তোমরা যারা টানো

যার আপনাকে সম্মান করার কোনো কারণ‌ই নেই, তার আপনার পরামর্শ শোনার‌ও কোনো কারণই নেই। এ ধরনের কাউকে গায়ে পড়ে কখনোই পরামর্শ দিতে যাবেন না। গেলে অসম্মানিত হবেন। আপনি যত ছোটো অবস্থানের‌ই হোন না কেন, হাতে ধরে নিজেকে অসম্মানিত করার তো কোনো মানে নেই, তাই না? অবশ্য আপনি চরম লেভেলের নির্লজ্জ বা ফাতরা হলে ভিন্ন কথা।

আপনি যাকে রাস্তাঘাটের লোক মনে করেন, সে-ও গায়ে পড়ে আপনাকে পরামর্শ দিতে এলে আপনি খুবই বিরক্ত হতেন। সৎভাবে নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সব বুঝে যাবেন। মানুষ উপদ্রবকারী তেলাপোকা, ইঁদুরকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে। আপনি যখন কাউকে পরামর্শ বা উপদেশ দেবার নামে অহেতুক উপদ্রব করতে যান, তখন আপনার অবস্থানটাও তার চোখে তেলাপোকা-ইঁদুরের পর্যায়ে নেমে যায়। নিজেকে জোকার বানিয়ে কার‌ও সামনে বার বার গিয়ে ওরকম হাতে তালি বাজিয়ে বাজিয়ে ফ্রিতে হিজড়ামার্কা খ্যামটা ডান্স দেবার কী মানে, সিরিয়াসলি?

আপনি কোথাও চান্স না পেয়ে যখন বুয়েটে চান্সপ্রাপ্ত কারও সামনে গিয়ে গায়ে পড়ে এটা বলে বলে ঘ্যানরঘ্যান করতে থাকেন যে, আপনি যে স্যারের কাছে পড়েছেন, তাঁর কাছে পড়লে এবং যে গাইডলাইন ফলো করেছেন, তা ফলো করলে বুয়েটে-চান্স-পাওয়া স্টুডেন্টটির বেসিক কোথাও-চান্স-না-পাওয়া আপনার বেসিকের মতোই স্ট্রং হতো; শুধু তা-ই নয়, আপনি যে কোথাও চান্স পাননি, সেটা বুয়েটে চান্স পাবার চাইতে হাজার গুণে ভালো এবং এই সত্যটা সে বুঝতে পারবে সময় হলেই... তখন আপনার মতন মিউজিয়াম বা চিড়িয়াখানায় থাকার উপযুক্ত মাস্টারপিসকে দেখে সে নিশ্চয়ই অবাক হবার বদলে করুণা করবে বা যারপরনাই বিরক্ত হবে... কিংবা মনে মনে বলবে... আমি... আমি বিশ্বাস করি না! আমি বিশ্বাস করি না!! আমি বিশ্বাস করি নাআআআ!!!... এমনকী আপনার বেপরোয়া মূর্খতা দেখে অতিবিনোদিত ও ক্লান্ত হয়ে নিজের গাল-থুতনি হাতের তালুতে রেখে গান‌ও ধরতে পারে... বলো বলো, আরও বলো... লাগছে মন্দ নয় ডট ডট ডট

আমরা ছোটোবেলায় সেই স্যারের কাছেই পড়তে যেতাম, যাঁর কাছে ভালো স্টুডেন্টরা পড়ত। যাঁর কাছে তারাই পড়ত, যারা পরীক্ষায় ফেইল করে কিংবা কোনোমতে পাশ করে, তাঁর কাছে পড়তে যাবার তো কোনো মানেই নেই। তিনি ভালো শিক্ষক হতে পারেন, কিন্তু তাঁর প্রোডাক্টের কোয়ালিটি তো খুবই খারাপ। তাহলে তাঁর কাছে পড়তে যাবার রিস্ক কেন নেব যদি তাঁর স্টুডেন্টরা সবাই মিলে হাতেপায়ে ধরে টানাটানি করেও, যখন যাবার আরও জায়গা আছে? এমনকী মাথায় অল্প ঘিলুও থাকলে, ভালো অপশন ফেলে বাজে অপশন নিয়ে মানুষ কখনও সময় নষ্ট করে না।

অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ভালো স্টুডেন্টরা যেখানে পড়ে, মানে (রেজাল্ট বিবেচনায়) ভালো স্যার বা ভালো প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি, সেখানে ইচ্ছে থাকলেও অনেকসময় পড়া যায় না। আর আজেবাজে প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন এসে লিফলেট নিয়ে আমাদের স্কুল-কলেজের সামনে ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে থাকত, আমাদের পেছন পেছন ঘুরত আর বলত, ওখানে পড়তে গেলে হ্যান ফ্রি দেবে, ত্যান ডিসকাউন্ট দেবে, আরও কত-কী সুযোগ-সুবিধা! আমরা, মানে ভালো স্টুডেন্টরা তবুও ওসব জায়গায় পড়তে যেতাম না। ভালো স্টুডেন্টরা যেখানে পড়ে, সেখানেই যেতাম স্যারের লাথি-গুঁতা আর চড়থাপ্পড় খেয়েও। (বিনয়ের সাথে বলি, স্টুডেন্টলাইফে, সব বিবেচনাতেই, অতিমাত্রায় ভালো ছাত্র হিসেবে শিক্ষক, সহপাঠী ও অভিভাবকদের কাছে পরিচিত ছিলাম। একদমই টপ ক্যাটাগরির অতিপড়ুয়া বোকাসোকা ছাত্রের ভূমিকায় জীবনের সেই রঙ্গমঞ্চের রংহীন দিনগুলি পার করেছি। তাই আজেবাজে জিনিস গেলার অভ্যাস বা চর্চা তখন থেকেই আমার নেই।)

মাথায় আজ‌ও সবসময়ই রাখি, ছাগল উৎপাদন কেন্দ্রের প্রোডাক্ট ছাগল‌ই হয়, সিংহ কখনও হয় না। তার চাইতে বড়ো কথা, কোনো কেন্দ্রের এন্ড-প্রোডাক্ট যদি ছাগল হয়, তবে সেই কেন্দ্র সিংহ উৎপাদন করে বা করতে পারে, এ জাতীয় গালগল্প মেরে তো লাভ নেই, তাই না?

কাউকে জ্ঞান দিতেও যোগ্যতা লাগে। যার পরনে লুঙ্গিই নাই, সে যখন অন্যের কাছে গিয়ে প্যান্ট পরার বয়ান দেয়, তখন ব্যাপারটা দেখতে খুবই ফালতু লাগে। এই দুর্ভাগা দেশে সার্টিফিকেটের নয়, কমনসেন্সের চরম সংকট চলছে।

ফেইসবুক না থাকলে কত মানুষকে যে পাবলিক ট্রেনে-বাসে ওঠা লাগত জ্ঞান দেবার জন্য, তার কোনো হিসেব নেই। রাস্তার ক্যানভাসার যখন ভদ্রলোকের ড্রয়িংরুমে জোর করে ঢুকেই শুরু করে দেয়... আসুন আমাদের গাড়ির নিকট, দেখুন আমাদের মলমখানা... তখন তাকে পরহিতৈষী নয়, বেআক্কেল বলে। ওরকম পথসম্রাট জ্ঞানীর ধাক্কায় রাস্তাঘাটে চলাই মুশকিল।

কমনসেন্স অর্জন করার চেষ্টা করুন, মস্তিষ্ককে কখনোই কোনো অবস্থাতেই কোনো কিছুর কাছে বর্গা দিয়ে দেবেন না। যদি দিয়েও ফেলেন, দল ভারী করার জন্য ডেসটিনি কোম্পানির অপদার্থগুলির মতন লোকের সামনে গিয়ে ম্যাঁ ম্যাঁ করবেন না। আচ্ছা, ওদের কথা মনে আছে তো? ওই যে দুইটাকার কোট-প্যান্ট আর ছেঁড়া জুতোর সাথে টাই-পরা একদল নির্লজ্জ ভদ্রলোক মাঠঘাট দাপিয়ে বেড়াতেন একসময়...? ওরা মানুষকে সেই ফেইস-ভ্যালু পাইয়ে দেবার স্বপ্ন দেখাত, যে ফেইস-ভ্যালু ওদের নিজেদেরই ছিল না।

ওরা মানুষকে ধরে-বেঁধে জোর করে বড়োলোক বানাতে চাইত, আর আপনি চাইছেন এক‌ই কায়দায় জ্ঞানী বানাতে। ওদের অনেকেরই যে দুপুরে খাবার টাকাটাও পকেটে থাকত না, সেটা আমরা জানি। আর জানি বলেই ওদের ওসব গালগল্প শুনে ওদের ভীষণ সস্তা লাগত। ইয়ে মানে, আপনাদের অবস্থাও আবার সেরকম নয় তো?

আমি সেই স্টুডেন্টটা, আপনার আদরের সন্তানটি যার মতো হলে আপনি খুশি হবেন।
আপনি সেই স্টুডেন্টটা, আমি যার মতো হলে আপনি খুশি হবেন।

একমিনিট! একমিনিট!! ইয়ে মানে, বলছিলাম কী, মাঝে মাঝে মাথাটা একটু এদিক-ওদিক ঝাঁকা দেবেন; দেখবেন, আপনার ব্রেইন‌ও কাজ করছে।