জীবনের কিছু সহজ পাঠ


এক। কোনও একটা মানসিক হাসপাতালে ডাক্তারই সবচেয়ে বড়ো পাগল; সেখানে পাগলরাই স্বাভাবিক, সুস্থ মানুষ। শত পাগলের ভিড়ে, ডাক্তারকে যদি পাগলেরাই বিচারের ভার নেয় অনেকটা জোর করেই, তবে ডাক্তার সারাজীবনই তাদের মাঝে পাগল হিসেবেই প্রমাণিত হয়ে যাবেন, কখনও স্বাভাবিক মানুষ হয়ে থাকতে পারবেন না, কেননা ডাক্তারের প্রধান ভুল হলো এই যে, তিনি এমন কিছু পাগলের চিকিৎসায় নেমেছেন, যেখানে এমনকি বিচারক নিজেই বদ্ধপাগল! যেখানে বিচারক নিজেই পাগল কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট, সেখানে ন্যায়বিচার আশা করাটা চরম বোকামি।


দুই। যদি আমরা স্বেচ্ছায় নরকে বাস করি, তাহলে এতে বিন্দুমাত্রও ভুল নেই যে, আমরা সেখানে সুখে থাকব, কিন্তু যদি আমাদের জোর করে স্বর্গেও পাঠানো হয়, তবু সেটি আমাদেরকে অসুখী করে তুলবে। মনের বিরুদ্ধে অমৃত খেলেও সেটি পেটে গিয়ে বিষে পরিণত হয়। কারও ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে রাজপ্রাসাদে পাঠানোর চাইতে বরং তার ইচ্ছেমাফিক তাকে কুঁড়েঘরে রাখা ভালো। স্বর্গ কি নরক, দুটোই মানুষের মনের মধ্যে! বিষ কি অমৃত, দুটোই মানুষের জিভের মধ্যে!


তিন। পরনির্ভরশীলতা কোনও একমুখী পথ নয়। যদি আমরা কাউকে আমাদের উপরে নির্ভরশীল করতে চাই, তাহলে সেটি ততক্ষণ অসম্ভব, যতক্ষণ না সে ব্যক্তি আমাদের উপর স্বেচ্ছায় নির্ভরশীল হচ্ছে। যদি আমরা নিজেরাই নিজেদের পূর্ণসম্মতিতে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হই, তবে অন্য কারও পক্ষেও আমাদেরকে তার উপর নির্ভরশীল করা সম্ভব হবে না। আরেকটি ব্যাপার ঘটে। কখনও কখনও, এই নির্ভরশীলতা দুই দিক থেকেই হয়ে থাকে। কীরকম? আমি কারও উপর নির্ভরশীল বলেই সে আমার উপর নির্ভরশীল, কিংবা সে আমার উপর নির্ভরশীল বলেই আমি তার উপর নির্ভরশীল---এই দুটির যে-কোনওটি ঘটতে পারে।


চার। পৃথিবীতে সবাইকে বুঝে চলার মতো বড়ো ভুল আর একটিও নেই। যে সবাইকে বুঝে চলতে চেষ্টা করে, যে নিজেকে সবার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে, যে সবাকেই খুশি দেখতে চায়, যে সবার কাছ থেকেই স্বীকৃতি বা প্রশংসা পাবার আশা করে, সবার মুখেই একচিলতে হাসি দেখবার জন্য অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যায়, তার মতো কপট ব্যক্তি আর দ্বিতীয়টি নেই। সব মানুষকেই ভালোবাসা এবং সবার সুখের জন্য কাতর হওয়া কেবলমাত্র একজন শীর্ষ কপট ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। সব কিছু বুঝতে পারে যে, সবার মন বুঝে চলে যে, প্রকৃত অর্থে সেই ব্যক্তিই মনে মনে একজন হারামি।


পাঁচ। যদি মরতে চান, তাহলে সবার কথা মেনে চলুন। আর যদি বাঁচতে চান, তাহলে নিজের বুদ্ধি ও বিবেক কাজে লাগান। যার কথা শুনে চলতে আপনি বাধ্য নন, তাকে ‘না’ বলতে শিখুন।


ছয়। বেশিরভাগ সময়ই, আমরা যা-কিছু জানি, তা-কিছু তুচ্ছ। যা-কিছু ভাবি বলে মনে করি, আসলে ওসবকে বোধই বলে না। এই অন্ধত্ব নিয়ে সুখী থেকে থেকেই আমরা একটা অন্ধের জীবন কাটিয়ে দিই।


সাত। জীবনের প্যাঁচ কিছুই জানা ছিল না কখনওই। প্রয়োজনও হয়নি। কিন্তু এখন বুঝি, জীবনের পথে হাঁটতে গেলে দৃশ্যমান সব কিছুকে বিশ্বাস করা যাবে না। বিশ্বাস করে মরার চাইতে অবিশ্বাস করে বাঁচাটা জরুরি। অনেকেই অন্য কথা বলবে হয়তো, কিন্তু মাথায় রাখবেন, বিশ্বাস করে মরবেন যখন, তখন পাশে ওদের কাউকেই পাবেন না, সমস্ত মৃত্যুযন্ত্রণা নিজেকে একাই ভোগ করতে হবে। এ পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে, যারা, যাকে শত্রু ভাবেন, তার সাথেও ভালো আচরণ করে।


আট। এই পৃথিবীতে সকলের সমস্যা বুঝতে যাবার মতো বড়ো পাপ আর একটাও নেই। তুমি যার সমস্যা বুঝতে যাবে, দেখবে, সবার আগে ভুলটা সে-ই তোমাকে বুঝবে। এমনও হতে পারে, এর ফলে তুমি কোনও বিপদে পড়লে তোমাকে আরও বেশি বিপদে ফেলে দেবার রাস্তাটা সে-ই সবার আগে তৈরি করবে।


নয়। যে অন্যের বিশ্বাস ভাঙে, সে নিজেই নিজের জন্য বিপদ ডেকে আনে, নিজের খননকৃত গর্তে নিজেই সবার আগে পড়ে। কীভাবে? একটু অপেক্ষা করতে হয় সময়ের সমুচিত জবাবটা দেখতে চাইলে। সময়, সব উত্তর, সময় হলেই দিয়ে দেয়।


দশ। যদি তোমার কাছের মানুষগুলো কোনওভাবে বুঝে যায় যে, তুমি তাদের প্রচণ্ড ভালোবাসো, তাহলে তারা তোমার এই তীব্র ভালোবাসাকে সুযোগ ভেবে কাজে লাগাতে শুরু করে দিতে পারে, আর দিনশেষে তাদের কাছে তুমি হয়ে যাবে আস্ত একটা বলদ, যদিও তারা তোমার সামনে সেটি কখনও প্রকাশ করবে না হয়তোবা, কিন্তু মনে মনে তৃপ্তির হাসিটা ঠিকই হাসবে।