গুরুপ্রণাম (সমীরণ স্যার এবং সমরেন্দ্র স্যার)

 (আমার দুইজন শিক্ষকের কথা লিখছি, আজকের অবস্থানে আসার পেছনে যাঁদের অবদান আমি সবসময়ই নতমস্তকে স্মরণ করি।)

আমি ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলে। এইট পর্যন্ত আমি ছিলাম ক্লাসের সেকেন্ড। এইটে আমাদের স্কুল থেকে আমরা ৯ জন বৃত্তি পাই। বৃত্তি পাওয়ার পর আমাদের ফার্স্ট বয় সহ ৫ জন স্কুল পরিবর্তন করে কলেজিয়েট স্কুলে চলে যায়। আমি থেকে গিয়েছিলাম। আমার বাবার ফিলসফি ছিল প্যারাডাইজ লস্ট-এর ফিলসফি: বেটার টু রেইন ইন হেল দ্যান সার্ভ ইন হেভেন। বাবা আমার সাইকোলজি বুঝতেন। তিনি বুঝেছিলেন, ওই বয়সে পাত্তা না পেলে আমি হারিয়ে যাবো। বাবার মনে হয়েছিল, যেহেতু আমি ছোটোবেলা থেকে স্কুলে প্রথম সারিতে থাকতে অভ্যস্ত ছিলাম, সেহেতু কলেজিয়েট স্কুলে প্রথম সারিতে থাকতে না পারলে হয়তো সেটা সামলে নেয়ার মতো যথেষ্ট বড় তখনও আমি হইনি। কলেজিয়েট স্কুলে ভাল স্টুডেন্টরা পড়ে। ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমি হয়তো পারব না। তাছাড়া, বাবা প্রচণ্ডভাবে বিশ্বাস করতেন, যে স্কুল আমাকে ছোটোবেলা থেকে মানুষ করেছে সে স্কুল ছেড়ে চলে গেলে স্যারদের কষ্টটা আমার উপরে অভিশাপ হয়ে পড়বে। যাই হোক, ক্লাসের ফার্স্ট বয় কলেজিয়েট স্কুলে চলে যাওয়ায় আমাকে ক্লাসের ফার্স্ট করা হল। আমার এখনো মনে পড়ে, ওই সময়ে আমার আত্মীয়স্বজন কিংবা অন্য কেউ আমাকে রোল নাম্বার জিজ্ঞেস করলে আমি বলতাম, আমার রোল নাম্বার ২, কিন্তু আমাদের ফার্স্ট বয় কলেজিয়েটে চলে যাওয়াতে আমার রোল নাম্বার এখন ১। এ বুদ্ধিটা আমার মায়ের শিখিয়ে দেয়া। এখন বুঝি, একটা কিশোরের মনে যাতে কোনো ধরনের অহংবোধ না আসে, সেজন্য আমার মা কতোটা ভেবে ওই কাজটা করেছিলেন। পৃথিবীর প্রত্যেক মাবাবা-ই অনেক বড় ফিলসফার। প্রকৃতি ছেলেদের বাবা আর মেয়েদের মা বানানোর সময়ই ওদের ভিন্ন মানুষ করে দেয়। এ এক আশ্চর্য রহস্য! স্কুলে পড়ার সময় আমি দেখেছি, ওই স্কুলে ফার্স্ট বয় না হওয়াটা খুব একটা সহজ ছিল না। কেউই তেমন একটা পড়াশোনা করতো না। যারা করতো, ওরা ফার্স্ট সেকেন্ড এরকম হতো। উজাড় বনে তো শেয়ালই রাজা। আমি যে সব স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়তাম, সেখানে কলেজিয়েট স্কুল, গভর্নমেন্ট হাই স্কুল, ইস্পাহানি স্কুল, খাস্তগীর স্কুলসহ চট্টগ্রামের নামকরা অনেক স্কুলের স্টুডেন্টরা পড়তো। মা খুঁজে-খুঁজে বের করতেন ভাল স্টুডেন্টরা কোথায় প্রাইভেট পড়ে। ওদের সাথে পড়ে আমি যে ব্যাপারটা খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলাম, সেটা হল, আমি একটা ভাল স্কুলের সবচেয়ে পেছনের স্টুডেন্টের চাইতেও পিছিয়ে। আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে নিজেকে এগিয়ে নেয়ার।

সমীরণ স্যারের কাছে বাংলা, ইংরেজি, আর সামাজিক বিজ্ঞান পড়তাম। স্যার সবার সামনে আমাকে ‘বালতি’ বলে ডাকতেন। (আমাদের স্কুলকে অনেকেই ‘বালতি স্কুল’ বলতেন, এবং এখনো বলেন। আমরা একবার বন্যার্তদের সাহায্যার্থে অনেকগুলো বালতি দিয়েছিলাম। তাই হয়তো। অনেকের মতে, আমাদের স্কুলে দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে বালতি করে টিফিন দেয়া হত বলে ওই নামটা দেয়া হয়েছিল।) শুনে আমার খুব কষ্ট লাগতো। স্যার কখনোই আমার প্রশংসা করতেন না। সেই সময়ে স্যারের কাছ থেকে একটা থ্যাংকস শোনার জন্য আমি পৃথিবীর যেকোনো কাজ করতে রাজি ছিলাম। (‘পৃথিবীর’ বললাম, এইজন্যে যে, আমি সেইসময়ে ছোটো ছিলাম। আমার পৃথিবী ছিল ছোটো মানুষের পৃথিবী, একটা কিশোরের পৃথিবী। সে পৃথিবী খুব সহজ ছিল, বোকা ছিল, সরল ছিল।) স্যারের কাছে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস নাইনের শুরুর দিকে। স্যারের প্রাইভেটে প্রথমদিনে গিয়ে দেখলাম, সব ভাল-ভাল স্কুলের ফার্স্ট বয়/ গার্ল টাইপের স্টুডেন্টরা বসে আছে। ওদের সামনে দাঁড়াতেই কী এক সংকোচ আমাকে ছেয়ে ফেলেছিল। ওরা কেউ-কেউ আমাকে দেখে বালতি-বালতি করছিল। আমি ক্লাসে গিয়ে স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। দেখলাম, সেটা নিয়েও হাসাহাসি। স্যার আমাকে পেছনের বেঞ্চে বসতে বললেন। অথচ আমার পরে আসা অনেককেই প্রথম বেঞ্চে বসতে দিয়েছিলেন। পরে দেখলাম, ওরা হয় খাস্তগীর স্কুলের ফার্স্ট গার্ল কিংবা কলেজিয়েট স্কুলের ফার্স্ট বয় টাইপের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। অল্পবয়েসে ফার্স্ট সেকেন্ড হলে অনেক সময়ই যেটা জন্মে সেটা বিনয় নয়, অহংকার। আমাকে কেউই পাত্তা দিচ্ছিল না। পরে দেখলাম, আমাকে পাত্তা দেয়ার তেমন কোনো কারণও ছিল না। ওরা যেখানে অবজেক্টিভ (এমসিকিউ) পরীক্ষায় ৫০’য়ে ৪০-৪২ পায়, সেখানে আমি পাই, বড়জোর ২৮-৩০। একদিনের ঘটনা বলি। একবার আমি একটা অবজেক্টিভ প্রশ্নের উত্তর না পারাতে স্যার আমাকে কানে ধরে বেঞ্চের উপরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। আমার পরের জনও একই প্রশ্ন পারেনি। ও ছিল গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের ফার্স্ট বয়। ও যখন নিজেই বেঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, তখন স্যার বললেন, “এই, তুমি দাঁড়াচ্ছ কেন? তুমি তো আমার প্রিয় ছাত্র। তোমাকে কি আমি দাঁড় করাবো?” আমি তখন ভাবলাম, আমিও বসে যাই। বসতে যাচ্ছি, তখন স্যার রুমের পর্দা টাঙানোর লাঠি (স্যার আমাদেরকে মারার সময় এটা ব্যবহার করতেন) দিয়ে একটা বাড়ি দিয়ে বললেন, “মাক্কি! (স্যার গালি দিতে এই শব্দটা ব্যবহার করতেন। এর অর্থ যে কী, তা আজও জানি না।) তোমাকে কি বসতে বলেছি নাকি? তুমি তো বালতি! চুপচাপ বালতির মতো দাঁড়িয়ে থাক।” আমার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়তে লাগলো। স্যাররা সবসময়ই আমার খুব প্রিয় মানুষ, শ্রদ্ধার মানুষ। আমি প্রিয় মানুষের সাথে কখনোই রাগ করতে পারি না, শুধু প্রচণ্ড অভিমান হয়। স্যারের কথাটা অনেক অভিমান নিয়ে মা’কে বলি। মা বললেন, “বাবা, স্যাররা যা বলেন, তোর ভালর জন্যই বলেন। তুই চেষ্টা কর যাতে ওরকম কথা আর কখনো শুনতে না হয়।” আত্মসম্মানবোধে আঘাত পেয়ে আমার মধ্যে অসম্ভব রকমের জেদ চেপে যায়। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম স্যারের নজরে আসতে। বাসায় শিখেছি, স্যাররা হচ্ছেন ঈশ্বরের মতো। আমি কোনো স্যারের সাথে কখনো গলা উঁচু করে কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না। সব স্যারকেই পা ছুঁয়ে প্রণাম করতাম। এটা বাবার শিক্ষা। বাসায় গুরুজন কেউ এলে উনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করাটা ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের জন্যে বাধ্যতামূলক। সেই গুরুজন বিলেত থেকে পিএইচডি-করাই হোক, কিংবা একেবারে অজপাড়াগাঁয়ের মূর্খ অশিক্ষিত চাষাই হোক। সবার ক্ষেত্রেই একই নিয়ম কড়াকড়িভাবে প্রযোজ্য ছিল। স্যাররা এই বিনয়ের জন্যে আমাকে অনেক ভালবাসতেন। পড়া কম পারাটা অনেক সময়ই এটা দিয়ে ‘পুষিয়ে’ নিতাম। তখন অবশ্য এতোটাই বোকাসোকা ছিলাম যে, বিনয় না দেখানোটাই যে একটা স্মার্টনেস (!) হতে পারে, এটাই কখনো মাথায়ই আসেনি।

যখন আমরা ক্লাস টেনে উঠলাম, তখন সমীরণ স্যারের সব ব্যাচে সবাই পড়ার সুযোগ পেতো না। কিছু ব্যাচ ছিল স্পেশাল। ওখানে স্কুলের প্রথমসারির স্টুডেন্টরা পড়ার সুযোগ পেত। ওরা খুব ভাল মার্কস পেত। ওইসব ব্যাচে আমার পড়ার ব্যাপারে আমার মায়ের চেষ্টা ছিল প্রাণান্তকর। মা কতো রাত জেগে আমার পাশে বসে-বসে আমার কাছ থেকে অবজেক্টিভ পড়া ধরেছেন, সাবজেক্টিভ পড়া পড়িয়েছেন, নোট করে দিয়েছেন (মায়ের হাতের লেখা মুক্তোর মতন ঝরঝরে), সে সব কথা মনে হলে এখন ভাবি, মায়ের স্বাস্থ্যটা খারাপ হয়েছে আমাদের দুই ভাইয়ের পেছনে ছুটে-ছুটেই। আমাদের পড়াশোনার দেখভালের সিংহভাগ ক্রেডিট মায়ের। মা আমার সাথে-সাথে সব স্যারের বাসায় যেতেন। স্যার যতক্ষণ পড়াতেন, ততক্ষণ গার্ডিয়ানদের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করে থাকতেন। সাথে করে বাসায় নিয়ে আসতেন। আমার অবজেক্টিভ টেস্ট পেপারসগুলো আমার চাইতেও আমার মায়ের বেশি মুখস্থ ছিল। আমি ওইসময়ে ছিলাম মাম্মিড্যাডি টাইপের বুকিশ আনস্মার্ট বোকাসোকা ছেলে। এভাবে করে একটা সময়ে সমীরণ স্যারের সব ব্যাচ মিলিয়ে ক্লাস টেস্টের যে কম্বাইন্ড মেরিট লিস্ট হতো সেটাতে প্রথম ৫ জনের মধ্যে থাকতে শুরু করলাম। ক্লাস টেন থেকেই স্যার আমাকে সবার সামনেই অনেক ভাল বলতেন, এতে অন্যান্য ‘বিখ্যাত’ টাইপের ভাল স্টুডেন্টরাও আমাকে সমীহ করা শুরু করে। আমি ছিলাম প্রচণ্ড রকমের জেদি। আমি খারাপ, আমি কিছু পারি না, এসব শুনতে ছোটোবেলা থেকে অভ্যস্ত ছিলাম না বলে সমীরণ স্যারের প্রথম দিককার কথাগুলোকে মনে হতো ধারালো ছুরির মতো। আজকের দিনে এসে বুঝি স্যার আমাকে সবার সামনে অপমান করে আমার কতো বড় উপকার করেছেন। আমাদের সময়ে বোর্ড স্ট্যান্ড বলে একটা ব্যাপার ছিল। পাবলিক পরীক্ষায় (এসএসসি এবং এইচএসসি) যেকোনো বোর্ডের সায়েন্স আর্টস কমার্স গ্রুপ থেকে আলাদা আলাদাভাবে সবচেয়ে বেশি মার্কস পাওয়া প্রথম ২০ জনকে স্ট্যান্ড করেছে, বলা হতো। এটা ছিল অনেক সম্মানের। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তা ভাবতেও পারবে না। মা-বাবাসহ ওদের ছবি আর সাক্ষাৎকার পেপারে আসতো। পুরো দেশ ওদেরকে চিনতো। ভাল স্কুলের একটা ভাল স্টুডেন্টের পক্ষে স্ট্যান্ড করাটা ছিল যতোটা সহজ, খারাপ বা গড়পড়তা একটা স্কুলের তার চাইতেও ভাল স্টুডেন্টের পক্ষে স্ট্যান্ড করাটা ছিল ততোটাই কঠিন। স্যাররা পরীক্ষার খাতা দেখার সময় কয়েকটা ভাল খাতা পরপর দেখলে ওসব খাতায় বেশি মার্কস দিতে থাকেন। ওগুলোর মধ্যে বেটার খাতাতে আরো বেশি মার্কস দেন। কিন্তু কয়েকটা খারাপ খাতা পরপর দেখলে, কমকম মার্কস দিতে-দিতে একটা আগের সারির বেশির মধ্যে বেশি মার্কস পাওয়াটার সেইম স্ট্যান্ডার্ডের খাতা দেখলে এতক্ষণ দেয়া কম মার্কসগুলো থেকে মার্কস একটু বাড়িয়ে দেন বটে, কিন্তু সেটা কিছুতেই ভাল খাতার ভিড়ে বেশি মার্কস পাওয়া খাতাটার মতো অতো বেশি হয় না। পরীক্ষায় মার্কস দেয়ার ব্যাপারটা নিউটনের গতির প্রথম সূত্র মেনে চলে। একটা খাতা কতোটা ভাল মার্কস পেল, সেটা খাতাটার ভালত্বের উপর পরমভাবে নির্ভর করে না, অন্যান্য মার্কসের আপেক্ষিকতার উপর নির্ভর করে। ভালত্ব কখনোই অ্যাবসলিউট কোনো বিষয় নয়। ভালত্ব এবং খারাপত্ব দুটো ব্যাপারই আইনস্টাইন স্যারের কথা শোনে। ভাল কথা, ওই সময়টা ছিল ইংরেজি আর বাংলা পরীক্ষার খাতায় কঠিন-কঠিন দুর্বোধ্য শব্দ দুর্বোধ্য স্টাইলে লিখেটিখে স্যারদের কাছ থেকে জোর করে বেশি মার্কস আদায় করে নেয়ার যুগ। যে যতো বেশি দুর্বোধ্য, সে ততো বেশি ভাল স্টুডেন্ট, অতএব ততো বেশি মার্কস পাবে। আমি ক্লাস সেভেনে কঠিন-কঠিন ভাষায় কঠিনতর ব্যাকরণে লেখার বিদ্যায় দীক্ষিত হই। আমার দীক্ষাগুরু আমার বাবা। সমীরণ স্যারের কাছে এই বিদ্যার পূর্ণ প্রয়োগ ঘটাই। কোনও প্রশ্ন বানিয়ে লেখার ক্ষেত্রে আমার চাইতে কঠিন স্টাইলে কেউ লিখতে পারত না। সবাই বিস্মিত হয়ে দেখত, ‘বালতি স্কুল’-এর এক খ্যাত আনস্মার্ট হাবাগোবা ছেলেটার চাইতে ভাল ব্যাচের কেউ লিখতে লিখতে পারছে না। একটা কিশোরের কাছে সবাইকে বিস্মিত করতে পারাটা অনেক বড় একটা উপহার। আমি এ উপহারের জন্য সমীরণ স্যারের কাছে ঋণী।

আরেকজন পিতৃতুল্য স্যারের কথা বলি। তিনি আমাদের স্কুলের সমরেন্দ্র স্যার। স্যারের কাছে সায়েন্সের সাবজেক্টগুলো প্রাইভেট পড়তাম। স্যার আমাকে প্রচণ্ডভাবে বিশ্বাস করতেন এবং এটা আশা করতেন যে, টেস্টপেপারসের সব চাইতে কঠিন অংকটা সুশান্ত সবার আগে করতে পারবে। যে অংক সুশান্ত করতে পারবে না, সে অংক ব্যাচের অন্য কেউ করতে পারার কথা নয়। শুধুই আশাই করেই হাল ছেড়ে দিতেন না, না পারলে নির্দয়ভাবে পিটাতেন। ব্যাপারটা ছিল এমন, অন্যরা যেখানে দুইয়ে-দুইয়ে চার হয়, এটা না পারলেও স্যার কিছুই বলতেন না, সেখানে আমি তেরোর নামতা না পারলে বেদম মার খেতাম। স্যার আমাকে আদর করে বুদ্ধিজীবী ডাকতেন। আমি অন্তত ২টা পুরো টেস্ট পেপারস সলভ করতাম। পুরো মানে, পুরোটাই। এক্সট্রা জ্যামিতি সবগুলো তো করতামই, এক্সট্রা জ্যামিতিকে একটু ঘুরিয়েটুরিয়ে টেস্ট পেপারসে যেগুলো দেয়া থাকত, সেগুলোও সলভ করে দেয়ার জন্যে স্যারকে জ্বালিয়ে মারতাম। যে যে চ্যাপ্টারগুলো অনেকেই বাদ দিয়ে পড়ে, সেগুলো নিয়ে আরো বেশি কিউরিয়াস ছিলাম। স্কুলের প্রত্যেক টার্মের সিলেবাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর পরের টার্মের সিলেবাস শেষ করে দেয়ার জন্যে স্যারকে জ্বালাতাম। একটা সাময়িক পরীক্ষার সময়ই পরের সাময়িক পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করে ফেলতাম। ব্যাচে যে অধ্যায়ই পড়ানো হোক না কেন, সে অধ্যায় আমার সিলেবাসে থাক না থাক, শেষ করে ফেলতাম। স্যার বলতেন, “তুই সামনের মাস থেকে বেতন বাড়িয়ে দিবি।” স্যারদের কোনো ধরনের বক্রোক্তিকেই গায়ে না মাখার অসীম ধৈর্য্য আর নির্লজ্জতা আমার মধ্যে ছিল সেই সময়। হাইয়ার ম্যাথসের সব অংক না করলেও পরীক্ষায় ফুল আনসার করা যেত। কিন্তু কখনো কোনো অংক বাদ দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। অনেক রিকোয়েস্ট করার পরেও স্যার যেসব অংক করাতেন না, সেগুলো আমি নিজেই পাঞ্জেরি গাইড দেখে-দেখে বুঝে-বুঝে সলভ করতাম। পরে স্যারকে এটা বলতাম, যাতে স্যার রাগ করে ওই অংকগুলো করিয়ে দেন। স্যার অবশ্য রাগ করতেনই। মারতেনও ভীষণ। ওইসময় স্যারদের মারটার কোনো ব্যাপার ছিল না। বাসা থেকে সবসময়ই শুনে এসেছি, স্যারদের মার হচ্ছে আশীর্বাদ। মার খেয়ে হলেও পড়া বুঝে নিতে হবে, তাহলেই জীবনে মানুষ হওয়া যাবে। (এখন বুঝি, কী পরিমাণ বেকুব ছিলাম সে সময়টাতে।…ভাগ্যিস, ছিলাম!) বাংলা ইংরেজি সমাজের মতো অবজেক্টিভের জন্য সায়েন্সের বইগুলোও লাইন ধরেধরে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই পুরো বই পুঙ্খানুপুঙ্খ মুখস্থ ঠোঁটস্থ কণ্ঠস্থ ছিল। এটা পুরোপুরি স্যারদের অবদান। ওই কাজটা করেছিলাম স্যারের মারের ভয়ে, কিংবা ক্লাসের সবার সামনে অপমানিত হতে হবে, এই ভয়ে। সেই সব দিন ছিল মেয়েদের সামনে নিল ডাউন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দিন, কানে ধরে উঠবস করার দিন।

স্যার আমাকে বলতেন, “শুধু পেপারের দিকে স্ট্যান্ড-করা ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখলে স্ট্যান্ড করা যায় না। এর জন্যে নিজেকে চেষ্টা করতে হয়।” স্যারের প্রাইভেটে যাওয়ার আগে অনেক পড়াশোনা করে যেতাম শুধু এই লোভে যাতে স্যার আমাকে সবার সামনে ভাল বলেন। ওই সময়ে স্যারদের কাছ থেকে একটু স্নেহমাখা কথা শোনার জন্যে মনপ্রাণ আকুল হয়ে থাকতো। মনে হতো, শুধু এইজন্যই কয়েক রাত না ঘুমিয়ে পড়াশোনা করা যায়। স্টুডেন্টদের এই সাইকোলজিটা বোঝা শিক্ষকদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সমরেন্দ্র স্যার নিয়মিত অবজেক্টিভ পরীক্ষা নিতেন। অন্যরা যেখানে ৫টা ভুল করলে এক বেতও খেত না, সেখানে আমি প্রতিটা ভুলের জন্যে ৫ বেত করে খেতাম। স্যার কী এক সম্মোহন-যাদু জানতেন জানি না, তখন গর্দভের মতো মার খাওয়ার সময় স্যারের উপরে কিছুতেই রাগ হতো না, সব রাগ হতো নিজের উপর। কখনো-কখনো ভুল করলেও স্যার মারতেন না। তখন নিজের ভেতরে খুব অপরাধবোধ কাজ করতো। সেই তের-চৌদ্দ বছরের কিশোরের একটা মার খাওয়ার জন্যে মনের যে আকুলতা, তার খবর স্যার কখনোই জানতে পারবেন না। আমি ভাবতাম, স্যার বোধ হয় অসুস্থ। মনে-মনে বলতাম, হে ভগবান, তুমি স্যারকে সুস্থ করে দাও। সত্যিই স্যারের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতাম। যে শিক্ষক স্টুডেন্টের মনের মধ্যে কৃত ভুলের জন্য অপরাধবোধের জন্ম দিতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই সাধারণ নন। স্যারের বাসা ছিল আমার বাসার কাছেই। স্যারের প্রাইভেট ছিল বিকেলে। একদিন স্যার ক্লাসে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে সুশান্ত, তুই কাল রাতে ঘুমাসনি?” আমি প্রায় রাতেই টুইনওয়ানে ক্যাসেট চালিয়ে দিয়ে গান শুনতে-শুনতে বারান্দায় বসে-বসে সারারাত অংক করতাম, অবজেক্টিভ সলভ করতাম। (সেই সময় আমরা সিডি চোখেও দেখিনি।) স্যারের একটা প্রিয় অভ্যেস ছিল, প্রতি রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে শহরে ঘুরতে বের হওয়া। স্যার হয়তো এর আগের রাতে আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে এসেছিলেন এবং দেখেছেন, তিন তলার বারান্দায় বসে আমি বাতি জ্বালিয়ে পড়ছি। মজার ব্যাপার হল, সেদিন ক্লাসে আমি কেমিস্ট্রি অবজেক্টিভে মার্কস কম পেয়েছিলাম এবং স্যারের প্রশ্নে আমার মনে হয়েছিল, এই জন্যই হয়তো স্যার বাঁকাভাবে জিজ্ঞেস করছেন, আগের রাতে এতো পড়ে কী লাভ হল তবে? খুব কষ্ট হচ্ছিল, এই ভেবে যে আমি আগের রাতে সমরেন্দ্র স্যারের পড়া না পড়ে সামাজিক বিজ্ঞানের অবজেক্টিভ পড়ছিলাম পরের দিন সকালে সমীরণ স্যারের প্রাইভেটের পরীক্ষায় যাতে কলেজিয়েট-খাস্তগীর স্কুলের স্টুডেন্টদের চাইতে বেশি মার্কস পাই। সমর স্যারের চোখের দিকে লজ্জায় তাকাতেও পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, উনি যেন আমার মন পড়তে পারছেন এবং উনার পড়া তৈরি করিনি বলে খুব রেগে আছেন। আমার মধ্যে এতটা সংকোচ আর দায়িত্ববোধ, একইসাথে উনার প্রতি অসীম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জন্মানোর পুরো কৃতিত্বই স্যারের।

ভাল কথা, সেদিন সমীরণ স্যারের প্রাইভেটেও কম মার্কস পেয়েছিলাম এবং যথারীতি মার খেয়েছিলাম। সমীরণ স্যার আমার সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছিলেন। সেটা হল আমার স্কুল। উনি প্রায়ই বলতেন, “ঠিকই তো আছে। বালতি স্কুলের স্টুডেন্ট অমুক জিনিসটা কীভাবে পারবে?” আমি আমার স্কুল নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য কোনোভাবেই সহ্য করতে পারতাম না। হোক খারাপ স্কুল, আমার স্কুল তো! স্কুলের স্যাররা আমাকে কতো আদর করেন, বিশ্বাস করেন, অন্য সবাইকে আমার কথা অনেক বড় মুখ করে বলেন। সমীরণ স্যারের প্রাইভেটে আমি অনেক পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতাম, শুধু এই জন্যই যে, যাতে কেউই আমার স্কুলকে ছোটো করে কোনো কথা বলতে না পারে। আমার বাবার পর সমরেন্দ্র স্যারের কাছ থেকে শিখি কীভাবে প্রতি মুহূর্তের দুনিয়ায় সবচেয়ে সুন্দর করে বিন্দাস বাঁচা যায়। স্যারের আয়ব্যয় দুই-ই ছিল অপরিমিত। সমীরণ স্যারের কাছ থেকে শিখি কীভাবে পিঁপড়ের পেট থেকে চিপেচিপে গুড় বের করে সেটা দিয়েই চা খেয়ে চিনি বাঁচানো যায়। স্যার ছিলেন মহাকিপ্টে! তবে আমি গ্রহণ করেছি সমরেন্দ্র স্যারের ফিলসফিটাই।

আমি যা এবং আমি যা নই, দুইয়ের জন্যই স্যারদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।