ব্যাসের আশিস পেয়ে সঞ্জয় দিব্য-চক্ষুষ্মান, যুগের যজ্ঞাগ্নি-পাশে বসে একা নিশিদিনমান অন্ধ নরপতি-কাছে বলবেন যুদ্ধের বারতা— হয়ে আছে স্থিরীকৃত। প্রভাতের আলো-কথা গোটা রণক্ষেত্রব্যাপী প্রসারিত বিপুল ব্যাপ্তিতে— ধ্বংসের ভূমিকা নিয়ে জাগে যুগ-দেবতার চিতে সৃষ্টির নূতন ছন্দ; রণবাদ্য ওই বুঝি বাজে, কালের সমুদ্রতটে প্রলয়ের ঘন মেঘ সাজে। সরে গেল যবনিকা সঞ্জয়ের আঁখির সমুখে একপলকেই যেন, দৃষ্টি তাঁর অদূরের বুকে অসংখ্য শিবিররাজি—ধনুর্ধর শত-লক্ষ বীর উন্নত বিশাল বক্ষ, সারি সারি সমুন্নত শির। দেখলেন, দুর্যোধন গিয়ে গুরু দ্রোণাচার্য-পাশে রণ-সম্ভারের কথা বলেন বিপুল উচ্ছ্বাসে। বুকে তাঁর বিজয়ের বহু আশা, গতিতে দৃপ্ততা— জীবনের আয়োজন বুঝি পায় সকল সার্থকতা সমর-তরঙ্গ দোলে প্রান্তরের বীর্য-বন্যায়! ব্যূহের আকারে ওই পাণ্ডব-সৈন্য দেখা যায়!
সহসা দেখেন চেয়ে, বিষাদে ব্যাকুল পার্থ বীর, শরীরে রোমাঞ্চ তাঁর…শুকনো মুখ, বড়ো অস্থির! জানু পেতে রথ-'পরে বসে—কাতর জিজ্ঞাসা নয়ন-কোণে তাঁর ওঠে ফুটে বেদনার ভাষা; "হত্যা করে স্বজনেরে যুদ্ধে জিতেও কী মঙ্গল?" গাণ্ডীব পড়ছে খসে, আঁখি-পদ্ম জলে টলমল! "হে কৃষ্ণ, চাই না জয়, রাজ্যসুখ, বৃথাই সে ভাব; আচার্য ও পিতামহ সংহারে, নেই বিন্দুসমও লাভ বেঁচে এই বিশ্বমাঝে! হে মাধব, এত স্বজনের বধে কী সুখ পাবো আমি? এতে হায় বিপুল জগতে কুলনাশকারী রূপে হব কলুষিত, হারাব সম্মান।" এই বলে সব্যসাচী বিষণ্ণতায় ছাড়েন ধনুর্বাণ!
দাঁড়িয়ে তাঁর সমুখে কেশব—আয়ত নয়নে যুগ-চেতনার দৃষ্টি, কী দেখেন দিগন্তকোণে? জানু-স্পর্শে ধরেন পাঞ্চজন্যখানি বাহুতে বাম, অভয়ের ভঙ্গি ডানহাতে—স্বৰ্গলোক তার নাম, কী যেন অমৃত-বার্তা দিয়ে যায় সমুখে তাঁর! নব-দূর্বাদলশ্যাম দেহ হতে জ্যোতির বিথার— কেবল ছড়িয়ে যায় শাশ্বতের বিপুল মহিমা! অনন্তের অন্তহীন সত্যবোধ পার হয়ে সীমা অসীমের রূপলোকে সে ইঙ্গিতে পায় অধিষ্ঠান! তামস যায় দূরে, রজঃ লভে সত্ত্বের সম্মান! নাই কোনো দুর্বলতা, পৌরুষহীনতা সেখানে নাই— মৃত্যু যখন স্বৰ্গ আনে, জয়-আহ্বানই যুদ্ধ জানায় সসাগরা ধরণীরে!—নশ্বরত্ব হয় না আত্মার, এ অমৃত-বার্তা আসে, সেই অমৃত-রূপ হতে তাঁর! সর্বশাস্ত্র-সমাহৃত আনন্দের স্বরূপ সুন্দর; সাংখ্য আর পাতঞ্জল পায় সমন্বয় পর পর! সে বালক নচিকেতা—মৃত্যুর অন্বেষা তাঁর এসে এ রূপের পদপ্রান্তে এক সুর নিয়ে যেন মেশে! কর্ম আসে কামহীন, ভক্তিআলোয় মধুময়— জ্ঞান মিলে এখানে রচে মুক্তির ত্রিবেণী অক্ষয়; অধর্ম যখন আসে, এ রূপের ঘটে আবির্ভাব দুষ্কৃতের শাস্তি দিতে—এ অভয় জীবনের লাভ।
এমন অক্ষর—অব্যক্ত কি ব্যক্ত হয়ে প্রাণে জাগে, অধ্যাত্মজ্যোতি তাই আলিঙ্গনে নিত্য বেঁধে রাখে! হৃষীকেশ বলেন, "সব্যসাচী, হত্যা করো কারে?" অর্জুন দেখেন চমকে জেগে, জাগে তাঁর চারিধারে অসংখ্য মুখ ও নেত্র, অনন্ত এক দিব্য-আভরণ, দিব্যঘ্রাণে অনুলিপ্ত, দিব্যমাল্যে মূর্তি সুশোভন, সহস্র সূর্যের প্রভা সে রূপেরে করে দীপ্তিমান, সমগ্র জগৎ ভাসে—সে রূপের লীলা অফুরান। সে দেহে দেবর্ষি জাগে, ব্রহ্মার সেখানে পদ্মাসন, অব্যয় পরম বেদ্য, সে পুরুষ নিত্য সনাতন! মুখে জ্বলে হুতাশন, বিশ্বভূমি তেজে তপ্ত তাঁর, আদি-মধ্য অবসান, নাই নাই কোথা নাই আর! সে রূপের দেহ হতে বিশ্বে হয় তাপ সঞ্চারিত, এ বিশ্বেরে করে গ্রাস পুনর্বার করে আলোকিত!
এ রূপ দেখেন পার্থ, জানেন নিজ পরিচয়, যুগের সন্ধ্যায় জাগা অভয়ের কান্তি মধুময়! গেলেন ভীষ্ম, গেলেন দ্রোণ-কর্ণ-কৃপ-দুর্যোধন; ধ্বংসের হোমাগ্নি-কুণ্ডে, সৃষ্টির সে বীজ উচ্চারণ! পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজে, সে সুর জ্ঞান-ভক্তি সমন্বিতা, কুরুক্ষেত্র হতে জাগে শ্রীভগবানমুখে পূর্ণতম গীতা।