তন্দ্রা ভেঙে

ভোরবেলায় সবে তন্দ্রা ভেঙেছে; চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে দেখি, হায় খোদা! এ যে আরেকটা আমি বসে!!




ঝকঝকে সাদা জমিনে বসে নিমীলিত কুচকুচে কালো দুটো চোখ নিবিষ্টচিত্তে তাকিয়ে রয়েছে আমারই দিকে! কিছুটা চিন্তামগ্ন, তবে প্রশান্ত ললাটে দেড়-দুইটা ভাঁজ। অর্ধকুঞ্চিত ভ্রুজোড়া ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পরিবর্তন করে চলছে। এক ঠোঁটের কোনায় মৃদু অথচ অর্থপূর্ণ হাসি স্থির হয়ে ঝুলে রয়েছে যেন! কিছুটা ঝুঁকে বামহাতের করতলে থুতনি ঠেকিয়ে নিশ্চল বসে আছে সে।




বলল, বাছাধনের শাহীঘুম ভেঙেছে তাহলে! রাতে যে পাঠ দিলাম, তার কতখানি গিলেছ, ফলাফল যে চাই এখন‌ই!
আড়মোড়া ভেঙে বললাম, তা যদি কিছু দিয়েই থাকো, দিলে না হয়; বিনিময় চাইতে এলে যে বড়ো!?
আচ্ছা, তবে এই! তুমি যখন কারও অনুরোধে কিছু করো, বিনিময় প্রত্যাশা করো না?
হেঁয়ালিভরা চাহনিতে বললাম, আমি প্রত্যাশা করতেই শিখিনি কখনও।
তাই? অবচেতন মন কী বলে?
বিনিময়ে কিছু কেউ দিতে চাইলে কখনও গ্রহণ করি না। এটা আমাকে বিব্রত করে।
বেশ বেশ! আমি একটা কথা বলতাম একসময়…দিতে শেখো প্রকৃতির মতো, পেতে চেয়ো না, সবাই দিতে জানে না!
একটা অহংকারের গন্ধ আছে এতে, তাই না, নীল? না, মানে ওই যে দিতে জানে না বলে নিজেকে একটু উঁচুতে ওঠালাম আর কি!
দেখলাম, নিজের মুখে নিজের নাম শুনতে মন্দ লাগে না! উত্তরে বললাম, আমি আমার গুরুভাজন নানার কাছ থেকে একটা জিনিস শিখেছি। তিনি সবসময় বলতেন, “হাত সবসময় উপুড় রাখবে, কখনও কোনও পরিস্থিতিতে পাতবে না।” তা-ও এবার তুমি একে অহংকার যদি বলো, বললে! আর দশজনের কাছে যা অহেতুক অহংকার, আমার কাছে তা সেলফএস্টিম। তাই প্রত্যাশা করা ব্যাপারটা মোটেই মেনে নিতে পারি না।
প্রসন্নতাব্যঞ্জক চোখ নাচিয়ে বলল, চমৎকার কথা, আত্মসম্মানবোধে পরিপূর্ণ কথা! দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কিন্তু কিছু পাবার একটা ন্যায়সংগত অধিকার স্বীকার করে নেয় এবং এটা কারও করুণা বলে মানে না।
কুচুটেপনা করে বললাম, আমি অধিকার রাখি, কিন্তু আমি গ্রহণ করি না…এইটা আমাকে একধরনের প্রচ্ছন্ন আনন্দ দেয়, হে!
মাথা দুলিয়ে সে বলল, বন্ধুবর, না, গ্রহণ না করে যদি স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব হয়, তাহলে গ্রহণ না করলেও চলে। আমি প্রান্তিক মানুষের কথা বলছিলাম। মানুষ হিসেবে মানুষকে করুণা করার কোনও সুযোগ ডায়লেকটিভ ম্যাটারিয়ালিজম স্বীকার করে না। বস্তুবাদ তা-ই বলত।
জানতে চাইলাম, বলো হে, তোমার নিজস্ব মতবাদটা কী?
মুখখানায় বেশ একটু গাম্ভীর্যের পোস্টার সেঁটে বলল, আসলে মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত থাকলে তো করুণা গ্রহণের প্রয়োজনই হয় না, কিন্তু ভাববাদ যা বলে, তা হলো, মানুষের ক্রমবর্ধনশীল চাহিদা বলে একটা কথা আছে।
চোখে নষ্টামি নাচিয়ে বললাম, তুমি ব্যাপারটাকে জাগতিকভাবে বললে! মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ব্যাপারটাকে তুমি কীভাবে দেখো?
চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বলল, আসলেই কঠিন।
বললাম, বেশ। তা পারিবারিক বন্ধনে ব্যাপারটা কেমন?
চশমাটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বিজ্ঞের মতো বলে চলল, আসলে অধিকার এবং দক্ষতার সমন্বয় হয়নি। সবারই সমমাত্রায় জীবনযাপন আসলে যৌক্তিক কি না, এটা বিবেচনার অবকাশ রাখে।
বুঝলাম, সামনে বসা বন্ধুবর আজ বেশ তেতে আছে। একটু সতর্ক হয়ে কণ্ঠে প্রশংসার সুর ভেঁজে বললাম, বাহ্! তোমার সাইট অব ভিউ বেশ পরিচ্ছন্ন। তোমাকে পেয়ে আজ বেশ বর্তে গেলাম। একটা ব্যাপার একটু ঝেড়ে কাশো দেখি এবার; কাউকে করুণা করা আর অপমান করা, এই দুইকে এক বলা যায়?
এবার সে গলাটা একটু খাদে নামিয়েই বলল, না, কাউকে করুণা না করেও অপমান করা যায়। মানে বিষয় দুইটি mutually exclusive; একটা আরেকটার উপর নির্ভর করে না। এমন-কী আর্থিক বা সামাজিক অবস্থানের উপর‌ও নির্ভর করে না। এক জায়গায় মিল আছে, তা হলো, দুটো করতেই, যাকে করা হচ্ছে, তার একধরনের ‘মেনে নেওয়া’ লাগে। কার‌ও সম্মতি ছাড়া তাকে এই দুই করা একটু কঠিন। কিছুটা ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্টের বিষয়‌ও এখানে থাকে। একেবারেই নিঃস্পৃহ মানুষকে এসব করা শক্ত।
বললাম, এখানে করুণা শব্দটার একটু সংশোধন দরকার। দুই জন মানুষের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারটা
আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। করুণা মূলত স্রষ্টা  ও সৃষ্টির মধ্যকার একটা বিষয় হতে পারে।
বুদ্ধিদীপ্ত গভীর সুন্দর দু-চোখ মেলে সে বলল, এটা নানান দিক থেকে বলা যায়। যে যত বশ্যতাস্বীকার করে, সে নিজেকে তত করুণাপ্রাপ্ত ভাবতে শান্তি পায়।
সুফিরা এটা করে। এটা একধরনের আত্মতৃপ্তি দেয়। আবার যারা স্রষ্টা মানে না, তারা নিজের ক্ষমতার উপর ভর করে চলে, নিজের আত্মার শরণাপন্ন হয় বা না হলেও ওদের মনের শক্তি আত্মিক শক্তির দিকেই ইঙ্গিত দেয়। ও-ই এক‌ই হলো। আত্মার মানেই তো নিজের ভেতরের মানুষটা, মানে মনের ঈশ্বর।
সন্তুষ্টচিত্তে বললাম, আচ্ছা, মানুষে মানুষে তবে কী হয়? বড়োজোর অংশীদার সম্পর্কে আসতে পারে, মানে যেমন উৎসব উদ্‌যাপনে একীভূত হওয়া এবং আনন্দ বিকেন্দ্রীকরণের কাজে অংশগ্রহণ করা।
আমার পরিচ্ছন্ন চিন্তার বিজ্ঞ বন্ধুটি বরাবরের মতো স্বচ্ছ যুক্তিতে বলল, মানুষে মানুষে কী হয়, তা ওদের ইচ্ছে ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে।
মনে মনে ভাবলাম, বেশ একটা বন্ধু জুটেছে বটে! কয়েক জনম এভাবে আলোচনায় বসে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যাবে!
নীরবতা ভেঙে বললাম, কাউকে সম্পূর্ণ একা নিভৃতে আনন্দ উদ্‌যাপন করতে দেখেছ কখনও? বিষয়টা এমন, একজন, যে সবার আনন্দ উদ্‌যাপনে অংশগ্রহণ করে, সে-ও কিন্তু নিজের একান্ত আনন্দে কাউকেই অংশীদারিত্ব দেয় না।
দেখলাম, সুকৌশলে আমার প্রশ্নটা কড়িকাঠে ফেলে গম্ভীর মুখে ফের বলে চলল বন্ধুটি…কাল বলছিলাম রাজনীতির তত্ত্বকথা, আসলে বাস্তবে এর প্রয়োগের আগে মানুষকে কিছুটা হলেও মানুষ হতে হয়। আমার মনে হয়, বস্তুবাদ ব্যাপারটা দেখতে ও শুনতে মানবিক, কিন্তু এর প্রয়োগে অনেকেরই তীব্র বিরোধিতা থাকে। না, আমি একচেটিয়া বলছি না, ভাববাদ মানুষকে নিজের মতো চলার অবাধ অধিকার দেয় এবং ব্যক্তি-অভিরুচির নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনও দেয়।
বললাম, বটে! তুমি নিজে কোনটা প্রেফার করো?
চিন্তারেখায় জর্জরিত মুখখানা হেলিয়ে দুলিয়ে খেই ধরল, মানুষ পুঁজির দাসত্ব করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আসলে আমি মুক্ত অর্থনীতি পছন্দ করি, তবে সমস্যা হলো, মুক্ত অর্থনীতি ব্যক্তিকে পুঁজির অবাধ মালিকানা অর্জনে সমর্থন
দেয়। এখানে ব্যক্তির বিকাশ খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা না হলে একটা লজ্জাজনক অসাম্য দেখা দেয় সমাজে, যা মানুষের সভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে বসে। বিষয়টা রসালো নয়, নীল…থাক্!
অপমানের একটা সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করলাম, চোখে-মুখে শিশুসুলভ কৌতূহল দেখে বিজ্ঞ বন্ধুবর হতাশ হলেন, তখন আমার একতোলা প্রশংসায় যে চিড়ে ভেজেনি, বেশ বুঝতে পারলাম।
বিনয়ের সঙ্গে বললাম, তুমি আলোচনা করো, আমি নবীশ, শিখছি।
ফের খেই ধরে বলে চলল, মুক্ত অর্থনীতি মানুষের মৌলিক অধিকার তেমন একটা স্বীকার করে না, নিজের পুঁজির পাহারাদার হিসাবে সে খুব নির্মম।
বেশ লাগল। বললাম, মুক্ত অর্থনীতির ব্যক্তিত্ব আছে বলতে হয়।
ভূতগ্রস্তের চমকে উঠে বলল, কী বললে?
যা শুনলে।
দুলকিচালে মাথা দুলিয়ে বলল, না না, এটা মোটেও না। মুক্ত অর্থনীতি ব্যক্তিযোগ্যতাকে তেমন একটা বিবেচনা করে না, তার বিবেচ্য, কে কতটা পুঁজির অধিকারি। আর এজন্য একজন প্রায়অবিকশিত, মানে শিক্ষাহীন মানুষ শুধুই পুঁজির জোরে প্রভুপর্যায় মানুষের মতো হয়ে যায়।
সোল্লাসে বললাম, তা-ই তো বলেছি। টাফ গেইমার মুক্ত অর্থনীতির একটা স্বতন্ত্র নীতি আছে। এবার তা মানুষকে যেভাবে ইচ্ছে নাচাতে পারে, সেটা অবশ্য পরের বিষয়।
চিন্তাচ্ছন্ন আঁখিযুগল মেলে দিয়ে ভাবুক প্রেমিকের মতো উদাস কণ্ঠে বলল, আকাশটা কেমন, নীল?
বজ্রাহতের মতো চেয়ে থেকে আপনমনে বলে উঠলাম, মেঘলা।
অমন নিবিষ্ট চিন্তায় বিভোর হয়ে বলল, বেশ! মেঘলা কি?
হুম।
চিন্তার কুয়াশা কেটে স্বরূপে তত্ত্বজালের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বন্ধুবর পুনরায় অবতীর্ণ হলেন…বুঝলে নীল, এমন দিনে দুটো ঘটনা ঘটে:
১। মানুষ একটু আয়েশী জীবন কাটাতে চায়।
২। বেশিরভাগ মানুষ তখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, যেটা আমরা আসলে মনেই আনি না।
হুম, গম্ভীর স্বরে বললাম, মুক্ত অর্থনীতির মতো আর কি।
হ্যাঁ, এটাই। আর এজন্য আমি বলি, একটা বিশেষ মাত্রায় মানুষ বিকশিত হবার আগ পর্যন্ত, রাষ্ট্রকে বস্তুবাদী তথা কল্যাণ-রাষ্ট্রিক রাখতে পারলে ভালো।
কণ্ঠে হেঁয়ালির সুর ভেঁজে বললাম, শিল্প, বাণিজ্য, রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ তিন খাতেই তো মুক্ত অর্থনীতির প্রভাবই বেশি দেখা যাচ্ছে।
কপালে যুগপৎ দুশ্চিন্তা আর হতাশার ঘন ভাঁজ টেনে বলল, এটাই বিষয়! বস্তুত মানুষ ভোগবাদী দাসত্বে বন্দি।
পরিবার থেকেই সম্পদের মালিকানার উপর অধিকারবোধ সে অর্জন করে। তারপর থেকেই সম্পদের একচ্ছত্র মালিকানা অর্জনে সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তার মধ্যে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়। কারণ এটা ব্যবহার করে সে সহজেই ক্রমশ পুঁজির একচ্ছত্র মালিকানা অর্জন করতে পারে। আর অন্য পুঁজিগুলো সুবিধা নেবার জন্য তার সহযোগী হয়ে ওঠে। আর এখান থেকেই  শিল্প-বাণিজ্য-রাজনীতি মুক্তবাজার অর্থনীতির ত্রিপাণ্ডা হয়ে বসে।
কৌতূহলে দু-চোখ চকচক করে উঠল; বললাম, বেশ মজার তো। শেয়ার বাজার সম্পর্কে বলো।
এ কথায় যেন একটু মজা পেল, খেলার সুরেই বলল, এখানে একটা ইঁদুর-বেড়াল খেলা হয়, বুঝলে! বড়ো পুঁজি ছোটো পুঁজিকে লোভ দেখায়। লোভ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ছোটো পুঁজি আকর্ষিত হয়। একটা সময় পর্যন্ত ছোটো পুঁজি অর্থাৎ শেয়ারহোল্ডার নিজে লাভবান হচ্ছে মনে করতে করতে একটা
অভ্যস্ততা অর্জন করে এবং বিনিয়োগ ক্রমশ বাড়াতে থাকে।
ঠিক তখনই বড়ো পুঁজি চতুরতা করে দেউলিয়া সাজে। ফলাফল, বিশাল এক জনগোষ্ঠী নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল শুনে, জিজ্ঞেস করলাম, যিনি ইনভেস্ট করেন, তিনি তা করার আগে কোনও চুক্তিতে আসেন না?
হ্যাঁ, চুক্তি তো থাকেই, সেটাও একটা ব্যবসায়ী চুক্তি। সেখানেও দেউলিয়া হওয়াটা নীতিসিদ্ধ।
অবহেলাভরে বললাম, মানে তুমি জানবে, দেউলিয়া হওয়াটা নীতিসিদ্ধ, তবুও তুমি খেলবে। বিষয়টা এমন, চোরকে বলে চুরি করো, গৃহস্থকে বলে সজাগ থেকো। ব্যাটা হতচ্ছাড়া বাঁদর!
আমার এহেন মন্তব্যে বন্ধুবর না হেসে পারল না! হাসির লয়ে কথা জুড়ে দিল, হ্যাঁ, দেউলিয়া হওয়া নীতিসিদ্ধ হবার পরও শেয়ার কেনাবেচা হয়। কারণ ওই যে আরেকটা কারিশমা হচ্ছে গুডউইল। এই বৈশিষ্ট্য মানুষকে মোহাচ্ছন্নতায় ঢেকে রাখে।
বেশ, গুডউইল সম্পর্কে কিছু বলো।
একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের মতো বলল, গুডউইল হলো একটা বিশেষ ইতিবাচক ব্যাবসায়িক বৈশিষ্ট্য। তুমি কি জানো, কোনও ব্যাংক বাংলাদেশে দেউলিয়া হলে আমানতদার যত টাকাই আমানত রাখুন না কেন, তিনি মাত্র এক লক্ষ টাকা পাবেন!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, হ্যাঁ, বিষয়টা আমি শুনেছি।




কিছুক্ষণ অসীম নীরবতায় রইলাম দু-জনে! যেন কোনও বিশেষ আত্মপরিজনের বিদায়ে শোকাহত দুটি মানুষ! আপনমনে বিড়বিড় করে উঠল আমার একান্ত বন্ধুটি, বাতাসে কথার খেই ধরে ফের আলোচনার সূচনা করল, যা-ই হোক, যেটা বলছিলাম…দেখো, প্রকৃতিকেও মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে মনে হয়। যেমন
মনে করো, আজকের দিনটা নিম্ন ও বিত্তহীন শ্রেণীর জন্য জীবনের প্রতিপক্ষ।
ক্রূর হেসে বললাম, প্রকৃতি  হরহামেশাই যাচ্ছেতাই আচরণ করে! প্রক‍ৃতি অনেকটা কম্পাউন্ড প্রফিটে খেলে।
চোখে-মুখে একপ্রস্থ হেসে নিয়ে বলল, কী হে, তুমি দেখি অদৃশ্যশক্তির ঘোর বিরোধী!
সময়ের কিন্তু অর্থনৈতিক মূল্য অনেক এবং এটা যাদের অগাধ, তারাও কিন্তু বুর্জোয়া একপ্রকার, বুঝলে ভায়া!
আচ্ছা, সময় আর প্রকৃতি কি সমপর্যায়ের? না পরস্পরবিরোধী?
সমপর্যায়ের।
বললাম, সময় তো একটা সামগ্রিকতা।
প্রকৃতির তো একটা ক্রম পরিবর্তনশীল চরিত্র আছে।
আরেকটু ব্যাখ্যা করো।
তৃপ্তির হাসি দেখে বুঝলাম, বিষয়টা বন্ধুবরের মনে ধরেছে। প্রকৃতি আসলে মূর্ত সবকিছু… আলো, জল, বৃক্ষ, পাহাড়কে ধারণ করে অগ্রায়িত হয়। বিমূর্ততা প্রকৃতির বন্দনায় থাকে না।
ফুলের সৌরভ প্রাকৃতিক, কিন্তু হৃদয়ে ও চোখে এর অদৃশ্য আবেদন সে বলতে পারে না, যা
বোধের গৃহে অনুরণন সৃষ্টি করে, যা কিনা কাব্যে, গল্পে, কথনে লৌকিক-নৌকায় চড়ে এগিয়ে যায় পরবর্তী মানুষের কাছে।
সময়ই একটা সময়কে পরবর্তী সময়ের কাছে নিয়ে যায়, নিতে পারে। প্রকৃতির ক্রমবিধ্বস্ততাকেও সময় ইতিহাস হয়ে প্রজন্মান্তরে নিয়ে যায়। প্রকৃতি তার দুঃখময় অতীতটা জানতে সময়ের কাছে ফিরে যায়।
বলতে পারো, ফুল ও সৌরভ প্রকৃতি আর আমোদিত আবেগ এবং সুখানুভূতির বিমূর্ত আখ্যানের ধারক হলো সময়।
প্রকৃতি সময়ের কাছে গল্প জমা রাখে, সময় গল্পকে প্রজন্মান্তর করে। 
তুমি খুঁটিয়ে দেখলে বুঝবে, দুঃস্বপ্নের অনুবাদও সুন্দর হতে পারে। ক্লান্তির অপর প্রান্তে সজীবতা অপেক্ষায় থাকে। অবসন্নতাও জীবনের অংশ।
কষ্টের কাছাকাছি কিছু দুঃখের নামও সুখ হতে পারে!
বাতাসের শরীর তোমাকে বলবে না…আড়ালে ধ্বংস খেলা করে।




মোহিত হয়ে কথাগুলো শুনছিলাম, যেন প্রতিটি শব্দ দ্যুতি ছড়াচ্ছে! বললাম, আচ্ছা, তুমি কি মনে করো, সময় যে-কোন‌ও কিছুর থেকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী!?
যুক্তির ভাণ্ডার খুলে নিয়ে বলল, আসলে সময়ের একটা বস্তুগত ব্যাখ্যা হয়। যেমন ভালো সময় বলতে আমরা ইতিবাচক মাত্রায় জীবনযাপনকে বোঝাই, আবার খারাপ সময় বলতে নেতিবাচক অবস্থায় থাকা জীবনকে বুঝি।
আসলে তুমি যদি নেতিবাচক মাত্রায় থাকো, তবে তুমি সেখান থেকে উঠে আসতে চাইলে তোমাকে সময়ের দ্বারস্থ হতে হবে। সময় তোমাকে নির্মিত হতে সাহায্য করবে। আবার সময়ই তোমাকে ধ্বসিয়ে দেবে নিমিষেই।
বিষয়টা সময়ের উপযুক্ত ব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত। সময়কে যে যত যথার্থভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম, তার সাফল্য তত বেশি। সুতরাং যথাসময়ে যথাযথ কাজটি করলেই তুমি অপ্রতিরোধ্য। কালনির্ণয়টা জীবনে সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। পৃথিবীতে আর কী এমন আছে, যার যথার্থ ব্যবহার জীবনকে এত প্রভাবিত করে!?
নেই মনে হয়। সুতরাং সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী আসলে নেই।




তন্ময়তা কাটিয়ে মুখিয়ে থাকা পরবর্তী প্রশ্নটা ছুড়লাম, সময়ের সঙ্গে ভাগ্যের যোগাযোগটা কী?
প্রশ্রয়ের সুর টেনে বলল, এটা অদৃষ্টবাদী মানুষের কথা।
সময় ভাগ্যকে বদলায় না, সময়ের কার্যকরী ব্যবহার ভাগ্যকে/জীবনকে প্রভাবিত করে।
বললাম, ধরো, আমি দিনে তেরো ঘণ্টা রুটিন মেনে পড়াশোনা করলাম, নিয়মিত টিউশন নিলাম, সময়ের পড়া সময়ে শেষ করলাম, কিন্তু আমি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলাম না! এক্ষেত্রে সময়ের ইতিবাচক ব্যবহার এবং পরিশ্রম বাদেও তৃতীয় কোন ফ্যাক্টরের জন্য ফলাফল আশানুরূপ হলো না?
বন্ধুবরকে কিছুটা ব্যথিত মনে হলো, ম্রিয়মাণ মুখখানা তুলে বলে চলল, এখানে একটা ফ্যাক্টর কাজ করে, যেখানে মানুষ অসহায়।
মানুষ সময়ের ব্যবহার যথার্থ করে দক্ষ হয়, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মস্তিষ্কের জেনেটিক্যাল ফার্টিলিটি সফলতা অথবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
সুতরাং এটা দেখাই যায়, অনেক পাঙ্চুয়াল স্টুডিয়াস ছেলেও বেশ অগোছালো জেনেটিক্যালি ফার্টাইল ছেলের কাছে হেরে যায়।
সুতরাং তৃতীয় ফ্যাক্টরটা জেনেটিক্যাল ফার্টিলিটি বলা যায়।




বন্ধুকে প্রশ্নবিদ্ধ করার দ্বিতীয় মহড়া টেনে বললাম হুম, ব্যাখ্যাটা সুন্দর। কিন্তু আমি এমন অনেককে দেখেছি, যারা জেনেটিক্যালি বেশ উর্বর, কিন্তু ফলাফল খারাপ করেছে!
আমার দ্বিতীয় আক্রমণকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, সহজ অভিব্যক্তির সঙ্গে বলে চলল, এটা স্বাভাবিক।
সময়ের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে জিনিয়াস লোকজন‌ও চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়।
এখানে একটা জিনিস হয়, তা হলো, রানিং-টাইম শর্ট ডিউরেশনে জিনিয়াসরা বেশ ভালো করে। কিন্তু এটা চর্চিত বিষয়ে সম্ভব।
তুমি মেধাবী, তোমার চর্চাও আছে, কিন্তু সামগ্রিকতা নেই, অর্থাৎ ভলিয়ম অব নলেজ
তোমার কম, এক্ষেত্রে তুমি ব্যর্থ হতে পারো। আবার কো-অপারেশন অব ব্রেইন যদি
তোমার টাইমিংকে ডিজঅনার করে, সেক্ষেত্রেও ব্যর্থতা আসতে পারে।
বুঝলাম এবার, গো-হারান হেরেছি বটে, তবে চিত্ত তুষ্টি লাভ করেছে।
আত্মমগ্ন হয়ে…বন্ধুবর, তুমি এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছ… এগুলোর আলোচনা আমার জন্য অনধিকার চর্চা অনেকটা। আমি
তো চর্চিত জীবনের মানুষ না; যা বললাম, তা আমার উপলব্ধি।
আহা! এমন বোলো না। আমি আমার মনের মতো যুক্তিসঙ্গত উত্তরগুলোই তোমার কাছ থেকে পাচ্ছি। শেষ একটা বিষয় একটু বুঝিয়ে দাও দেখি! সময় আর প্রকৃতির সঙ্গে মুক্ত অর্থনীতির আচরণগত কতটা মিল?
সহাস্যে ফের বলল, সময় প্রকৃতি মুক্ত অর্থনীতি, এই তিন ব্যাপক আলোচনার বিষয় বলেই আমার মনে হয়।
একটা মজার কথা বলি, প্রকৃতির সর্বনাশ করে মানুষ মুক্ত অর্থনীতির কাঁধে ভর করেছে।
সময় নেহায়েত ইনফিনিটি।
প্রকৃতি ক্রিয়েটরের উদারতা।
মুক্ত অর্থনীতি মানুষের লোলুপতা পূর্ণ করার হাতিয়ার।
একটা যৌক্তিক সময়ের মাধ্যমে মানুষ সভ্যতাকে এগিয়ে নিলে, আজ আমরা যে ইনসিকিউর ইকোসিস্টেমে দাঁড়িয়েছি, তা কিছুতেই হতো না। এটা আমার ধারণা।অতি দ্রুততার সাথে কিছু মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রয়াসই এর জন্য দায়ী।




মানুষ প্রকৃতিকে নিজের জায়গায় স্বপ্রকৃতিতে রেখে সভ্যতার বিকাশে মনোনিবেশ করলে এই ভারসাম্যহীন অবস্থা হয়তো সৃষ্টি হতো না। জীবন উপভোগ্য থাকত প্রকৃতির আদরে।
একটা হালকা কথা বলি। আগে মেয়েরা বউচি খেলে যে আনন্দ পেত, এখন হার্ডহিটিং ব্যাটিং দেখেও তা পায় না। কেননা জীবনে আবরণ রাখতে হয়, মানুষ সেটা রাখেনি। ষাটের দশকে একটা যুবক তার প্রিয় মানুষের অলক্ষ্যে হাসিতে যে আনন্দ পেত, আজ গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটিং করেও তা পায় না! কারণ মানুষের প্রাকৃতিক রহস্য মানুষ সংরক্ষণ করেনি।
যা-ই হোক, সময়ের আগেই সফলতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা থেকে কিছু প্রিম্যাচিউর সাফল্য মানুষ পেয়েছে, যার কিছু বিকলাঙ্গ ফলাফল তাকে কোণঠাসা করে ফেলে। সে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারে না, উলটো তার প্যারালাল শক্তি দাঁড়িয়ে যায়! এর কারণ, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অথবা একনিষ্ঠতা ধরে রাখতে না পারার কারণে মেধাস্বত্ত্ব পাচার হয়ে যায়। ফলে একাধিক
পরাশক্তির আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এরা কেউই প্রকৃতির বিপর্যয় নিয়ে উদ্‌বিগ্ন হয়নি। ফলে প্রকৃতি পরিচর্যার অভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। প্রকৃতি নিষ্ঠুর, টাফ-গেইমার বলে বলে গলা ফাটানো মূর্খতার পরিচয় দেওয়া ছাড়া কিছু নয়।
এরপর যে বিষয়টা আমার মনে হয়, তা হলো মানুষ মূলত আত্মকেন্দ্রিক প্রাণী। সে নিজস্ব
শ্রেষ্ঠত্বের প্রেমিক। ফলে প্রকৃতি ও বিকাশ যখন অসাম্যে ভুগছে, তখন সে নিজস্ব শ্রেষ্ঠত্ব দখলে রাখতে মানবিক প্রাচীর ভেঙে একটা দখলদারী কৌশল বেছে নেয়। আর সেটা হলো মুক্তবাজার অর্থনীতি, যেখানে মেধা ও মানুষকে পুঁজির দাস বানিয়ে রাখা হয়।
সে যা-ই হোক, আমার মনে হয়, সময়কে সময় না দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নেবার ভ্রান্তিবিলাসের
দৈন্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ নির্মমতা হলো মুক্তবাজার অর্থনীতি।
আলোচনা কোথাও খেই হারিয়ে থাকতে পারে সেটাও সময়ের আগে বলতে চাওয়া…আমার এই ভ্রান্ত ফলাফল।




কৃতজ্ঞতায় ভেজা গলায় বললাম আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধুবরকে, তোমার কাছে আমার অশেষ ঋণ! আজ যথেষ্ট নিয়েছি তোমার কাছ থেকে, তাই আর কোনও প্রশ্ন নয়। তোমাকে ধন্যবাদ দেবো না, ধন্যবাদ একটা শব্দ, যা তোমার পাশে বড্ড দীন-মলিন!
লজ্জিত নয়নে বলল, আরে, আমি তো গড় কথা বলি, তুমি অনেক তথ্য-উপাত্তভিত্তিক ব্যাখ্যা নিজের কাছেই রাখো।
আমাকে এত বাহবা দিলে!!
বললাম না হে, আমি একদমই ফাঁকা!
কৌতুকে বলল, আমি জানি, ভরা কলস নিজেকে ফাঁকাই বলে।
জের টেনে বললাম, তবে তুমিও তাই-ই!
আরে না! বিশ্বাস করো, আমার এ সম্পর্কে কোনও লেখাপড়া নেই, এটা আমার একান্ত নিজস্ব অ্যানালাইসিস।
কর্তৃত্বের সুরে বললাম, এটাই যথেষ্ঠ! অনেক পড়াশোনা করেও এমন বিশ্লেষণভিত্তিক আলোচনা অনেকেই করতে পারে না।
গৎবাঁধা পড়াশোনায় আমি বিশ্বাসী নই। গবেষণাভিত্তিক অভিজ্ঞতালব্ধ একান্ত জ্ঞান অধিক বাস্তব এবং কার্যকরী।




সুমিষ্ট হেসে বলল, চলো, এবার একটু গলা ভিজিয়ে নেওয়া যাক, অর্থনীতি অর্থনীতি চেঁচিয়েও দাঁতে কাটার জন্য কুটোটিও তো কেউ দিল না!