চাকরি থেকে শেখা/ দ্বিতীয় পর্ব

চাকরিতে একটা মজার ব্যাপার দেখেছি। বাক্যের প্রচলিত গঠন বদলে নতুন এক ধরনের বাক্যপ্রণালীতে আমরা কথা বলি, কথা বলতে অভ্যস্ত হই। কীরকম? ধরুন, কেউ আপনাকে ডাকলে আপনি যদি যেতে সম্মত হন, তবে আপনি কী বলবেন? হ্যাঁ ভাই, আমি আসছি। এরকমই তো, না? সিভিল সার্ভিসে সেটা হয়ে যাবে…স্যার স্যার! জ্বি স্যার, আমি আসছি, স্যার! বাক্যের নানান জায়গায় ‘স্যার’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে কথাবলার কায়দা আমরা রপ্ত করে নিই চাকরির প্রয়োজনেই। যাঁর সাথে আপনি কথা বলছেন, তিনি পদমর্যাদায় আপনার যত উপরে, ‘স্যার’ শব্দটি তত বেশিবার উচ্চারিত হবে। এবং একটু জোর দিয়ে উচ্চারণ করতে হবে। এমনও হয়েছে, বেশ সিনিয়র কারও ফোন এলে আমি এতবার ‘স্যার’ উচ্চারণ করি, পরে কখনও নিজের ভয়েস রেকর্ড শুনলে নিজেরই একটু অন্য রকম লাগে। এই তো সেদিন। একজন কমিশনার মহোদয়ের (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার) সাথে প্রায় সাড়ে তিন মিনিটের কথায় আমি ৭৪-বার ‘স্যার’ উচ্চারণ করেছি। কিছু করার নেই, এটাই রীতি। আর একটা মজার নিয়ম বলি। আমরা সিনিয়রদের সাথে কথা বলবার সময় ‘হ্যাঁ স্যার’, ‘জ্বি স্যার’ না-বলে বলি ‘স্যার স্যার!’, মানে দুইবার ‘স্যার’ উচ্চারণ করার অর্থই হলো আমি তাঁর কথার সাথে সম্মতিপ্রকাশ করছি। (না করেই-বা উপায় কী!) প্রায়ই, নিজেকে এবং অন্যদের দুইবারেরও অধিক ‘স্যার’ উচ্চারণ করতে শুনি। ধরুন, আপনি সিনিয়র কারও দীর্ঘসময় ধরে বলা কথার প্রতিটির সাথেই (স্বাভাবিকভাবেই, চাকরির খাতিরে) সহমত পোষণ করছেন। তখন আপনি হাসিমুখে একটু নিচুস্বরে ‘স্যার স্যার স্যার স্যার স্যার…’ করেই যেতে পারেন, এতে তেমন কোনও ঝামেলায় আপনি পড়বেন বলে মনে হয় না। আরও মজা আছে। একটু চেঁচিয়ে মিলিটারি স্টাইলে ‘স্যার!’ সম্বোধন শুনতেও অনেক সিনিয়র পছন্দ করেন। লেডি অফিসাররা একটু আহ্লাদি কণ্ঠে ‘স্যাআআআর…স্যাআআআর…’ বলেন অনেক সময়, যা সিনিয়রদের (পুরুষ ও মহিলা উভয়ই) প্রায় সকলেই স্বাভাবিকভাবেই নেন।


খোঁজ রাখুন কার কার সাথে আপনার বসের সম্পর্কটা ভালো। ওদের খেপিয়ে দেবেন না। ওরা খুশি না-থাকলে আপনার পক্ষে চাকরি-করা সহজ নয়। আপনার বসের বন্ধুও কিন্তু আপনার এক ধরনের বস। বসের স্ত্রী আপনার বিগবস, বসের সন্তান ও আত্মীয়স্বজনও আপনার শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার পাত্র, এমনকি বসের গাড়ির ড্রাইভারও আপনার লিটলবস! আপনার চোখে (আই মিন, মুখে) বসের স্ত্রী হোক পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মানুষ। বসের সন্তান অবশ্যই এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, মেধাবী, গুণসম্পন্ন মানবসন্তান, যার কোনও তুলনাই হয় না। (রীতিমতো গিফটেড চাইল্ড আরকি!) বসের ভুঁড়ি যদি জ্যামিতিক প্রগমনেও বাড়ে, তবুও হাসিমুখে বলবেন, “স্যার, আপনি দিনদিন স্লিম হচ্ছেন আর বয়স কমছে! সত্যিই আপনি সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন, স্যার!” কিংবা ফেসবুকে বসের প্রোফাইল পিকচারে ‘এভারগ্রিন হিরো’, ‘আউটস্ট্যান্ডিং’, ‘সুপার্ব’, ‘হারানো দিনের নায়কের মতো লাগছে’, ‘স্যার তো অলওয়েজ ইয়াং’, ‘অভিনন্দন’ ইত্যাদি লিখে দেবেন। মনে রাখবেন, আপনার পোস্টে লাইক বা কমেন্ট দেন না মানে এ নয় যে আপনার বস ফেসবুকে বসার সময়ই পান না কিংবা আপনার পোস্ট আপনার বস খেয়ালই করেন না! বস কিন্তু ঠিকই বুঝবেন যে আপনি স্রেফ তেলবাজি করছেন, এবং সব বুঝেশুনেও উনি খুশি হবেন। মানবজাতি জেনেবুঝেও তেল খেতে পছন্দ করে। তা ছাড়া, বস এবং তাঁর পরিবার অনিন্দ্যসুন্দর হলে তো আপনার কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা হওয়ার কথা নয়, তাই না? আরে ভাই, বসের কোনার দাঁতটা বাঁকা, এটা বলে আপনার কী লাভ? ওই বাঁকা দাঁত দিয়ে কষ্ট করে মাংস ছিঁড়ে তো উনাকেই খেতে হচ্ছে, আপনার তো ওতে কোনও আপত্তি দেখি না!...যেখানে ছিলাম, সেখানে আসি। আমি দেখেছি, বাংলাদেশে প্রায় সব কিছুই নির্ধারিত হয় ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে। তাই কাউকে আটকে দেওয়াই বড় কথা নয়, উনি আটকে গেলে আপনি যে বিপদে পড়বেন, সে বিপদ হজম করার মতো সামর্থ্য, ধৈর্য ও সময় আপনার আছে কি না, সেটাই বড় কথা। প্রয়োজনে আপনার বসের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন কিংবা কোনও সিদ্ধান্ত না-লিখে ফাইলটা উপরে পাঠিয়ে দিন। এসব ক্ষেত্রে বলটা নিজের কোর্টে রাখবেন না, বসের কোর্টে ছেড়ে দিন, উনাকেই খেলতে দিন। এতে আপনারও লাভ। সবসময়ই মনে রাখবেন, যিনি চাকরিতে আপনার একদিন আগেও জয়েন করেছেন, কী করে জটিল পরিস্থিতি সামলাতে হয়, তিনি তা আপনার চাইতে অবশ্যই বেশি জানেন ও বোঝেন। বস ফাইলে কী লিখলেন, কেন লিখলেন, কীভাবে লিখলেন এসব নিয়ে ভাবলে ও চর্চা করলে আপনি অনেক কিছু শিখতে পারবেন। জানুন, বুঝুন, চাকরি করতে চাইলে এর কোনও বিকল্প নেই।


সবসময়ই মাথায় রাখুন, এই চাকরিটা না-থাকলে আপনাকে রাস্তার কুত্তায়ও গুনবে না। চাকরি নাই, আপনার চেয়ার নাই, ফেসবুকে আপনার লাইকও নাই! ফেসবুকে আপনার লাইক-কমেন্টের শতকরা ৮০ ভাগই পান আপনার চাকরির কারণে। হ্যাঁ, লাইক ও কমেন্ট পাওয়ার মতো যদি অন্য বিশেষ কোনও যোগ্যতা থাকে, তা হলে ভিন্ন ব্যাপার। তবে কী জানেন, যার চাকরি, ব্যবসা, এককথায় জীবিকার অবস্থানটা শক্ত না, সাধারণত তার কোনও অবস্থানকেই কেউ আসলে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। সে অনেক চমৎকার কবিতা লিখে পোস্ট করলেও লোকে বলে, ছাগলে কি না লেখে! আপনার ছবিতে এত লাইক পড়ে কেন, ভেবে দেখেছেন কখনও? আপনি দেখতে কি ঋত্বিক রোশানের মতো নাকি? দেখতে ওরকম হলেও আপনাকে এত লোক গুনত নাকি? এই লাইকগুলির শতকরা ৮০ ভাগের মালিক আপনার চাকরি ও আপনার অবস্থান, আপনি নন। আমার কথায় আহত হলে আমায় ক্ষমা করবেন, আমি যা দেখেছি, তা-ই বলছি। আপনার যা প্রতিপত্তি, যা গ্রহণযোগ্যতা, যা স্বীকৃতি, যা সন্তুষ্টি, তার প্রায় সব কিছুই এই চাকরিকে ঘিরেই। চাকরি আছে বলেই আপনি নিজেকে ও আপনার পরিবারকে সাহায্য করতে পারছেন, কিছু লোক আপনাকে চিনছে ও সম্মান দিয়ে কথা বলছে, চাকরিতে ব্যস্ত আছেন বলেই অনেক দুঃখ ও হতাশা আপনাকে গ্রাস করতে পারছে না। আপনার চাকরিই আপনাকে কেয়ার করে চলতে অনেক লোককে বাধ্য করে! ওটা না থাকলে আপনাকে না গুনলেই-বা কী এসে যায়? এটা আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্যদের রিজিক। চাকরি থাকলে চাকরিকে ইচ্ছেমতো গালি দেওয়া যায়। চাকরিকে গালি দিতে হলেও একটা চাকরি লাগেই! একবার নিজেকে বেকার কল্পনা করে দেখুন না কেমন লাগে! দেখবেন, সবার চোখে এক অথর্ব, অপদার্থ, বোঝা ও করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে আছেন। আত্মসম্মান ও তৃপ্তি নিয়ে বাঁচতেও একটা চাকরি লাগে। যার চাকরি নেই, সে নিজেকেই একটা সময় সম্মান করতে ভুলে যায়। হয়তো বলবেন, ব্যবসা করবেন, উদ্যোক্তা হবেন, হ্যান করবেন ত্যান করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তো করুন না! যারা করতে পারে, ওরা এত কথা বলে না। যারা করতে পারে না, তারাই শুধু এইসব বড় বড় কথা বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগে। ব্যবসা-করা পৃথিবীর মহত্তম ও কঠিনতম কাজগুলির একটি। আবারও বলছি, সত্যিই যদি আপনার অন্য কিছু করার থাকে, তবে চাকরিটা ছেড়ে দিন, সেই কাজটা করুন। মুখে এত কথা বলে কী লাভ? আপনি কখনওই আপনার চাকরির চাইতে বড় নন, বড় হলে আপনি চাকরিটা করতেন না, চাকরি দিতেন। আরে ভাই, না-পোষালে অন্য রাস্তা দেখেন না! কে আপনাকে এখানে আটকে রেখেছে? এত ফালতু কথা বলে কী লাভ? আমার অভিজ্ঞতা বলে, চাকরি নিয়ে অসন্তোষ ও অভিযোগ আপনার কর্মক্ষমতাকে নষ্টই করবে শুধু, আর কিছু নয়।


বস আপনার কোনও ব্যাপারে প্রশংসা করলে সেটা আপনার সমপর্যায়ের কারও বা সিনিয়রদের সাথে শেয়ার না করে অধস্তনদের সাথে শেয়ার করুন। এতে ঈর্ষার বদলে সমীহ পাবেন। কাজেকর্মে আপনি যত ভালোই হন না কেন, মাথায় রাখুন, আপনার সহকর্মীরা সবাই মনে করে, আপনি ওদের চাইতে খারাপ। আপনার সাথে গল্প করলে কারও যদি নিজেকে ভালো মনে হয়, তবে সে আপনাকে অবশ্যই পছন্দ করবে। যার সাথে সময় কাটালে নিজেকে লো ফিল হয়, আমরা তাকে কখনওই পছন্দ করি না। সেই আয়নাই সবচাইতে ভালো আয়না, যে আয়নায় নিজেকে দেখতে সুন্দর লাগে। সেই মোবাইলই সবচাইতে ভালো মোবাইল, যে মোবাইলে সেলফিটা ফরসা ফরসা আসে। আমরা এরকমই ভাবি। এটাই হিউম্যান নেচার। তাই নিজের কৃতিত্ব প্রচার করে ওদের চোখে ঈর্ষার বস্তু হয়ে ওঠার কোনও মানে হয় না। অধস্তনরা ঈর্ষা করুক আর যা-ই করুক, আপনাকে সমীহ করে চলবেন, কেননা ওঁদের মাথায় আসবে, আপনার মাধ্যমে ওরা হয়তো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও সুযোগসুবিধা আদায় করে নিতে পারবেন বা ঝামেলামুক্ত হয়ে চাকরি করতে পারবেন। (তবে আপনার সাথে এমন অধস্তনদেরও দেখা হবে, যাঁদের হাত অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, বরং ওঁদের খুশি রেখে চললে আপনার নিজেরই সুবিধা।) চাকরিতে কেউ কাউকে এমনিএমনি পছন্দ করেন না, কোনও নির্দিষ্ট সুবিধা আদায় করতে বা অসুবিধা ছাড়া কাজ করতেই এখানে কারও কারও প্রতি অন্যদের এক ধরনের ‘আরোপিত পছন্দ’ তৈরি হয়। যে মানুষটি আপনাকে কেয়ার না করেই চলতে পারেন, সে মানুষটির কাছে যেচে যেচে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ দেখানোটা চরম বোকামি। লোকে আপনার আড়ালে আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে ওরকম করলে। আপনার গুরুত্ব আপনাআপনিই বাড়বে আপনার কাজে, ওটা বাড়াতে অত কথার ভূমিকা তেমন একটা নেই। অফিসে আপনার অবস্থান কেমন, সেটা এমনিতেই সবাই বুঝতে পারেন, সেটা নিয়ে ঢাকঢোল পিটানোর সত্যিই কিছু নেই।


বস যদি বলেন, এটা করলে কেমন হয়, তবে বুঝতে হবে, উনি চাইছেন, আপনি সেটা করেন। Disagree as less as possible. There are always loopholes in the existing laws and your boss knows them better. বসের সাথে যুদ্ধে গিয়ে আপনি কখনওই টিকে থাকতে পারবেন না। আপনাকে বিপদে বা বেকায়দায় ফেলতে হয় কী করে, সেটা আপনার বস অনেক ভালো করে জানেন। আমরা তো কেউই নিখুঁত নই, আমাদের প্রত্যেকটি ভুলের মাশুল যদি গুনতে হয়, তবে চাকরি করাটাই বিশাল এক বোঝার মতন মনে হবে। ক্ষমা পেতে চাইলে বসের সাথে বিরোধে যাবেন না। বস আপনার পাশে যত বেশি থাকবেন, আপনার জন্য চাকরি করাটা তত বেশি সহজ। বস ইগনোর করলে অনেক বড় ভুলও কিছুই না, আবার আমলে নিলে অনেক ছোটখাটো ভুলের জন্যও আপনাকে অনেক সাফার করতে হতে পারে। হ্যাঁ, কিছু বস আছেন, যাঁদের কোনও গ্রামারেই ফেলা যায় না, তাঁরা অনেক সময়ই সাইকোপ্যাথ প্রকৃতির। তাঁরা কখন কী করেন, কোনটাতে খুশি হন, কখন কী বলে বসেন, এইসব আগে থেকে বোঝা যায় না। এমন মানুষ যাকে একবার অপছন্দ করেন, তাকে অপছন্দ করতেই থাকেন এবং অপছন্দের পরিমাণ জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। কারও একটা ভুল কখনও চোখে পড়লে সে ভুলটা নিয়ে তাকে অপদস্থ করতেই থাকেন বারবার। যা নিয়ে ভুল ধরার কিছুই নেই, তা নিয়েও ক্রমাগত ভুল ধরতে থাকেন। আত্মপ্রশংসায় পঞ্চ- নয়, দশমুখ হয়ে থাকেন। তাঁদের সাথে কথা বলার সময় মনে হয়, এক তাঁরা বাদে বাকি সবাই-ই বুঝি চাকরিতে ঘাস কাটে। অন্যকে কষ্ট পেতে দেখলে তাঁরা এক ধরনের আনন্দ পান। এরকম সাইকোপ্যাথ বসের বেলায় তেমন কিছুই করার নেই, তেল মেরে আর স্যার স্যার করে যতটা মানিয়ে চলা যায় আরকি! ওরা খুবই অসহায় প্রকৃতির জীব, ওঁদের অনেকের ব্যক্তিগত জীবন, অনেকের পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত। তাঁরা সে ক্ষোভটা পুরো পৃথিবীর উপর ঝাড়েন! চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর ওঁদের সাথে রাস্তাঘাটে দেখে হলে ওঁদের কেউ একটা সালাম পর্যন্ত দেয় না, কথাবলা দূরে থাক…এরকম হতে আমি নিজে দেখেছি। এমন মানুষ বেঁচে থাকে অন্যদের ঘৃণায় ও ভয়ে।


বেশিরভাগ কাজই করা হয় না আমরা সেগুলি স্রেফ মাথায় রাখি বলে, কাগজে লিখে রাখি না বলে। কোনও জরুরি জিনিস লিখে না-রাখলে আপনি ভুলে যাবেন। Think on paper. একটা নোটবুক মেইনটেইন করুন। জরুরি যা-কিছুই আপনার মনে আসুক না কেন, তা লিখে রাখুন। আমরা সত্যিই ভুলে যাই। এটা ফাঁকিবাজি নয়, এটা বিস্মৃতি, এক ধরনের অসহায়ত্ব। আপনার মনে যতই আত্মবিশ্বাস কাজ করুক না কেন, আপনার সব কিছুই মনে থাকবে, একটাও কাজ করতে মিস হয়ে যাবে না, সময়মতো সব কিছুই গুছিয়ে করে ফেলবেন…বেশিরভাগ সময়ই দেখবেন, পরে অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। একটা কাগজে লিখে রাখুন, কাগজটা পকেটে রাখুন, চোখের সামনে রাখুন। নিজেকে মনে করিয়ে দিন, আমাকে এটা এটা করতে হবে। ওই কাগজে লেখা কথাগুলিই আপনাকে শাসাবে, মনে করিয়ে দেবে। এটাকে অভ্যাস হিসেবে গড়ে তুলুন, খুব কাজে দেবে। আপনার ভাবনা মাথায় নয়, কাগজে রাখুন। মাথায় রাখলে হারিয়ে যাবে, কাগজে রাখলে হারাবে না। আপনি কাজটা না-করলেও পরবর্তীতে করার একটা তাগিদ থাকবে। অতএব, হৃদয়ে নয়, কাগজে লিখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে…


বসের সামনে বেশি স্মার্টনেস না-দেখানোই স্মার্টনেস। আপনি কখনওই আপনার বসের চেয়ে বেশি স্মার্ট নন। বিশ্বাস না হলে স্মার্টনেস শো করেই দেখুন, কেমন ‘মাননীয় স্পিকার…’ হয়ে যান! আপনার বসও কিন্তু উনার বসের সামনে ভেড়াভেড়া টাইপ অ্যাপিয়েরেন্স নিয়ে বসে থাকেন। সিংহের সামনে বসার সময় মাথা নত করেই বসতে হয়। মাথা উঁচু করে বসলে সিংহ একথাবায় মাথা নামিয়ে দিতে পারে, সে ক্ষমতা সিংহের আছে। আপনার উঁচু মাথা আপনার বসের পছন্দ নাও হতে পারে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অনেক উদার মনের মানুষও অধস্তনদের উঁচু মাথা সহ্য করতে পারেননি, সময়মতো কায়দা করে মাথাটা নামিয়ে দিয়েছেন। আর একটা বুদ্ধি দিই। আপনি যা করতে জানেন, তার সবটুকুই যদি বসের সামনে দেখিয়ে ফেলেন, তা হলে কিন্তু আপনার উপর অনেক বাড়তি চাপ এসে যাবে। যদি সে চাপ ঠিকমতো সামলাতে না পারেন, তবে আপনি বসের বিরাগভাজন হয়ে যাবেন। আপনার কলিগের ক্ষেত্রে সে ক্ষতিটা হবে না, যেটা আপনার ক্ষেত্রে হবে।…আর কেউ তো এই দায়িত্ব নেয়নি, এই বেচারা যে ঝামেলাটা নিজের ঘাড়ে নিল, তার জন্য তাকে একটু মনের সফট কর্নারে রাখি, সে চেষ্টা করেছে বলে তাকে নিদেনপক্ষে একটা থ্যাংকস বা ওয়েলডান বলি, এইসব উদারতা বেশিরভাগ বসের মধ্যে থাকে না। আর যদি বাড়তি চাপটা নিয়ে ঠিকমতো সামলাতে পারেন, তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন, সামনে আরও কিছু চাপ আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। প্রায়ই দেখা যায়, অফিসে কাজের পুরস্কার বাড়তি কাজ, আর কিছু নয়! জীবনটাকে পুরোপুরি চাকরিকেন্দ্রিক করে ফেলতে না-চাইলে অফিসে কখনও কখনও নিজেকে অথর্ব হিসেবেই উপস্থাপন করুন। অথর্বকে লোকে বড়জোর গালি দেয়, কিন্তু এমন কোনও বিপদে ফেলে দিতে পারে না, যে বিপদ থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে করতেই জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়!


যখন কোনও একটা ফাইল আপনার বসকে ফরোয়ার্ড করছেন, তার আগেই ভেবে নিন। কী লিখলে, কীভাবে লিখলে আপনার বস খুশি হন এবং আইনবিধি মোতাবেক আপনিও রিস্ক-ফ্রি থাকেন। কৌশলী হোন। কাউকে কোনও অবস্থাতেই আপনার কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করতে দেবেন না। ফাইলে কী লিখছেন, সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মাথায় রাখুন, দেশ উদ্ধার করার চাইতে চাকরি বাঁচানো জরুরি। কিছু ফাইল থাকে, যেগুলি খুব জটিল ধরনের। ফাইলটি কার বা কাদের, ফাইলে কী লিখলে কী পরিণতি হতে পারে, কীভাবে লিখলে সাপও-মরবে-লাঠিও-ভাঙবে-না টাইপের সুবিধা পাবেন এইসব মাথায় রেখে ফাইলে লিখবেন। আপনার কলমের কালি কাগজের উপর এসে গেলে তখন সেটি আর কালি থাকে না, ছুরি হয়ে যায়--তা আপনাকে বাঁচাতেও পারে, মেরেও ফেলতে পারে। আপনার প্রতিটি শব্দকে ভাঙলেও যেন কেউ এমন কিছু বের করতে না পারে, যার কারণে আপনি বিপদে পড়ে যেতে পারেন, এমন কিছুই ফাইলের নোটে লিখবেন। অনেক সময় দেখবেন, আপনার বসই আপনাকে এমন কিছু লিখতে বলবেন, যা লিখলে উনি কোনও দায়িত্ব না-নিয়েই সুবিধা ভোগ করতে পারবেন, কিন্তু আপনি নিজেই বিপদে পড়ে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে খুবই বিনয়ের সাথে তেমন কিছু লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। তাই বলে ফাইল ধরে রাখবেন না, তখন আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে পারে যে আপনি ফাইল আটকে রেখেছেন। কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না দিয়েই ফাইল উপরে পাঠিয়ে দিন। আবারও বলছি, অফিস থেকে বের হওয়ার আগেই টেবিলের সব ফাইল ছেড়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন, ওতে যদি অফিস থেকে দেরিতে বের হতে হয়, তা-ই হবেন। অতি দ্রুত কাজ করতে শিখুন। যখন ফাইল দেখবেন, অফিসের যেকোনও কাজ করবেন, তখন পুরো মনোযোগ ওটার উপরেই দিন, একটুও ফাঁকি দেবেন না। দেখবেন, আপনার টেবিলে ফাইল জমে থাকছে না। তবে আপনি যে দ্রুত কাজ সেরে নিজেকে একটু ফ্রি রাখছেন, সেটা আপনার বসকে বুঝতে দেবেন না। উনি বুঝতে পারলে আপনার কাঁধে বাড়তি অনেক কাজ চাপিয়ে দেবেন, হয়তো সে-কাজগুলি আদৌ আপনার নয়!


বসের ব্যক্তিগত কিছু টুকিটাকি কাজ করে দিন। এমন কিছু কাজে উনাকে সাহায্য করুন, যে কাজটি আপনার জন্য কোনও কিছুই না, কিন্তু উনার জন্য অনেক কিছু! সেটা হতে পারে বসের ছেলের জন্য ভালো একজন টিচার খুঁজে দেওয়া, বসের একটা পেপার রেডি করে দেওয়া, আপনার পরিচিত কারও কাছ থেকে বসকে কোনও একটা সেবা পাইয়ে দেওয়া, বসকে উনার পছন্দের কিছু বই কিনে দেওয়া, বসের ল্যাপটপে অতি সাধারণ কিছু ট্রাবলশ্যুটিং করে দেওয়া, বসের কোনও আত্মীয়স্বজন আপনার এলাকায় বেড়াতে গেলে উনাদের প্রটোকল দেওয়া…এরকম আরও অনেক কিছু। অফিসের কাজের বাইরে যে ব্যক্তিগত সেবাগুলি আপনার কাছ থেকে বস পাচ্ছেন, সেগুলিই আপনাকে তাঁর কাছে একটু হলেও অন্যদের চাইতে বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। বস আপনাকে উনার কাছে রাখছেন, এটাও কিন্তু এক ধরনের সৌভাগ্য। আপনি এখন যেমন অবস্থানে আছেন, তেমন অবস্থান থেকে আপনাকে ছুড়ে ফেলে দিতে দুই মিনিটও লাগবে না যে ব্যক্তির, যদি কখনও সে ব্যক্তির কোনও কাজে আসার সুযোগ পান, সে সুযোগ লুফে নিন। আপনি লুফে না নিলে আপনারই অন্য এক কলিগ সেটা লুফে নেবে। সিদ্ধান্ত আপনার। বসের প্রিয়ভাজন হয়ে থাকার সময়টাতে বস যাতে কোনওভাবেই বুঝতে না পারেন, আপনার মধ্যে আনুগত্যের বা আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। অভিনয় করলে অভিনয়ের মতোই করুন। ধরা পড়ে গেলে সেটা আর অভিনয় থাকে না, সেটা হয়ে যায় ছাগলামি! আমরা প্রায় সবাই-ই কিছু না কিছু অভিনয় করেই প্রতিদিনের জীবনে বেঁচে থাকি।


যদি কখনও কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা আদায় করতে ইচ্ছে করে, কিংবা অফিসের কোনও কাজে লাগে, তবে আপনার সিনিয়র (পদমর্যাদায় বা অভিজ্ঞতায়) কারও সাথে আলাপ করে নিন। এসব ব্যাপারে কৌশল ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন অনেক বেশি। যারা আপনার ডিপার্টমেন্টে আপনার চাইতে বেশিদিন ধরে চাকরি করছেন, তাঁদের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলি অনেকভাবেই হয়তো ঋণী। ফলে তাঁদের অনুরোধ যত সহজে ওরা রাখবে, আপনার অনুরোধ তত সহজে নাও রাখতে পারে। আপনার অনুরোধ না-রাখলে যদি আপনি নিজের চেয়ারের দাপটে দুর্ব্যবহার করে বসেন ভুলক্রমেও, এর পরিণতি আপনাকে ভোগ করতেই হবে। মাথায় রাখুন, বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষমতা, ওদের সাথে আপনার বসের সম্পর্কটাও মধুর। তাদের সাথে সম্পর্কটা ভালো রাখুন, তাদের দ্রুত সেবা দিন, অনেক কাজে আসবে। সবসময়ই কৌশলে কাজ আদায় করতে হবে, বলপ্রয়োগে বা রাগ দেখিয়ে নয়। আপনি সৎ, তাই আপনার যেকোনও অনুরোধ রাখতেই হবে, আপনি রাগ করলেও কেউ কিছু মনে করতে পারবে না, আপনি কাজে দেরি করলেও আপনাকে কিছু বলা যাবে না এইসব উদ্ভট ভাবনা মাথায় নিয়ে বসে থাকবেন না। আপনি আপনার সততার জন্য প্রাণভরা দোয়া আর আত্মতৃপ্তি ছাড়া আর কিছুই আশা করতে পারেন না। সততা কিংবা অসততা হলো, just a state of mind that makes you happy. যা করে আপনি সুখী থাকছেন, সে-কাজের পুরস্কার তো সুখ, তার চাইতে বেশি কিছু আপনি আশা করছেন কেন? আপনি আর্থিকভাবে সৎ, কিন্তু আবার সুবিধাও চাইছেন অনেক রকমের, আপনার ওরকম সততার কী দাম? আমি এমন অফিসার দেখেছি, একপয়সাও নেন না, কিন্তু প্লেনের টিকেট করে দিলে, মাঝেমধ্যে গিফট কিনে দিলে, উনার কোনও ব্যক্তিগত কাজে পয়সা ঢাললে কোনও আপত্তি করেন না, বরং খুশি হন। আমি সত্যিই বুঝি না ওরকম সততার কী মানে!


কাজের ডেডলাইন কখনওই মিস করবেন না। না মানে, না! আপনি যতই অজুহাত দেখান না কেন, আপনার শাস্তির পরিমাণ এতে বড়জোর হ্রাস পেতে পারে। দিনের শেষে, ব্যর্থতা মানে কিন্তু ব্যর্থতাই, পৃথিবীর সব অজুহাত মিলেও ব্যর্থতাকে সাফল্য করে দিতে পারে না। আপনার দেরির কারণে সরকারের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, সেবাগ্রহীতারা প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বা দেরিতে পাচ্ছেন। আপনার কাছ থেকে এটা কোনওভাবেই কাম্য নয়। আপনাকে বেতন দিয়ে ও এত সুযোগসুবিধা দিয়ে সরকার রেখেছেন, আপনার মধ্যে এইটুকু দায়িত্ববোধ থাকতেই হবে। প্রয়োজনে আপনার অফিস সহকারীর পাশে বসে উনাকে ডিকটেশন দিয়ে ফাইলের নোট, চিঠিপত্র, ডকুমেন্ট ইত্যাদি রেডি করান। কোনওভাবেই কাজে দেরি করা যাবে না। আপনার গাফিলতির সাথে কিন্তু আপনার স্টেকহোল্ডারের আর্থিক ক্ষতির ব্যাপারটি জড়িত। আপনার সেবাগ্রহীতাকে খুশি রাখুন, তার প্রাপ্য সেবাটি দ্রুত দিন। কাজে দেরি করার কারণে আপনার সম্পর্কে অভিযোগ অনেক উপরেও চলে যেতে পারে। সেটি হতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে বাড়তি সময় কাজ করে, ফাইল স্টাডি করে, সিনিয়র ও অন্যান্য কলিগদের সাথে আলাপআলোচনা করে, প্রয়োজনীয় যাচাই ও নিরীক্ষা করে কাজটি শেষ করে দিন, অন্তত আপনার হাত থেকে ফাইলটি যেন অন্য জায়গায় চলে যায়, সে ব্যবস্থা নিয়ে নিন। কেউ কাজেকর্মে অদক্ষ, ইচ্ছে করেই গাফিলতি করে, কোনও বিশেষ কারণে ফাইল আটকে রাখে…এমন অভিযোগ সত্যিই অনেক সুনামহানি ঘটায়। ফাইলে স্পষ্ট করে সংশ্লিষ্ট আইনবিধি উল্লেখ করে প্রস্তাব লিখে দেবেন। সে প্রস্তাব আপনার সেবাগ্রহীতার পক্ষে যাক না যাক, কেন যায় বা কেন যাচ্ছে না, সেটিও আইনের ধারা বা বিধির আলোকে নিজস্ব মতামতসহ লিখে দেবেন। আপনার বেতনকে হালাল করুন, এর ফলস্বরূপ যা হবে, তা আপনার ভালোর জন্যই হবে।


ক্যারিয়ার নিয়ে অত ভাবাভাবির কিছু নেই। আপনারা যথেষ্ট ভালোই থাকবেন, অন্তত যতটা ভাবছেন, তার চেয়ে বেশি। হাতি মাটিতে পড়ে গেলেও কিন্তু ছাগলের চেয়ে উঁচু। আপনারা কেন হাতি, তা তো বোঝেন মনে হয়। না বুঝলে আমি যা বুঝি, তা বলি। খেয়াল করে দেখবেন, বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি ট্রল হয় সরকারি চাকরি নিয়ে। মানুষ কী নিয়ে বেশি ট্রল করে? কোন গাছে লোকে বেশি ঢিল ছোড়ে? কার পেছনে অন্যরা বেশি লাগে? আমাদের নিয়ে বাকিদের হইচই-ই প্রমাণ করে দেয় আমরা এমন একটা অবস্থানে আছি, যেখানে তাদের অনেকেই থাকতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। কই, অন্য কারও চাকরি নিয়ে তো সরকারি চাকরিজীবীদের বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই! তবে কেন ওদের নিয়ে সবার এত চুলকানি? লোকে সরকারি চাকরির পেছনে দৌড়াচ্ছে কেন? সরকারি চাকুরেরা ওদের দৌড়াতে বলেছে? যে যার ধান্দায় ব্যস্ত! যার রিজিকে যা লেখা আছে, সে তা-ই করে খাচ্ছে। এটা নিয়ে এত কথা কীসের? ব্যাপারটা সত্যিই খুব বিরক্তকর! কথাগুলি শুনতে খারাপ লাগছে, জানি। কিন্তু যে হারে লোকজন আমাদের এলিয়েন টাইপের কিছু ভাবে, আমাদের সহ্যই করতে পারে না, তা দেখে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে ভালো লাগে না। আমি আমার দশটা বন্ধুর সাথে বসে আড্ডা দেওয়ার সময় যদি বেছে বেছে আমিই কোনও কারণ বা উস্কানি ছাড়াই আমার চাকরি-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে খোঁচা বা বক্রোক্তির শিকার হই, তখন তা হজম করতে নিশ্চয়ই আমার ভালো লাগে না। হজমটা কেন করব? আমি কি কারও খাই, না পরি? আমি লোকের কাছ থেকে অন্য দশজনের মতো স্বাভাবিক রিঅ্যাকশন পেতে চাই। আপনার রিজিক নিয়ে আমি তো বাজে কথা বলছি না, বাজে কথাবলা তো দূরের কথা, ওটা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথাই নেই, তবে আপনি কেন আমার রিজিক নিয়ে বাজে কথা বলছেন? আমি আপনাকে সম্মান করি, আপনার কাছ থেকে সম্মানটা আমার প্রাপ্য। আমি কোথাও কিছু বলতে গেলেই কিছু লোক মহা-উৎসাহে অযাচিত ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ‘বিসিএস’ শব্দটি ব্যবহার করে নানান কথা বলতে থাকেন। কেন? জাতি আজ বিসিএস-জ্বরে আক্রান্ত। আপনি তাদের মধ্যে নেই, ধরে নিলাম। তো? ওরা বিসিএস দিচ্ছে, আপনি দিচ্ছেন না। আপনার ইচ্ছা নাই, অত ধৈর্য নাই, আপনি সে লাইনে যাচ্ছেন না। ওরা যাচ্ছে, এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাতে আপনার কী? আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে তো ওদের কোনও মাথাব্যথা নাই। লজ্জাও করে না এরকম বেহায়ার মতো আচরণ করতে? সত্যিই আমরা জাতিগতভাবে খুব কিউট টাইপের বেআক্কেল।


যে বিষয়গুলির উপর আপনার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, সেগুলি নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। সরকারি চাকরিতে বেশি বেশি অভিযোগ করলে মানসিক অশান্তিবৃদ্ধি আর সময়নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হয় না। পারলে সমাধানের পথ নিজে বের করুন। আপনাকে জোর করে এই চাকরিটা দেওয়া হয়নি। বেটার অপশন পেলে, just go for it. আমরা যারা চাকরি করছি, তারা যে একেবারে মনের মধ্যে কোনও অভিযোগ না রেখেই খুব খুশিমনে চাকরি করছি, তা কিন্তু নয়। অভিযোগ তো আছেই! এই যেমন, চাকরি করছি বলেই দেশবিদেশ ঘুরে দেখতে পারছি না, বর্ডার পার হতে গেলেই জিও (সরকারি আদেশ) লাগে, সেটা পাওয়াও কম ঝক্কিঝামেলার ব্যাপার নয়। ডিপার্টমেন্টে কেউকেউ প্রায়ই বিভিন্ন ফরেন ট্রেনিংয়ে আর সেমিনারে যাচ্ছেন, বাকিরা কোনও সুযোগ পাচ্ছেন না বিদেশভ্রমণের, বসেবসে ওঁদের দেশবিদেশ ঘুরতে দেখছেন আর আঙুল চুষছেন। কেউকেউ নিজের পছন্দমতো জায়গায় পোস্টিং পাচ্ছেন, আর যাঁরা তদবির করছেন না, তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে যেখানে খুশি। এইসব দেখতে কার ভালো লাগে, বলুন? তবু আমি এবং আমরা খুব ভালো করেই জানি, আমরা এটা জেনে ও বুঝে চাকরিতে এসেছি যে সরকারের যেকোনও সিদ্ধান্ত মেনে নিতে আমরা বাধ্য, এটা নিয়ে কোনও আপত্তি খাটবে না, কোনও কথাবলাও যাবে না। আমি তো প্রায়ই ভাবি, এই যে এত কিছু পেতে চাইছি, যা পেয়েছি, তা কি কম নাকি? আমি কি আদৌ এতটা পাওয়ার যোগ্যতা রাখি? চাকরিটা না পেলে…যা পেয়েছি, তাও কি পেতাম? আমরা নিরুপায় বলেই তো অন্য কোথাও যাচ্ছি না। কেউকেউ চাকরি ছেড়েও দিয়েছেন তো। ওরা অন্য কিছু করে খাচ্ছে। এটাই তো হওয়ার কথা! আর একটা কথা। ‘নিরুপায়’ ব্যাপারটা আপেক্ষিক। আমার কাছে যেটা উপায় মনে হয়, আর একজনের কাছে হয়তো তা নয়। আজকে যেটা উপায় মনে হয়, কাল হয়তো তা নয়। কেউ কেউ ব্যাপারগুলো আগেভাগে দেখতে পায়, কেউ কেউ পায় না। কারও কারও উপায় বের করার শক্তি বা আগ্রহ থাকে, কারও কারও থাকে না। কেউ কেউ অনেকখানি আপোষ করার বুদ্ধি রাখেন, কেউ রাখেন না।


অফিসে আসার সময় আপনার ইগোটাকে বাসায় রেখে আসবেন। চাকরিতে কেউ কারও ইগোর ধার ধারে না। ইগো আপনাকে মানতে দেবে না ভুলটা আপনারই। ইগো আপনাকে সমস্যার গভীরে ঢুকতে দেবে না। ইগো আপনাকে আপনার সেবাগ্রহীতাদের সাথে মন খুলে কথা বলতে দেবে না। ইগো আপনাকে মনে করিয়ে দেবে আপনার বস আপনার ভার্সিটিতে চান্সই পাননি। ইগো আপনাকে প্রতিটি মুহূর্তেই জানিয়ে দেবে আয়নার ভেতরে আপনার অফিসের যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে আপনিই সবচাইতে সুদর্শন। ইগো আপনাকে আপনার কলিগদের সাথে সহজভাবে মিশতে দেবে না। ইগো আপনার রাগ ও অভিমান আরও বাড়িয়ে দেবে, ফলে বসের কথায়, কলিগদের কথায়, সেবাগ্রহীতাদের কথায় আপনি অহেতুকই কষ্ট পাবেন, যেখানে অফিস মানঅভিমানের জায়গাই নয়। ইগো আপনাকে বারবারই বলবে, এই অফিসে আপনিই সেরা, বাকিরা ছাগল। ইগো আপনাকে আপনার অতীতের কিছু অর্জন নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগাবে। ইগো আপনাকে প্রশ্ন করবে, তোমার বস তোমার ফেসবুক পোস্টে লাইক দেন নাই, তুমি কেন উনার পোস্টে লাইক দেবে? ইগো আপনাকে দেখিয়ে দেবে আপনার বস আপনার জুনিয়রকে যে দামটা দেন, আপনাকে সে দামটা দেন না। ইগো আপনাকে অনেক কিছুই বলা ও করা থেকে থামিয়ে রাখবে, চাকরির স্বার্থে যা বলা ও করা উচিত। ইগো আপনাকে আপনার অফিসের প্রয়োজনের চাইতে আপনার নিজের প্রয়োজনকে বড় করে দেখাবে। ইগো আপনাকে বলবে, বসকে অত পাত্তা দেওয়ার কিছু নাই। ইগো আপনাকে প্রয়োজনের সময়ও মাথা নত করতে দেবে না। ইগো আপনাকে বলে বসতে পারে, আপনার সামনে-থাকা সেবাপ্রার্থীকে অত পাত্তা দিয়ে কথা বলার কিছু নেই। ইগো আপনাকে এটা মনে আনতে দেবে না যে আপনি প্রজাতন্ত্রের একজন সামান্য কর্মচারী মাত্র, যে লোকটি আপনার অফিস ঝাড়ু দিচ্ছেন, তাঁর ট্যাক্সের টাকায়ও আপনার বেতন হয়। মনে, মগজে, কথায়, আচরণে, ভাবনায় কোনও ইগো রাখবেন না। আপনি চাকরিজীবী, মানে চাকর। চাকরবাকরের এত ইগো কীসের? এত ইগো থাকলে চাকরিটা ছেড়ে স্বাধীন ব্যবসায় নামুন না! চাকরিতে এসেছেন মানেই কিন্তু সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় নিজের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করার চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেছেন। করেন তো চাকরি, এত ভাব কীসের? যার স্বাধীনতাই নেই, তার আবার কীসের অত ইগোফিগো?