স্বর্গের দিন শেষ হবার গল্প (স্পয়লার অ্যালার্ট)
………………………………………………………………
কিছু সিনেমা আছে, শুরু থেকে শেষ অবধি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় মনে হয়, একটি চিত্রিত কবিতার দিকে তাকিয়ে আছি। ‘ডেজ অব হেভেন (১৯৭৮)’ তেমনই এক সিনেমা। যে জলটা হাতের তালুতেই ছিল, আঙুলের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ল বলে তেষ্টা থেকেই গেল, সে জলটার কথা ভেবে এক ধরনের কষ্ট হয়। সে সূক্ষ্ম কষ্টের নাম আফসোস। পুরো সিনেমা জুড়েই দুঃখ ছড়িয়ে আছে, সে দুঃখ হাত বাড়ালেই যে সুখ, তাকে ছুঁতে না পারার দুঃখ, স্মৃতির ডায়রিতে কেবলই আফসোস জমেথাকার দুঃখ। স্বপ্নের মতো কিছু একটা, তবে ঠিক স্বপ্ন নয়, কতকটা পরাবাস্তব, কতকটা ঘোর-উদ্ভূত, এরকম একের পর এক দৃশ্যপট সাজিয়ে সিনেমাটি বানানো হয়েছে। প্লটের সাথে গোছানো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, এর সাথে ভিজ্যুয়ালের অপূর্ব মিশেল সিনেমাটিকে অনন্য করে রেখেছে গত ৪০ বছর ধরে।
১৩ বছরের লিন্ডা পুরো সিনেমাটিকে তার বর্ণনায় টেনে নিয়ে গেছে নানান বাঁকে, নানান ধাঁচে। সিনেমাটিকে, সেখানে যা ঘটছে, সে লেন্সে না দেখে যদি লিন্ডার ন্যারেশনে দেখি, তবে সিনেমার অর্থটা অন্য রকমের হয়ে যায়। এ এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। কীরকম? ভেঙে লিখছি।
সিনেমার গল্পটা অল্প কথায় বলছি। বিল ও অ্যাবি পরস্পরকে ভালোবাসে। বিল শিকাগোতে একটা স্টিল মিলে কাজ করে। একদিন দুর্ঘটনাক্রমে মিলের ফোরম্যানকে বিল খুন করে। এরপর ওরা টেক্সাসে পালিয়ে আসে। সাথে ছিল বিলের ছোটবোন লিন্ডা। সেখানে ওরা একটা খামারে কাজ নেয়। সন্দেহ এড়াতে সবাইকে বলে ওরা তিন ভাইবোন। সে খামারের মালিক সম্ভ্রান্ত কৃষক অ্যাবিকে পছন্দ করে ফেলে, বিয়ে করতে চায়। বিল জানতে পারে, কৃষকটি অসুস্থ, মাত্র কয়েকমাস বাঁচবে, তখন অ্যাবিকে বিয়েতে রাজি করায়। বিয়ের পর কৃষক, অ্যাবি, বিল এবং লিন্ডা, চারজন মিলে সুখে দিন কাটাতে থাকে। কৃষক বিলকে দেখে ভাইয়ের দৃষ্টিতে, লিন্ডাকে দেখে বোনের দৃষ্টিতে। ওদিকে কৃষক ধীরেধীরে বেশ সুস্থ হয়ে ওঠে, তা দেখে বিল অ্যাবিকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। হঠাৎ বিল আবিষ্কার করল, অ্যাবি কৃষককে একটুএকটু ভালোবাসতে শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে অ্যাবি এই ত্রিভুজ প্রেমের ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করছিল। কৃষক বিলকে সন্দেহ করে, অ্যাবি বিলকে এটা বলায় বিল একটা সার্কাস দলের সাথে টেক্সাস ছেড়ে যায়।
এক বছর কাটল। বিল ফিরে এল। এসে অ্যাবিকে বলল, সে তাদের ছেড়ে চলে যাবে। তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে বিদায় নেয়ার সময় কৃষক ওদের দূর থেকে দেখে ফেলে। পুরনো সন্দেহটা বাড়ে। এতে বিলের উপর সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং বিলকে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। আত্মরক্ষার্থে স্ক্রু-ড্রাইভার জাতীয় কিছু একটা বিল কৃষকের বুকে ঢুকিয়ে দেয়। কৃষক মারা যায়। তখন সে অ্যাবি আর লিন্ডাকে নিয়ে একটা নৌকায় চড়ে পালিয়ে যায়। কৃষকের পিতৃতুল্য ফোরম্যান, যিনি বিল আর অ্যাবিকে আগে থেকেই সন্দেহ করতেন, তিনি পুলিশের সহায়তায় তিনজনকে ধরে ফেলেন। বিল পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। অ্যাবি উত্তরাধিকারসূত্রে কৃষকের সম্পত্তি লাভ করে।
সে ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখত, বড় হয়ে নৃত্যশিল্পী হবে। লিন্ডাকে সে একটি ড্যান্স একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেয়, এবং সেখানকার বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। প্রথম মহাযুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়া আমেরিকান সৈন্যদলের সাথে সে একটা ট্রেনে উঠে পড়ে। অন্যদিকে লিন্ডা বোর্ডিং স্কুলে গিয়ে তার পুরনো বন্ধুর দেখা পায়। মেয়েটি লিন্ডার চাইতে বয়সে বড়, খামারে কাজ করার সময় ওদের পরিচয় হয়েছিল। ওরা দুজন মিলে বোর্ডিং স্কুল থেকে পালিয়ে যায়।
এখন সিনেমা-জার্নিটা লিন্ডার চোখে হোক।
লিন্ডা তার ভাই বিলকে ভালোবাসে। তারা একসাথে অনেক মজা করে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কত লোকই খেতে পায় না, রাস্তায় অনাহারে পড়ে থাকে। তার সে কষ্ট নেই। বিল তাকে অনেক আদর করে, ওরা দুই ভাইবোন মিলে অনেক আনন্দে আছে।
সবাই জানে, অ্যাবি ওদের বোন। ওরা একসাথে থাকে, একসাথে কাজ করে, একসাথে ঘুরে বেড়ায়। বিল চায় না, কেউ জানুক, অ্যাবির সাথে ওদের কী সম্পর্ক। লোকের অভ্যাস, ওদের কিছু বলা হলেই ওরা জেনে না জেনে ওটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে।
একদিন এ পৃথিবীতে আগুন লেগে যাবে। পাহাড় আগুনে পুড়বে, জল আগুনে ফুঁসবে। সকল প্রাণী আগুনে ঝলসে যাবে। মানুষ সাহায্যের জন্য চিৎকার করবে। ওদের মধ্যে যারা ভাল, তারা স্বর্গে চলে যাবে; যারা খারাপ, ওদের ডাক ঈশ্বর শুনতে পাবে না, এমন-কী, ওরা যে কিছু একটা বলছে, ঈশ্বর তাও বুঝতে পারবে না।
কৃষক জানে না সে কবে অ্যাবিকে প্রথম দেখেছে, কিংবা কী দেখে অ্যাবিকে তার ভাল লেগেছে। হয়তোবা বাতাসে অ্যাবির চুল উড়ছিল, যা দেখে তার ভাল লেগে যায়।
সে জানে, সে মারা যাবে। সে জানে, কিছুই করার নেই।……..এ পৃথিবীতে তুমি একবারই বাঁচতে পারবে। আমার মনে হয়, যতদিন বেঁচে আছো, চমৎকারভাবে বাঁচো।
সূর্য ওঠা থেকে শুরু করে ডোবা পর্যন্ত ওরা সবসময়ই কাজ করে যায়। থামে না। করেই যায়। তুমি কাজ করবে না? তোমাকে বের করে দেয়া হবে। তোমাকে ওদের দরকার নেই। তোমার বদলে কাউকে না কাউকে ওরা পেয়ে যাবেই।
এ কৃষকের অনেক টাকা আছে। লোকটা ভালই। কারো কোনো ক্ষতি করে না। তুমি যদি ওকে একটা ফুল দাও, সেই ফুলটা সে রেখে দেবে, ফেলে দেবে না। তার জন্য আমার খারাপ লাগে। তার পাশে কেউ নেই, প্রয়োজনের সময় হাতটা ধরার মতো কেউ তার জীবনে নেই। মানুষটা ভাল, তার জন্য সত্যিই খারাপ লাগে।
সে ক্লান্ত। সবার মতো করে বাঁচতেবাঁচতে সে আজ ক্লান্ত। তার কিছু ভাল লাগে না। কিছু লোক যা পায়, তার চাইতে বেশি চায়। কিছু লোক যা চায়, তার চাইতে বেশি পায়। পৃথিবীটা বোধহয় এমনি করেই চলে।
আচ্ছা, বড় হয়ে আমি কী হবো? মাটির ডাক্তার? মাটি নিয়ে ভেবেভেবে জীবনটা পার করে দেবো?
এতটা ধনী আমরা কখনো ছিলাম না, তাই না? মানে, এই যে হঠাৎ করেই রাজার মতো করে বাঁচছি, আমি সেকথা বলছি। সারাদিন কোনো কাজ নেই, শুধু আড্ডা মারো আর শুয়ে থাকো। কিচ্ছু করতে হচ্ছে না, ধনীরা তো এভাবেই বাঁচে, না?
এই খামারে মন বসাতে হবে। যে করেই হোক! দরকার হলে আমি যা ইচ্ছে তা-ই করবো। মাঠে গড়াগড়ি খাবো, গমের গোছাগুলির সাথে গল্প করবো। আমি ঘুমিয়ে পড়লে ওরাও আমার সাথে গল্প করবে। ওরা আমার স্বপ্নে আসবে।
কেউ আমাদের চিঠি পাঠায় না। আমরা কোনো কার্ড পাই না। মাঝেমাঝে নিজেকে খুব বুড়ো মনে হয়, মনে হয়, আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল! যেন আমি আর নেই!
ওর অসুখ আর বাড়ল না, সে আগের মতোই রয়ে গেল। সে অসুস্থও হল না, সুস্থও হল না। ওরা ভাবল, তার অসুখটা তো বেড়ে যাওয়ার কথা, বাড়ছে না কেন? কেউ হয়তো ওকে খুব ভাল কোনো ওষুধ খেতে দিয়েছে, কিংবা এমনকিছু, যা তাকে স্থিতিশীল রেখেছে। ওরা অসুস্থ ঘোড়াকে গুলি করে মেরে ফেলে, সে মানুষ বলে ওরা তাকে মেরে ফেলতে পারছে না।
এখানে সার্কাসের দল এল। ভালই হল। এ ছয়মাসে আমার দম আটকে আসছিল। হাওয়াবদল দরকার। ওরা চেঁচাচ্ছিল। দলের বড়সড় লোকটা ছোটোখাটো লোকটাকে বলল, আমি শুরু করেছি, তুমিও করো। ছোটটা এল, শুরু করল। মঞ্চে উঠে ভাল কিছু করে দেখাতে না পারলে, ওরা মারামারি করতে শুরু করে। ছোটটা বলে, না, আমি এটা করিনি। বড়টা বলে, হ্যাঁ, তুমি এটা করেছ। ওরা আসলে কী করছে, তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না। ওদের কাণ্ড দেখে তোমার নিজেকে বোকা মনে হবে। একটু দূরে শয়তান বসে আছে, ওদের দেখছে আর হাসছে। মানুষকে খারাপ কাজ করতে দেখলে সে খুশি হয়। তখন সে তাদের ধরে সাপের ঘরে পাঠিয়ে দেয়। সাপ ওদের চোখ খেয়ে নেয়, ধীরেধীরে ওদের পুরোপুরি খেয়ে সাবাড় করে দেয়। শয়তান চুপচাপ দেখে আর হাসে। আমার মনে হয়, এমন একটা শয়তান খামারে ছিল।
কৃষক ভাবল, মেয়েটা আমায় ভালোবাসে।
কৃষক আমাকে পিয়ানো শিখিয়েছে। কীকরে বাজায়, কীকরে সুর তোলে। কৃষকই শিখিয়েছে। এ পৃথিবীর কোথায় কী আছে, কৃষক আমাকে তাও শিখিয়েছে।
কেউই নিখুঁত নয়। কোথাও কখনো কোনো নিখুঁত মানুষ ছিল না। তোমার ভেতরটা অর্ধেক শয়তান, অর্ধেক দেবদূত। মেয়েটা নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে এখন থেকে ভাল হয়ে বাঁচবে। সব দোষই তার একার। সে সুখী কি দুঃখী, এতে তার কিছু এসে যায় না। সে জানে, সে অনেক ভুল করেছে; সে এও জানে, সব ভুল সে শুধরে নেবে। নদীতে যখন কুয়াশা থাকে, এবং চারপাশটা শান্ত হয়ে থাকে, তখন সূর্যকে দেখতে লাগে ভূতের মতো। আমি আগে কখনো এটা জানতাম না। তুমি দেখবে, নদীর তীরে অনেক মানুষ। তবে তারা এতটাই দূরে, ওরা কী করছে, তুমি তা দেখতে পাবে না। ওরা সম্ভবত……সাহায্য চাইছে কিংবা অন্যকিছু। এমনও হতে পারে, ওরা কাউকে বা কোনোকিছুকে কবর দেয়ার চেষ্টা করছে। আমরা অনেক গাছ দেখেছি, সেসব গাছের পাতাগুলিকে কাঁপতে দেখেছি। দেখে মনে হয়েছে, যেন কিছু মানুষের ছায়া তোমার কাছে আসছে আর তোমার পথ আটকে রাখছে। রাতের প্যাঁচাগুলি কেমন কর্কশ স্বরে চেঁচায়, উড়ে বেড়ায়। আমরা জানতাম না আমরা কোথায় চলেছি, আমরা কী করতে যাচ্ছি। এর আগে আমি কখনো নৌকায় চড়িনি, সেবারই প্রথম।
কিছু দৃশ্য ছিল সত্যিই ভূতুড়ে, দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যেন আমার ঘাড়ের পেছনে কিছু শীতল হাত স্পর্শ করছে, এবং—এবং আমার কিংবা কিছুর খোঁজে এক মৃতব্যক্তি এসেছে। এ লোককে আমি চিনি, তার নাম………ব্ল্যাকজ্যাক। সে মারা গিয়েছিল। তার পা ছিল একটা, এবং সে মারা গিয়েছিল। এবং আমার মনে হয়, ব্ল্যাকজ্যাকই ওই হৈচৈটা করছিল।
ওই যে মেয়েটা, সে জানতো না, সে কোথায় যাচ্ছে, কিংবা সে কী করতে যাচ্ছে। তার টাকা ছিল না। হয়তো কারো না কারো সাথে তার দেখা হয়ে যাবে। আমি চাই, তার যেন ভাল কিছুই হয়। সে আমার ভাল বন্ধু ছিল।
কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে না লিন্ডা প্রকৃতপক্ষে ফিল্মের নির্মাতা টেরেন্স মালিক নিজেই? এক প্রহেলিকার বাতাবরণে জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজের ভাবনাগুলিকে কায়দা করে বলিয়ে নিচ্ছেন ১৩ বছরের লিন্ডার মুখ দিয়ে? আবার সে বলানোর ধরনটা এতটাই নিখুঁত যে সিনেমায় লিন্ডাকে দেখি কখনোকখনো ভুল গ্রামারে ন্যারেশন দিতে। স্বাভাবিক! ১৩ বছরের মেয়ে সবসময়ই নির্ভুল গ্রামারে কথা বললে সিনেমাই যে নির্ভুল হয় না!