দুর্ঘটনা

ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা থেমে গেল। আমার কোলে অর্থাৎ দু-হাঁটুর মাঝে কোঁচকানো কাপড়ে কী যেন ছিটকে এসে পড়ল। মাথার ঘিলু কী?




শুধু কোলে নয়, আমার বাঁ-গালের জুলফি থেকেও দেখি রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁধ আর বুকের ওপর পড়ছে। পাঞ্জাবিটা রক্তে ভিজে জব জব করছে।




চারিদিকে চিৎকার। বিরাট একটা ভয়ে চোখ বুজি।




অধিকাংশ লোক বাস থেকে নেমে নিচের নিরীহ ল্যাম্পপোস্টটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কে যেন আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠল—”কী হলো আপনার, ভাই?”




উত্তেজিত কয়েকটি যুবক চিৎকার করে উত্তপ্ত অশালীন ভাষায় বলছে, “ড্রাইভারকে নামিয়ে আনো, সাইড চেপে চালালে এরকম হতো না।”




কিছুক্ষণ পর সংবিৎ ফিরে আসে। ধড়মড় করে উঠে বাস থেকে নেমে পড়ি। এরই মধ্যে কখন একজন আমার কোলের ওপর থেকে সেই থেঁতলানো জিনিসটা তুলে নিয়ে নিচে ভিড়ের কাছে এগিয়ে গেছে টের পাইনি।




বার্ধক্য সম্বন্ধে উদাসীন একদল বৃদ্ধ অফিসটাইমে এই ঝামেলার প্রতিবাদে মুখর। একদল নিস্পৃহ দর্শক। একদল ব্যস্ত সমব্যথী।




এগিয়ে ভিড়ের কাছে যাই—অনেকটা নিশি-পাওয়া লোকের মতো। আমার চেহারাও তখন কম বীভৎস নয় বোধ হয়। দেখে পথ ছেড়ে দেয় সবাই।




ল্যাম্পপোস্টটা রক্তাক্ত। নিচে থেঁতলানো শরীরটা দুমড়ে ছোটো একতাল মাংসের স্তূপের মতো পড়ে আছে। মাথাটা অস্পষ্ট। কাঁধের ওপরের বাকি অংশে একটা বাজারের থলি জড়িয়ে আছে অনেকটা ঠিক ক্রুদ্ধ সাপের মতো।




ড্রাইভারটা পালিয়ে গেছে; কন্ডাকটর পারেনি। তাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে ভীষণভাবে মারধর করতে একদল ব্যস্ত; কেউ কেউ আবার ক্ষীণকণ্ঠে তার প্রতিবাদও করছে। বাসের মহিলা যাত্রীরা ভয়ে কুঁকড়ে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।




চারিদিকে চোখ বুলিয়ে শিউরে উঠলাম। মৃত্যুর ছায়া আতঙ্কিত প্রত্যেকের মুখে কাঁপছে। মৃত্যুকে এত কাছে দেখে আমিও শিউরে উঠলাম। গেঞ্জিটাও ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপটে যাওয়ায় সারা শরীর ঠক ঠক করছে যেন!




“পুলিশস্টেশনে আর অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করা হয়েছে তো?”—কে যেন চিৎকার করে বলল।




রুমাল দিয়ে মুখ ঘষে আবার তাকাই ল্যাম্পপোস্টটার দিকে। থেঁতলানো শরীরটার পাশে থলিটা তেমনি পড়ে আছে; ভেতরে অক্ষত কোয়ার্টার পাউণ্ডের পাউরুটি উঁকি মারছে একটা। একটা হাত বিকৃতভাবে ওটার দিকে তখনও প্রসারিত।




চারিদিকে কথার ঝড়।




অথচ লোকটাকে কেউ চেনে না।