টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭)

বাদি নামের এক লোক আত্মহত্যা করবেন। তাঁর বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। কাজটা কীভাবে করবেন, সে প্ল্যানও করা শেষ। তিনি একটা কবর খুঁড়ে রেখেছেন। সে রাতে কিছু ঘুমের ওষুধ খেয়ে কবরটিতে শুয়ে পড়বেন। পরদিন ভোরবেলায় কেউ এসে তাঁকে মাটিচাপা দিয়ে দেবে। এখন কথা হল, এই কাজটা কে করবে? সকাল হতেই তিনি গাড়ি নিয়ে ওরকম কারো খোঁজে বেরিয়েছেন। বাদিকে কেউ এই সাহায্যটা করলে তার বিনিময়ে সে অনেক টাকা পাবে। গাড়িতেই টাকা রাখা থাকবে, মাটিচাপা দেয়া শেষ করে সে টাকাটা নিয়ে চলে যাবে, এমন-কী কাজটা করার জন্য কাউকে পেলে তাকে কিছু টাকা অ্যাডভান্স করে রাখতে চান বাদি। কবরে একজন মানুষ, মৃত কিংবা ঘুমন্ত। কবরটি মাটি ফেলে ভর্তি করতে হবে। এইটুকুই কাজ। ব্যস্‌! সহজ তো! কবরে মাটিফেলার কাজটা করতে ইচ্ছুক, এমন কাউকে বাদি খুঁজছেন। এটা নিয়েই ‘টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭)’, আব্বাস কিয়ারোস্তামির।

ভাবুন তো, আপনি এমন একটা গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যে গাড়িটার চালক আর বাঁচতে চাইছেন না, তিনি সেদিনই আত্মহত্যা করবেন, কেমন লাগবে? কেন আত্মহত্যা করবেন তিনি? নিজেকে খুন করে ফেলা! ভাবা যায়! ধর্মেও এটা করতে বারণ করা আছে। সব ধর্মেই। অন্যকে খুন করলে একটা মানুষ খুন করা হয়, নিজেকে খুন করে ফেললেও তো তা-ই করা করা হয়। হ্যাঁ, আত্মহত্যা মহাপাপ। আবার অসুখী হয়ে বেঁচেথাকাও এক ধরনের পাপ। যে জীবনটা ঈশ্বর আমাদের উপহার দিয়েছেন, সেটিকে বিষণ্ণ অবস্থায় রেখে দেয়ার কী অধিকার আমাদের আছে? কারো মন খারাপ থাকলে, তার কথাবার্তা, আচরণ অন্যদেরও কষ্ট দেয়। একজন অসুখী মানুষ আরও কিছু মানুষকে অসুখী করে দেয়। সেটা করা কি পাপ নয়? পরিবারকে, বন্ধুদেরকে, আশেপাশের মানুষকে, কাছের সবাইকে এবং নিজেকে ক্রমাগত আঘাত করে বাঁচা—এটা কি পাপ নয়? যদি তা না হয়, তবে আমি কাউকে আঘাত করে বেঁচে আছি, তা পাপ নয়, আর আমি সেখান থেকে মুক্তি পেতে ও অন্যদের মুক্তি দিতে নিজেকে খুন করে ফেললে, সেটা কেন পাপ হবে? ঈশ্বর নিশ্চয়ই চান না যে তাঁর সৃষ্টি কষ্ট পাক। এ কষ্টের সমাধান কী? একজন পৃথিবী থেকে চলে গেলে অনেকেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়। তাহলে তো সে চলেযাওয়ায় ঈশ্বরেরও সায় থাকারই কথা, তাই না? যুক্তি কী বলে?

: কবরে মাটি দেয়ার জন্য আপনি চাইলে কোদালের বদলে আপনার হাত দুটি ব্যবহার করতে পারেন। ওতে আপনার হৃদয়ের স্পর্শ থাকবে, আপনি কাউকে সত্যিই সাহায্য করছেন, একটা ভাল কাজ করছেন, এই অনুভূতিটা আপনার মধ্যে কাজ করবে।

: কাউকে সাহায্য করার কথা বলছ? মরতে? এটাকে সাহায্য বলে? আমি একটা জীবন বাঁচাতে পারি, এটা ভাল কাজ। এটাকে তুমি সাহায্য বলতে পারো। কিন্তু তুমি যাতে ঠিকভাবে মরতে পারো, সে সাহায্য করতে বলছ? তোমাকে বরং অন্য যেকোনোভাবে সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হতাম। তুমি আমাকে কারো মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে বলছ? তবে হ্যাঁ, যদি সত্যিই আমার সাহায্য তোমার কাজে লাগে, আমি কাজটা করবো। কাজটা সহজ নয়। কিছুতেই সহজ নয়! আচ্ছা, এখন বলো, বেঁচে থাকতে তোমার সমস্যা কোথায়? তোমার সমস্যা না জানালে কে তোমাকে সাহায্য করতে রাজি হবে? তুমি আমাকে চিন না, আমিও তোমাকে চিনি না। তোমারও তো পরিবার আছে, আত্মীয়স্বজন আছে, ভাই আছে। ওদের সাথে কোনো সমস্যা? কিংবা ব্যক্তিগত? নাকি ঋণ পরিশোধ করতে পারছ না, তাই এ পথ বেছে নিচ্ছ? প্রত্যেক সমস্যারই তো সমাধান আছে। তুমি যদি তোমার সমস্যা নিয়ে আলাপ না কর, কে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে? আমাদের সবারই সমস্যা আছে। সমস্যা নেই, এমন একটা মানুষও খুঁজে দাও তো দেখি! পারবে না। যদি সবাইই তোমার মতো সমস্যার সমাধান হিসেবে এই পথটা বেছে নিত, তবে এ পৃথিবীতে কেউই বেঁচে থাকতো না, পৃথিবী হয়ে যেত মানুষশূন্য। তাই না, বলো? কোথাও কেউ নেই, পুরোপুরি ফাঁকা একটা পৃথিবী……….ভাবতে পারো?

এ দুনিয়ায় একজনও মানুষ খুঁজে পাবে না, যে বিবাহিত, অথচ যার কখনো মরতে ইচ্ছে হয়নি। আমারও হয়েছিল। বিয়ের পরপর। এমন কোনো ঝামেলা ছিল না যেটা আমাদের মধ্যে হত না। এতো সমস্যা আর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়? সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, নিজেকে শেষ করে দেবো। একদিন ভোর হবার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে নিলাম শক্ত দড়ি, যেটাতে ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়া যায়। গাড়ি নিয়ে পৌঁছলাম মালবেরি গাছের বাগানে। তখনও ভোর হয়নি, চারিদিকে অন্ধকার। দড়িটাকে একটা উঁচু গাছের উপরের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। আটকালো না। আবারো মারলাম, হল না। তখন আমি নিজেই গাছে চড়লাম। গাছের সাথে দড়িটা বাঁধলাম শক্ত করে। হঠাৎ! দেখি, আমার হাতের নিচে নরম কী যেন! ওটা ছিল মালবেরি ফল। সুস্বাদু মালবেরি ফল! আমি ওটা খেলাম। আহা, কী রস, কী স্বাদ! আরও একটা খেলাম, এরপর আরও একটা। হঠাৎ দেখি, পাহাড়ের গায়ে সূর্য উঠছে। চারপাশে সবুজ প্রকৃতি। আহা, সে কী দৃশ্য! কী অপূর্ব সে অনুভূতি! একসময় দেখলাম শিশুরা সে পথ দিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। ওরা গাছের নিচে এসে থামল, সবাই মিলে আমার দিকে তাকাল। ওরা আমাকে গাছটা ঝাঁকাতে বলল। আমি ঝাঁকালাম। কত মালবেরি ঝরে পড়ল। ওরা সবাই তৃপ্তি ভরে মালবেরি খেল। দেখে বড়ো শান্তি পেলাম। কিছু মালবেরি সাথে করে নিয়ে বাড়িতে ফিরলাম। ফিরে দেখি, আমার স্ত্রী তখনও ঘুমাচ্ছে। ঘুমভেঙে সেও মালবেরি খেল। খুব তৃপ্তি নিয়েই খেল।

কী হল ব্যাপারটা? আমি বেরিয়েছিলাম নিজেকে খুন করতে আর ফিরে এলাম হাতে কিছু মালবেরি নিয়ে। ওই একটা মালবেরি আমার জীবন বাঁচিয়ে দিল। ওটার স্পর্শ না পেলে আজকের দিনে আমি হয়তো থাকতাম না। আমি নিজেকে বদলে ফেললাম। আগে যেমন করে জীবনটাকে দেখতাম, তেমন করে আর দেখতাম না। নিজের এ পরিবর্তনে এক ধরনের শান্তি অনুভব করলাম। সবার জীবনেই সমস্যা আছে। জীবন এরকমই। দেখো, এ পৃথিবীতে কত মানুষ আছে, একটাও পরিবার খুঁজে পাবে না, যে পরিবারে সমস্যা নেই। তুমি তো বলছই না তোমার সমস্যাটা আসলে কী। জানলে তোমাকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারতাম। ডাক্তারের কাছে গেলে তো তোমার সব সমস্যা উনাকে খুলে বলতে হবে। না বললে উনি কীকরে তোমাকে সাহায্য করবেন? এক লোক ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল, আমি আমার শরীরের যেখানেই স্পর্শ করি, সেখানেই ব্যথা পাই। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, তোমার আঙুলটাই তো ভাঙা, ব্যথা তো লাগবেই! তোমার সমস্যাটা কোথায়, জানো? তোমার মনেই। আর কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিক আছে, যেমন থাকার কথা, তেমনই আছে। তোমার মনটাকে বদলে ফেলো, দেখার ধরনটা বদলে ফেলো, চিন্তার রাস্তাটা বদলে ফেলো, দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি ঘর ছেড়েছিলাম মরার জন্য, অথচ একটা সাধারণ মালবেরি ফল আমাকে বাঁচিয়ে দিল, ঘরে ফিরিয়ে আনল। পৃথিবীটা, তুমি যেমন দেখো, তেমন নয়। পৃথিবীটা পৃথিবীর মতোই। তোমাকে দেখার ধরনটা বদলাতে হবে, পৃথিবীও তখন বদলে যাবে। যাবেই যাবে! আশাবাদী হও। জীবনটা দেয়া হয়েছে বাঁচার জন্য, মরার জন্য নয়। ছোটোখাটো সমস্যার জন্য যদি মরে যেতে ইচ্ছে করে, তবে তো আর কিছু হল না। জীবনের সকল সমস্যার চাইতেও জীবন বড়ো। এটা মনে রেখো। এই জীবন একটা রেলগাড়ির মতো, কেবলই সামনের দিকে ছুটেচলা, ছুটতে ছুটতে একসময় শেষ স্টেশনটা আসবে, তখন জীবনের শেষ। সেখানে মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে। হ্যাঁ, মৃত্যু একটা সমাধান বটে, তবে তার একটা সময় আছে। যখন তোমার সব শক্তি শেষ, তুমি আর চলতে পারছ না, দেহ ক্ষয়ে গেছে, শরীর জরাগ্রস্ত, তখন নাহয় মরো, এর আগে কেন? তুমি কিছু একটা ভেবে নিলে, এরপর বুঝলে তুমি ভুল করেছ, ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কী লাভ ওতে? আমরা যখন কোনোকিছু করি, তখন মন বলে, যা করছি, তা-ই ঠিক। একসময় মনে হয়, হায়, কেন এটা করেছিলাম? মুহূর্তের উত্তেজনায় মানুষ কত কী যে ভুল করে বসে!

বেঁচেথাকার যা আশা ছিল, তার সবই হারিয়ে গেছে, তাই না? আচ্ছা, সকালে ঘুম থেকে উঠে কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছো? এই যে এতো দারুণ সূর্যোদয়, এটা কি আর দেখতে ইচ্ছে করে না? সূর্যাস্তের সময় যে লাল-হলদে সূর্যটা, ওটাকে আর দেখবে না? থালার মতো রুপোলী চাঁদটা দেখেছ না? আকাশভরা তারার মেলা, এটা দেখার জন্যও তো বেঁচেথাকা যায়! চাঁদনি রাত, চাঁদটা শুভ্র আলোর বন্যায় চারিদিক ভাসিয়ে দিচ্ছে, আর তুমি তোমার চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলবে? ওই পৃথিবীর মানুষগুলি এই পৃথিবীর দিকে তাকায় আর বলে, আহা, যদি ফিরে যেতে পারতাম! আর তুমি কিনা সেখানে চলে যেতে চাইছ! কলকল করে যে ঝর্না বয়ে চলে, সেখানে আর কখনো গা ভেজাবে না? অমন টলমলে পানি খেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার? ঋতুগুলির দিকে তাকিয়ে দেখো, প্রতিটি ঋতুই সাথে করে কোনো না কোনো সুস্বাদু ফল নিয়ে আসে। গ্রীষ্ম কি হেমন্ত, শীত কি বসন্ত, প্রত্যেকেই কিছু না কিছু আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে আসে। প্রকৃতি আমাদের যা খাবার দেয়, অতো খাবার কোনো মা-ই তার সন্তানের জন্য ফ্রিজে রাখতে পারবে না। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টির জন্য যা করেন, তা কোনো মা-ও তার সন্তানের জন্য করতে পারবে না। এই যে এতো ঐশ্বর্য, এর কি কোনো মূল্যই নেই? তুমি এই সবকিছু পেছনে ফেলে চলে যেতে চাও? চেরি ফলের যে স্বর্গীয় স্বাদ, তা তোমাকে টানে না? বাঁচতে বলে না? আমি তোমার বন্ধু। আমি তোমাকে মিনতি করে বলছি, বেঁচে থাকো।

এতকিছুর পরও বাদি বাঁচতে চান না। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। আমাদের জানতে ইচ্ছে করে, কেন তিনি মরতে চান? মুভিতে এর কোনো সরাসরি উত্তর নেই। একটা পাহাড়ি পাথুরে পতিত জমি, ধুলো উড়িয়ে একটা গাড়ি ছুটে চলছে। জায়গাটি মৃত্যুরই কথা বলে, কবরটা ওখানেই খোঁড়া। বাদি তাঁর মৃত্যুর পরের বন্ধুকে খুঁজে চলেন, আর আমরা স্ক্রিনের এদিক থেকে জীবনের অর্থ খুঁজে চলি। ফিল্মের গতি ধীর, দেখতে দেখতে ক্লান্তি আসতে পারে, তবু এ ফিল্ম যতই সামনের দিকে এগোয়, আমাদের ভেতরের মানুষটা ততই নানান প্রশ্নের উত্তর যেন না চাইতেই পেয়ে যায়। বাদির মৃত্যুর প্লট নয়, বরং মৃত্যুইচ্ছাই এ সিনেমার প্রাণ। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বাদি কি বেঁচে ছিলেন শেষ পর্যন্ত? কবরে শোয়ার পর বৃষ্টি নামে। সে বৃষ্টিতে প্রাণহীন সে ভূমিতে প্রাণের সঞ্চার হয়নি? পরদিন সকালে কে আসবে তাঁর কবরে মাটি ফেলার জন্য? আচ্ছা, বাদি কেন বাঁচতে চান না, এটা কেন তিনি আমাদের জানাচ্ছেন না?

কখনো কখনো মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আসে, যখন মানুষ ঈশ্বরের আশায় বসে থাকতে পারে না, নিজের মৃত্যুর ভারটা নিজের হাতেই নিয়ে নেয়। কিন্তু কেন? জীবনের প্রতি এ অনীহার পেছনে কী আছে? বাদি বলছেন, আমি কেন মরতে চাইছি, এটা জেনে তোমার কোনো লাভ নেই। আর আমি নিজেও এটা তোমাকে জানাতে চাইছি না। জানালেও তুমি এটা বুঝবে না। এমন নয় যে, তোমার বোঝার শক্তি নেই। আছে। তবে আমি কোন অনুভূতি থেকে মরতে চাইছি, সেটা তুমি কখনোই অনুভব করতে পারবে না। তুমি বড়োজোর সহানুভূতি দেখাতে পারবে, বোঝার চেষ্টা করতে পারবে, কিন্তু কিছুতেই আমার যন্ত্রণাটা অনুভব করতে পারবে না। তুমি যেমনি কষ্ট পাও, আমিও তেমনি কষ্ট পাই। আমি কষ্ট পাচ্ছি, এইটুকুই কেবল বুঝতে পারবে, তবে সেটা অনুভব করা তোমার সাধ্যের বাইরে। শুধু তোমার কেন, সবারই সাধ্যের বাইরে।……….সত্যিই তা-ই। নিজের কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা অন্যের কাছে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। কষ্ট গিলে বাঁচার মজাই আলাদা! কষ্টের ভাগ কেউই নিতে পারে না, উল্টো কষ্ট শেয়ার করলে বাড়তি কিছু কষ্ট এসে ভাগ্যে জুটতে পারে, যদি আমার কষ্টকে কেউ ভুলভাবে নেয়। হাসি মুখে, কষ্ট বুকে—এর নামই তো জীবন!