ডুবাইয়ো-না

সস্তা লোকজন হচ্ছে কমদামি সিগারেটের মতো। একটা কমদামি সিগারেট যেমন রাস্তাঘাটেই বিক্রি হয়, ওটার খোঁজে বেশিদূর যেতে হয় না, ওরাও ঠিক তেমনই---চোখ হাঁটালেই পাবেন, হাত বাড়ালেই পাবেন। লোকে সস্তা সিগারেট খায় কীভাবে জানেন তো? নিতান্ত অভ্যস্ততায় প্যাকেট থেকে বের করে দ্রুত আগুন ধরায়, আর টানতে টানতে শেষ করে ফেলে। শেষ হলেও কোনও চিন্তা নেই, প্যাকেটে আরও আছে। পুরোটাও খেতে ইচ্ছে করে না মাঝেমধ্যে, অর্ধেক খেয়েই ফেলে দিলেও চলে। দামে কম, মানে তো আরও কম। সিগারেট খাচ্ছি, এইটুকুই সান্ত্বনা বা প্রয়োজন, ব্যস্‌, এর বেশি কিছু নয়। পুরো-খাওয়া কিংবা আধ-খাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দিতে দিতেই পরেরটা চোখের সামনে উঁকি দেয়। মনের মধ্যে একটুও আফসোস তৈরি হয় না। আরেকটা নিয়ে অর্ধেকটা খেয়ে ওটাও পায়ের নিচে পিষতে পিষতে যখন বাকিগুলি আপনার চোখের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে, তখন হঠাৎই আপনার মনে হবে,---ধুউস শালা! এই সস্তা মালটা খাচ্ছি কেন এত? খেয়ে কী হচ্ছে? পুরোটা খেতে ইচ্ছে পর্যন্ত করছে না! ছুড়ে ফেলে দেবার আগে দুইমিনিটও ভাবতে হচ্ছে না! সস্তা সিগারেট খেয়ে খেয়ে নিজেই সস্তা হয়ে যাচ্ছি! শালা!


ধরুন, আপনার মন চাইল একটা দামি চুরুট খেতে। চাইলেই কিন্তু পাবেন না। হয়তো আপনার পকেটে অত পয়সা নেই, কিংবা পয়সা থাকলেও ওই সিগারেট (মানে সিগার) সব জায়গায় পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট দুই-একটা দোকানে পাওয়া যায়। আয়েশ করে দামি ব্র্যান্ডের সিগার বা চুরুট, যা-ই বলুন না কেন, ফুঁকতে চাইলে ওটা কেনার মতো সামর্থ্য ও ইচ্ছে থাকতে হবে; কোথায় পাওয়া যায়, তা-ও জানতে হবে। দামি জিনিস রাস্তাঘাটে পাওয়া যায় না। দামি জিনিস বরাবরই লিমিটেড এডিশনের জিনিস। আরও ব্যাপার আছে। ওটাতে ঠিকঠাকমতো আগুন ধরানোর পর প্রথম সুখটানটা দেবার সময় খুব ধীরে ধীরে দিতে ইচ্ছে করবে, বিশেষ করে, সিগারটা যদি আপনি জীবনে প্রথম বার ফোঁকেন। চোখ বন্ধ করে ঠান্ডা হাওয়ায়, নির্ভার মস্তিষ্কে ধীরে সুস্থে এমন একটা সিগার শেষ করতে পারার আনন্দের সাথে আর কিছুর তুলনা হয় না। পুরো এক প্যাকেট হয়তো কিনতেও পারবেন না, দুই-একটা মাত্র কিনবেন। দুম্‌ করে পরের সিগারটা পোড়াতে ইচ্ছে করবে না, একধরনের মায়া লাগবে, পরে খাওয়ার জন্য রেখে দিতে ইচ্ছে করবে। একটার পুরোটা শেষ করতে না-পারলে আগুন নিভিয়ে যত্ন করে রেখে দেবেন পরে খাওয়ার জন্য। মনে হবে, আহা, একটাতেই যেন পয়সাউসুল! চুরুট ফুরোবে সময় নিয়ে, জীবনটাকেও ফুরোতে মন চাইবে সময় নিয়ে।


দামি চুরুট খুঁজে পেতেও কষ্ট, কিনতেও কষ্ট। সময় নিয়ে আয়েশ করে টানতে ইচ্ছে করে, তড়িঘড়ি করে শেষ করেই ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না। মনে হতে থাকে, থাকুক না…আরও কিছুক্ষণ, আরও একটু বেশি সময়!...কিছুক্ষণ আরও নাহয় রহিতে কাছে…একটা ভালো সিগারেট ভালো একটা স্মৃতির জন্ম দেয়। একটা দামি চুরুট দামি একটা গল্পের জন্ম দেয়। মুখের ভেতর টেনে-নেওয়া ধোঁয়ার দামে নিঃশ্বাসের দামটা ঠিক হয়ে যায়। সেই নিঃশ্বাসের দামের সাথে সাথে আয়ুর দামটা বাড়ে কিংবা কমে। অমন একটা সিগারেট বা সিগার প্রথম ও শেষ বারের মতো মাত্র একটি খেলেও হৃদয়ে যে অনুভূতির জন্ম হয়, তা লক্ষ সস্তা সিগারেট মিলেও দিতে পারে না। সস্তা সিগারেট সস্তা প্যাকেটে থাকে, সস্তা হাতে ওঠে। দামি চুরুট দামি প্যাকেটে থাকে, দামি হাতে ওঠে। দামি চুরুট খেতে চাইলে নিজেকে আগে দামি করে নিতে হয় কিংবা দামি ভাবতে শিখতে হয়। রাস্তার পাশে পানবিড়ির দোকানে বিক্রি হবার জন্য ওর জন্ম হয়নি। আধ-খাওয়া অবস্থায় পায়ের নিচে পিষে মরতেও ওর জন্ম হয়নি। রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পর ওয়েটারকে, সমান আর্থিক সামর্থ্যসম্পন্ন দুজনের মধ্যে, যে পাঁচ টাকা বকসিস দেয়, আর যে বিশ টাকা বকসিস দেয়, তাদের মনের দাম কিছুতেই একই নয়।


একজন দামি মানুষ ঠিক এই দামি চুরুটটার মতো। তাঁকে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে না। তাঁর সাহচর্য পেতে চাইলে আগে তাঁর সময়ের দাম মেটাতে হয়। চাইলেই তিনি আপনাকে সময় দেবেন না, তাঁর হাতে সময় থাকলেও দেবেন না। কেন দেবেন, বলুন তো? ভাবছেন, তাঁকে পরোয়া না-করলে কী হবে? পরোয়া যে করতেই হবে, ভায়া! হালচাষ করতে হলে বলদই লাগবে, ছাগল দিয়ে হালচাষ হবে না। একজন জিনিয়াসের কাজটা লক্ষ মেধাবী লোক মিলেও করতে পারে না। দুঃখের ব্যাপার, ওই সময়টা প্রায়ই পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। দুনিয়ায় দামি জিনিসগুলি সব সময়ই পয়সার চাইতে দামি। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় ওসব পেতে চাইলে। জগতের সবচেয়ে ভালো জিনিসগুলি কেবল পয়সা খরচ করলেই পাওয়া যায় না। যার সময়ের দাম আপনি চাইলেই মেটাতে পারেন, প্রায় সময়ই দেখবেন, তার সময় আপনার তেমন কোনও কাজেই আসছে না। যার সময় পেতে কিছুই লাগে না, তার সময় তেমন কোনও কাজেই আসে না। সবচাইতে ভালো জিনিস ভূরি ভূরি জন্ম নেয় না। বাঘকে কখনও ইঁদুরের মতো ডজনে ডজনে বাচ্চা প্রসব করতে দেখেছেন? লোকের মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে শুনতে চান ‘বাঘের বাচ্চা’, আর আপনার দৌড় কিংবা আচরণ হচ্ছে ইঁদুরের বাচ্চার মতন। ওরকম হলে হবে? বাঘের বাচ্চার বন্ধু হয় আরেকটা বাঘের বাচ্চা, বাঘের বাচ্চা কখনও ইঁদুরের বাচ্চার সাথে বন্ধুত্ব করে না। এইটুকু তো…ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে!


ফুটনোট। আমি স্মোকিং করি না। জীবনের প্রথম ও শেষ সিগারেটটা কয়েক টান খাওয়ার গল্পটা হলো এরকম: আমাদের র‍্যাগ-ডে’তে রাতের বেলায় বন্ধুরা সবাই মিলে আমাকে চুয়েটের তৎকালীন ‘নিউ হল’-এর ছাদে নিয়ে গেল। চার-পাঁচজন আমাকে চেপে ধরে জোর করে সিগারেট খাওয়ানোর চেষ্টা করল, কেননা আমি সিগারেট খেতে কোনওমতেই রাজি হচ্ছিলাম না। বাকিরা বলছিল, ‘সুশান্তকে আজকে সিগারেট খেতেই হবে। শালা, (চ-বর্গীয় বর্ণ দিয়ে শুরু একটা শব্দ উচ্চারণ করে সম্বোধনটা করেছিল আসলে।) সিগারেট না-খেয়েই অনার্স শেষ করে দিবি, এটা কেমন কথা?’ তখন আমার রীতিমতো নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছিল। বন্ধুদের বললাম, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি নিজেই খাচ্ছি, তোদের খাওয়াতে হবে না। আমাকে ছেড়ে দে।’ ‘ঠিক তো?’ ‘হ্যাঁ, প্রমিজ! খাব।’ ওরা ছেড়ে দিল আমাকে। তখন সেই জ্বলন্ত বেনসনটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘কীভাবে খায় এটা?’ আমার খুব কাছের বন্ধুদের একজন বলল, ‘ফিলটার মুখে লাগিয়ে ধোঁয়াটা মুখ দিয়ে টেনে গিলবি, এরপর নাক দিয়ে ছাড়বি।’ মুখে নিলাম, গাল ফুলিয়ে রাখলাম। আমাকে দেখে ওরা বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার গিলে ফেল, নাক দিয়ে ছাড়!’ পারলাম না। মুখ দিয়েই ছেড়ে দিলাম, উলটা খুব কাশি হচ্ছিল। ‘ওই শালা লেডিস! সিগারেট তোকে খেতেই হবে! খা খা, আবার খা!’ ‘তুই মেয়েদের চাইতেও অধম! লজ্জা করে না তোর? আমাদের অমুককে (নামটা সংগত কারণেই বললাম না।) বলতে হবে তোকে স্মোকিং শেখাতে!’ আমি সত্যিই চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারছিলাম না। এরকম তিন-চার বার চেষ্টা করার পর আমাদের বন্ধুদের মধ্যে নেতা গোছের যে বন্ধুটা, সে বলল, ‘থাক, ওকে ছেড়ে দে। বেচারার কষ্ট হচ্ছে। সুশান্ত, তাহলে তোকে ড্রিংক করতে হবে। রাজি?’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ড্রিংক তো করবই, সমস্যা নাই। আসলে এটা আমি খেতে পারছি না, চেষ্টা করলাম তো, দোস্তো!’


এটাই আমার প্রথম ও শেষ সিগারেটটা (মানে প্যাসিভ নয়, অ্যাকটিভ স্মোকিং আরকি!) খাওয়ার ইতিহাস। সেদিন আমি পারিনি, পরে আর কখনও ইচ্ছেও করেনি। এ কারণেই স্মোকিং করি না। স্মোকিং করা ভালোও নয়, খারাপও নয়; এটা জাস্ট একটা হ্যাবিট। আমি দেখেছি, যারা স্মোকিং করে, ওদের কাছে একটা সিগারেটের সুখ এক প্লেট বিরিয়ানির সুখের চাইতে অনেক অনেক বেশি। আমার এমন এক বন্ধু ছিল, যে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিতে পারবে দরকার হলে, কিন্তু সিগারেট খাওয়া ছাড়তে পারবে না মরে গেলেও। সিগারেটের সামনে ক্যানসার, করোনা এসব খুবই তুচ্ছ বিষয়। তার পকেটে সিগারেট নাই, এটা ছিল একটা অসম্ভব ঘটনা। সিগারেটের দামে সে তার প্রেমিকাকেও বেচে দিতে রাজি, এরকমই একটা ছেলে ছিল সে। তাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে ‘তোর এইম ইন লাইফ কী?’, সে বলত, ‘এই দুনিয়ার সব ব্র্যান্ডের সিগারেট একবার হলেও টেস্ট করা।’ তো, এই লেখাটা তৈরি করতে গিয়ে ওকে ফোন দিলাম। (জীবনে বেঁচে থাকতে চাইলে কখন যে কাকে কাজে লাগে!) অনেক দিন পর বন্ধুর ফোন পেয়ে সে তো মহাখুশি! ওর কাছ থেকে সিগারেটের দাম-টাম জেনে নিলাম। আমি তো ভাবতাম, একশো-দেড়শো টাকা দামের সিগারেটও বুঝি আছে! পরে শুনলাম, না অত দামের সিগারেট হয় না, তবে সিগার বা চুরুট হয়। হাজার টাকা দামেরও চুরুট বিক্রি হয় কিছু দোকানে, তা-ও সব জায়গায় পাওয়া যাবে না সে জিনিস। মনে পড়ে গেল, যখন আমার গিফটশপ ‘দোভানা’ ছিল, তখন আমি আমার দোকানে তিন-চারশো টাকা দামের চুরুট রাখতাম, অনেকেই কেবল চুরুট নিতেই আসতেন। সেই বন্ধুকে তখন যেদিন প্রথম আমার দোকানের নাম আর অর্থটা বলেছিলাম, কয়েক বার বলার পর সে নামটা বুঝতে পেরে হো হো করে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ও আচ্ছা, আমি তো ওদের মুখে শুনে ভাবলাম, ‘ডুবাইয়ো-না’---এটা আবার দোকানের নাম হয় কী করে!’