ক্রাইস অ্যান্ড হুইস্পারস (১৯৭২)

ইংমার বার্গম্যান তাঁর অটোবায়োগ্রাফি ‘ইমেজেস: মাই লাইফ ইন ফিল্ম’-এ লিখছেন:

“একমাত্র ক্রাইস অ্যান্ড হুইস্পারস বাদে আমার সব ছবিকেই সাদাকালো বিবেচনা করা যেতে পারে। যদি চিত্রনাট্যের দিকে তাকাই, তবে দেখবো, আমার কাছে লালরং হচ্ছে আমাদের আত্মার অন্তর্ভাগের প্রতীক। যখন আমি ছোট, তখন আমি ভাবতাম, আত্মা ড্রাগনের মতো কিছু একটা, বাতাসে নীল ধোঁয়ার মতো ভাসতেথাকা একটা ছায়া—বড়ো ডানাওয়ালা একটা প্রাণী, এমনকিছু, যা অর্ধেক পাখি, বাকি অর্ধেক মাছ। তবে সে ড্রাগনের ভেতরের সবকিছুই লাল।”

ক্রাইস অ্যান্ড হুইস্পারস মুভিতে সবচাইতে বেশি যা চোখে পড়ে, তা হল লালরঙের ছড়াছড়ি। ওয়ালপেপার লাল, কম্বল লাল, ঘরের জিনিসপত্র লাল, এমন-কী সিনেমার শুরুতে ক্রেডিটের লেখাগুলির ব্যাকগ্রাউন্ডটাও লাল। সিনেমায় এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে যাওয়ার সময়ও বার্গম্যান লাল দিয়ে পর্দা নামিয়েছেন। আর রক্ত তো আছেই!

সিনেমায় মোট তিনটা রং আছে। লাল, সাদা, কালো। এ তিনটি রং কিন্তু চাঁদের রং। উদীয়মান চাঁদের রং লাল, পূর্ণচাঁদের রং সাদা, নতুন চাঁদের রং কালো। এ সিনেমা মূলত তিনবোনের সিনেমা। তিনরং তিনবোনকে প্রতিনিধিত্ব করে। একই চাঁদের তিনটি রূপ। কিংবা বলা যেতে পারে, একই মায়ের শরীরের তিনটি ছায়া।

এক বোন মারিয়া। তাঁর চুলের রং লাল, গাউনের রং লাল। মুভিতে তিনি কামার্ত, আফ্রোদিতির প্রতিভূ যেন। ডাক্তারকে সিডিউস করেন, পরবর্তীতে ডাক্তারের সাথে পরকীয়া করেন।

“আমাকে স্পর্শ কোরো না।” “আমি চাই না কেউ আমাকে স্পর্শ করুক।” করিনের এমন কথা বুঝিয়ে দেয়, তিনি কিছুতেই কারো সাহচর্য সহ্য করতে পারেন না, এমন-কী তাঁর স্বামীরও না। তিনি খিটখিটে মেজাজের, তাঁর পোশাকের রং কালো।

বাকি বোনের নাম অ্যাগ্নেস। ক্যান্সারে আক্রান্ত। সিনেমায় আমরা তাঁকে দেখি সাদা চাদরে, সাদা কাপড়ে, লাল কম্বলে। তিনি মৃত্যুর প্রতীক। তাঁর দেখাশোনা করেন আনা নাম্নী এক পরিচারিকা। আনা স্নেহময়ী, ধার্মিক, ধৈর্যশীলা। তিনি সবসময়ই অ্যাগ্নেসের পাশে থাকেন, এমন-কী যখন তাঁর দুইবোনের কেউ তার পাশে থাকেন না, তখনও। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ভাস্কর্য পিয়েতা-তে আমরা দেখি মা মেরির কোলে শায়িত যিশুর মৃতদেহ। ঠিক তেমনি মৃত্যুপথযাত্রী অ্যাগ্নেসের মাথা উন্মুক্ত বক্ষে রেখে আনা যেন তাকে মায়ের স্নেহ দিয়েছেন। সিনেমায় দেখানো হয়, যে দুইজনকে আনা মায়ের স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন—তার নিজের মেয়ে ও অ্যাগ্নেস, দুইজনই মারা যান। আনা জীবন কি মৃত্যুর প্রতীক, তা বোঝা দুষ্কর। তাই হয়তো বার্গম্যান আনার রংটা দর্শকের কল্পনাআশ্রিত করে দিয়েছেন।

মুভিতে পুরুষদের কীভাবে দেখানো হয়েছে? মারিয়ার স্বামী মারিয়ার পরকীয়া বুঝে ফেলার পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ব্যর্থ চেষ্টা। করিনের স্বামী পেশায় ডিপ্লোম্যাট। করিনকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেন না! এরপর ডাক্তার ডেভিড। তাঁর নৈতিক শক্তি দুর্বল, মারিয়া তাঁকে সহজেই প্রেমের ফাঁদে ফেলে দেয়। বাকি রইল ধর্মযাজক। অ্যাগ্নেসের মৃত্যুর পর মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে মন্ত্র পড়ার জন্য তাঁকে ডাকা হয়। সিনেমায় খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকায় পুরুষের উপস্থিতি আমরা দেখি না। এ মুভিতে নারীর মনস্তত্ত্ব দেখানো হয়েছে। তা দেখানোর প্রয়োজনেই পুরুষের অনুজ্জ্বল উপস্থিতি। লক্ষণীয়, নেতিবাচক ভূমিকায় যে দুইজন নারীকে মুভিতে দেখা যায়, তাঁদের পাশে পুরুষ আছেন, বাকি দুইজনের পাশে কোনো পুরুষ নেই।

মুভিতে প্রকৃতিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে বিভিন্ন সময়ে প্রকৃতির দিকে তাকালে মুভি কোনদিকে যাচ্ছে, কীসের ইঙ্গিত করছে, সহজেই ধরা যায়। মুভির শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি আনাসহ তিনবোনই সাদা পোশাকে পার্কে হাঁটছে। এখানে সাদা শুভ্র ও নিষ্পাপ আত্মিক বন্ধনের প্রতীক। ওরা সবাই একটা দোলনার কাছে গেল। সবাই দোলনায় বসেছে, গল্প করছে, আনা দোলনা দোলাচ্ছে। ছোটবেলায় তিনবোন যেমনি করে পরস্পরের কাছে ছিল স্নেহে, ভালোবাসায়, ঠিক তেমনি। অ্যাগ্নেসের ডায়রি থেকে আনাকে পড়তে দেখি:

“লক্ষ্মী তিনটি ছোটবোনের মতো আমরা দোলনায় বসলাম এবং আনা আমাদের দোলাতে লাগলো খুব ধীরেধীরে। আমার সকল ব্যথা ও যন্ত্রণা চলে গেল। পৃথিবীতে যাদের আমি সবচাইতে বেশি পছন্দ করি, তারাই আমার সাথে আছে। আমি শুনতে পাচ্ছি ওরা আমার সামনে বসে গল্প করছে। ওদের শরীরের উপস্থিতি আমি টের পাচ্ছি, ওদের হাতের উষ্ণতা আমি অনুভব করতে পারছি। আমি সেই মুহূর্তটাকে ধরে রাখতে চাইলাম আর ভাবলাম, “সামনে যা-ই আসুক না কেন, এখন যা আছে, তার নামই সুখ। এর চাইতে ভাল কিছুর কথা আমি ভাবতেও পারি না। এখন, এই কিছু মুহূর্তের জন্য, পরিপূর্ণতা কী, তা আমি বুঝতে পারছি। আমার এ জীবন, যা আমাকে এতকিছু দিয়েছে, তার প্রতি আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।”

মুভির শেষের দিকে অ্যাগ্নেস হঠাৎ মৃত্যুর হিমশীতল ঘুমভেঙে তাঁর দুইবোনকে আঁকড়ে ধরতে চান। দুই বোনই পালিয়ে বাঁচে! মানুষকে কষ্ট পেতে হয় একাকী, মানুষকে মরতেও হয় একাকী। হ্যাঁ, অ্যাগ্নেস একজনকে পাশে পেয়েছিলেন। তিনি আনা। তিনি মেয়ের মৃত্যু আটকে দিতে পারেননি, ভালোবাসার বাঁধনে অ্যাগ্নেসের মৃত্যু আটকে দিয়ে কিংবা মৃত্যুর অচেনা পথে অ্যাগ্নেসের হাত ধরে হেঁটে তিনি জীবনের প্রকৃত স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ সিনেমায় জীবন অহেতুকই চিৎকার করেকরে মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর আয়োজন করে, আর মৃত্যু কানেকানে ফিসফিস করে কথা বলে বেঁচেথাকার মন্ত্র শেখায়। এইসব ক্রাইস কিংবা হুইস্পারস, রঙের ত্রিমাত্রিকতা, সবই হার মেনে যায় নারীর ভালোবাসামাখা স্পর্শের কাছে—সে স্পর্শ মায়ের, মেয়ের, প্রিয়জনের, স্ত্রীর।