনুপ্রাণিত হয়। আবার এমনও হতে পারে, মানসিক শক্তির অভাবে অফুরন্ত শারীরিক শক্তিকেও সে কিছুতেই কাজে লাগাতে পারছে না।




বিনয়, বুদ্ধিমত্তা, বোধশক্তি, সম্ভ্রম, সংবেদনশীলতা, নেতৃত্বগুণ, প্রজ্ঞা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ধারণক্ষমতা, চেতনাবোধ, সহনশীলতা, ভাবনাশক্তি, প্রতিভা, সৃজনশীলতা, স্মৃতিশক্তি, সংকল্প, জীবনতৃষ্ণা, ত্যাগাকাঙ্ক্ষা, অনুরাগ-সহ বিভিন্ন ধরনের প্রেরণা ও প্রেষণার উদ্‌ভব মনের মধ্যে ঘটে, যা চৈতন্যের জাগরণে মুখ্য ভূমিকা রাখে।




৫. এই শ্লোকে চৈতন্য কী, তা বলা হয়েছে।




চৈতন্য হচ্ছে আমাদের মধ্যে যা যা পরিবর্তন ঘটে চলেছে, সেগুলির এক চিরন্তন অবিনশ্বর দলিল। এর কোনও জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। যা আগে কখনোই ছিল না, তার জন্ম হ‌ওয়া সম্ভব, কিন্তু চৈতন্য সবার মধ্যেই সুপ্তাবস্থায় থাকে বিধায় এর কেবলই জাগরণ আছে, কোনও জন্ম নেই। যা আগে কখনোই ঘটেনি, যার অস্তিত্ব আগে কখনোই ছিল না, চৈতন্য তার‌ও নির্ভুল সাক্ষ্য দেয়। যদি এমন হতো যে চৈতন্যের জন্ম হয়, তবে তা মানুষের মধ্যে বোধের সৃষ্টি করতে পারত না, কেননা বোধের অনস্তিত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত হ‌ওয়ার ফলে বোধের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা সত্ত্বেও চৈতন্য তাকে বোধ বলেই চিনতে পারত না। আমাদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত অভ্যাস ও অনভ্যাস এবং তার সাথে দ্বিতীয় ধাপের দ্রষ্টা মনে উদ্‌ভূত কোন‌ও আকস্মিক ভাবের মিলন... এই দুইয়ের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব দুটোই চৈতন্য উপলব্ধি করতে পারে। তাই বলা যায়, চৈতন্যের জন্ম নেই, শুধুই সুপ্তাবস্থা থেকে জাগরণ আছে।




চৈতন্যের মৃত্যুও নেই, কেননা এই যে মন বুঝতে পারে, আমাদের অন্তরস্থিত কোনও সত্তার মৃত্যু ঘটছে, চৈতন্য সেই সত্তার জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও বিনাশের সাক্ষ্য দেয় বলেই মন তা স্পষ্ট করে ধরতে সক্ষম হয়। নতুবা কোনও একটি অস্তিত্বের অনস্তিত্বে বিলীন হয়ে যাওয়া কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়া, এর কোনও কিছু নিয়ে মন ভাবতেই পারত না। চৈতন্য‌ই এখানে নীরব সাক্ষী।




এক চৈতন্য বাদে জগতের সকল উপলব্ধ সত্তারই জন্ম, অস্তিত্ব, বৃদ্ধি, পরিবর্তন, ক্ষয় ও বিনাশ আছে। আগেই বলেছি, চৈতন্যের জন্ম নেই, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই চৈতন্যের ক্ষয়ও হয় না। যার জন্ম ও ক্ষয় নেই, তার বেলায় বাকি চারটি বৈশিষ্ট্যের আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। চৈতন্য একটি সামগ্রিক সত্তা, যাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাঙা কিংবা ছড়িয়ে রাখা যায় না। আমরা যখন স্বামীজির ভাবাদর্শের কথা ভাবি এবং বলি, তখন আমরা স্বামীজির সমগ্র জীবন, কাজ ও আদর্শ আমাদের মধ্যস্থিত দ্রষ্টাসমূহের চূড়ান্ত ধাপে, তথা চৈতন্যে জাগ্রত ও প্রোথিত তেজ বা প্রেরণার অখণ্ডতায় ধারণ করি। এই অখণ্ডতাই চৈতন্যের প্রাণ।




চৈতন্য নিজের দীপ্তিতেই উজ্জ্বল। কার‌ও সাহায্য ছাড়া, কার‌ও মুখাপেক্ষী না হয়েই চৈতন্য বা আত্মা বরং নিজেই তার চারপাশের সবকিছুকে আলোকিত করে তোলে, উজ্জ্বল করে তুলে ধরে। চৈতন্যের জাগরণ যার মধ্যে হয়, শান্ত-স্থির মন নিয়ে তার কাছাকাছি থাকলেও একধরনের তীব্র জ্যোতির ধারা অনুভব করা যায়, নিজের মাঝে অনির্বচনীয় শান্তি অনুভূত হয়।




৬. বুদ্ধি হলো চৈতন্যের পুনঃপ্রতিফলন। চৈতন্যকে বস্তুগত কোনও কিছু দিয়েই প্রকাশ করা যায় না। তাই চৈতন্য স্বয়ংপ্রভ হলেও এর কোনও বাহ্যিক প্রকাশ থাকা সম্ভব নয়। যখন চৈতন্যের উপর অজ্ঞতার স্তর পড়ে, তখন চৈতন্য ধীরে ধীরে কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আগের ধাপ, অর্থাৎ মন-এ ফিরে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, এই সুপ্তাবস্থা থেকে পুনরুত্থান হয় কী করে? মন যদিও জড় পদার্থ, তবু মনের সাথে চৈতন্য বা আত্মার সংযোগ ঘটলে মন একসময় সচল হয়ে আপনাআপনিই উপরের স্তরে উঠে যায়। আত্মা যখন অন্তঃকরণের সাথে মিলে যায়, তখন জন্ম হয় বুদ্ধির। বুদ্ধির সাথে চৈতন্যের এমন সংযোগে সৃষ্টি হয় ইচ্ছের ও প্রেষণার।




বুদ্ধিমত্তা বা ধীশক্তি হচ্ছে আমাদের অভ্যন্তরীণ একটি সত্তা, যা সময়ে সময়ে নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বদলে যায়। বুদ্ধির সাথে যখন কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার মিলন হয়, তখন জন্ম হয় অহংবোধের। এই বুদ্ধিই আরেক ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। বাহ্যিক নানান জ্ঞান ও বিদ্যা যখন বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধ ও গৃহীত হয়, তখন তাকে বলা হয় স্মৃতি। বুদ্ধি জড় পদার্থ হলেও চৈতন্যের প্রভাবের কারণে বুদ্ধি দৃষ্ট, কখনোবা দ্রষ্টা, এমনকী উপলব্ধির সহায়ক হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে। চৈতন্যের যথার্থ প্রতিভাস যখন মানুষের বুদ্ধিতে ঘটে, তখন মানুষ বস্তু বা দৃষ্ট সম্পর্কে বিবিধ উপলব্ধি বা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।




যখন ব্যক্তির অন্তরস্থিত চৈতন্য তার বুদ্ধিতে প্রতিভাসিত হয়, তখন বুদ্ধি মূলত দুই ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ওদের একটির নাম অহংবোধ, অপরটির নাম মনন। অহংবোধ একটি বিষয়ের গভীরে না ঢুকে উপরিস্থিত সাপেক্ষ দিয়েই তার বিচার করে।‌ অপরদিকে মনন হচ্ছে ব্যক্তির সেই সত্তাটি, যা সংকল্প ও সংশয়... এই দুই আপাতবিরোধী মনোবৃত্তির সাথে স্মৃতি ও কর্মশক্তিকে সমন্বয় করে।




৭. প্রথম শ্লোকে চোখ এবং মনকে বিবিধ বস্তু বা দৃষ্টের প্রেক্ষিতে দ্রষ্টা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যদিও দুই-ই জড় পদার্থ। তাই তাদের প্রতীতি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। আলোচ্য শ্লোকে এ সংশয়ের সমাধান দেওয়া হয়েছে।‌ বলা হয়েছে, যদিও চোখ ও মন জড় পদার্থ, তবুও তাদের মধ্যে চৈতন্য প্রতিভাসিত হলে তারাও চেতনাগ্রস্ত হয়। তাই তাদের পক্ষেও দ্রষ্টা হওয়া, অর্থাৎ বস্তু বা দৃষ্টের জ্ঞান ধারণ করা সম্ভব।




জ্ঞানীরা বলেন, চৈতন্যের যে প্রতিফলন, তার পরিচয় এবং বস্তু সম্পর্কে যে ছবি মনশ্চক্ষুতে তৈরি হয়, তার পরিচয়... এই দুই আসলে কীরকম, তা বুঝতে হলে আগুন এবং আগুনে-গোলার মধ্যকার সম্পর্কটা বুঝতে হবে। লোহার তৈরি গোলককে উত্তপ্ত করে লাল টকটকে করে ফেলা হলে ওটাতে আগুন ও লোহা দুই-ই থাকে, তবে এই দুই মিলেমিশে একটি সত্তা হয়ে যায়, সেখানে ওদের অস্তিত্ব আলাদা করে ঠিক বোঝা যায় না। ঠিক এক‌ইভাবে আমাদের মনশ্চক্ষুতে যখন চৈতন্যের প্রতিফলন ঘটে, তখন চৈতন্য আর মনশ্চক্ষু মিলে এক ও অভিন্ন সত্তা হয়ে আবির্ভূত হয়, এই দুইকে আর আলাদা করা যায় না।




চৈতন্যের এই সংমিশ্রণ, তথা মনশ্চক্ষুর ঔজ্জ্বল্য ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণে প্রতিভাসিত হয়, যা আশেপাশের সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন ঔজ্জ্বল্যের আগ পর্যন্ত ব্যক্তির বাহ্যিক অবয়ব লোকের কাছে অন্য দশটি জড় বস্তুর মতোই নির্জীব এক মানসচিত্র ছাড়া আর কিছু নয়। সবার সামনেই তা নড়ে চড়ে, অথচ কার‌ও চোখেই ওটিকে আলাদা করে কিছু মনে হয় না। চৈতন্যের প্রভাবেই ব্যক্তির ইন্দ্রিয় বাইরের আমি’র সাথে ভেতরের আমি’র একটা আধ্যাত্মিক সংযোগ ঘটায়, এবং তখন চোখ-কান-নাক-জিভ-ত্বক, অর্থাৎ পঞ্চইন্দ্রিয় এবং চৈতন্য... এই দুই সত্তা মিলে-মিশে এক হয়ে যায়। এই স্তরের নাম‌ই অধিচেতনা, এই স্তরে পৌঁছোতে পারলেই মানুষ হয়ে ওঠে এক আলোর মানুষ।