ঘুম ভেঙে/ ১ম পর্ব

 (হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট হিমু চরিত্রের আংশিক ছায়ায় একটা চরিত্র আঁকছি। ‘আঁকছি’ মানে, লেখাটাকে আরও টেনে নেব। তুলির আঁচড়টা দিচ্ছি উত্তম পুরুষে। প্রিয় লেখকের জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমার এই সামান্য নৈবেদ্য।)

আমার অ্যালার্ম ক্লকটা বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেছে। বাজতে শুনেছি, তবু আমার কোনও নড়াচড়া নেই। আমি এখনও বিছানায় শুয়ে আছি। আমি আবারও চোখ বন্ধ করলাম। তবে এই কাজটা করার কোনও প্ল্যান আমার ছিল না। আচ্ছা, এটা কি আদৌ কোনও কাজ? এই যে শুয়ে আছি, ঘুমিয়েও পড়ব হয়তো, এটাকে কি কাজ বলে? নাকি কিছুই বলে না? এটা কি এমন কোনও কাজ, যা আমি করছিই না? নাকি এটা কিছু অবশ্যকর্তব্য কাজ এড়িয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পূর্বাভাস?

এমন নয় যে আমি দেরিতে ঘুমাতে গেছি। আমার ঘুমে কোনও সমস্যা হয়নি, ঘুমও ভালই হয়েছে। ঘুমানোর আগে আমি অ্যালার্ম ক্লকটা সেট করে দিয়েছিলাম। কেন দিয়েছিলাম? নির্দিষ্ট সময়ে ওঠার জন্যই তো, নাকি? আমি অ্যালার্ম বাজতেও শুনেছি। অ্যালার্মটা বাজতে বাজতে বন্ধই হয়ে গেল। আর আমি অপেক্ষা করেই ছিলাম, কখন ওটা বন্ধ হবে, তার জন্য। অ্যালার্ম বাজছে আর আমি চুপচাপ শুনছি। অন্তত কয়েক মিনিট ধরেই ওটা বেজেছে। আমি কেবলই শুনে গেছি, বিছানা ছেড়ে উঠিনি। অ্যালার্ম বাজতে শুনেও যে নির্বিকার থাকা যায়, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ আমি। এদিকে জানালা দিয়ে আলো এসে আমার চোখেমুখে পড়েছে। রৌদ্রও পড়েছে। দেখা গেল, তাও আমি উঠছি না। আমি যখন অ্যালার্ম ক্লকের আওয়াজ শুনছিলাম, তখন তো আমি ঘুম থেকে উঠেই গেছি। তবু বিছানা ছাড়লাম না কেন? আসলে আমি এরকমই করি। নড়াচড়া না করে শুয়ে থাকি। মড়ার মতো। অ্যালার্ম বাজুক আর যা-ই হোক, আমি বিছানা ছেড়ে উঠব না।

ওদিকে আমার ভেতরের একজন মানুষ, যে দেখতে অবিকল আমারই মতো, তবে আমার চাইতে আরও একটু সতর্ক ও আন্তরিক, সে আমার হয়ে, যা যা আমার করার কথা, তা তা করতে থাকে। একের পর এক। আমি অলসভাবে শুয়ে আছি, সে কিন্তু শুয়ে থাকে না। সে ওঠে, হাতমুখ ধোয়, শেভ করে, তৈরি হয়ে কাজে বেরিয়ে পড়ে। আমি চুপচাপ দেখি, সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে, রাস্তায় নেমে দৌড়ে চলন্ত বাসে উঠে পড়ছে। সে সময়মত পৌঁছে যায়। পৌঁছে হাঁপাতে থাকে, কিন্তু পরীক্ষার হলে ঠিক সময়েই ঢোকে। সে ক্লান্ত কিন্তু খুশি। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিতে হয়। সে এই নিয়মটা মেনে চলেছে।

আর আমি? ঘুম থেকে দেরি করেই উঠলাম। আমি চাইলেই পাতার পর পাতা লিখতে পারতাম, কিন্তু আমি তো পরীক্ষার হলেই যাইনি! আমি ধরেই নিয়েছি যে আমার জীবনটা এরকম একাকীই কাটবে। পুরোপুরি ছন্নছাড়া। আমি নিজেকে পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলেছি। যারা কাজ করে, ওদের দলে আমি নেই। যারা আধুনিক জীবনযাপনের কায়দায় অবসর কাটায়, ওদের দলেও আমি নেই। বড়বড় অফিসে যারা চাকরি করে, আমি ওদের দলেও কখনও যাব না। কোনও ব্যবসা করে বড়োলোক হবার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই। মানুষের জ্ঞান, প্রযুক্তির ব্যবহার, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ বা কোনও মতবাদ, রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি, ইতিহাস, সিনেমা, সাহিত্য এসবের কোনও কিছু নিয়েই আমার বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই। পৃথিবীতে প্রলয় হয়ে যায় তো যাক, তবু আমি কিছুই বলব না, কোনও গুরুত্বপূর্ণ বা অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমার কোনও মতামত নেই। কেন? হয়তো আমি এত কিছু জানিই না। কিংবা এসব নিয়ে ভাবতে বা কথাবলতে আমার ইচ্ছে করে না। আমি এমন কেন? কারণ আমি এমনই! এর আর কোনও ব্যাখ্যা নেই।

ওদিকে পরীক্ষার হলে আমার সিটটা খালিই থাকে। ওখানে কেউ বসে না। ওখানে আমারই বসার কথা ছিল। আমি তো আমার রুমেই! আমার ডিগ্রিটা কমপ্লিট হবে না। আমি কোনও সার্টিফিকেট পাব না। সার্টিফিকেট না পেলে আমার কোনও চাকরি হবে না। এটা নিয়ে আমার দুঃখ দূরে থাক, কোনও ভাবনাই নেই। আমি যে আবারও নতুন করে পড়াশোনা শুরু করব, এরকমও নয়। আমি আর পড়ব না। আমার আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। সবাই অনেক পড়াশোনা করছে, পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করছে। করলে করুক! ওরা সবাই বড়বড় মানুষ হয়ে যাক। ওসব নিয়ে ভাববার সময়ই নেই আমার!

আমি ঘুম থেকে উঠলাম, বিছানা ছাড়লাম। খুব ধীরে। আমার কখনও কোনও তাড়া থাকে না। এরপর প্রতিদিনের মতোই এক কাপ নেসক্যাফে বানালাম। প্রতিবারের মতোই ওটাতে কয়েক ফোঁটা ঘন কন্ডেন্সড মিল্ক মেশালাম। আমার চোখমুখ ধুতে ইচ্ছে করছে না, পোশাকটা বদলাতে ইচ্ছে করছে না। কফিতে চুমুক দিতেদিতে একটা গোলাপি গামলায় তিন জোড়া মোজা ভিজাতে দিলাম। ওগুলি ধুতে হবে। তবে ওগুলি গামলা থেকে নিয়ে কখন ধোবো কিংবা আদৌ ধোবো কি না, আমি এখনও ভাবিনি। আমি প্রায়ই এমন করি। কাপড় ভিজিয়ে রাখি। কেন রাখি, আমি জানি না। আমি এখনও ব্রাশ করিনি। আমার ব্রাশ করতে ইচ্ছে করছে না। আমি ব্রাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।

আমি রুমেই বসে থাকব। পরীক্ষার হলে যাব না। যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, ওরা হল থেকে বের হয়ে এলে ওদের কাছ থেকে প্রশ্ন দেখে নেব। এরপর আমি বোঝার চেষ্টা করব ক্যান্ডিডেটদের বেকায়দায় ফেলার কতটুকু আন্তরিক চেষ্টা স্যাররা করেছেন। আবার এমনও হতে পারে, আমি এসবের কিছুই করব না। আমার কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। প্রশ্ন সহজ হোক, কঠিন হোক, আমার ওতে কিছুই এসে যায় না। আমার কোনও আফসোস নেই, আমার কোনও ভয় নেই। আমার হারানোর কিছুই নেই। আমি কিছুই চাই না। আমি কখনও কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামব না। সবাই জিতে যাক। আমি ওদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ওসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাববার সময়ই আমার নেই। আমার ঘুম ভাল হয়েছে। গায়ে এখনও আলস্য জড়িয়ে আছে। আমি খুশি।

আমি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে কোনও ক্যাফেতেই যাই না। প্রতিদিনই আড্ডা দেয়া আমার সাথে যায় না। আমি বন্ধুদের সাথে দেখাই করি না। দিনের পর দিন। কেন করি না, এর কোনও কারণ নেই। আমার কোনও জীবনদর্শন নেই। আমি ভাল আছি। একদিন সকালে আমার বন্ধুদের একজন আমার বাসায় আসে। ছয়তলা বেয়ে উঠে আমার দরোজার সামনে এসে নক করে। আমি রুমের ভেতরে আছি, কিন্তু দরোজা খুলছি না। সে নক করতেই থাকে। অপেক্ষা করে। আমি তবু খুলছি না। সে আবারও নক করে। একটু জোরেই করে। তবু আমি ওকে দাঁড় করিয়েই রাখি। এইবার সে একটু আস্তে নক করে। আমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। আমার কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে একটু ইতস্ততবোধ করে। এরপর সে চলে যায়। আমি ভেতরে মরে পড়ে আছি কি না, তা নিয়ে সম্ভবত সে ভাবে না। মানুষের মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে এত হৈচৈ করার কিছু নেই। এ ঘটনায় আমার কিছুই এসে যায় না। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমার জীবনের একমাত্র সত্য হল, আমার ঘুম পায়।

পরেরদিন অন্যরা আসে। একই ঘটনা ঘটে। ওরা নক করে, অপেক্ষা করে, চলে যায়। তার পরেরদিনও একই ব্যাপার ঘটে। ওরা আমার দরোজার ফাঁকে কিছু চিরকুট রেখে যায়। ওগুলিতে কী লেখা আছে, তা পড়ার কোনও আগ্রহই আমার মধ্যে কাজ করে না। আমি একটা সরু বেঞ্চে শুয়ে থাকি, আমার হাত দুটো আমার মাথার নিচে ভাঁজ করে রাখি। কখনও আমি পিঠের নিচে বা কোমরের পেছনে হাত রেখে শুয়ে থাকি। কখনওবা, বুকের উপর। আমার হাঁটু দুইটি ভাঁজ করে ওপরের দিকে ওঠানো থাকে। কখনও বাম হাঁটুর উপরে ডান হাঁটু সিলিংয়ের দিকে সমকোণে রেখে শুয়ে থাকি।

আমার কারও সাথেই দেখা করতে ইচ্ছে করে না, কারও সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আমার কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করে না, ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে না, কখনওবা নড়াচড়া করতেও ইচ্ছে করে না। এমনি করে আমার দিন কাটে। একদিন আমার হঠাৎ করেই মনে হয়, কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। আমি যেভাবে বেঁচে আছি, সেভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না। এর মানে হল, আমি ভুল পথে বাঁচছি। কীকরে বাঁচতে হয়, তা আমি ভুলে গেছি। এটা নিয়ে আমার মধ্যে কোনও উচ্ছ্বাস কিংবা বিস্ময় কাজ করে না। আমি দিনদিন উচ্ছ্বসিত কিংবা বিস্মিত হতে ভুলে যাচ্ছি। সবাই যেমনি করে বাঁচে, আমি তেমনি করে বাঁচতে না পারলেও ওটা নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি যে বেঁচে আছি, এটাই কখনও আমার মাথায় আসে না। আসলে আমার মাথায় কিছুই আসে না। আমার সামনে যে সময়টা আছে, আমি সেটাতে বেঁচে আছি। আমার কাছে বেঁচেথাকার অর্থই হল সময় কাটানো। সময় নষ্ট করা বলে কিছু নেই, সময় কখনও নষ্ট হয় না, সময় কেবল অতিবাহিত হয়।

ছাদে রোদ বাড়ছে। আগুনের মতো রোদ। আমার রুমটাও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। এই অসহ্য গরম সহ্য করেও আমি রুমে বসে আছি। আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না। ওঠার চেয়ে এই উত্তাপ সহ্য করা সহজ। আমি বিছানার উপরে বসে আছি। আমার কোলের উপর একটা বই। বইটা খোলা। অনেকক্ষণ আগেই আমি বইটা পড়া বন্ধ করে দিয়েছি। তবু আমি ওটার দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে আছি, কিন্তু দেখছি না। আমার দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত—কখনও সাদা রঙের বুকশেলফটার দিকে, কখনও গোলাপি গামলাটার দিকে, যেখানে ছয়টা মোজা পচছে। আসলে আমি যে কোনদিকে তাকিয়ে আছি, তা আমি নিজেই জানি না। হতে পারে আমি কোনওদিকেই তাকাচ্ছি না, এমনও হতে পারে আমি যেটির দিকে তাকিয়ে আছি, সেটি আমার মাথায়ই নেই। আমার মাথায় কিছুই নেই। পুরোপুরি ফাঁকা মাথা নিয়ে বাঁচার এক ধরনের মজা আছে। আমার কোলের বইটা আমাকে বিছানায় আটকে রেখেছে। আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যে শেলফ থেকে অন্য একটা বই হাতে নেব, সেটাও না পড়ে কোলের উপর ফেলে রাখব। কিংবা কিছুটা পড়ার পর বাকিটা পড়তে ভুলে যাব। বইটার কথাই ভুলে যাব।

আমার আধখাওয়া সিগারেট থেকে ধোঁয়া উঠছে। দেখলে মনে হয়, অ্যাশট্রেতে আগুন ধরে গেছে, ওটারই কাঠ পুড়ে ধোঁয়া উঠছে। ধোঁয়াটা উপরের দিকে উঠছে প্রায় সোজাসুজিই, একরেখায়। উপরে উঠে সিলিংয়ে পৌঁছে দেয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যেন। আমার মনে হচ্ছে, ধোঁয়াগুলি গিলে ফেলতে পারলে ভাল হতো। কিছু জিনিস গিলে ফেলা যায় না। সেগুলির একটি হচ্ছে ধোঁয়া। হঠাৎ মনে হল, কিছু একটা ভেঙে গেছে। আমার ভেতরেই। অনেকখানি ভেঙে গেছে, আরও ভাঙছে। আমি হয়ে উঠছি একজন ভঙ্গুর মানুষ। এই যে আমি বেঁচে আছি, আমার একটা অস্তিত্ব আছে, আমিও এই পৃথিবীর কেউ একজন, এসব ভাবনা আমার মাথায় কাজ করছে না। আমার এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না। আমার অতীত, আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যৎ, এসবের কোনও কিছু নিয়েই আমার বিন্দুমাত্রও আগ্রহ নেই। আমার জীবনের যা কিছু আছে, তার সব কিছুই একটা বিন্দুতে এসে থেমে গেছে, সেই বিন্দুতেই আমি স্থির হয়ে আছি বহুদিন ধরেই। আমার শরীরটা ভারি হয়ে আসছে, আমার নড়তেও ইচ্ছে করছে না। সাথে আমার মাইগ্রেনের ব্যথাটা বাড়ছে। আজকের নেসক্যাফেটা অন্য দিনের চাইতে তেতো হয়েছে। কফির পরিমাণটা বেশি হয়ে গেছে। আচ্ছা, কফি খেলে কি মাইগ্রেনের ব্যথা কমে?

আমার বেডরুমটার আয়তন ৫ বর্গমিটারের একটু বেশি। এত ছোটো একটা রুম বেডরুম হওয়ার কথা না, কিন্তু হয়ে গেছে। ছাদের পাশের এই জায়গাটাতে, যেটাকে আমি বেডরুম হিসেবেই ব্যবহার করছি, সেখানে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কাটিয়ে দিই সেখান থেকে একটুও বাইরে বের না হয়ে। ভাবছেন, কীকরে পারি! পারি, কেননা আমার মাথায় ভাবনাটা এখনও আসেনি, যেদিন আসবে, সেদিন থেকে হয়তো আর পারব না। যে বিছানায় বসে আছি, সে বিছানা এত ছোটো যে আমি সেখানে শুতেই পারছি না। এটা এতটাই সরু যে এখানে শুয়ে একটুও অসতর্ক হয়ে এপাশ থেকে ওপাশে ফেরা সম্ভব নয়। তবু আমার সে বিছানায় থাকতেই ভাল লাগছে।

আমি এখনও গামলার দিকেই তাকিয়ে আছি। আমাকে দেখতে খুশিখুশি লাগছে। আমার এ খুশির তেমন কোনও কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ওদিকে গামলার মধ্যে তিন জোড়া মোজা পচছে। আমি রুমের মধ্যে বসে আছি। আমার খাওয়াও হয়নি, একটাও বই পড়া হয়নি। আমি তেমন কোনও নড়াচড়া না করেই ভাস্কর্যের মতো বসে আছি। আমার দৃষ্টি গামলার দিকে, বুকশেলফের দিকে, আমার হাঁটুর দিকে। সময়েসময়ে আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ভাঙা আয়নাটার দিকে, কফির কাপের দিকে, লাইটের আর সুইচের দিকে। রাস্তার হৈচৈ কানে আসছে। আমার রুমের পাশে যে কলটার প্যাঁচ নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা থেকে পানি মেঝেতে পড়ার শব্দ আমার কানে আসছে। আমার প্রতিবেশির বাসায় কী নিয়ে যেন কোলাহল হচ্ছে, সে শব্দও আমার কানে আসছে। কোথাও এক বৃদ্ধ গলা খাঁকারি দিয়ে কেশে উঠলেন, সে শব্দও আমার কান শুনতে পেয়েছে। কোথায় যেন চা বানানো হচ্ছে, কেটলির শোঁশোঁ আওয়াজ আসছে। সেখানে নিশ্চয়ই চায়ের পোর্সেলিনের পেয়ালায় স্টিলের চামচের টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। শুনতে পেলে ভাল লাগত। আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ পর এ ইচ্ছেটাও চলে যাবে। আমার কোনও ইচ্ছেই জিইয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না।

সিলিংয়ের দেয়ালে ঢেউ আকৃতির ফাটল ধরেছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি। একটা মাছি আঁকাবাঁকা পথে উড়ছে। সিলিংয়ের একটু নিচ দিয়ে। আমি সে মাছিটার ছায়ার গতিপথ দেখছি। আসলে সেখানে কোনও ছায়া নেই। আমি ভেবে নিচ্ছি একটা ছায়া রেখার মতো চলে যাচ্ছে। ওরকম করে ভাবতে আমার ভাল লাগছে। আমি ছায়া ভালোবাসি। এর মানে এ নয় যে, আমি আলো ঘৃণা করি।

আমার বয়স ২৫, আমার দাঁত ২৯টা, আমার শার্ট ৩টা, মোজা ৮টা। আমাকে মাসে ৭ হাজার টাকার মধ্যেই চলতে হয়। আমার সংগ্রহে কিছু বই আছে, যেগুলির একটাও আমি আর পড়ি না। আমার টেবিলের এক কোণায় কিছু সিডি স্তূপ করে রাখা আছে, যেগুলির একটাও আমি কখনও শুনি না। আমার কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করে না, কোনও স্মৃতিই মনে আনতে ইচ্ছে করে না। আমি এখানেই বসে থাকি, কিছু একটার জন্য অপেক্ষায় থাকতে চাই, এবং ততক্ষণ পর্যন্তই অপেক্ষায় থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার মনে হয়, অপেক্ষা করার মতো আর কিছুই বাকি নেই।

বন্ধুদের সাথে আমার কখনও দেখা হয় না। কেউ এলেও আমি দরোজা খুলে দেখি না। কেউ আমাকে চিঠি লিখেছে কি না, তা দেখতে একতলায় রাখা ডাকবাক্স খুলে কখনওই চেক করি না। আমাকে কেউ চিঠি লিখবে না, আমার কেউ নেই। লাইব্রেরি থেকে যে বইগুলি নিয়ে এসেছি, সেগুলি পড়িও না, ফেরতও দিই না। বাবা-মা’কে কখনও ফোন করি না, চিঠি লিখি না। ঘরের বাইরে বের হলেও ইঁদুর, বেড়াল ও অন্যান্য পোকামাকড়ের মতো আমিও রাতের বেলায় বের হই। তখন আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, ক্লান্ত হলে নোংরা ঘিঞ্জি কোনও সিনেমাহলে ঢুকে পড়ি। মাঝেমাঝে আমি সারারাতই হাঁটতে থাকি। রাতের শহর দেখতে অন্যরকম। রাস্তায় অনেক মানুষ থাকে, যাদের সাথে আমার অনেক মিল খুঁজে পাই। ভাল লাগে। কখনও সারাদিনই ঘুমিয়ে থাকি। বিছানার সাথে মৃত মানুষের মতো লেপটে থাকি। আমার দিন কেটে যায় আলস্যে। ঘুমন্ত অবস্থায় শামুকের মতো শ্লথ গতিতে হেঁটে বেড়াই, ওই অবস্থাতেই খাওয়াদাওয়া করি, বাথরুমে যাই।

সামনের দিনগুলিতে কীভাবে বাঁচব, কী করব, সেটা নিয়ে আমার মধ্যে কখনওই কোনও ভাবনা আসে না। নতুন কিছু করার ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমার একটাই ইচ্ছে, তা হল, আজকের দিনটা কাটিয়ে দেয়া। আমি অপেক্ষা করতে থাকি এবং কীসের জন্য অপেক্ষা করছি, তা একসময় ভুলে যাই। পৃথিবীর কোনও কিছু নিয়েই আমার কোনও আপত্তি নেই, আমার অভিধানে ‘প্রত্যাখ্যান’ বলে কিছু নেই, আমি সব কিছুকেই গ্রহণ করে ফেলতে পারি। আমি আর সামনের দিকে এগোই না, অবশ্য, আমি কখনও সামনের দিকে এগোতে চাইইনি। আমার কোথাও যাওয়ার নেই, আমার বর্তমানের অবস্থানই আমার গন্তব্য। জীবনে আরও এগিয়ে যেতেই হবে কেন, এর পক্ষে কোনও কারণ আমি কখনও খুঁজে পাইনি। অবশ্য, আমি কখনও কারণ খুঁজিওনি। আমি আমার জীবনটাকে এরকম করেই কাটিয়ে দিচ্ছি।

যে বইটা পড়তে শুরু করে শেষ করতে ভুলে গিয়েছিলাম, সে বইটার যতটুকু পড়েছি, সেটুকুই আমার মনে আসছে না। নেসক্যাফের স্বাদ খুব তেতো, ওদিকে প্লাস্টিকের গামলায় ছয়টি মোজা কুচকুচে কালো জলে ভাসছে কিংবা গামলার গভীরতা পর্যাপ্ত নয় বলে ডুবে যেতে পারছে না। উল্লেখ করার মতো এর বাইরে আর কিছুই নেই। আমার এই মুহূর্তের গল্পটা খারাপও না, ভালও না। গল্পটা সমাপ্তও না, অসমাপ্তও না। গল্পটা যেমন, তেমনই। এমন একজন মানুষের জীবন একইসাথে হাস্যকর ও কষ্টের। জীবন থেকে আমার কিছুই চাওয়ার নেই। কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই, কোনও স্বপ্ন নেই। বেঁচেথাকার জন্য আমার স্রেফ দুইটি জিনিস লাগে—রাত ও আমার রুমটা। আমি একটা সরু বিছানায় কোনওমতে শুয়ে পড়ি আর সিলিংয়ের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থেকে বিচিত্র সব জিনিস কল্পনায় নিয়ে আসি। রাতের শহরে এত লোকের ভিড়েও আমি একা, আমার সাথে একমাত্র আমিই আছি। আমার আর কাউকেই প্রয়োজন নেই।

কখনও এমন হয়, আমার কোলাহল ভাল লাগে, আলোর ঝলকানি ভাল লাগে। আড্ডা আর হৈচৈ ভাল লাগে, এরপর সব কিছুই ভুলে যেতে ভাল লাগে। আমি সাগরের সেই ঢেউ, যা জোয়ারে এক রকম, ভাটায় অন্য রকম। আবার কখনও দুই সময়েই একই রকম। আমার মুহূর্তগুলি মৃত, একঘেয়ে। আমার চলার রাস্তা খালিই পড়ে থাকে। আমার খুব ইচ্ছে, ইসস, যদি কোনও কিছুই না দেখে আর না শুনে জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যেত! আমার কথা বলতে ভাল লাগে না, নতুন কিছু দেখতে ভাল লাগে না, আসলে আমার নড়াচড়া করতেও ভাল লাগে না। আমি চুপচাপ ও স্থবির হয়ে বাঁচতে পছন্দ করি। আমার স্বপ্নের পুরোটা জুড়েই থাকে নির্জনতা। আমি প্রায়ই পুরোপুরি স্মৃতিভ্রষ্ট অবস্থায় অন্ধদের দেশে ঘুরে বেড়াই। রাস্তাঘাট ফাঁকা ও প্রশস্ত, জ্বলতেথাকা সব আলোই শীতল। আমার আশেপাশে কিছু মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের চেহারায় মুখের কোনও অস্তিত্ব নেই। তাদের দিকে না তাকিয়েও তাদের একপলক দেখে নেয়া যায়। ওরা সবাই একই রকমের দেখতে।

আমার শান্ত ও নিশ্চিন্ত ইতিহাসের পাতার নিচে ছোট্ট ছেলেটা দৌড়ে ছুটে চলে, সেখানে সে একটু একটু করে বেড়ে ওঠে। বাথরুমের দরোজায় গ্রাফিতি আঁকা হয়। ছেলেটা হাফ প্যান্ট ছেড়ে লং ট্রাউজারস ধরে। জীবনের প্রথম সিগারেটটা ফুঁকে। প্রথম শেভের ঘা’টা ওর গালে লেপটে থাকে। একটুআধটু মদ ছোঁয়। ছুটির সময় রাত্রে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। যৌনতার প্রথম স্বাদটা নেয়, যুগের হাওয়া ও আগুন গ্রহণ করতে শেখে। একদিকের আগুন নিভলে আরেক দিকে আগুন ধরে যায়। একদিকের ঝড় থামলে আরেক দিকে ঝড় ওঠে। এইসবের মধ্যেই ছেলেটার নিজেকে পুনরাবিষ্কার করা হয়ে যায়। ফেলেআসা দিনগুলিতে তাকে আর বাঁচতে হয় না। যে সত্য চোখের সামনে চলে আসে, সে সত্যের তেজকে দমিয়ে রাখতে হয়, সে জেনে গেছে। জীবনের ছবিগুলি কখনও ঝাপসা হয়ে আসলে শান্ত হয়ে বসে পরের সিদ্ধান্তটা নিতে হয়।

আমার চোখে এইসব স্মৃতি পুরনো হয়ে মৃত পড়ে থাকে, বর্ণহীন হয়ে বাঁচে। স্মৃতির ফসিল নিয়ে আমি বেঁচে আছি। একটা ঘুমন্ত শহরের সুনসান রাস্তায় সবকটা দোকানের শাটার নামানো। ছায়াগুলি বিবর্ণ। ল্যাম্পপোস্টের পাশে কিছু মৌমাছি ভনভন করছে। কিছু উইপোকা একটু দূরে ফুটপাথের উপর মরে পড়ে আছে। একটা ঘরের মেঝেতে ধুলোর উঁচু স্তর জমে আছে। ধুলোর কিছু কণা আলোয় নেচেনেচে উড়ছে। গ্রামগুলি খালি পড়ে আছে, সবাই শহরে চলে এসেছে। প্রতিটি ছুটির দিনে কবরস্থানে লোক বেড়ে যাচ্ছে। কিছু লোক প্রার্থনারত, কিছু লোক প্রার্থনাসিক্ত। ওইখানে লোকেরা দল বেঁধে কোথায় যেন বেড়াতে যাচ্ছে।

কোনও এক মঙ্গলবারের বিকেল। সরু পুরনো বিছানায় আমি বসে আছি। আমার হাঁটুর উপর একটা বই, আধখোলা। ওটা কী বই, মনে নেই। আমি শেলফ থেকে একটা বই নিয়েছিলাম অনেকক্ষণ আগে, এইটুকুই শুধু মনে আছে। আমি মরামাছের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কোনদিকে তাকিয়ে আছি, আমি জানি না। আমাকে দেখাচ্ছে একটা বিষণ্ণ ছায়ার মতো, আমার শক্ত খোলসের ভেতরে যদি কেউ কোনওভাবে তাকিয়ে দেখে, সেখানে ঔদাসীন্য ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। অন্যরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, এমন একটা মুহূর্তে ওদের কারও দিকেই না তাকিয়ে চোখ খোলা রাখতে হলে এক ধরনের দৃষ্টি চোখের ভেতরে আটকে দিতে হয়। আমার দৃষ্টি এখন ওরকম। আমার ঠোঁটে কোনও শব্দ নেই, চোখে কোনও প্রাণ নেই।

আমি ভেজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি, সেখানে কিছু লোকজন এদিকওদিক ছুটছে। রাস্তার পাশে কিছু দোকান দেখা যাচ্ছে, ওখানে কী কী যেন বিক্রি হচ্ছে। গাড়িগুলি ঝকঝকে—নতুন কিংবা নতুনের মতো। এটা আমার স্থবির জীবনের এই মুহূর্তের প্রতিফলন। পাশের কল থেকে মেঝের উপর শব্দ করে জল পড়ছে, ওটা এখনও সারানো হয়নি। আমার প্রতিবেশী ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তার নৈঃশব্দ্য ভেঙে একটা ট্যাক্সির হর্নের ক্ষীণ আওয়াজ কুয়াশার মধ্য দিয়ে কানে ভেসে আসছে। আমার স্মৃতির ঘরে বিস্মৃতি জায়গা করে নিচ্ছে। সিলিংয়ের ফাটলগুলির মানচিত্র এক দুর্বোধ্য রহস্যময় গোলকধাঁধা তৈরি করেছে। ওটা কীসের ইঙ্গিত, আমি বুঝতে পারছি না। সম্ভবত, ওটা কোনও কিছুরই ইঙ্গিত নয়।

রুমের তাপমাত্রা অসহ্য রকমের বেশি। যেন কড়াইয়ে জল ফুটছে। যেন চুল্লিতে কয়লা জ্বলছে। ছয়টা মোজা পচছে। কোথাও, কিছু হাঙর সারা গায়ে আলস্য মেখে ঘুরে বেড়ায়, কিছু তিমি ঘুমিয়ে কাটায়। এমন সময়, গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের গামলায় কালো রঙের জল। অ্যালার্ম ক্লকটা আজকে বাজেনি। ওটা আর বাজে না, ওটা আর বাজবে না। ওটা আর আমার ঘুম ভাঙাবে না। আমি হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছি। আমি নিজের ভুলগুলিকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। আমি হুট করেই আধোঘুমে ঢুকে পড়ছি। এই পৃথিবীর ঠিক কেন্দ্রেই আমার রুমটার অবস্থান। আমি এখান থেকেই সব কিছু দেখতে পাচ্ছি, সব কিছু বুঝতে পারছি।

এই ঘরের এক ধরনের ঘ্রাণ আছে। হয়তো ওটা আমারই ঘ্রাণ কিংবা এই ঘরেরই। এটা আমার চেনা। পৃথিবীর প্রতিটি ঘরেরই এক ধরনের ঘ্রাণ আছে। সে ঘ্রাণটা থেকে যায়, কখনও হারিয়ে যায় না। একেকটা ঘরের ঘ্রাণ একেক রকমের। আমি এই বিছানায় একটার পর একটা ভুল করেকরে বেঁচে আছি। একাএকাই ভুল করছি। এর এক ধরনের মজা আছে। ওই যে বুকশেলফটা। শেলফের উপর জমেথাকা ধুলো। বিছানার চাদরে জমেওঠা তেল চিটচিটে দাগ। সিলিংয়ের সূক্ষ্ম ফাটলগুলি, যেগুলি আমি অসংখ্যবার গুনে ফেলেছি। ঘরের দেয়ালের এখানেওখানে খসেপড়া পলেস্তারা, ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা দাগগুলি। খসখসে মেঝের উপর আঁকাবাঁকা ফাটলরেখা। মুখ ধোয়ার বেসিনটা, যেটা এতই ছোটো যে পুতুলঘরের ফার্নিচারের মতো দেখায়। কফির পুরনো বিশ্বস্ত কাপটা। রুমের একমাত্র বন্ধ জানালাটা। দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারটা, যেটার বারোটি পাতা অসংখ্যবার উল্টেউল্টে সেখানেথাকা সব ফুলের নাম আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। অনেক দিন আগের কিছু খবরের কাগজ, যেগুলির প্রত্যেকটিই আমি অন্তত কুড়িবার করে পড়ে ফেলেছি, এবং সামনেও অনেকবার পড়ব। তিনটি অসমান ভাগে বিভক্ত ভাঙা আয়নার টুকরো, যেগুলিকে আমি আয়না হিসেবেই চালিয়ে নিচ্ছি। ওই টুকরোগুলিতে আমার নিজের চেহারা বাদে আর কারও চেহারা কখনও প্রতিফলিত হয়নি। বুকশেলফের বেকার বইগুলি। এইসব নিয়েই আমার রাজ্যের শুরু ও শেষ।

আমি সে রাজ্যে সবসময়ই মগ্ন হয়ে থাকি কিছু অনুষঙ্গে। কানে আসে কিছু কোলাহল, কিছু শব্দ। মেঝেতে জলের আওয়াজ। পাশের বাড়ির শব্দ। কেউ গলা পরিষ্কার করতে কাশছে। শহরের অবিরাম গুনগুন আর গুঞ্জন। এর সাথে গাড়িছোটার শব্দ। কিছু গাড়ি ব্রেক করছে, কিছু গাড়ি থেমে যাচ্ছে, কিছু গাড়ি গতি বাড়াচ্ছে। এইসব শুনি। কল থেকে এখনও জল পড়েই চলেছে। মেঝেতে জলের শব্দ, রাস্তায় গাড়ির শব্দ। আযানের ধ্বনি, গির্জা থেকে ভেসেআসা ঘণ্টার ধ্বনি, একই সময়ে মন্দির আর প্যাগোডা পাঠিয়ে দিচ্ছে প্রার্থনার কোরাস। অ্যালার্ম ক্লকটা সোয়া পাঁচটায় বেজে আর কখনও বাজেনি। কোনদিনের সোয়া পাঁচটা, মনে নেই। এই রুমের নিস্তব্ধতায় দিন, ক্ষণ বা সময়ের কোনও দাবি খাটে না। সময় এখানে স্থির হয়ে আছে, রুমের পরিবেশ অনেক দিন ধরেই এরকম হয়ে আছে। এখানে কিছুই বদলায় না। এখানে ছেলেবেলা কি বুড়োবেলা, একইরকমের। রুমের সিলিং, দেয়াল আর মেঝের প্রতিটি কণায় মিশে আছে মগ্নতা, জড়িয়ে আছে কিছুটা দ্বিধা ও ঔদাসীন্য। সময় কেটে যায়, আমি কখনও জানতেই পারি না, কয়টা বাজে। আমার কখনও জানতে ইচ্ছে করে না।

দশটা বাজল নাকি? নাকি এগারোটা হয়ে গেছে? হলই-বা! দেরি হয়ে যাচ্ছে? নাকি এখনও অনেক দেরি আছে? নাকি সব কিছুই ঠিকঠাক? সূর্য ওঠে, রাত নামে। শব্দ কখনও পুরোপুরি থেমে যায় না। আর কিছুর শব্দ শোনা না গেলেও বিকল কল থেকে মেঝেতে জল পড়ার শব্দ ভেসে আসে। ওই কলটা কেউ সারিয়ে নিচ্ছে না। কলটাকে সারানোর দরকার নেই বোধহয়। সময় এগিয়ে চলে। প্রায় সব কিছুই, যেমন নৈঃশব্দ্যের দেয়ালে কেশের মতো সরু একটুখানি ফাটল, মৃদু গুঞ্জন, ধীরেধীরে ভুলেযাওয়া কোনও স্মৃতি, হৃদকম্পনের চেয়ে ক্ষীণ কোনও স্পন্দন, এরকম আরও অনেক কিছু যদি গ্রাহ্যসীমার বাইরেও চলে যায়, তবুও অনুভবের ফাঁদে সবই টুকরো টুকরো হয়ে আটকে থাকে।

আমার রুমটা সবচাইতে সুন্দর মরুভূমিগুলির একটি। এখানে কেউ কখনও ঘুরতে আসেনি। এখানে কারও আসা বারণ। আমি চাই না কেউ এখানে আসুক। আমি যা চাই, তা হল, ঘুম, নীরবতা, স্থবিরতা। সাথে আমার পাঁজরখাঁচার ওঠানামা। আমি যে এখনও বেঁচে আছি, নিজের অস্তিত্বকে আটকে রেখেছি, এইটুকুর প্রমাণ রাখতে এর বেশি কিছু না হলেও আমার দিব্যি চলে যায়। আমার কিছুই লাগে না। বেঁচেথাকার জন্য যাদের অনেক কিছু লাগে, আমি ওদের দেখি আর ভাবি, আচ্ছা, ঠিক আছে। ওদের ওসব লাগবে। ওরা ওসব নিয়ে যাক।………আমি অপেক্ষা করতে থাকি, ততক্ষণ পর্যন্তই, যতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষাটাকে নিরর্থক মনে হচ্ছে না। অপেক্ষা করে থাকার মতো আমার কেউ নেই, কিছু নেই। তবু অপেক্ষা করতে থাকি। কীসের জন্য? জানি না। কিছু রাতে ঘুরে বেড়াতে ও বাকি রাতগুলিতে ইচ্ছে হলেই ঘুমিয়ে পড়তে আমি বেঁচে আছি। আমার জীবনের কোনও মহৎ উদ্দেশ্য নেই। বাঁচতে হলে কোনও মহত্ত্ব লাগে না, ওটা ছাড়াই দারুণভাবে বেঁচে থাকা যায়। রাস্তার টান ও রাস্তার ভিড়, এই দুই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, কেননা এই দুই আছে বলেই আমি এই দুইয়ের কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচে আছি।

জলের প্রান্ত, বাগানের ঘ্রাণ, জীবনের খাঁজ………এইসব কিছুটা বুঝে আর কিছুটা না বুঝে আমি বেঁচে আছি। নদীর তীর ধরে হেঁটে যেতে নদীকে প্রয়োজন হয় না। শহরের দেয়ালগুলিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শহরকে ভুলে থাকলেও চলে। তোমাদের ব্যাকরণ ঘেঁটে দেখে যা বুঝলাম, আমার সময় কখনওই নষ্ট হয় না, কেননা আমার সময়ের তো কোনও দামই নেই! আমি এমন কিছু সময়ে বেঁচে আছি, যেখানে আকাঙ্ক্ষা নেই, অভিমান নেই, ক্রোধ কিংবা দ্রোহ নেই। সময়েসময়ে আমার জীবন আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে—এক নিশ্চল জীবন। সেখানে কোনও সংকট নেই, কোনও সম্ভাবনা নেই। শৃঙ্খলা নেই, বিশৃঙ্খলা নেই। দিনের পর দিন, ঋতুর পর ঋতু। সেখানে যা শুরু হয়, তা আর শেষ হয় না। সেখানে যা শেষ হয়, তা আর শুরু হয় না। প্রাণিবিদ্যায় এটাকে বেঁচেথাকা বলে। তোমাদের বিদ্যায় এটাকে বাতিলহওয়া বলে। আমার বিদ্যায় এটাকে কিছুই বলে না। আমার কখনও মনে হয়নি যে বেঁচে থাকতে হলে পৃথিবীর সব কিছুকেই একটা করে নাম দিয়ে দিতে হয়।

আমি কেবলই টিকে আছি। কখনও মনে হয়, এমনি করে সময়কে শাসন করে, নিজেই নিজের পৃথিবীর প্রভু হয়ে টিকে থাকার চেয়ে সুখ আর কোথাও নেই। আমার ভাবনার বিস্তৃত জালের কেন্দ্রবিন্দুতে একটা খামখেয়ালি মাকড়শা এই শহরের প্রতিটি প্রাণকণাকে তীব্র চাহনিতে চোখ রাঙাচ্ছে। শহরের যত কাজ আর অকাজ, হ্রাস আর বৃদ্ধি, আলো আর আঁধার, সবকিছুকেই এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে আমার স্বোপার্জিত ছেলেমানুষি, আমার ভাষায়, মুক্তি। আমি এমন অনেক কিছুই শিখে নিয়েছি আর শিখছি, যা কিছু শেখা যায় না, শেখা উচিত নয় বলেই লোকে জানে। নৈঃশব্দ্য, একাকিত্ব, নির্বিকারত্ব, অবিচলতা। এইসব শেখার তো কোনও স্কুল হয় না! আমি একা, এবং আমি একা বলেই আমার কখনওই জানতে হয় না, কয়টা বাজে! ‘কয়টা বাজে’ ব্যাপারটাকে তোয়াক্কা না করেই যারা বাঁচতে পারে, ওদের মতো সুখী আর কেউ নয়। আমার যেখানে যেতে ইচ্ছে করে, আমি সেখানে চলে যাই। নিজেকে ইচ্ছেমত, যেখানে খুশি, মর্জিমাফিক চলে যেতে দিই বলেই ফিরেআসাটা আমার জন্য খুব সহজ। ওরা ফিরে আসতে পারে না। ওরা শুধুই চলে যায়। ওরা আসলে ফিরে আসতে জানেই না। ফিরে আসতে জানতে হয়। ফিরতে জানার চেয়ে বড়ো স্বস্তি আর হয় না। সময়কে আটকে রাখতে নেই, চলে যেতে দিতে হয়। সময়কে আটকে রাখলে সময়ের মানুষগুলিও আটকে থাকে। বাঁচতে হলে স্মৃতি ভুলে যেতে জানতে হয়। কিছু মুখ ভুলে যেতে হয়, কিছু ঠিকানা ভুলে যেতে হয়, কিছু ফোন নম্বর ভুলে যেতে হয়, কিছু হাসি ভুলে যেতে হয়, কিছু চোখ ভুলে যেতে হয়, কিছু কণ্ঠ ভুলে যেতে হয়, কিছু বিকেল ভুলে যেতে হয়। ভুলে যেতে না পারলে বাঁচতে বড়ো কষ্ট হয়। ওদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের অনেকটা জুড়ে কেবলই স্মৃতি। ওরা আসলে অতীতে বেঁচে আছে। ওদের প্রতিদিনই খুব কান্না পায়। ওরা কাউকে দেখিয়ে কাঁদতে পারে না। ওরা সত্যিই ভাল নেই।

আমি যে ভুলে যেতে শিখে নিয়েছি, ওটাই আমি একেক সময় ভুলে যাই। কোনও এক গোধূলির চোখে চোখ রেখে নিজেকে ভুলে যেতে বাধ্য করেছিলাম, জোর করেই। এটাও প্রায়ই মনে থাকে না। আমি আর ক্যাফেগুলিতে ঢুকে পড়ি না। সারা চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ মেখে ক্যাফের টেবিলগুলির পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াই না আর। রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় কাদেরকে এখন আর চিনতে পারছি না, বোঝার চেষ্টা করি না। সিনেমার টিকেট কাউন্টারের সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়েথাকা মানুষগুলির মাঝে পরিচিত মুখ আর খুঁজে বেড়াই না। আমি একা। একাকী রাস্তায় কীকরে মানুষের মতো হাঁটতে হয়, আমি শিখেছি। অতশত না ভেবেই হাঁটতে শিখেছি, নিজের তালে, নিজের পথে। আমি সব কিছুর দিকেই না দেখে তাকাতে জানি, আমি কোনও দিকেই না তাকিয়ে দেখতে জানি। আমি স্বচ্ছ হয়ে বাঁচতে জানি, অস্তিত্বের বাইরে গিয়ে স্থবির হয়েও বাঁচতে জানি। কুঁড়ের মতো চুপচাপ বসে থেকে কিংবা ক্ষিপ্র ঋজুতায় বাঁচতেও শিখে নিয়েছি।

আমি যখন পেইন্টিংয়ের দিকে তাকাই, তখন আমার দৃষ্টি এমন করে রাখি, যেন কোনও দেয়ালের কিছু অংশ বা সিলিংয়ের কিছু রেখা দেখছি। কখনওবা, দেয়ালের দিকে তাকাই এমনভাবে, যেন এমন একটা পেইন্টিং দেখছি, যেটার কথা ভেবে, যেটার দেখানো পথ মেনেই আমি বেঁচে আছি। কিছু নির্দয় গোলকধাঁধা, কিছু চিরকালেরই অবোধ্য ভাষা, কিছু ক্ষয়েযাওয়া মুখ। এইসব আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে। ইচ্ছে হলেই আমি ডুব মেরে দিই যখন যেখানে খুশি, যেমন খুশি। এ পৃথিবীর সবখানেই আমার অবাধ ও সহজ যাতায়াত। ধীরে, খুব ধীরে, কোনও বাড়তি চাপ না রেখেই আমি হাঁটতে পারি, যে পথে দিয়ে এসেছি, সে পথে দিয়েই ফিরে যেতে পারি, দোকানের সামনে দিয়ে সামনের কাঁচের অবয়ব ঘেঁষে তবে স্পর্শ না করে খুব সন্তর্পণে হেঁটে যেতে পারি। প্রার্থনালয়ের উঁচু দেয়ালের উপর অদৃশ্য শরীরে বসে থেকে বাঁকানো বাঁকানো খিলানগুলির আশেপাশে কিছু অশান্ত মানুষের আশার ও দুরাশার ভাঙাগড়া দেখতে আমার ভালই লাগে।