তুমি, আমি, জগৎ

তুমি, আমি, জগৎ এই তিনকে আমি এখনও এক ভাবতে শিখিনি। কত বার এক ভাবতে শেখালে, তবু শিখলাম না। শিখলাম না বলেই তোমাকে হারাই, নিজেকেও হারাই। কী এক মন্ত্র নিয়ে আসো, যা শোনামাত্রই তোমাতে আমায় দেখি, আমাতে জগৎ দেখি, জগতে আমায় দেখি, তোমাতে জগৎ দেখি, জগতে তোমায় দেখি। সব ভেদের মধ্যে তুমি অপূর্ব অভেদ দেখিয়ে দাও।




তবু মন্ত্র কিন্তু ধরে রাখতে পারিনে। মন্ত্র আমার সাধন হয়নি। এই তো মন্ত্র এখন শুনছি, আর তো কিছুই আলাদা করতে পারছিনে। তুমি ছাড়া আমি নই, আমি ছাড়া তুমি নও, তোমাকে ছাড়া জগৎ নয়, জগৎ ছাড়া তুমি নও, আমি ছাড়া জগৎ নয়, জগৎ ছাড়া আমি নই। কী অপূর্ব বন্ধন! আমি ছাড়া তুমি নও, এ কী আশ্চর্য কথা! তোমাতে আমার নিত্যস্থান রয়েছে, আমি একেবারে তোমার স্বরূপের অন্তর্গত, আমি না হলে তুমি অপূর্ণ হতে, তোমার পূর্ণতা আমার অপেক্ষা রাখে। কী অদ্ভুত কথা! আমি ভাবি, আমি তোমার আকস্মিক কাজ, ছিলাম না, হয়েছি; আবার না থাকতেও পারি।




আমার আসা-যাওয়াতে যেন তোমার কিছুই আসে যায় না। আমাকে ছেড়েও যেন তুমি পূর্ণ, অনন্ত। তুমি বলছ, এ আমার ভুল, আমি তোমাকে চিনি না বলেই এ রকম ভাবছি, তোমার ভেতর আকস্মিক, অবাস্তব, অদরকারি কিছুই নেই, তোমাতে যা-কিছু আছে, সবই তোমার নিত্য, পূর্ণ, অনন্ত স্বরূপের অঙ্গীভূত। আর আমি তো যেমন-তেমন বস্তু নই, যদিও যেমন-তেমন বস্তু তোমাতে কিছু থাকেই। আমি একেবারে তোমার স্বরূপের প্রকাশ, তুমি আমাতে স্বয়ং প্রকাশিত।




আমি তো এখন আমাকে কিছুতেই তোমার রূপ থেকে স্বতন্ত্র করতে পারছিনে। আর এই গম্ভীর মুহূর্তে, এই স্বরূপ, ব্যক্তির অবয়বে ও সময়ে যখন দেখছি, আমি তুমি থেকে স্বতন্ত্র নই, তখন এই তত্ত্ব নিশ্চিত। অন্য মুহূর্তগুলি তো কল্পনায় দূষিত, অবিদ্যায় আচ্ছন্ন। আমি তোমার, তোমার ভালোবাসার বস্তু। আমার সৃষ্টিতে, লালনে-পালনে, শিক্ষায়, দীক্ষায় তোমার গভীরতম অভিপ্রায়, তোমার জগৎসৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম উদ্দেশ্য প্রকাশ পাচ্ছে। এই যে তোমার সঙ্গে আমার মিলন, তোমাকে আমার চেনা, তোমাতে আমার আকৃষ্ট হওয়া, এ অপেক্ষা তোমার ব্যস্ততার উচ্চতর উদ্দেশ্য আর কিছু তো বুঝতে পারছিনে... তোমার সমুদয় সৃষ্টির গতি, পরিণতি, আর এই মিলনের ব্যাপারে।




কী নির্বোধ তবে আমি যে, আমি তোমাকে আমার অস্তিত্ব ছাড়া ভাবি! দেখছি, আমি তোমার জ্ঞানে রয়েছি অনন্তকাল, আর থাকবও অনন্তকাল। তোমার সঙ্গে আমার এই মিলন ঘটাবার জন্যে তোমার সমুদয় জগৎ এতদিন কাজ করেছে, আর চিরদিনই কাজ করবে। আমি তোমার স্বরূপবৈভব কতটুকু দেখেছি? তোমার স্বরূপমাধুরী কতটুকু আস্বাদন করেছি? আরও কত দেখাবে, কত আস্বাদন করাবে! অনন্ত বৈভব, অনন্ত মাধুরী তো ফুরাবে না।




এই যে দেখাচ্ছ। এই দৃষ্টি যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ আমি আর আমাকে তুমি ছাড়া, আর তোমাকে আমি ছাড়া ভাবতে পারিনে। দেখি, তুমি আমাতে, আমি তোমাতে... অপূর্ব ভেদাভেদ, অপূর্ব মিলন, অপূর্ব তোমার স্বরূপবৈভব, অপূর্ব তোমার স্বরূপমাধুম; কিন্তু এই দৃষ্টি তো আমি ক্রমাগতই হারিয়ে ফেলি। এই যে মন্ত্র শোনাচ্ছ, তা ক্রমাগতই ভুলে যাই। আমাকে এই মহামন্ত্রে সিদ্ধ করো, সিদ্ধ করো, সিদ্ধ করো।